Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বিজ্ঞানী, অধ্যাপক,ড. অনির্বাণ দাস

বিজ্ঞানী, অধ্যাপক,ড. অনির্বাণ দাস 
ছোট থেকেই বিবেকানন্দ মিশন আশ্রমকে আত্মীকরণ করছেন জীবনের সাথে। 'জীব সেবাই শিব সেবা' ভাবনা তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল ভরাট করে রেখেছে। মানুষের দুঃখ, মানুষের কষ্ট তাঁকে খুব নাড়ায়। আদুল গায়ের …

 





বিজ্ঞানী, অধ্যাপক,ড. অনির্বাণ দাস 


ছোট থেকেই বিবেকানন্দ মিশন আশ্রমকে আত্মীকরণ করছেন জীবনের সাথে। 'জীব সেবাই শিব সেবা' ভাবনা তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল ভরাট করে রেখেছে। মানুষের দুঃখ, মানুষের কষ্ট তাঁকে খুব নাড়ায়। আদুল গায়ের ছেলে মেয়েগুলো যখন পড়াশোনা ফেলে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে দিন কাটায় ইটভাটার বুকে কিংবা অন্যত্র, তখন তাঁর হৃদয় উদ্বেলিত হয়। অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে অব্যক্ত যন্ত্রনায়। তখন তাঁর মন শক্তিশালী করতে সংকল্প নেন এঁদের জন্য কিছু করার। একমাত্র শিক্ষার আঙিনাই পারে এই পিছিয়ে পড়া প্রজন্মকে কিছুটা হলেও আশার দিশারী দেখাতে। 

ড. অনির্বাণ দাস সকলের কাছে পরিচিত একজন বিজ্ঞানী হিসেবে। অধ্যাপনার সাথেও যুক্ত। কিন্তু এর বাইরে তাঁর একটা মানবিক রূপ রয়েছে। সেটা অপ্রকাশিত। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র এই মানুষটি আজ জঙ্গলমহল তথা ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর সহ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, কোচবিহার, বর্ধমান, আলিপুরদুয়ার জেলার আর্থিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ভরসা ও বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সকলের অগোচরে। আসলে তিনি চেয়েছেন এখানকার শিশুরা শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরে আসুক। দেশের 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড' এর অংশ হোক। বহু ড্রপআউট ছাত্রছাত্রী আজ উচ্চশিক্ষায় এসেছে তাঁর সহযোগিতায়। বহু ছাত্রছাত্রী স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছে তাঁর সক্রিয় অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসায়। আজ তাই বহু গরিব পরিবার তাঁদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। আর শিশুশ্রম করতে পীড়াপীড়ি করে না তাঁদের বাবা মায়েরা। ফলে এই কৃতিত্ব তাঁরই। একটা নীরব আন্দোলনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন মানবসেবার মাধ্যমে। তাঁর কাছে শিক্ষা হল সেই আলো, যা সকল প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা দূর করে মহত্ত্ব লাভ করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার শিশু কিশোর স্কুলে ফিরে এসে আজ নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তাঁর শৈশব কেটেছে হলদিয়াতে। ১৯৮৪ র ১০ ই জুন জন্ম। বাবা নন্দগোপাল দাস এবং মা শেফালী দাস। স্ত্রী নিবেদিতা দাস ও মেয়ে স্বরলিনা দাসকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট পৃথিবী হলেও আদপে তাঁর পৃথিবীর মানচিত্রে অনেক অনেক মানুষ। যাঁদের প্রত্যেকেই তাঁর কাছে অজানা অচেনা। কিন্তু তিনি তাঁদের কাছে হয়ে উঠতে চান পরমাত্মীয়। 

হলদিয়ায় থাকাকালীন এখানকার বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম শিক্ষায়তনে তাঁর শিক্ষায় হাতেখড়ি। ফলে একটা কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে কালাতিপাত করতে হয়েছে ছোট থেকেই। রামকৃষ্ণ পরমহংসের চিন্তাধারার সাথে সাথে বেদ এবং নীতিশিক্ষার মাধ্যমে জীবনের মূল্যবোধগুলি শিখেছেন এবং শিখিয়ে চলেছেন অন্যদের। নিঃস্বার্থ ক্রিয়াকলাপের ঘেরাটোপে থেকে বেদান্ত দর্শনের প্রতি আকর্ষণ তাঁকে গ্রামীণ বাংলায় শিক্ষার চেহারা গঠনের মহান কাজ আত্মীকরণ করার নির্দেশ তিনি পেয়েছিলেন অন্তর থেকে। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে মাথায় রেখেই সমাজের মধ্যে সামাজিক সাম্য ও একতার দিকে কাজ করার জন্য নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। 

ড. অনির্বাণ দাস বর্তমানে কলকাতার ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে ইনোভেশন কাউন্সিলের পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়েছেন। তিনি ২০০৭ সালে এইচসিএল টেকনোলজিস লিমিটেডের একজন সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ২০১২ সালে এনআইটি দুর্গাপুর থেকে আইসিটিতে পি এইচ ডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন, ইউরেশিয়া রিসার্চ, ইউএসএ-এর সাম্মানিক ভাইস প্রেসিডেন্ট, আরএসএ-এর ফেলো, আইইটিই ইন্ডিয়ার ফেলো, আইএসআরডি ইউকে-এর ফেলো এবং ইন্ডিয়ান ক্লাউড কম্পিউটিং অ্যাসোসিয়েশনের ফেলো হয়েছেন। তিনি ১২ টি বই লিখেছেন, ১ টি গবেষণা প্রকল্প ডিএসপি এসইআরবি সরকারের অর্থায়নে করেছেন। ভারতের ৭৬ টি পেটেন্ট (ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক) প্রকাশিত এবং নিবন্ধিত এবং ৬১ টিরও বেশি গবেষণা প্রকাশনা করেছেন। যেগুলির বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল এবং সম্মেলনে প্রকাশিত হয়েছে।

মলিকুলার বায়োলজি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মৌলিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবন হয়েছে এমন একটি ডিভাইস যা অনেক কম বয়সের সুস্থ বা অসুস্থ মানুষের চুলের ফলিকলের সাহায্যে বলে দেবে যে, তাঁর ব্রেন ক্যান্সারের সম্ভাবনা কতটা! এই উদ্ভাবন করেছেন উইপ্রোর ইঞ্জিনিয়ার ব্রতীন সরকার, টাটা কন্সালটেন্সি সার্ভিসেসের ইঞ্জিনিয়ার সৌরভ চন্দ্র, তাঁদের মেন্টর ইউ.এ.এম কলকাতার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. প্রতীক তালুকদার এবং ড. অনির্বাণ দাস। 

ডিএনএ এর অনুক্রম ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স  বেসড জটিল আলগোরিদমসের মেলবন্ধনে আমাদের শরীরের আমাইনো অ্যাসিড কোডন এর মিউটেশন, টিউমার সাপ্রেসার জিন ও অঙ্কো জিনের অ্যানালিসিস ও বিশ্লেষণ এর ফলশ্রুতি হলো এই গবেষণা। এই গবেষণা সংক্রান্ত পেটেণ্ট সম্প্রতি ইন্ডিয়ান পেটেণ্ট সাইটে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নামকরা চিকিৎসকমহলে ড. অনির্বাণ দাস এই গবেষণার বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করেছেন, যা প্রশংসিত ও স্বীকৃত হয়েছে সকলের কাছে। অনির্বান দাস বলেন, এই গবেষণাটি ব্রেন ক্যান্সার সরিয়ে দিতে পারবে না, বরং ক্যান্সারের সম্ভাবনার খবর কয়েক দশক আগেই জানিয়ে দিতে সক্ষম। ফলে একজন মানুষ আগাম সতর্ক ও সাবধান হতে পারবেন রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে। সেইসাথে অনেকটা সময় পেয়ে যাবেন চিকিৎসা শুরু করার জন্য। ব্রেন ক্যান্সারের উপর এমন গবেষণা এর আগে হয়নি।

সেইসাথে সক্রিয়ভাবে গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও (GER) বৃদ্ধির জন্য এবং পশ্চিমবঙ্গের কমে যাওয়ার হার কমানোর জন্য বিগত প্রায় ২ দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। তাঁর লক্ষ্য হল সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের কাছে শিক্ষার অধিকার পৌছানো, যা কিনা ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের মোট তালিকাভুক্তির অনুপাতকে উন্নত করতে পারে। AISHE-এর মতে, পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষায় GER মাত্র ১৮.৭ শতাংশ। এটি জাতীয় গড় অর্থাৎ ২৫.৮ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। তিনি যখন তাঁর যাত্রা শুরু করেন, তখন GER খুবই কম ছিল।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শীর্ষস্থানীয় সম্মেলনে (IEEE, IET, Springer, ACM, IETE ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত) তিনি ভারতীয় শিল্প কনফেডারেশনের মতো বিভিন্ন জাতীয় সংস্থার শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন বহুবার। ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স, NASSCOM, FICCI এবং EDCN এও তিনি ওয়াল অফ ফেমে মনোনীত হয়েছেন DST ভারত সরকার দ্বারা চালিত "IICDC এর এলিট একাডেমিশিয়ানস কনফেডারেশন" হিসাবে। তিনি MHRD ইনোভেশন দ্বারা প্রত্যয়িত ভারত সরকারের 'ইনোভেশন অ্যাম্বাসাডর সেল' থেকে 'ইনোভেশন অ্যাম্বাসাডর' হয়েছেন। তিনি UNESCO, USA, ২০১৯ থেকে ইনক্লুসিভ পলিসি ল্যাব এক্সপার্ট মনোনীত হয়েছেন। তিনি ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল ২০২২ এর জাতীয় জুরি। হলদিয়া কালচারাল ফোরাম সিলভার চ্যাম্প এক্সট্রা দ্বারা ২০১৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ যুব সম্মানের প্রাপক। এইচসিএল টেকনোলজিস লিমিটেডের মাইলস অ্যাওয়ার্ড ২০০৯ পেয়েছেন। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনে গত ২৫ শে ডিসেম্বর ২০২৩ এ ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি স্টাডি সার্কেল কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ 'শ্যামাপ্রসাদ সম্মান ২০২৩' এর প্রাপক হয়েছেন ড. অনির্বাণ দাস। 

তাঁর আরেকটি প্রকল্প DATA গার্ড গোয়াতে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল ২০২১ এ ২য় স্থান অর্জন করেছে। ড. দাস হলেন জাতীয় জুরি সদস্য এবং ISRO দ্বারা নাসা স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জ, আইইটি চেন্নাই এবং ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল স্পেস হ্যাকাথন ২০২৩ এর পরামর্শদাতা। এহেন মানুষটি আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন বিলি করছেন। গত ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল স্বয়ং রাজভবনে তাঁর মিশন সংক্রান্ত এক বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২০২১ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স টেকনোলজিতে তাঁর অসাধারণ কাজের জন্য তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান বিপিন রাওয়াতও তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। 

একটা উন্নত লক্ষ্য নিয়ে তিনি নীরবে নিভৃতে সমাজ সংস্কারের সংগ্রাম করে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। প্রত্যন্ত এলাকায় সুবিধা থেকে বঞ্চিত, আদিবাসী গ্রামের হাজার হাজার শিশু এখন নিজেদের মাঠে গড়ে উঠেছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় বারো হাজার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন এবং সেখানে হাত জোড় করে অনুরোধ করেছেন এবং তাঁদের ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছেন যে তাঁদের সন্তানরাও জাতি গঠনের অংশ হতে পারে। তিনি সমাজ থেকে ঝরে পড়া ছেলে মেয়েদের মূলধারার শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করছেন সেখানে, যেখানে দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিমজ্জিত গ্রামবাসীরা মনে করতেন যে তাঁদের সন্তানদের প্রতিষ্ঠানে পাঠানো বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।

তাঁরই সক্রিয় কর্মতৎপরতায় উপজাতীয় গ্রামবাসীরা তাঁদের সেকেলে ধ্যানধারণা এবং বদ্ধ ধারণাগুলোর পরিবর্তন করে নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষিত করে জাতি গঠনের অংশ করতে সচেষ্ট হয়েছে অনেকাংশেই। এরফলে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ লাভ করার মাধ্যমে GER এই এলাকায় ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। উপজাতীয় গ্রামবাসীদের মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি শিক্ষার সারমর্মও উপলব্ধি করতে পারছে। আজ এই মানুষটি একাধারে বিজ্ঞানের কঠিন জগতে বিচরণ করেও নিজেকে রেখেছেন মাটির কাছাকাছি। ছোটদের সাথে মিশতে ভালোবাসেন। মানুষের সাথে জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করেন। কাজের সাথে লেপটে থাকতে ব্যাপৃত রাখেন নিজেকে। সত্যিকারের 'মানুষ রতন' হয়ে উঠেছেন নিজের কর্মগুণে।



No comments