শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নিজ সহধর্মিণী শ্রীমা সারদা দেবীকে শ্রীশ্রীষোড়শীরূপে পূজা করেন
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নিজ সহধর্মিণী শ্রীমা সারদা দেবীকে শ্রীশ্রীষোড়শীরূপে পূজা নিয়ে দু চার কথা :--আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের চতুর্দশীবিদ্ধা অ…
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নিজ সহধর্মিণী শ্রীমা সারদা দেবীকে শ্রীশ্রীষোড়শীরূপে পূজা করেন
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নিজ সহধর্মিণী শ্রীমা সারদা দেবীকে শ্রীশ্রীষোড়শীরূপে পূজা নিয়ে দু চার কথা :--
আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের চতুর্দশীবিদ্ধা অমাবস্যা। শাস্ত্রমতে শ্রীশ্রীফলহারিণী কালীপূজা । আজ থেকে শতাধিক বছর আগে এমনি এক ফলহারিণী কালীপূজার মহানিশায় যুগাবতার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজ সহধর্মিণী শ্রীমাকে দশমহাবিদ্যার তৃতীয় বিদ্যা ষোড়শী মূর্তিতে পূজা করেছিলেন একথা আমরা অল্পবিস্তর সকলেই জানি । ঠাকুরের সাক্ষাৎ মন্ত্রশিষ্য স্বামী সারদানন্দ লিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থে (যা কিনা ঠাকুরের সবচেয়ে প্রামাণ্য জীবনি হিসাবে সম্প্রদায় নির্বিশেষে স্বীকৃত), এই ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দৃষ্ট হয় ।
কাজেই এই দিনে কি কি হয়েছিল সেই প্রসঙ্গের পুনরাবতারণা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয় । আমার এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য ভিন্ন ।
কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি যে ঠাকুরের নিজ স্ত্রীকে মাতৃরূপে পূজার ঘটনাটিকে অনেক অত্যুৎসাহী ভক্তেরা পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাতিক্রমী ঘটনা বলে প্রচার করছেন । এবং সেই ভক্তদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কৃতপিণ্ড সন্ন্যাসীও আছেন যাঁরা ঠাকুরের নামে ঘর ছেড়েছেন ।
যাইহোক, তাঁদের এই মন্তব্য আমাকে ব্যাথিত করেছে, কেননা আমার মনে হয়েছে যে ঠাকুরের জীবনের এই ঘটনাকে ব্যাতিক্রমী প্রতিপন্ন করা আসলে তাঁদের সঠিক শাস্ত্র অনুসন্ধিৎসার অভাবকেই দর্শায় ।
আমরা সকলেই ঠাকুরকে অবতার বলে মানি । আর এটাও জানি যে ভগবানের অবতার গ্রহণের অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটি কারণ হল শাস্ত্রকে সত্য বলে প্রমাণ করা । অর্থাৎ, যে যে শাস্ত্রোক্তি সাধারণ মানুষ অসাড় বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, অবতার নিজ জীবনে সেই সমস্ত চর্যার মাধ্যমে তার প্রত্যক্ষ ফল প্রমাণ করেন ও শাস্ত্রের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ষোড়শী পূজাও এমনি একটি ঘটনা । যা ব্যাতিক্রমী তো নয়ই, বরং তন্ত্রশাস্ত্রের দৃষ্টিতে খুবই স্বাভাবিক একটি অনুষ্ঠান। যদিচ আজকের তথাকথিত আধুনিক সমাজের দৃষ্টিতে এই ঘটনা অবশ্যই যুগান্তকারী, কেননা আমরা প্রকৃতপক্ষে নারীর মর্যাদা রক্ষা করতেই বিস্মৃত হয়েছি ।
মনে রাখতে হবে ঠাকুর আদপে ছিলেন শাক্ত । হুগলী জেলার বেঙ্গাই গ্রামের জনৈক কেনারাম ভট্টাচার্যের (কৌলনাম শ্রীমৎ পূর্ণানন্দনাথ) কাছ থেকে তিনি কালীমন্ত্রে অভিষিক্ত হয়েছিলেন । কাজেই তন্ত্রের দৃষ্টিতে ঠাকুর ছিলেন কৌল । আর শ্রীমাও ছিলেন একই পথের পথিক । কেননা তিনিও বিবাহের পরে স্বামীর সতীর্থ হন ।
আরও আমরা জানি যে ঠাকুর তাঁর তান্ত্রিক উত্তরসাধিকা ভৈরবী ব্রাহ্মণীর কাছে সাড়ে তিন বছর ধরে বিষ্ণুক্রান্তায় প্রচলিত ৬৪ টি তন্ত্রের যথাবিধি সাধনা করেছিলেন ও তাতে কৃতসিদ্ধ হয়েছিলেন। এহেন মহাসাধকের পক্ষে জগতের সমস্ত স্ত্রীমূর্তিতে ইষ্টদর্শন স্বাভাবিক।
তন্ত্রশাস্ত্র বলেন-
জননী জন্মকালে চ স্নেহকালে চ কন্যকা ।
ভার্য্যা রমণে সম্পৃক্তা মরণকালে সা কালিকা ।।
অর্থাৎ, যে শক্তি জন্মকালে সন্তানের কাছে জননী, স্নেহকালে পিতার কাছে ভগিনী ও রমণকালে স্ত্রীরূপে প্রতিভাত হন । তিনিই মরণকালে মোক্ষদায়িনী ভগবতী কালিকারূপে সাধকের সংসার বন্ধন ছিন্ন করেন ।
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে তাই দেবতারা মহামায়ার স্তব করতে গিয়ে বলছেন 'স্ত্রীয়াঃ সমস্তা সকলা জগৎসু..ত্বয়ৈকায়া পূরিতমম্বয়ৈতৎ ইত্যাদি। "
তন্ত্র চর্চার নয়, বস্তুত চর্যার বিষয় । তাই উপরোক্ত মতকে সাধকের জীবনে, মননে বাস্তবায়নের নিরিখে তন্ত্রে সাধারণ নারীকে বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ ভগবতীজ্ঞানে উপাসনার বিধান রয়েছে । আমাদের সকলের অতি পরিচিত কুমারীপূজা এমনই এক মহৎ বিধান । এক থেকে ষোড়শ বর্ষীয়া যে কোন নারীকে, সে যে কোন বর্ণ বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, সাক্ষাৎ ভগবতী জ্ঞানে পূজার বিধান তন্ত্রের এক অপূর্ব ব্যবস্থা। কোন নারীকে কুমারী পূজার করতে গেলে মূল শর্ত হল তাঁকে কুমারী হতে হবে । অর্থাৎ যতদিনপর্যন্ত না তাঁর রজোদর্শন হচ্ছে, ততদিন তাঁকে যে কোন শক্তিপূজার অঙ্গ হিসাবে পূর্ণফলপ্রাপ্তি কামনায় পূজা করা যাবে ।
যদি কেউ বলেন এই কুমারীপূজার প্রচলন স্বামী বিবেকানন্দ করেছিলেন বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোর মধ্যে দিয়ে তাহলে তা হবে শাস্ত্রজ্ঞানের অভাবের পরিচায়ক। কেননা বেলুড় মঠে কুমারীপূজা শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই কুমারীতন্ত্র বা মহাকাল সংহিতায় এই পূজার বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। তবে যদি বলেন যে এই পূজার জনপ্রিয়তার নেপথ্য নায়ক স্বামীজি, তো সে কথা স্বতন্ত্র।
এ তো গেল কুমারীপূজার কথা । এখন প্রশ্ন হল যে সমস্ত নারীর রজোদর্শন হয়ে গিয়েছে তাঁদের জন্য তন্ত্রের বিধান কি ?
বলে রাখি, তান্ত্রিক পরিভাষায় এক থেকে ষোড়শ বর্ষীয়া অপুষ্পিতা নারীকে যেমন কুমারী বলা হয়েছে, ঠিক তেমনি ষোড়শ থেকে চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত নারীকে, অর্থাৎ যাদের রজোদর্শন হয়ে গিয়েছে, তাঁদের বলা হয়েছে সুবাসিনী । এই সুবাসিনী পূজার বিধানও তান্ত্রিক কৌল সম্প্রদায়ের মধ্যে সুবিদিত । তান্ত্রিকাচার্য্য ভাস্কর রায়ের শিষ্য উমানন্দনাথ রচিত নিত্যোৎসব, গন্ধর্বতন্ত্রে এই সুবাসিনী পূজার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। তান্ত্রিক পরিভাষায় দূতীযাগ বা লতাসাধনও এই গুহ্য আচারের একটি প্রকরণ । প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য যে এই পূজাতে শক্তিকে সর্বদাই দশমহাবিদ্যার তৃতীয় বিদ্যা ষোড়শী মূর্তিতে পূজা ও আরাধনা করতে হয় । উল্টোদিকে সাধক নিজেকে নিজে সাক্ষাৎ শিবজ্ঞানে পূজা করেন । মনে রাখতে হবে, তন্ত্রের দৃষ্টিতে নারী নিত্যসিদ্ধা । তিনি সাধ্যা । আর পুরুষ সাধক ।
শুধুমাত্র কুমারী বা সুবাসিনী নয়, সাধারণ সমাজে অমঙ্গল সূচক বলে যাঁদের যে কোন শুভ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, উদার তন্ত্রশাস্ত্রে সেইসব বিধবা নারীদেরও উপাসনা বিধান হয়েছে সপ্তম মহাবিদ্যা বিধবা বিরদ্বিজা শ্রীশ্রীধূমাবতী সাধনার মধ্য দিয়ে।
প্রসঙ্গক্রমে বলি কৌল অর্থে সেই সমস্ত বামমার্গী তন্ত্রাচারীদের কথা বলা হচ্ছে যাঁরা সাধনকালে যথাবিধি পঞ্চমকারের (মদ্য, মাংস, মৎস্য মুদ্রা ও মৈথুন) ব্যবহার করেন । ঠাকুর যে তন্ত্র সাধন কালে পঞ্চমকারের যথাবিধি ব্যবহার করেছিলেন সে কথা সুবিদিত । লীলাপ্রসঙ্গ সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন । বামমার্গী সাধনায় শক্তিগ্রহণ বা ভৈরবীগ্রহণের বিধানও তন্ত্রে সুবিদিত । আর শ্রীমা যে ঠাকুরের সাধনসঙ্গিনী বা শক্তি একথা বলাই বাহুল্য । কাজেই ঠাকুরের মতো এহেন মহাকৌল, কৌলকুলতিলক যে তাঁর স্বকীয় শক্তিতে ষোড়শীপূজা করবেন সেটা একেবারেই স্বাভাবিক। আর এও ঠিক যে তান্ত্রিক সাধনার শেষ সোপানই হল এই দূতীযাগ বা লতাসাধন । তাই দেখা যায় যে শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীমাকে সাক্ষাৎ জগজ্জননী জ্ঞানে পূজা করলেন তাইই নয়, তাঁর সাধনার অন্তিম সোপান আরোহনের নিদর্শন স্বরূপ নিজের জপের মালাটি পর্যন্ত দেবীর শ্রীপাদপদ্মে অর্পণ করলেন । আর সেই মহালগ্নে যে প্রার্থনা ধ্বনিত হল (হে বালে ! ত্রিপুরসুন্দরী সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো......ইত্যাদি) তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে সেটি আসলেই তন্ত্রোক্ত ভগমালিনী মন্ত্র, যা কিনা যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হয়েছে সিদ্ধ কৌলসাধকদের শ্রীমুখ দিয়ে ।
তন্ত্রশাস্ত্রের কৌলের দুটি পর্যায় । পূর্বকৌল ও উত্তরকৌল । তান্ত্রিকাচার্য্য ভাস্কর রায় তাঁর রচিত বিখ্যাত সৌভাগ্যভাস্কর গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেছেন, যে সমস্ত সাধক ধাতু , পাষাণাদি আধারে দেবীর যোনিযন্ত্র অঙ্কিত করে উপাসনাদি করেন, তাঁরাই পূর্বকৌল । আর যাঁরা সাধনার উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ শক্তি দেহে দেবীর উপাসনা করেন তাঁরাই উত্তরকৌল । এঁদের মধ্যেও যাঁরা তাঁরাই মহাকৌল যাঁরা কোনরূপ প্রত্যক্ষ মুদ্রাক্রিয়া ভিন্ন শুধুমাত্র যোগবলে শক্তির সাথে তাদাত্ম্য প্রাপ্ত হন ও সামরস্যানুভূতি লাভ করেন । এইই হল প্রকৃত যামল অবস্থা। শিবশক্তির অবিনাভাব সহজ দশা । তাই দেখতে পাই ষোড়শী পূজা কালে ঠাকুর ও শ্রীমা উভয়েই একে ওপরে সমাহিত । ঠাকুর তাই উত্তরকৌলদের মধ্যেও শিরোমণিস্বরূপ । কৌলকুলতিলক মহাকৌল ।
ঠিক একই ব্যাপার আমরা প্রত্যক্ষ করি শ্রী প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গের প্রথম খণ্ডে বক্রেশ্বরের অঘোরী ও তাঁর দূতী মহেশ্বরী মায়ের চক্রানুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে।
কাজেই ষোড়শী পূজার মধ্য দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর নতুন কিছু শুরু করলেন না । করলেন তন্ত্রসাস্ত্রের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা। করলেন শাস্ত্রের সত্যতা প্রমাণ । আমাদের সনাতন ধর্মের যে সুমহান ঐতিহ্য আমরা কালান্তরে বিস্মৃত হয়েছিলাম, ঠাকুর তাকেই আবার জনসমক্ষে নিয়ে এলেন । আর যেটা করলেন সেটা অবশ্যই যুগান্তকারী। নারীত্বকে তাঁর পূর্ণ প্রাপ্য মর্যাদায় সার্বজনীন অভিষেক ।
নিবন্ধের প্রথমে আমি যে এই ঘটনাকে ব্যাতিক্রমী বলার মৃদু প্রতিবাদ করেছি, আলোচনার এই পর্যায়ে এসে সেই আমিও স্বীকার করছি যে, শাস্ত্রধর্ম অনুসারে ঠাকুরের পূর্বে ও পরে অনেকেই হয়তো নিজ শক্তিকে ভগবতীজ্ঞানে উপাসনা করেছেন । কিন্তু ঠাকুরের যে পূজা তার অনন্য সাধারণতা এখানেই যে তিনি যে ভাবে শ্রীমাকে ষোড়শী মূর্তিতে পূজা করেছেন, তাঁর পায়ে সমগ্র জীবনের সাধনার ফল অর্পণ করেছেন, নিজ স্ত্রীর প্রতি তাঁর সেই মাতৃভাবের ব্যাত্যয় জীবনের শেষ মূহুর্ত অবধি হয়নি । শ্রীমাকে প্রথমদিন দেখে তিনি যেমন বলেছিলেন যে মন্দিরের মা ভবতারিণী, তাঁর পুণ্যশ্লোক জননী চন্দ্রমণি দেবী ও শ্রীমা অভেদ, ঠিক সেই ভাব আজীবন বজায় ছিল । তন্ত্রের যে বচন আমি উপরে উদ্ধৃত করেছি, সেই বচন ঠাকুরের জীবনে, মননে, চর্যায় মূর্ত বিগ্রহ ধারণ করেছিল । আর এখানেই ষোড়শী পূজার এই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাতিক্রমী ।
No comments