Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

অক্ষয় তৃতীয়ার অনন্ত মাহাত্ম্য

'      অক্ষয় তৃতীয়ার অনন্ত মাহাত্ম্য

কৌরবদের সঙ্গে দ্যূতক্রীড়ায় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পরাভূত। শেষে কী যে মতিভ্রম হল তাঁর, দ্রৌপদীকেও পণ রাখলেন! দ্রৌপদীপণেও ধর্মরাজের পরাজয় হল। দুরাত্মা দুর্মতি দুঃশাসন পাঞ্চালির দীর্ঘ কেশাকর্ষণপূর্…

 




'      

অক্ষয় তৃতীয়ার অনন্ত মাহাত্ম্য



কৌরবদের সঙ্গে দ্যূতক্রীড়ায় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পরাভূত। শেষে কী যে মতিভ্রম হল তাঁর, দ্রৌপদীকেও পণ রাখলেন! দ্রৌপদীপণেও ধর্মরাজের পরাজয় হল। দুরাত্মা দুর্মতি দুঃশাসন পাঞ্চালির দীর্ঘ কেশাকর্ষণপূর্বক সভাসমীপে আনয়ন করল। দুঃশাসনের কটুবাক্যে পীড়িতা পাঞ্চালিকে এ অবস্থায় দেখেও দ্রোণাচার্য, ভীষ্মসহ রাজসভায় উপস্থিত কুরুবংশীয় বৃদ্ধগণও কোনও প্রতিবাদ তো করলেনই না, বরং তাঁরা হাস্য-পরিহাসে অংশগ্রহণ করে অধিকতর আনন্দলাভে সচেষ্ট হলেন। চূড়ান্ত অপমানিত দ্রৌপদী আত্মত্রাণের জন্য ‘হা কৃষ্ণ! হা অর্জুন!’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। দুঃশাসন সভামধ্যে জোর করে যাজ্ঞসেনীর পরিধেয় বস্ত্র খোলার চেষ্টা করলে তিনি এইরূপে শ্রীকৃষ্ণকে করজোড়ে স্তব করতে লাগলেন— ‘হে গোবিন্দ! হে দ্বারকাবাসিন কৃষ্ণ! হে গোপীজনবল্লভ! কৌরবগণ আমাকে অপমানিত করিতেছে, তুমি কি তার কিছুই জানিতেছ না? আমায় রক্ষা করো।’ অবনতমুখী হয়ে রোদন করতে লাগলেন দ্রৌপদী। এরপরই ঘটে গেল এক অত্যাশ্চার্য ঘটনা। সকলের অলক্ষে করুণাময় অন্তর্যামী কৃষ্ণের আশীর্বাদে তাঁর পরিধেয় বস্ত্র দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল। দ্রৌপদীকে বিবসনা করার চক্রান্ত ব্যর্থ হল দুঃশাসনের। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই কৃষ্ণার লজ্জা নিবারণ করেন কৃষ্ণ। তাই এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। 

পৌরাণিক কথা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের কাছে অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রাজা যুধিষ্ঠির। এর উত্তরে স্মিত হেসে ব্রজনাথ শুধু একটি বাক্যই প্রয়োগ করলেন, প্রথম পাণ্ডব, জেনে রাখুন এই দিনের মাহাত্ম্য অপরিসীম। দ্বাদশবর্ষ বনবাসের সময় যুধিষ্ঠিরকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন অক্ষয় পাত্র দান করেন সূর্যদেব। ধর্মরাজ ভক্তি চিত্তে এই দান গ্রহণ করেন। মহাভারতের রচনা শুরু এদিন। এক সুবিশাল মহাকাব্য রচনার ক্ষেত্রে অক্ষয় তৃতীয়ার চেয়ে উপযুক্ত দিন আর কী হতে পারে! 

মহর্ষি বেদব্যাস তপোবলে সনাতন বেদশাস্ত্রের সারমর্ম উদ্ধার করে মনে মনে এক পবিত্র ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু কীভাবে তাঁর শিষ্যবর্গকে তা পড়াবেন সেই চিন্তায় ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠেন। মহর্ষিকে দর্শন দেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। মহর্ষি সবিনয়ে নিবেদন করলেন, ‘ভগবন! আমি এক অদ্ভুত কাব্য রচনা করিয়াছি। তাহাতে বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ এই সকলের সার-সঙ্কলন, ইতিহাস ও পুরাণের অনুসরণ ও ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান কালত্রয়ের সম্যক নিরূপণ করিয়াছি...।’ ব্রহ্মার নির্দেশে সিদ্ধিদাতা গণেশকে কায়মনোবাক্যে স্মরণ করলেন বেদব্যাস। গণপতি তথায় উপস্থিত হলে মহর্ষি ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে বললেন, ‘হে গণনায়ক! মনঃসঙ্কল্পিত মহাভারতাখ্য গ্রন্থ আমি অবিকল বলিতেছি, আপনি তাহার লেখক হউন।’ প্রত্যুত্তরে গণেশ বললেন, ‘মুনে! যদি লিখিতে লেখনী ক্ষণমাত্র বিশ্রামলাভ না করে, তাহা হইলে আমি আপনার লেখক হইতে পারি।’ একথা শুনে ব্যাসদেব বললেন? ‘হে বিঘ্ননাশক! কিন্তু আমি যাহা বলিব, তাহার যথার্থ অর্থবোধ না করিয়া আপনিও লিখিতে পারিবেন না।’ 

মহর্ষির এই প্রস্তাবে গণাধিপতি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানালেন। তিনি এমন কিছু কিছু কঠিন শ্লোক রচনা করলেন যার প্রকৃত অর্থ বুঝে তবেই গণেশকে লিখতে হতো। (তথ্যসূত্র: কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত) মহাভারত পঞ্চম বেদ হিসেবে স্বীকৃত। মহাভারত নামক এই মহাগ্রন্থের ইতিহাস প্রদীপেরই মতো মোহের অন্ধকার দূর করে মানুষের মনোলোককে জ্ঞানের আলায় উদ্ভাসিত করে। ‘ইতিহাস-প্রদীপেন মোহাবরণঘাতিনা।/ লোকগর্ভগৃহং কৃৎস্নং যথাবৎ সম্প্রকাশিতম্‌।’ অতএব অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে অনেকেই স্নানের পর শুদ্ধ বস্ত্র পরে মহাভারত পড়েন। 

বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়ায় অক্ষয় তৃতীয়া ব্রতপালন। শাস্ত্রানুযায়ী অক্ষয় তৃতীয়া যদি সোমবার অথবা বুধবার হয় এবং এর সঙ্গে রোহিণী নক্ষত্রের যোগ হলে সেই অক্ষয় তৃতীয়া তিথি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য এ বছর শুক্রবার ১০ মে অক্ষয় তৃতীয়া পালন করা হবে। এদিন সূর্য মেষ রাশিতে এবং চন্দ্র বৃষ রাশিতে অবস্থান রবে। সূর্য, চন্দ্র এবং বৃহস্পতি একজোট হয়ে চলে। চন্দ্র ও সূর্যের ঔজ্জ্বল্য সবচেয়ে বেশি হয়। 

মহাসমারোহে মহাপর্ব উদ্‌যাপনের আর এক নাম অক্ষয় তৃতীয়া। বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রে শুক্লা তৃতীয়ার এই দিনটির অশেষ পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে। ‘অক্ষয়’ শব্দের আভিধানিক অর্থ যার কোনও ক্ষয় নেই। যা চিরস্থায়ী, জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী এই তৃতীয়া তিথি ক্ষয়হীন। অর্থাৎ যার ফল কখনও নষ্ট হয় না। মানবজীবনে এর প্রভাব সীমাহীন। তাই এমনই এক পবিত্র দিনে দান ও স্নানের (বিশেষ করে গঙ্গাস্নান) মাহাত্ম্য অসীম। যে কোনও শুভ কাজ শুরুর আদর্শ দিন অক্ষয় তৃতীয়া। হাজার হাজার বছর ধরে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। এদিন পুজো-পার্বণ, যজ্ঞ, জপতপ সমস্ত শুভ কর্মের ফলাফল অনন্ত ও অক্ষয় হয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে জলদান ও অন্নদান অক্ষয় তৃতীয়ার অন্যতম অঙ্গীকার। 

অক্ষয় তৃতীয়ায় ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর পুজো-অর্চনা বিশেষ ফলবতী হয়। স্নানের পর হলুদ বস্ত্র পরে ঠাকুরঘরে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে গঙ্গাজলে ভালোভাবে স্নান করিয়ে পুজোর্চনার আয়োজন করা কর্তব্য। বিষ্ণুর প্রিয় তুলসীপাতা ছাড়া এই স্নানপর্ব সম্পন্ন হয় না। তুলসী ও হলুদ ফুলের মালা পরিয়ে হলুদ রঙের আসনে বসে উত্তরদিকে মুখ করে একাগ্রচিত্তে বিষ্ণুর আরাধনা ও বিষ্ণুপুজো— ‘ওঁ নমো নারায়ণায় নমঽ।’ বারংবার বিষ্ণুনাম উচ্চারণ। এরপর লক্ষ্মীপুজো— ‘ওঁ শ্রীনমঽ’, শ্রীযন্ত্রের পুজো। ধূপ-দীপ প্রজ্বলন ও ধ্যান। পুজোর সময় অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করা অনুচিত। এতে পুজোর মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। বিষ্ণুসহস্রনাম ও বিষ্ণুচালিসা পাঠ করতে হয়। 

বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীকে ভোগ নিবেদন অক্ষয় তৃতীয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক্ষেত্রেও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যবের ছাতু, জলে ভেজানো ঠান্ডা কাঁকড়ি ও ভেজা চানার ডাল ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। ছানা ও নানারকম মিষ্টান্ন থাকে। বৈশাখের এই প্রচণ্ড দাবদাহে ঠান্ডা ভোগই পছন্দ শঙ্খচক্র গদাপদ্মধারী ত্রি-জগৎপতি শ্রীহরির। শেষে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর আরতি। 

ভবিষ্যপুরাণে অক্ষয় তৃতীয়ার সঙ্গে এক অহংকারী ব্রাহ্মণের কাহিনি জড়িয়ে আছে। ব্রাহ্মণ কাউকে কোনওভাবে সাহায্য করেন না। একদিন ক্ষুৎপিপাসায় কাতর এক ব্যক্তি ব্রাহ্মণের কাছে জল চাইলে তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণ তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন। তারপর বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বললেন যে, তাঁর ঘরে খাবারদাবার, জল কিছুই নেই। 

ব্রাহ্মণ-পত্নী দয়াবতী। তিনি স্বামীর নিষেধ অমান্য করে তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিটিকে অন্ন ও জলদান করলেন। মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণের বিদেহী আত্মার ঠাঁই হল যমলোকে। সেখানে অন্ন-জল বিনা নিদারুণ কষ্টে দিন কাটে। অবশেষে পত্নীর পুণ্যকর্মে এক সময় আত্মা মুক্তি পেল যমলোক থেকে। ব্রাহ্মণ পুনর্জন্মলাভ করলেন। এই জন্মে অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রত ভক্তিভরে পালন করে যশ্বশী হলেন ব্রাহ্মণ। বিগত জন্মের পাপস্খলন হল তাঁর। কীভাবে? নবজন্মলাভ করে অন্ন ও জলদানের মতো পুণ্যকর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে। কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে ধরিত্রীদেবীর পুজো অনেক জায়গাতেই যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয়। লাঙল পুজোও হয়। 

সত্যযুগের শুরু অক্ষয় তৃতীয়ায়। এদিন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরুর আলাদা গুরুত্ব। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন। হালখাতা। এদিন দোকান ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং মা লক্ষ্মীর পুজো অত্যন্ত ভক্তিভরে হয়। দেবপ্রতিষ্ঠা, বিবাহ, মুণ্ডন সংস্কার, গৃহপ্রবেশ, সম্পত্তি ক্রয়, গৃহনির্মাণ, তর্পণ প্রভৃতি নানা ধরনের শুভকাজের ক্ষেত্রে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটির কোনও বিকল্প নেই। এদিন অনেকেই সোনা কেনেন। এদিনই মা লক্ষ্মীর আরাধনা করে প্রভূত ধন-সম্পত্তির অধিকারী হন দেবতা কুবের। সেইসঙ্গে আরও একটি বিশেষ দায়িত্বলাভ করেন। কী সেই দায়িত্ব? 

এক সময় স্বর্ণালঙ্কার অধীশ্বর ছিলেন কুবের। দশানন রাবণ তাঁকে লঙ্কা থেকে বিতাড়িত করে রাজ্য অধিকার করেন। এরপর কঠোর তপস্যা কুবেরের। দেবাদিদেব এবং ব্রহ্মার আশীর্বাদলাভ। কৈলাস পর্বতের সন্নিকটে ‘অলকাপুরী’ নামে এক অত্যাশ্চার্য নগরী নির্মাণ করেন বিশ্বকর্মা। এই নগরীর অধিকারী হন কুবের। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতেই স্বর্গের সমস্ত ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেলেন তিনি। 

স্বল্প পরিসরে অক্ষয় তৃতীয়ার সীমাহীন মাহাত্ম্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই ভূমণ্ডলে মা অন্নপূর্ণার আবির্ভাবের দিনটি হল অক্ষয় তৃতীয়া। তিনি হলেন ভুবনমোহিনী পরম করুণাময়ী সেই জগজ্জননী, যিনি আহার্য বস্তু পরিপূর্ণভাবে নিবেদন করে ভক্তদের জীবন রক্ষা করেন। হিন্দু ধর্মে খাদ্যবস্তুকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রসাদ হোক বা অন্য কোনও খাদ্যদ্রব্য, গ্রহণের আগে ঈশ্বরের প্রার্থনা করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। অন্নদান, জলদান হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র আচরণ বলে গণ্য করা হয়। অন্নদানের গুরুত্বকে বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে অগ্নিপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বায়ুপুরাণ সহ কয়েকটি পুরাণে। তাই শুধু অক্ষয় তৃতীয়ায় নয়, সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে অন্নপূর্ণার ভক্তরা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে অন্নদানের মাধ্যমে পুজো একটু অন্যরকমভাবে পালন করেন। 

যিনি মা ভবানী তিনিই রূপভেদে মা অন্নপূর্ণা। এমনকী স্বয়ং দেবাদিদেব ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দেবী অন্নপূর্ণার সামনে এসে দাঁড়ান। দেবী তাঁকে অন্নদান করেন। অক্ষয় তৃতীয়ায় শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব উৎসব খুব ধূমধামের সঙ্গে পালিত হয় বারাণসীর অন্নপূর্ণা মন্দিরে। শিবপুরী বারাণসীর সব কিছুই শিবময়। শিবপুরীর মান-মর্যাদা রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব তো শিবগৃহিণীরই। বাড়ির গৃহিণীরা যেমন যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্ম নীরবে করেন, অতিথি-অভ্যাগতদের পরম যত্নে খাবার পরিবেশন করে বাড়ির সুনাম বৃদ্ধির দায়িত্ব নেন, মা অন্নপূর্ণার সেই একই কাজ। অন্নপূর্ণা হলেন বারাণসী নগরীর অন্নদাত্রী। 

পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার গুরুত্ব আরও কয়েকটি কারণের জন্য। এদিন ভগবান নরনারায়ণ, শ্রীশ্রীহয়গ্রীবমাধব, শ্রীশ্রীধূমাবতীদেবী এবং শ্রীপরশুরামের শুভ আবির্ভাব। তাই দশমহাবিদ্যার অন্যতম চির শাশ্বত শক্তি শ্রীশ্রীধূমাবতীদেবী এবং বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম শ্রীপরশুরামের পুজো অনেকেই করেন। অক্ষয় তৃতীয়ায় স্বর্গ থেকে মা গঙ্গার মর্তে অবতরণ। ভগীরথের কঠোর তপস্যায় তুষ্ট মহাদেব তাঁর জটায় ধারণ করলেন গঙ্গাকে। এদিন শিব, গঙ্গা, কৈলাস, হিমালয় ও ভগীরথের পুজোও হয়। গলায় লাল ধাগা, সিঁথিতে সিঁদুর। বিবাহিত মহিলারা এদিন শিবমন্দিরে স্বামীদের দীর্ঘায়ু কামনা করে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা ও পুজো করেন। 

কিংবদন্তি, জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ভগবান ঋষভদেব অক্ষয় তৃতীয়ায় তাঁর বহুদিনের অনশন ভঙ্গ করেছিলেন আঁজলা ভরে আখের রস পান করে। তাই জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই দিনটির গুরুত্ব কিছু কম নয়। অক্ষয় তৃতীয়ায় পুরী ধামে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের ২১ দিন ব্যাপী চন্দনযাত্রার শুরু। এদিন থেকেই শ্রীশ্রীপুরুষোত্তম ভগবানের রথ নির্মাণ শুরু। শেষ হয় আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়ার আগে। অর্থাৎ রথযাত্রার একদিন আগে। রথ নির্মাণের আগে যথাবিহিত পুজো। শ্রীমন্দির থেকে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার তিনটি আজ্ঞামাল্য ভক্তিভরে বহন করে আনেন তিনজন পান্ডা। রথ নির্মাণের শুভ কাজ শুরু হোক— জগন্নাথদেবের অনুমতি আজ্ঞামালার মাধ্যমে পৌঁছে যায় পুজোস্থলে। চন্দনযাত্রা এসে যেখানে থামে রথ নির্মাণের কাজ শুরু হয় সেখানে। এরপর রথ নির্মাণের প্রস্তুতির শুভারম্ভ। 

জগন্নাথদেবের আচার-আচরণ একজন সাধারণ মানুষের মতোই— এরকম কল্পনা করা হয়। ভক্তের ভগবান তিনি। তাই ভক্তের নিকটে পৌঁছনোর জন্য অতি সাধারণ সহজ-স্বাভাবিক রূপ পরিগ্রহ করেন। গরমের সময় পুকুর অথবা নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় আমাদের যেমন আরামবোধ হয়, তেমনই জগন্নাথদেব স্থানীয় সুশীতল নরেন্দ্র সরোবরে হাওয়া খেতে গমন করেন। তাঁর চন্দনযাত্রা উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। জগন্নাথদেবের উৎসব মূর্তির শ্রীঅঙ্গে চন্দনের মোটা প্রলেপ পড়ে। অত্যধিক গরমে চন্দনের প্রলেপে পরমেশ্বরের আরাম হয়। নারকেল গাছ ও অন্য গাছগাছালিতে ঘেরা নরেন্দ্র সরোবরের স্বচ্ছ জলে সুসজ্জিত ময়ূরপঙ্খী নৌকা। জগন্নাথের নৌ-বিহার দেখতে বহু ভক্তের সমাগম হয় সরোবরের চারদিকে। সরোবরের মাঝখানে সুদৃশ্য মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলভদ্র এবং সুভদ্রার উৎসব মূর্তির প্রতিদিন পুজো-অর্চনা হয়। 

অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটি নবদ্বীপ ধামের সব মঠ-মন্দিরেই অত্যন্ত ভক্তিভাবনার সঙ্গে পালিত হয়। শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর চন্দনযাত্রা উৎসবে শামিল হন অসংখ্য মানুষ। মায়াপুরের ইসকনে আয়োজিত অক্ষয় তৃতীয়ার উৎসব উল্লেখের দাবি রাখে। কলকাতা সহ গৌড়ীয় মঠের বিভিন্ন শাখায় তিন সপ্তাহ জুড়ে চন্দনযাত্রা উৎসবে ভক্তের ভিড় দেখার মতো। অক্ষয় তৃতীয়ায় শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিতে চন্দন লেপন অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। শ্রীরামঠাকুরের তিরোধান অক্ষয় তৃতীয়ায়। বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরে মহাপুরুষের তিরোধান স্মরণোৎসব। 

কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী— এই চারধাম যাত্রা শুরু অক্ষয় তৃতীয়ায়। প্রতি বছরের মতো এবারেও গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রী মন্দির দুটি খুলছে আজ ১০ মে, শুক্রবার অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য প্রভাতে। কেদারনাথ মন্দিরের দ্বারও উন্মুক্ত হচ্ছে এদিন। তবে বদ্রীনাথ মন্দিরের কপাট উন্মোচিত হবে আরও দু’দিন পর অর্থাৎ ১২ মে। দেবপ্রয়াগ থেকে বদ্রীনাথ ধামের প্রবীণ পান্ডা পবন পঞ্চভাই বললেন যে, ‘কেদারনাথ-বদ্রীনাথ মন্দির সমিতি’ ইতিমধ্যেই চার ধাম যাত্রার তথ্যাদি তাদের ওয়েব সাইটে জানিয়ে দিয়েছে। 

শ্রদ্ধার সঙ্গে দান-ধ্যান অক্ষয় তৃতীয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। যা অহংকার বর্জিত সমাজসেবারই নামান্তর। অতএব অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য সমাজসেবার সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।




No comments