Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সার্কাসের সিংহ

সার্কাসের সিংহ - আশিস কুমার পন্ডা
আশি বা তার আগের দশকগুলিতে যারা জন্মেছেন, তাদের মধ্যে ছোটবেলায় সার্কাস দেখেননি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। তাদের কাছে শৈশবের স্মৃতি মানেই শীতের মরশুমের সার্কাস। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রঙ বেরঙের তাঁবুর …

 






সার্কাসের সিংহ - আশিস কুমার পন্ডা


আশি বা তার আগের দশকগুলিতে যারা জন্মেছেন, তাদের মধ্যে ছোটবেলায় সার্কাস দেখেননি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। তাদের কাছে শৈশবের স্মৃতি মানেই শীতের মরশুমের সার্কাস। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রঙ বেরঙের তাঁবুর মধ্যে পশু পাখিদের আশ্চর্য সব খেলা, জোকারের কারসাজী, ট্রাপিজের দুঃসাহসী খেলা, রোমহর্ষক বাহাদুরির খেলা যেগুলি অনায়াসে দু’-তিন ঘন্টা সময় ধরে টানটান উত্তেজনায় দর্শকদের মাতিয়ে রাখতো। সার্কাসের শেষ দৃশ্যে তৈরি করা হোত এক বিশাল লোহার খাঁচা, যার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হতো এক দল বাঘ, সিংহ, ভালুক, চিতার মত বন্য প্রাণী। এক হাতে চাবুক এবং অন্য হাতে এক চেয়ার নিয়ে একজন সাহসী পুরুষ/মহিলার (রিং মাষ্টার) সেই হিংস্র প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করার দৃশ্যটি ছিল সবচেয়ে উত্তেজনাময় এবং শ্বাসরুদ্ধকর ।


এক শতাব্দীরও বেশি আগে, ক্লাইড বিটি নামে একজন ব্যক্তি রিং মাষ্টার (tamer), বন্য প্রাণী প্রশিক্ষক, চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং সার্কাসের মালিক হিসাবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯০৩ সালে আমেরিকার ওহাইও প্রদেশের বেইনব্রিজে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়সেই, সার্কাসে যোগদানের জন্য তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। খাঁচা পরিষ্কারের কাজ করা থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলিতে, বিটি একজন সার্কাসের জনপ্রিয় বিনোদনকারীতে পরিণত হয়েছিলেন।


সার্কাসে হিংস্র বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লড়াইয়ের এর জন্য বিটি বিখ্যাত হয়েছিলেন। কর্মজীবনের শিখরে, বিটির অভিনয়ের এক বিশেষ অংশ ছিল যেখানে তিনি ৪০ টির মতো সিংহ, বাঘ, ভালুক, চিতা এবং হায়েনাকে একসঙ্গে সার্কাসের রিংয়ের মধ্যে  নিয়ে এসে, পুরো দলটিকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্লাইড বিটি সত্যিকারের শোম্যান ছিলেন। তিনি তার হেলমেট, বেতের চেয়ার, চাবুক এবং ফাঁকা আওয়াজ করা এক বন্দুক  নিয়ে লোহার খাঁচা ঘেরা মাঠে ছুটে বেড়াতেন। হৃদয়-স্পন্দনকারী, দ্রুত গতির এবং উত্তেজনাপূর্ণ এই শৈলী সার্কাসের ইতিহাসে এক সংবেদন সৃষ্টি করেছিল। আজ থেকে একশ বছর আগে যখন বেশিরভাগ রিংমাষ্টার রিংয়ের মধ্যেই সিংহের শিকার হয়ে যেতেন, বিটি সেই সময়ে ৩০ বছর রিং-এর মধ্যে কাটিয়ে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। শেষ পর্যন্ত, সিংহ নয়, ক্যান্সারের আক্রমণে তার মৃত্যু হয়।


কিন্তু, কীভাবে রিংএর মধ্যে ৩০ বছর ধরে তিনি সিংহের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন?


ক্লাইড বিটি তার কাজের মধ্যে এক নতুনত্ব এনেছিলেন। সার্কাস রিংয়ে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি চাবুকের পাশাপাশি, একটি চেয়ার ব্যবহার করা শুরু করেন। যদিও দর্শকরা চাবুকের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, তবে তার বেশিরভাগটাই থাকে বিনোদনের জন্য। বাস্তবে, চেয়ারটিই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। রিং মাষ্টাররা চেয়ার বা বসার স্টুলের আসন ধরে চেয়ারের চারটি পা সিংহের মুখের সামনে তুলে ধরেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, সিংহরা কি চেয়ারের মধ্যে ভয়ের কিছু দেখতে পায়? মোটেও না! তাদের সমস্যা হল চেয়ারের চারটি পা দেখে তারা বিহ্বল হয়ে যায়। চেয়ারের চারটি পা সিংহের কাছে অনেক বেশি তথ্য (information) হয়ে দাঁড়ায়। একই সময়ে তারা চেয়ারের চারটি পায়ে মনোযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা বিফল হয়। তার মনোযোগ এতগুলি বিকল্পের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কী করা যায় বা কোথা থেকে শুরু করা যায়- এই নিয়ে সে ভাবতে থাকে। সিংহ, চেয়ার ধরে থাকা রিং মাষ্টারকে আক্রমণ করার পরিবর্তে একেবারে ধীর স্থির হয়ে যায়। জঙ্গলের রাজা সিংহ বাস্তবে এক ভীতু বিড়ালছানা হয়ে ওঠে; কারণ হলো চেয়ারের চারটি পা।‘


'চেয়ার দেখিয়ে সিংহকে নিয়ন্ত্রণ করা' এক অসাধারণ রূপক, যা আমাদের সঙ্গে প্রায়শই ঘটে এবং আমরা সার্কাসের সিংহের মতো ব্যবহার করি - একটি বেতের চেয়ার আমাদের মুখের সামনে ধরা থাকে এবং আমাদের মনোযোগ সেই চেয়ারের চারটি পায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। আমাদের সবসময় মনে হয়, এই মূহুর্তে মনোযোগ করার মতো অনেক কিছু আছে, আরও অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে, আমরা এখন খুব ব্যস্ত, আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যেমন; আমাদের লক্ষ্য অর্জন, ব্যবসা তৈরি করা, বই পড়া, ভ্রমণ করা, শরীর তৈরি করা এবং আরও অনেক কিছু। প্রতিটি বিষয়ের আবার অনেক বিকল্প আছে; অগ্রাধিকার, সুযোগ, সময়সীমা, লক্ষ্য এবং ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি। শেষ পর্যন্ত, আমরা সার্কাসের সিংহের মতো, আমাদের সামনে রাখা চেয়ারের পাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকি, কোন পা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে নিজের মনে তর্ক করতে থাকি এবং বিভ্রান্ত হয়ে আমরা সার্কাসের সিংহের মতো স্থির হয়ে বসে থাকি!


এমনটা করলে কিন্তু চলবে না। যখন বিশ্ব আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে, তাদের মনে করিয়ে দেবেন আপনি জঙ্গলের রাজা! আপনার যদি কিছু করার থাকে তবে এই মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নিন। আপনাকে শুধু আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ 'একটি মাত্র কাজের' উপর মনোযোগ করতে হবে যা আপনাকে সরাসরি আপনার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। আপনি যদি আজকের দিনের মধ্যে আপনার সেই ‘একটি মাত্র কাজ’ সম্পূর্ণ করতে পারেন, অন্যান্য অনেক কাজ সম্পূর্ণ না হলেও, আপনার দিনটি হয়ে উঠবে একটি বিজয়ের দিন। একই যুক্তিতে, আপনি যদি সেই গুরুত্বপূর্ণ ‘একটি মাত্র কাজ’ সম্পন্ন না করেন,  অন্য যা কিছু সম্পন্ন করেছেন তা বিবেচনা করেও, আপনার দিনটি হবে একটি ব্যর্থতার দিন। সুতরাং, সমস্ত কাজের দিকে নজর দেওয়া বন্ধ করুন, আপনাকে একসঙ্গে সব কাজ করতে হবে না। সমস্ত কাজই সরল বলে মনে হবে, কিন্তু আমরা প্রায়ই তাদের সঙ্গে যুক্ত প্রয়োজনীয় সময়, শক্তি, এবং অর্থের খরচ ভুলে যাই। অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাক্তন সিইও, স্টিভ জবস একবার বলেছিলেন, "মনোযোগ করা হল ‘না’ বলা। ১০০০ জিনিসকে না বলতে পারলে একটা জিনিস আবিষ্কার করা সম্ভব হয়।" সুতরাং ‘না’ বলতে শিখুন। আপনার সামনে আসা প্রতিটি সুযোগ দেখে প্রলুব্ধ হবেন না, শুধুমাত্র  সঠিক সুযোগটির দিকে মনোযোগ দিন। আমাদের মনোযোগ যেখানে যায়, আমাদের সমস্ত শক্তি সেখানে কেন্দ্রীভূত  হয়। তাই, ভুল করেও সার্কাসের সিংহ হবেন না, আপনার মুখের সামনের চেয়ারটিকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিন। রিং মাষ্টারের চাবুকের দিকে নজর রাখুন এবং রিং মাষ্টারকে আক্রমণ করুন।

No comments