ভারতবর্ষের তৃতীয় প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করি
ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী [বিবাহের পূর্বে পদবী নেহেরু] (জন্ম : ১৯ নভেম্বর, ১৯১৭ – মৃত্যু : ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪) ছিলেন একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ভারতীয…
ভারতবর্ষের তৃতীয় প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর
জন্মদিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করি
ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী [বিবাহের পূর্বে পদবী নেহেরু] (জন্ম : ১৯ নভেম্বর, ১৯১৭ – মৃত্যু : ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪) ছিলেন একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভানেত্রী এবং ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীই হলেন একমাত্র মহিলা, যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা, ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ এবং পুনরায় ১৯৮০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। জওহরলাল নেহেরুর পরে তিনিই ভারতে দ্বিতীয় দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জওহরলাল নেহেরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর প্রধান সহকারী মনে করা হত। তিনি নেহেরুর সঙ্গে বহুবার বিদেশ সফরেও যান। ১৯৫৯ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে নেহেরুর মৃত্যুর পর তাঁকে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্যপদ প্রদান করা হয় এবং তিনি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ক্যাবিনেটে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পরে ১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে কংগ্রেসের সংসদীয় নেতা নির্বাচনে ইন্দিরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মোরারজী দেসাইকে পরাজিত করেন এবং ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী পরিচিত ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর আপোসহীন মনোভাব এবং ক্ষমতার অভূতপূর্ব কেন্দ্রীকরণের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতার যুদ্ধের সমর্থনে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করেন। এই যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়লাভ করে, সেই সঙ্গে ভারতের প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, এই দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ ও বিপ্লবের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। এই সময় মৌলিক নাগরিক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময় বহু স্থানে গণহত্যারও ঘটনা ঘটে। ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টার সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেওয়ার পরে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের শিখ জাতীয়তাবাদী দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হন।
১৯৯৯ সালে বিবিসি আয়োজিত একটি অনলাইন সমীক্ষায় ইন্দিরা গান্ধীকে ‘সহস্রাব্দের নারী’ আখ্যা প্রদান করা হয়। ২০২০ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে টাইম পত্রিকা কর্তৃক বিগত শতাব্দীর সংজ্ঞা-নির্ধারণকারী ১০০ শক্তিশালী নারীর তালিকাভুক্ত করা হয়।
প্রাথমিক জীবন ও কর্মজীবন :
১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর এলাহাবাদে এক কাশ্মীরী পণ্ডিত পরিবারে ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম। তাঁর পিতা জওহরলাল নেহেরু ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্রণী ব্যক্তি, যিনি পরবর্তীকালে ভারতীয় অধিরাজ্য (ও পরে প্রজাতন্ত্রের) প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ইন্দিরা ছিলেন জওহরলালের একমাত্র সন্তান (ইন্দিরার একমাত্র ছোটো ভাই অত্যন্ত অল্প বয়সে মারা যায়)। এলাহাবাদের বৃহৎ পারিবারিক এস্টেট আনন্দ ভবনে মা কমলা নেহেরুর সঙ্গে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। তাঁর শৈশব ছিল একাকীত্বে ভরা ও নিরানন্দময়। জওহরলাল রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিচালনায় বাইরে থাকতেন অথবা কারারুদ্ধ থাকতেন, অন্যদিকে কমলা নেহেরুও প্রায়শঃই অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকতেন। পরবর্তীকালে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রয়াত হন। পিতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রক্ষিত হতো প্রধানতঃ চিঠিপত্রের মাধ্যমেই।
ইন্দিরা প্রধানতঃ বাড়িতেই গৃহশিক্ষকদের নিকট শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি পড়াশোনা করেন দিল্লির মডার্ন স্কুল, এলাহাবাদের সেন্ট সিসিলিয়া’জ ও সেন্ট মেরি’জ ক্রিস্টিয়ান কনভেন্ট স্কুল, জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বেক্সের একোল নউভেল এবং অধুনা মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত পুণা ও বোম্বাইয়ের পিউপিল’স অন স্কুলে। তিনি ও তাঁর মা কমলা নেহেরু কিছুকাল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠে বাস করেন। সেখানে ইন্দিরার অভিভাবক ছিলেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দ। এছাড়া তিনি কিছুকাল শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতেও পড়াশোনা করেছিলেন, যা ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় রবীন্দ্রনাথই তাঁর নাম ‘প্রিয়দর্শিনী’ (সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ ‘যিনি দয়াপূর্ণ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখেন’) রাখেন এবং ইন্দিরা পরিচিত হন ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু’ নামে। যদিও এক বছর পরেই ইন্দিরাকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে ইউরোপে তাঁর মুমূর্ষু মায়ের পরিচর্যা করতে যেতে হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ইন্দিরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। মায়ের মৃত্যুর পর ইন্দিরা অল্পকাল ব্যাডমিন্টন স্কুলে পড়াশোনা করেন, তারপর ১৯৩৭ সালে ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য সমারভিল কলেজে ভর্তি হন। ইন্দিরাকে দুই বার প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। কারণ, প্রথম পরীক্ষায় লাতিনে তাঁর ফল খারাপ হয়েছিল। অক্সফোর্ডে তিনি ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে ফল ভালো করলেও আবশ্যিক বিষয় লাতিনে তাঁর গ্রেড কমই থাকে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জীবনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতেন, যেমন তিনি অক্সফোর্ড মজলিস এশিয়ান সোসাইটির সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন।
ইউরোপে অবস্থানের সময় ইন্দিরার স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়েছিল। সেই সময় তাঁকে ঘন ঘন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হত। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য তাঁকে বারবার সুইজারল্যান্ড যেতে হয়। যার ফলে তাঁর পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। ১৯৪০ সালে জার্মানি যখন দ্রুত গতিতে ইউরোপ দখল করতে শুরু করে, তখন ইন্দিরা সুইজারল্যান্ডেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি পর্তুগালের পথ ধরে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রায় দুই মাস আটকে থাকেন। অবশেষে ১৯৪১ সালের গোড়ার দিকে তিনি ইংল্যান্ডে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং তারপর অক্সফোর্ডে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই ভারতে ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একটি সাম্মানিক ডিগ্রি প্রদান করেছিল। ২০১০ সালে অক্সফোর্ড তাঁকে আরও সম্মানিত করে দশ জন অক্সেশিয়ানের (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকারী বিশিষ্ট এশীয়) তালিকাভুক্ত করে। ব্রিটেনে থাকাকালীন ইন্দিরার সঙ্গে তাঁর ভাবী স্বামী ফিরোজ গান্ধীর প্রায়শঃই দেখা হতো। ফিরোজকে ইন্দিরা এলাহাবাদ থেকেই চিনতেন। সেই সময় ফিরোজ লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে পাঠরত ছিলেন। এলাহাবাদে দুই জনে ব্রাহ্ম মতে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যদিও ফিরোজ ছিলেন গুজরাতের এক জরথুস্ট্রবাদী পার্সি পরিবারের সন্তান। ফিরোজ ও ইন্দিরা গান্ধীর দুই পুত্রের জন্ম হয় : রাজীব গান্ধী (জন্ম: ১৯৪৪) ও সঞ্জয় গান্ধী (জন্ম: ১৯৪৬)।
১৯৫০-এর দশকে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যভার সম্পাদনারত পিতার অঘোষিত ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে ইন্দিরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। সেই সূত্রে ১৯৫৯ সালে কেরলের কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করায় তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই সরকার ছিল ভারতের প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকার। ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পরে তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ক্যাবিনেটে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবন :
সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ বছর ভারত শাসন করেছেন ইন্দিরা গান্ধী৷ তুখোর রাজনীতিবিদ ইন্দিরা গান্ধী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন ভারতে৷ ২৫ বছর পর ভারত তথা বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গন স্মরণ করছে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে৷ ইন্দিরা গান্ধীর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আর কোন নারী এখনো আসেননি৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে ইন্দিরা সবুজ বিপ্লব, পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ (১৯৭১), অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন, সুস্পষ্ট বিদেশনীতি নির্ধারণ এবং একাধিক প্রকল্পর রূপায়ণ করেন। তার পুত্র সঞ্জয় গান্ধী বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান এবং আরেক পুত্র রাজিব গান্ধী এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা যান। দুই পুত্র বধু মানেকা গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী বেঁচে আছেন। ব্যক্তিগত জীবনে ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত শৌখিন মানুষ ছিলেন।
মৃত্যু :
১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে শিখদের পবিত্র ধর্মাশালা স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনা হানা দেয়৷ তার খেসারত ইন্দিরা গান্ধী দেন সে বছরই ৩১ অক্টোবর৷ তার নিজের দেহরক্ষীরাই তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়৷
বিদেশী সম্মাননা :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশের সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে ২০১১ সালে ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’ প্রদান করে। ২০১১ সালে ঢাকায় এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে এই সম্মাননা পুরস্কার তুলে দেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
No comments