Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

১৫৮৬ সালের ২৩শে এপ্রিল, শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। প্রয়াত হলেন সুর সম্রাট মিঁয়া তানসেন...

১৫৮৬ সালের ২৩শে এপ্রিল, শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। প্রয়াত হলেন সুর সম্রাট মিঁয়া তানসেন... 
মৃত্যুর কারণ- সঙ্গীত ও সম্রাট আকবর স্বয়ং...
রাগ "দীপক" শোনার জন্য ছেলেমানুষী বায়না ধরেছিলেন সম…

 





১৫৮৬ সালের ২৩শে এপ্রিল, শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। প্রয়াত হলেন সুর সম্রাট মিঁয়া তানসেন... 


মৃত্যুর কারণ- সঙ্গীত ও সম্রাট আকবর স্বয়ং...


রাগ "দীপক" শোনার জন্য ছেলেমানুষী বায়না ধরেছিলেন সম্রাট। বড় ভয়ানক সে রাগ। সে রাগের সঠিক প্রয়োগে শুধু প্রদীপই জ্বলে উঠে না, খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পুরোমাত্রায়। 


তাই প্রথমে রাজি না হলেও, পরে সম্রাটের আবদার রাখতে গিয়ে দীপক রাগের প্রভাবে ঠিকই অগ্নিদগ্ধ হন তানসেন। মেয়ে সরস্বতি, পিতার নির্দেশে মেঘ মলহার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে! 


আশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন আকবরের 'নবরত্ন সভা'র অন্যতম রত্ন মিঁয়া তানসেন।  একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হল। কিন্তু তানসেনের শেষকৃত্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হল ব্যাপক বিক্ষোভ।  


হিন্দু সমাজ ঘোষণা করলেন, তানসেন হিন্দুর ঘরের ছেলে। নাম- রামতনু মিশ্র, পিতা মুকুন্দ মিশ্র (মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষন ও সুগায়ক। জনৈকা মুসলিম রমনীর (তানসেনের স্ত্রী হুসেইনি বেগম) চক্করে পড়ে ধর্ম পরিবর্তন করলেও, তার শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। তাই তার শেষকৃত্য হিন্দুশাস্ত্রমতেই হওয়া উচিত। 


কিন্তু  নারাজ ইমাম-মৌলবীরা। তারা বললেন,  ধর্ম বদল করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন। তাই ইসলাম মতেই পালন করা হোক সুরসম্রাটের শেষ যাত্রা। 


তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে বেকায়দায় পড়লেন আকবর স্বয়ং। তার শেষকৃত্য নিয়ে দাঙ্গা বাঁধার উপক্রম। এমন সময় এটি সমাধান কল্পে আসরে নামলেন তানসেনের মেয়ে সরস্বতী (তানসেনের ছিল পাঁচ সন্তান - হামীরসেন, সুরটসেন, তানরস খান, সরস্বতী দেবী ও বিলাস খান। এরা প্রত্যেকে উচ্চমানের গায়ক ও বীনাবাদক)।  


মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন তানসেন। সেই সরস্বতী বললেন, পিতার মৃত্যুর পর যে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা তাঁর পিতা জীবদ্দশাতেই আঁচ করেছিলেন। তাই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা নিয়ে দিয়ে গেছেন এক বিস্ময়কর নির্দেশনা। আর সেটি হল - গান। যে গায়ক তাঁর গানের প্রভাবে তানসেনের মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন, তাঁর ধর্মানুসারেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে শবদেহের।  


অবাক হলেন আকবর....এ অসম্ভব কাজ! গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণের সঞ্চার? কখনও সম্ভব নাকি? আশ্বস্ত করলেন তানসেন দুহিতা - হ্যাঁ সম্ভব! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে রয়েছে সে গুণ, দরকার আধ্যাত্মিক সাধনা, সুরজ্ঞান ও আন্তরিক পরিবেশনের। 


অসম্ভব এই প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত মনে ধরে আকবরের। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মাতব্বরেরাও একমত হলেন এই প্রস্তাবে। সংরক্ষিত করা হল তানসেনের মরদেহ। মৃতসঞ্জীবনী সুরসুধার সন্ধান এক কথায় ছিল অসম্ভব! কারণ তানসেনের পরবর্তী এমন কোন গায়ক সে সময় তামাম হিন্দুস্থানে ছিল না, যে কিনা এমনই ঐশ্বরিক ক্ষমতাধারী; যার সুরের জাদুতে মৃতের শরীরেও প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে পারে।


তবু শুরু হল গান, সম্রাট আকবরের আমন্ত্রণে তামাম ভারতের সেরা ওস্তাদ ও সুরসাধকদের ভীড় হলো দিল্লির দরবারে। দিনরাত পালা করে চলছে ওস্তাদি গান। ওদিকে ফুল, আতর, বরফ আর ঔষধি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তানসেনের মরদেহ। মনে হচ্ছে যেন পরম নিশ্চিন্তে তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন। এক্ষুনি জেগে উঠে তানপুরার তার বেঁধে রেওয়াজে বসবেন তার গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্ট 'বৃন্দাবনী সারঙ্গ' রাগে।


তিনদিন ধরে সুরের বন্যা বয়ে গেল রাজ দরবারে অথচ নিস্পন্দ তানসেন। এত কিছু করেও কি তবে সব আয়োজন ব্যর্থ হতে চলেছে? এমন কোন গায়ক সত্যিই নেই সারা ভারতে, যে কিনা তানসেনের সমকক্ষ কোন সুরসাধক! যে কিনা এই অসাধ্য সাধন করতে পারেন! হতাশ হয়ে পড়লেন আকবর।   


হটাৎ বদলে গেল দৃশ‍্যপট...


২৬ শে এপ্রিল, ভোরের আলো ফুটতে তখনও দেরী। একটু একটু করে সরে যাচ্ছে রাতের পর্দা। ধীর পায়ে রাজদরবারে এসে দাঁড়ালেন এক ফকির! জানালেন, তিনি একবার চেষ্টা করতে চান। চালচূলোহীন সেই ফকিরের কথা শুনে হেসে কুটিপাটি সভাসদরা। তামাম হিন্দুস্তানের নামজাদা ওস্তাদেরা যেখানে ব‍্যর্থ, এই ফকির সেখানে কি চমৎকার দেখাবেন? ফকির কিন্তু অনড়। শেষ চেষ্টা করে দেখতে তিনি যেন মরীয়া। তার উজ্জ্বল দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সায় দিলেন সুর রসিক আকবর । 


তানসেনের পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন তার গান। কি আশ্চর্য! মূহুর্তে যেন পাল্টে গেল গোটা পরিবেশ। অজানা সেই রাগের অপার্থিব সুরের অদ্ভুত সেই মায়াজালে আচ্ছন্ন হলেন সকলে! ভোরবেলার সেই রাগের এমনই মাধূর্য, যেন সকালটা এরজন্যই অপেক্ষা করে বসেছিল! সেই রাগ কেউ কখনো শোনেনি। কেউ কখনও ভাবেনি এমনও গান হয়। কি গায়কি! কি তালিম! কি সুর! প্রতিটি চলনে সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত; যেন হারিয়ে ফেলেছেন মুখের ভাষা!


এমন সময় দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য! বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে রাজসভায় শায়িত মিঁয়া তানসেনের নিস্পন্দ শরীরে! ফকির ভাবলেশহীন, তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছেন। যেন পরম করুনাময় ঈশ্বরের সাধনায় বিলীন হয়ে গেছে তার সকল স্বত্তা, বোধ, জাগরণ। এরপর অবলীলাক্রমে একটি অসাধারণ গমক নিলেন সেই ফকির! সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন, মৃত তানসেনের ডান হাতটি কাঁপছে এবং ধীরে ধীরে সেই অজ্ঞাত গায়কের দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে তানসেনের ডানহাত। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন সময় থমকে গেল! তারপর সব শেষ। 


ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায়। সবাই আপ্লুত চোখে সেই ফকিরের দিকে তাকিয়ে। গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির। অদ্ভুত প্রশান্তি তার মুখে। সকলের মুখে তখন একটাই প্রশ্ন - কে এই ফকির? ইনি ত কোনও সাধারণ মানুষ নন! খোদ সম্রাট আকবর পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু নিজের পরিচয় দিতে চান না তিনি। উপস্থিত সকলের একান্ত অনুরোধে নিজের পরিচয় অবশেষে পেশ করেন।


#বিলাস_খান... তানসেনের কনিষ্ঠতম সন্তান! অল্প বয়সে সুফিসাধনায় মজে ঘর ছেড়েছিলেন। সেদিন তার গাওয়া সেই রাগ তার নিজস্ব রচনা। নাম - #বিলাসখানিটোড়ি।        


সেদিন দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বিলাস খানকে নজরানা দিতে চেয়েছিলেন সম্রাট আকবর। বিলাস খান জানিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকে তাঁর পিতার পাশে স্থান দেয়া হয়। আজও গোয়ালিয়রে পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা-পুত্র।

No comments