Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ভাইকিং-এর একশ শিং -আশিস কুমার পন্ডা

ভাইকিং-এর একশ শিং  -আশিস কুমার পন্ডা
ইতিহাসের ভাইকিংদের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বিনোদনের নানা মাধ্যমে দেখা মেলে তাদের। লম্বা, সুঠাম, পেশীবহুল সেই সব যুদ্ধবাজ ডাকাত কিংবা জলদস্যুদের মাথায় থাকত…

 




ভাইকিং-এর একশ শিং  -আশিস কুমার পন্ডা


ইতিহাসের ভাইকিংদের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বিনোদনের নানা মাধ্যমে দেখা মেলে তাদের। লম্বা, সুঠাম, পেশীবহুল সেই সব যুদ্ধবাজ ডাকাত কিংবা জলদস্যুদের মাথায় থাকতো একটি হেলমেট, তাতে আবার দু’পাশে থাকতো দুটি শিং। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের, অর্থাৎ ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেনের সমুদ্রে ভ্রমণকারী একদল মানুষকেই আমরা ভাইকিং বলে চিনি। ৮ম শতকের শেষভাগ থেকে ১১শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ইউরোপ থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় তারা অভিযান চালাতো, ব্যবসা করতো, স্থাপন করতো নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বসতি।

ভাইকিংদের মধ্যে অন্যতম কিংবদন্তি চরিত্র ছিলেন ওলাভ ব্রুটলসেন।  তিনি ছিলেন গাছের মতো লম্বা, ষাঁড়ের মতো শক্তিশালী এবং এক  অন্যতম অপরাজিত যোদ্ধা। খালি হাতে একটি ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি তাকে ধরাশায়ী করতে পারতেন। তার বীরত্বের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য তার হেলমেট এবং পোশাকটিতে তার বিজয় ট্রফিগুলি সাজিয়ে রাখতেন। তাঁর হেলমেটে ছিল একশোরও বেশি শিং এবং তাঁর পোশাকে ছিল এক হাজার মূল্যবান পাথর; পরাজিত প্রতিটি শত্রুর জন্য একটি করে পাথর। তিনি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন, সবাই ভয়ে দূরে সরে যেতেন।

কিন্তু একদিন এক অঘটন ঘটে গেল। একজন যুবক আনমনে রাস্তায় হাঁটছিলেন, অজান্তে ওলাভের সাথে তার ধাক্কা লেগে গেল। এই ঘটনায় রাগে ওলাভের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। যুবকটিকে যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করলেন এবং তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্যে আহ্বান করলেন। ওলাভের সঙ্গে চর্মসার যুবকটির কোন তুলনা ছিল না, তবে যুবকটির কাছেও কোন বিকল্প ছিল না। তবে তিনি এক শর্তে দ্বন্দ্বযুদ্ধে রাজি হলেন। বিনয়ের সঙ্গে তিনি ওলাভকে বললেন, "আমি ভাল করে দেখতে পাই না, তাই লড়াইয়ের সময় আপনাকে হেলমেট এবং পোশাক পরে থাকতে অনুরোধ করছি যাতে আমি আপনাকে ঠিকমত দেখতে পাই!"

ওলাভ যুবকটির এই বোকা বোকা শর্ত ঘৃণাভরে মেনে নিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন এবং পরের মুহুর্তেই যুবকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যুবকটি চর্মসার হলেও আসলে ছিলেন খুব চটপটে, তাই তিনি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডাইনে, বাঁয়ে বা পিছিয়ে গিয়ে ওলাভের আক্রমণ এড়িয়ে যেতে লাগলেন। লড়াই যত এগোতে লাগলো, ওলাভ তত ক্লান্ত হতে থাকলেন এবং যুবকের পক্ষে আক্রমণ এড়ানো ধীরে ধীরে সহজ হয়ে গেল। দর্শকরা যুবকটির লড়াই দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন, কারণ তারা সবাই আশা করেছিলেন যে ওলাভের প্রথম আঘাতেই যুবকটি মারা পড়বেন! ওলাভ বারবার আক্রমণ করে চললেন, কিন্তু সেই মোক্ষম আঘাত তিনি আর দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্তিতে অচৈতন্য হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দর্শকরা ভাবলেন যুবকটি নিশ্চয়ই কোনও অলৌকিক শক্তির অধিকারী, কারণ কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে ওলাভকে ধরাশায়ী করা সম্ভব নয়। কিন্তু তা নয়! আসলে একশো শিংযুক্ত হেলমেট এবং মূল্যবান পাথর খচিত পোশাকের ওজন ওলাভকে তার অতুলনীয় হিংস্রতা প্রদর্শন করতে বাধা দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল।

ওলাভ যেমন তার বীরত্বের নিদর্শন হিসাবে শিরস্ত্রাণ এবং পোশাকের বোঝা বয়ে বেড়াতেন, আমরাও ঠিক একই ভাবে আমাদের মাথায় এক সত্তাকে বয়ে বেড়াই যে সব সময় বৈধতা, স্বীকৃতি এবং শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান করে চলে। আমরা আমাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের বিরোধ করি, প্রতিটি সমালোচনায় আঘাত পাই, নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি, এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর সৌজন্যটুকুও দেখাই না। আমরা নিজেদেরকে একটি ছোটখাটো দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই এবং আশা করি অন্যেরা আমাদের মূর্তির সামনে অর্পণ করে তৃপ্তি পাবে। আত্ম-স্তুতি বা অহং এর এই নিরলস সাধনা ক্রমশ এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং আমাদের মানসিক সুস্থতার চেয়ে ভারী হয়ে যায়। আমাদের অহং আমাদেরই শত্রু হয়ে যায় কারণ এটি আমাদেরকে বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আমাদের নিজেদের ক্ষমতা এবং মূল্যকে অতিরঞ্জিত করে তোলে এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা এবং দক্ষতাকে কমিয়ে দেয়।

সবশেষে, মূল কথা হলো "ওজন কমানো", অর্থাত্‍ আমাদের অহং কম করা বা একেবারে ঝেড়ে ফেলা। কারণ এই অহংকারের ভার সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এবং অযৌক্তিক। আমাদের জীবনতরীকে আমরা যত বেশি অহং এর ভার থেকে  মুক্ত করতে পারবো, ততই আমাদের যাত্রা মসৃণ হবে। অহং এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে, আমাদের আরও নম্র, মুক্তমনা এবং সহানুভূতিশীল হতে হবে। প্রকৃত মানুষের মতো মানুষকে মানুষ ভেবে সম্মান করতে হবে। নীচুর কাছে নীচু হয়ে  নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা শিখতে হবে। যারা নিজেদেরকে নিচে নামাতে ভয় পায় না তারা সব সময়েই সন্তুষ্ট এবং খুশি থাকে।

No comments