Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সুন্দর হৃদয় - আশিস কুমার পন্ডা

সুন্দর হৃদয় - আশিস কুমার পন্ডা

সেই সময়কার কথা, যখন লোকেরা অন্যদের কাছে তাদের হৃদয় খুলে দেখাতে পারতো। শহরের এক যুবক সবসময় গর্ব করতো যে তার হৃদয় সবচেয়ে নিখুঁত এবং সুন্দর। একদিন শহরের চৌরাস্তার পাশে এক বিশাল জনতাকে জড়ো করে সে তা…

 




সুন্দর হৃদয় - আশিস কুমার পন্ডা



সেই সময়কার কথা, যখন লোকেরা অন্যদের কাছে তাদের হৃদয় খুলে দেখাতে পারতো। শহরের এক যুবক সবসময় গর্ব করতো যে তার হৃদয় সবচেয়ে নিখুঁত এবং সুন্দর। একদিন শহরের চৌরাস্তার পাশে এক বিশাল জনতাকে জড়ো করে সে তার হৃদয় খুলে দেখাতে লাগলো।  তার গোলাপী-লাল হৃদয়ের নিখুঁত ছন্দে 'লাব-ডাব’—‘লাব-ডাব’ সঙ্গীত তাদের মুগ্ধ করলো। তার হৃদয়ের মসৃণ ত্বক ছিল একেবারে নিখুঁত, কোন দাগ বা ত্রুটির চিহ্নমাত্র সেখানে ছিল না। উপস্থিত জনতা যুবকের হৃদয়ের প্রশংসা করতে লাগলো, তারা সকলেই একবাক্যে সম্মত হল যে সত্যিই এই হৃদয় তাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর হৃদয়। যুবকের গর্বের আর সীমা রইলো না, সে তার সুন্দর হৃদয় নিয়ে আরও বেশি করে গর্ব করতে লাগলো। হঠাৎ ভিড়ের ভিতর থেকে এক ছোট্ট মেয়ে সামনে এসে যুবককে বললো, “তোমার হৃদয় অবশ্যই নিখুঁত, কিন্তু সুন্দর নয়। আমার ঠাকুরমার হৃদয় তোমার দেখা উচিত। সেটি সত্যিই সুন্দর!" যুবকটি ছোট মেয়েটির কথায়  অপমানিত বোধ করলো, তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এক বৃদ্ধার হৃদয় তার হৃদয়ের চেয়ে কী করে সুন্দর হতে পারে! চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের জন্যে সে মেয়েটির সঙ্গে তার ঠাকুরমার বাড়ির পথ ধরলো। কৌতুহলী ও উত্সাহী জনতা তাদের অনুসরণ করলো।

মেয়েটির অনুরোধে তার ঠাকুরমা খুব সাবধানে ভিড়ের সামনে তার হৃদয় খুলে দেখালেন। বৃদ্ধার হৃৎপিণ্ডও প্রবলভাবে স্পন্দিত হচ্ছিল এবং সুরেলা গান ('লাব-ডাব’—‘লাব-ডাব’) গাইছিল, কিন্তু এর ত্বক যুবকের হৃদয়ের মতো মসৃণ এবং চকচকে ছিল না। অজস্র কাটা ছেঁড়ার দাগ, বিভিন্ন রংএর ছোপ তার হৃদয়ের রুক্ষ ত্বককে আরও বীভৎস করে তুলেছিল। হৃদয়ের আকৃতি বলে কিছু ছিল না; সেখানে এমন এমন জায়গা ছিল যেখান থেকে ছোট-বড় অনেক টুকরো সরানো হয়েছিল এবং অন্যান্য টুকরো রাখা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলি মাপসই না হওয়ায় অনেক রুক্ষ এবং ধারালো প্রান্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু জায়গায় আবার, মাংসের টুকরো খুবলে নেওয়ায় গভীর গর্ত তৈরি হয়েছিল, যেখান থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল।  জনতা তাদের দেখা সবচেয়ে কুশ্রী হৃদয় দেখে ব্যঙ্গ করতে লাগলো।

যুবকটি মেয়েটিকে বললো, “তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে রসিকতা করছো। আমার হৃদয়ের দিকে ভালো করে তাকাও, কত সুন্দর আর নিশ্ছিদ্র। তুমি আমার হৃদয়ে একটুও অপূর্ণতা খুঁজে পাবে না। তোমার ঠাকুরমার হৃদয় দেখেছ? অজস্র সেলাই, দাগ, গর্ত এবং ক্ষত দিয়ে পরিপূর্ণ। তুমি কিভাবে বলতে পার, এই হৃদয় আমার হৃদয়ের চেয়ে  সুন্দর?"

"হ্যাঁ, আপনার হৃদয় নিখুঁত দেখাচ্ছে বটে, তবে আমার ঠাকুরমা তার হৃদয়ের বিনিময়ে আপনার হৃদয় কখনই নেবেন না!", ছোট্ট মেয়েটি বলল।

"তুমি কী মজা করছো!", যুবকটি তার বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, "আমার নিখুঁত হৃদয়ের চেয়ে বৃদ্ধার এই হৃদয় কীভাবে সুন্দর হতে পারে?"

ছোট্ট মেয়েটি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো, “দেখুন, যখনই ঠাকুরমা কাউকে ভালোবাসেন, তিনি সেই ব্যক্তিকে তার হৃদয়ের এক টুকরো দান করে দেন। যখন কেউ বিনিময়ে তাকে তার হৃদয়ের এক টুকরো ফিরিয়ে দেন, তখন ঠাকুরমা তার হৃদয়ের খালি জায়গায় সেটিকে বসিয়ে দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, টুকরোগুলি পুরোপুরি মাপসই হয় না তাই সেগুলি ফোলা এবং রুক্ষ কিনারা তৈরি করে। আমার ঠাকুরমা এগুলিকে যত্নে আগলে রাখেন, কারণ তারা তাকে অন্যদের দেওয়া ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। কখনও কখনও ঠাকুরমা তার হৃদয়ের এক টুকরো কাউকে দিয়ে দেন, কিন্তু তার বিনিময়ে কোন টুকরো ফেরত পান না। তাতেই খালি গর্তগুলি তৈরি হয়ে যায়। ঠাকুরমা বলেন, ‘ভালোবাসা মানে ঝুঁকি নেওয়া, বিনিময়ে ভালোবাসা নাও পেতে পারো।’ যেহেতু এই গর্তগুলি খোলা থাকে এবং রক্ত চুইয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে, তাই এগুলি বেদনাদায়ক। কিন্তু, সেই ক্ষতগুলি তাকে সেই মধুর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় যে তিনি মানুষদের জন্য তার ভালবাসা দান  করেছিলেন এবং আশা করেন যে একদিন সেই ভালবাসাগুলি ফিরে আসবে এবং তার হৃদয়ের শূন্য স্থান পূরণ করবে। এই কারণেই আমি মনে করি আমার ঠাকুরমার হৃদয় সবচেয়ে সুন্দর। আমি যখন বড় হব, আমি চাই আমার হৃদয়ও আমার ঠাকুরমার হৃদয়ের মতোই সুন্দর হোক।"

যুবকটি চোখ বড় বড় করে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলো, "যখন আপনার হৃদয়ের কিছু অংশ দান করেন, তখন প্রতিবারই আপনাকে কষ্ট পেতে হয়। আপনি তাহলে দান করেন কেন?" স্নেহময় চোখে বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, “কারণ, নিজের হৃদয়ের এক টুকরো দেওয়া বা অন্য কারও হৃদয়ের এক টুকরো পাওয়ার অনুভূতি আমাকে আরও সুখী এবং উষ্ণ করে তোলে। চেষ্টা করে দেখ, আমার হৃদয়ের এই টুকরোটি তোমার হৃদয়ের উপর রাখ।" এই বলে, তিনি তার পুরানো ক্ষতবিক্ষত হৃদয় থেকে এক টুকরো তুলে এনে যুবকের হৃদয়ের উপর বসিয়ে দিলেন। টুকরোটি আদৌ মানানসই ছিল না, তার হৃদয়ের মসৃণ ত্বকের উপরে এবড়ো খেবড়ো হয়ে একাত্ম হয়ে গেল। যুবকটি তার হৃদয়ের দিকে তাকালো, সেটিকে আর আগের মত নিখুঁত দেখাচ্ছিল না, তবে আগের চেয়ে অনেক সুন্দর লাগছিল, কারণ বৃদ্ধার হৃদয় থেকে ভালবাসা তার হৃদয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তার ত্রুটিযুক্ত হৃদয়ে প্রথমবারের মতো ভালবাসা পাওয়ার বিশেষ মুহূর্তটি উপভোগ করে যুবকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিনিময়ে, সে বৃদ্ধার কাছে চলে গেল, তার নিজের হৃদয় থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাকে নিবেদন করলো। বৃদ্ধা তার কাঁপা কাঁপা হাতে যুবকের অর্পণ গ্রহণ করে তার হৃদয়ের ক্ষতগুলির একটির উপর বসিয়ে দিলেন। যুবকটি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, তার গাল বেয়ে চোখের জলের ধারা নেমে এলো। তার পরিপূর্ণ হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে সে দেখলো, এটি এখনও আগের মতই শক্তিশালীভাবে স্পন্দিত হয়ে চলেছে কিন্তু অসম্পূর্ণ হয়েও আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। যুবকটি বুঝতে পারলো, এক সুন্দর হৃদয় অন্যের কাছ থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নয়, একে অবাধে এবং গভীরভাবে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। 

এক নিখুঁত হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা অর্থহীন; এক নিখুঁত হৃদয় তার রঙ, আকৃতি এবং প্রতিসাম্যের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু এক নিখুঁত হৃদয়ের চেয়ে এক সুন্দর হৃদয়ের অধিকারী হওয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের হৃদয়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য অন্তর থেকে আসে এবং ইতিবাচক চিন্তা, নিজের এবং অন্যদের প্রতি ভালবাসার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এক ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে আমাদের জীবনে রঙ, সুবাস এবং সুখ এনে দেয়। আমাদের হৃদয় অনেক জাদু করতে পারে, ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেও অন্যকে গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পারে; মানুষকে নিমেষে প্রিয় ও নিকটবর্তী করে তুলতে পারে, অনুপ্রাণিত করতে পারে, সাধারণ কিংবা বিবর্ণ সময়কে সুন্দর ও রঙিন করে তুলতে পারে, মনের ক্ষত নিরাময় করতে পারে, মানুষদের মধ্যে সীমানা মিটিয়ে দিয়ে তাদের একত্রিত করতে পারে।

তোমরা সকলেই তোমাদের ভালবাসা ও মমতায় পূর্ণ এক সুন্দর হৃদয়ের  অধিকারী। বয়স, বর্ণ, জাতি এবং ধর্ম নির্বিশেষে এক বড় পার্থক্য করার ক্ষমতা তোমাদের সকলের রয়েছে। তোমাদের ভালোবাসা অন্যের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়ে তোমাদের সুন্দর হৃদয়কে আরো উজ্জ্বল করে তোল এবং অসাধারণ হয়ে ওঠো।

No comments