Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

প্রার্থনার হাত -আশিস কুমার পন্ডা

প্রার্থনার হাত -আশিস কুমার পন্ডা

পঞ্চদশ শতাব্দীতে, আলব্রেখট ডুরার (প্রবীণ) নামে একজন স্বর্ণকার তার স্ত্রী এবং আঠারো সন্তান নিয়ে জার্মানির নুরেমবার্গের কাছে একটি ছোট গ্রামে বাস করতেন। পরিবারের প্রধান হিসাবে, এই বিশাল পরিবারের ভরণপ…

 




প্রার্থনার হাত -আশিস কুমার পন্ডা



পঞ্চদশ শতাব্দীতে, আলব্রেখট ডুরার (প্রবীণ) নামে একজন স্বর্ণকার তার স্ত্রী এবং আঠারো সন্তান নিয়ে জার্মানির নুরেমবার্গের কাছে একটি ছোট গ্রামে বাস করতেন। পরিবারের প্রধান হিসাবে, এই বিশাল পরিবারের ভরণপোষনের জন্যে তিনি দিনে প্রায় আঠারো ঘন্টা কাজ করতেন। পরিবারের হতাশাজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, তার দুটি বড় সন্তান, আলব্রেখট এবং আলবার্ট, একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তারা উভয়েই শিল্পকলায় তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা পুরোপুরি জানত যে তাদের বাবা আর্থিকভাবে তাদের কাউকেই কলা বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য নুরেমবার্গে পাঠাতে সক্ষম হবেন না। এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হলো। অবশেষে তারা এক চুক্তিতে সহমত হলো। তারা একটি মুদ্রা নিক্ষেপ (টস) করবে। পরাজিত ব্যক্তি কাছাকাছি এক খনিতে কাজ নেবে এবং তার উপার্জন দিয়ে তার ভাইকে কলা বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাবে। তারপর, যখন সেই ভাইটি চার বছরের পড়াশুনা শেষ করে ফিরে আসবে, তখন সে তার শিল্পকর্ম বিক্রি করে বা প্রয়োজনে খনিতে কাজ করে অন্য ভাইকে কলা বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাবে। এক রবিবার সকালে গির্জা থেকে ফিরে এসে তারা একটি মুদ্রা টস করলো এবং বড় ভাই আলব্রেখট ডুরার টস জিতে নুরেমবার্গ কলা বিদ্যালয়ে চলে গেল। ছোট ভাই, আলবার্ট তার দাদার পড়ার খরচ যোগানোর জন্য এক বিপজ্জনক খনিতে কাজ করা শুরু করলো। আলব্রেখ্ট এতই প্রতিভাবান ছিলেন যে তিনি কলা বিদ্যালয়ে অল্প সময়ের মধ্যে যেন এক ঝড় তুলে ফেললেন; তার চিত্রকলা, জলরঙ, রেখাঙ্কন, ভাস্কর্য, খোদাই, তৈলচিত্র তার বেশিরভাগ অধ্যাপকদের চেয়ে উঁচু মানের ছিল। পড়াশোনা শেষ করার আগে থেকেই, তিনি তার শিল্পকর্মের জন্য যথেষ্ট পারিশ্রমিক অর্জন করতে শুরু করেছিলেন।


এক একটা করে চার বছর কেটে গেল। কলা বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তরুণ শিল্পী, আলব্রেখট তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন। ডুরার পরিবার বিজয়ী শিল্পীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে এক নৈশভোজের আয়োজন করলেন। সেই আনন্দের অনুষ্ঠানে সবাই স্বাদিষ্ট খাবার, গান এবং হাসি উপভোগ করলেন। সবশেষে, সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় হলো। সেই সন্ধ্যার সম্মানিত শিল্পী আলব্রেখ্ট উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় ভাইয়ের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, যার চার বছরের ত্যাগ ছাড়া আলব্রেখট কখনোই তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতেন না। অতিথিরা করতালি দিয়ে আলবার্টের  ত্যাগের প্রশংসা করলেন। সমাপনী শব্দে আলব্রেখট বললেন, "আলবার্ট, আমার ধন্য ভাই, এখন তোমার পালা। এখন তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নুরেমবার্গ যেতে পার এবং তোমার কলা বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ আমি যোগাব।" সমস্ত মাথা উদগ্রীব হয়ে টেবিলের শেষ প্রান্তে ঘুরে গেল যেখানে আলবার্ট বিষন্ন মুখে বসে ছিলেন। তারা আশা করছিলেন যে তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন এবং তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য খনির চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু, তখন আলবার্টের চোখ বেয়ে নেমে আসছিল জলের ধারা। ধরা গলায় তিনি বারবার বলতে থাকলেন, "না... না... না... না।" তার প্রতিক্রিয়ায় সবাই হতবাক হয়ে গেলেন। অবশেষে আলবার্ট উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের জল মুছে নিলেন। দু’ গালের উপর হাতদুটি চেপে ধরে, লম্বা টেবিলের দুদিকে বসা তার পছন্দের মুখগুলোকে একবার দেখে নিয়ে, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললেন, “না ভাই। দুর্ভাগ্যবশত, আমি নুরেমবার্গ যেতে পারব না। আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে।“ কথাগুলি বলে, আলবার্ট তার দু’ হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে চললেন, "দেখো ভাই, খনিতে চার বছরের কঠোর পরিশ্রম আমার হাতের কী ক্ষতি করেছে। আমার আঙুলের প্রতিটি হাড় অন্তত একবার ভেঙ্গেছে, আমার আঙ্গুলগুলির প্রতিটি অস্থিসন্ধি এতটাই বাতে আক্রান্ত হয়েছে যে জলের গ্লাসও ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারি না। আর কি, এই আঙ্গুলগুলি দিয়ে পার্চমেন্ট এবং ক্যানভাসের উপর কলম এবং ব্রাশ দিয়ে সূক্ষ্ম রেখা আঁকা সম্ভব! না, ভাই, আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে।“ অতিথিরা ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলেন। বড় ভাই দুঃখ পেলেন, চার বছর আগে তারা যে চুক্তি করেছিলেন, তার এই একতরফা পরিণতি তিনি  কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

অনুগত ভাই আলবার্টের নীরব এবং নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আলব্রেখ্টকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা এবং স্নেহের চিহ্ন হিসাবে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিশ্রম করে তিনি তার ভাইয়ের অপব্যবহৃত হাতের তালু দুটিকে নীল কাগজের এক টুকরোর উপর কালো কালি এবং কলমের আঁচড় দিয়ে ফুটিয়ে তুললেন। ভাইয়ের বিকৃত, কর্কশ, শক্ত, বাঁকানো, জীর্ণ ও শীর্ণ  আঙ্গুলগুলিকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে প্রসারিত করে দিলেন। আলব্রেখট ডুরার তার এই অসামান্য অঙ্কনটিকে কেবল "হাত (Hands)" বলে অভিহিত করেছিলেন, কিন্তু সমগ্র বিশ্ব এই মহান শিল্পকর্মটির প্রতি তাদের হৃদয় খুলে দিয়েছিল এবং তার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার নামকরণ করেছিল "প্রার্থনার হাত (The praying hands)”।


১৫০৮ সালে অঙ্কনটি শেষ হওয়ার পর থেকে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আজকের দিনে, প্রায় সব ধরণের কল্পনাযোগ্য বস্তুতে; যেমন গীর্জা, ট্যাটু, নেকলেস, স্টিকার, ক্লিপ আর্ট, ফলক, ব্রেসলেট, টি-শার্ট, বই এর শেষ পাতা, রাস্তার শিল্প, শ্মশানের কলস, সাবান এবং এমনকি সমাধির পাথরে ও এর প্রতিলিপি দেখতে পাওয়া যায়। কালি, পেইন্ট, কাঠ, প্লাস্টার, রঙিন কাঁচ এবং তামা থেকে শুরু করে সূচিকর্ম, কুরুশশিল্প এবং এমনকি ছোটদের ছবি আঁকা শেখার বই পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি মাধ্যমেই চিত্রটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এক অতি সাধারণ কালি-কলমের আঁচড়ে ফুটে ওঠা 'প্রার্থনার হাত' ছবিটির এক সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। হাত দুটি সাধারণ কোন পুরুষ বা মহিলা বা অন্য কারও হতে পারে। এই সাধারণ স্কেচে আমরা আমাদের সকলের কাহিনী দেখতে পাই, আমাদের প্রার্থনা, কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, প্রশংসা, অসহায়ত্ব, করুণার আবেদন এবং সব কিছু।


আলব্রেখটের জীবনে আলবার্টের মতো, আমাদের জীবনেও এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা তাদের কর্মজীবন এবং স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করার জন্য প্রার্থনা এবং কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তু তাদের আন্তরিক প্রার্থনা এবং গোপন আত্মত্যাগ ফল দেবে কিনা বা আমরা সফল হয়ে তাদের স্মরণ করবো কিনা; এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র শঙ্কা বা প্রতিদান পাওয়ার ইচ্ছা থাকে না। বড় ভাই, আলব্রেখটের মতো আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই সেই পরিচিত হাতগুলিকে চিনতে পারেন, যে হাতগুলির বিকৃত, শক্ত, কর্কশ, বাঁকানো, জীর্ণ ও শীর্ণ আঙ্গুলগুলি বিশ্বস্তভাবে করজোড়ে আমাদের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে।


সবশেষে, মনে রাখতে হবে যে সাফল্য কখনই একা পথ পাড়ি দিতে পারে না এবং অনেক ত্যাগ চোখের আড়ালেই থেকে যায়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের পিতামাতা, শিক্ষক, পরামর্শদাতা, ভাই-বোন, পতি/পত্নী, এবং বন্ধু নিরলসভাবে তাদের ত্যাগ, সহযোগিতা এবং অটল প্রার্থনা দিয়ে আমাদের জীবন সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলেন। তারা আমাদের জন্যে যা করেন তার সবকিছু ফিরিয়ে দেওয়া সবসময় সম্ভব নয় তবে আমাদের জীবনে এই সমস্ত বিশেষ ব্যক্তিদের অমূল্য ভূমিকার জন্য তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক 'প্রার্থনার হাত' এই সব ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ করে দেয় এবং বিনীতভাবে স্বীকার করার সুযোগ দেয় যে তাদের অনুষঙ্গ, নিবেদন, প্রেরণা, ও বলিদান আমাদের জীবনে সকল উৎসের আধার হয়ে আছে। তারা আছেন বলেই আমরা আছি।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে, আলব্রেখট ডুরার (প্রবীণ) নামে একজন স্বর্ণকার তার স্ত্রী এবং আঠারো সন্তান নিয়ে জার্মানির নুরেমবার্গের কাছে একটি ছোট গ্রামে বাস করতেন। পরিবারের প্রধান হিসাবে, এই বিশাল পরিবারের ভরণপোষনের জন্যে তিনি দিনে প্রায় আঠারো ঘন্টা কাজ করতেন। পরিবারের হতাশাজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, তার দুটি বড় সন্তান, আলব্রেখট এবং আলবার্ট, একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তারা উভয়েই শিল্পকলায় তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা পুরোপুরি জানত যে তাদের বাবা আর্থিকভাবে তাদের কাউকেই কলা বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য নুরেমবার্গে পাঠাতে সক্ষম হবেন না। এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হলো। অবশেষে তারা এক চুক্তিতে সহমত হলো। তারা একটি মুদ্রা নিক্ষেপ (টস) করবে। পরাজিত ব্যক্তি কাছাকাছি এক খনিতে কাজ নেবে এবং তার উপার্জন দিয়ে তার ভাইকে কলা বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাবে। তারপর, যখন সেই ভাইটি চার বছরের পড়াশুনা শেষ করে ফিরে আসবে, তখন সে তার শিল্পকর্ম বিক্রি করে বা প্রয়োজনে খনিতে কাজ করে অন্য ভাইকে কলা বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাবে। এক রবিবার সকালে গির্জা থেকে ফিরে এসে তারা একটি মুদ্রা টস করলো এবং বড় ভাই আলব্রেখট ডুরার টস জিতে নুরেমবার্গ কলা বিদ্যালয়ে চলে গেল। ছোট ভাই, আলবার্ট তার দাদার পড়ার খরচ যোগানোর জন্য এক বিপজ্জনক খনিতে কাজ করা শুরু করলো। আলব্রেখ্ট এতই প্রতিভাবান ছিলেন যে তিনি কলা বিদ্যালয়ে অল্প সময়ের মধ্যে যেন এক ঝড় তুলে ফেললেন; তার চিত্রকলা, জলরঙ, রেখাঙ্কন, ভাস্কর্য, খোদাই, তৈলচিত্র তার বেশিরভাগ অধ্যাপকদের চেয়ে উঁচু মানের ছিল। পড়াশোনা শেষ করার আগে থেকেই, তিনি তার শিল্পকর্মের জন্য যথেষ্ট পারিশ্রমিক অর্জন করতে শুরু করেছিলেন।

এক একটা করে চার বছর কেটে গেল। কলা বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তরুণ শিল্পী, আলব্রেখট তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন। ডুরার পরিবার বিজয়ী শিল্পীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে এক নৈশভোজের আয়োজন করলেন। সেই আনন্দের অনুষ্ঠানে সবাই স্বাদিষ্ট খাবার, গান এবং হাসি উপভোগ করলেন। সবশেষে, সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় হলো। সেই সন্ধ্যার সম্মানিত শিল্পী আলব্রেখ্ট উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় ভাইয়ের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, যার চার বছরের ত্যাগ ছাড়া আলব্রেখট কখনোই তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতেন না। অতিথিরা করতালি দিয়ে আলবার্টের  ত্যাগের প্রশংসা করলেন। সমাপনী শব্দে আলব্রেখট বললেন, "আলবার্ট, আমার ধন্য ভাই, এখন তোমার পালা। এখন তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নুরেমবার্গ যেতে পার এবং তোমার কলা বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ আমি যোগাব।" সমস্ত মাথা উদগ্রীব হয়ে টেবিলের শেষ প্রান্তে ঘুরে গেল যেখানে আলবার্ট বিষন্ন মুখে বসে ছিলেন। তারা আশা করছিলেন যে তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন এবং তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য খনির চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু, তখন আলবার্টের চোখ বেয়ে নেমে আসছিল জলের ধারা। ধরা গলায় তিনি বারবার বলতে থাকলেন, "না... না... না... না।" তার প্রতিক্রিয়ায় সবাই হতবাক হয়ে গেলেন। অবশেষে আলবার্ট উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের জল মুছে নিলেন। দু’ গালের উপর হাতদুটি চেপে ধরে, লম্বা টেবিলের দুদিকে বসা তার পছন্দের মুখগুলোকে একবার দেখে নিয়ে, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললেন, “না ভাই। দুর্ভাগ্যবশত, আমি নুরেমবার্গ যেতে পারব না। আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে।“ কথাগুলি বলে, আলবার্ট তার দু’ হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে চললেন, "দেখো ভাই, খনিতে চার বছরের কঠোর পরিশ্রম আমার হাতের কী ক্ষতি করেছে। আমার আঙুলের প্রতিটি হাড় অন্তত একবার ভেঙ্গেছে, আমার আঙ্গুলগুলির প্রতিটি অস্থিসন্ধি এতটাই বাতে আক্রান্ত হয়েছে যে জলের গ্লাসও ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারি না। আর কি, এই আঙ্গুলগুলি দিয়ে পার্চমেন্ট এবং ক্যানভাসের উপর কলম এবং ব্রাশ দিয়ে সূক্ষ্ম রেখা আঁকা সম্ভব! না, ভাই, আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে।“ অতিথিরা ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলেন। বড় ভাই দুঃখ পেলেন, চার বছর আগে তারা যে চুক্তি করেছিলেন, তার এই একতরফা পরিণতি তিনি  কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

অনুগত ভাই আলবার্টের নীরব এবং নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আলব্রেখ্টকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা এবং স্নেহের চিহ্ন হিসাবে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিশ্রম করে তিনি তার ভাইয়ের অপব্যবহৃত হাতের তালু দুটিকে নীল কাগজের এক টুকরোর উপর কালো কালি এবং কলমের আঁচড় দিয়ে ফুটিয়ে তুললেন। ভাইয়ের বিকৃত, কর্কশ, শক্ত, বাঁকানো, জীর্ণ ও শীর্ণ  আঙ্গুলগুলিকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে প্রসারিত করে দিলেন। আলব্রেখট ডুরার তার এই অসামান্য অঙ্কনটিকে কেবল "হাত (Hands)" বলে অভিহিত করেছিলেন, কিন্তু সমগ্র বিশ্ব এই মহান শিল্পকর্মটির প্রতি তাদের হৃদয় খুলে দিয়েছিল এবং তার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার নামকরণ করেছিল "প্রার্থনার হাত (The praying hands)”।

১৫০৮ সালে অঙ্কনটি শেষ হওয়ার পর থেকে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আজকের দিনে, প্রায় সব ধরণের কল্পনাযোগ্য বস্তুতে; যেমন গীর্জা, ট্যাটু, নেকলেস, স্টিকার, ক্লিপ আর্ট, ফলক, ব্রেসলেট, টি-শার্ট, বই এর শেষ পাতা, রাস্তার শিল্প, শ্মশানের কলস, সাবান এবং এমনকি সমাধির পাথরে ও এর প্রতিলিপি দেখতে পাওয়া যায়। কালি, পেইন্ট, কাঠ, প্লাস্টার, রঙিন কাঁচ এবং তামা থেকে শুরু করে সূচিকর্ম, কুরুশশিল্প এবং এমনকি ছোটদের ছবি আঁকা শেখার বই পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি মাধ্যমেই চিত্রটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এক অতি সাধারণ কালি-কলমের আঁচড়ে ফুটে ওঠা 'প্রার্থনার হাত' ছবিটির এক সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। হাত দুটি সাধারণ কোন পুরুষ বা মহিলা বা অন্য কারও হতে পারে। এই সাধারণ স্কেচে আমরা আমাদের সকলের কাহিনী দেখতে পাই, আমাদের প্রার্থনা, কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, প্রশংসা, অসহায়ত্ব, করুণার আবেদন এবং সব কিছু।

আলব্রেখটের জীবনে আলবার্টের মতো, আমাদের জীবনেও এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা তাদের কর্মজীবন এবং স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করার জন্য প্রার্থনা এবং কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তু তাদের আন্তরিক প্রার্থনা এবং গোপন আত্মত্যাগ ফল দেবে কিনা বা আমরা সফল হয়ে তাদের স্মরণ করবো কিনা; এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র শঙ্কা বা প্রতিদান পাওয়ার ইচ্ছা থাকে না। বড় ভাই, আলব্রেখটের মতো আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই সেই পরিচিত হাতগুলিকে চিনতে পারেন, যে হাতগুলির বিকৃত, শক্ত, কর্কশ, বাঁকানো, জীর্ণ ও শীর্ণ আঙ্গুলগুলি বিশ্বস্তভাবে করজোড়ে আমাদের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে।

সবশেষে, মনে রাখতে হবে যে সাফল্য কখনই একা পথ পাড়ি দিতে পারে না এবং অনেক ত্যাগ চোখের আড়ালেই থেকে যায়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের পিতামাতা, শিক্ষক, পরামর্শদাতা, ভাই-বোন, পতি/পত্নী, এবং বন্ধু নিরলসভাবে তাদের ত্যাগ, সহযোগিতা এবং অটল প্রার্থনা দিয়ে আমাদের জীবন সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলেন। তারা আমাদের জন্যে যা করেন তার সবকিছু ফিরিয়ে দেওয়া সবসময় সম্ভব নয় তবে আমাদের জীবনে এই সমস্ত বিশেষ ব্যক্তিদের অমূল্য ভূমিকার জন্য তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক 'প্রার্থনার হাত' এই সব ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ করে দেয় এবং বিনীতভাবে স্বীকার করার সুযোগ দেয় যে তাদের অনুষঙ্গ, নিবেদন, প্রেরণা, ও বলিদান আমাদের জীবনে সকল উৎসের আধার হয়ে আছে। তারা আছেন বলেই আমরা আছি।

No comments