Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

আত্মশুদ্ধির দীপাবলি

আত্মশুদ্ধির দীপাবলি
আজ নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া রাজনীতির কাটাছেঁড়া করার সময় নয়। গভীর অন্ধকার মুছে চারদিক উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করার সুখ প্রহর। কোথাও দীপাবলি, তো কোথাও দেওয়ালি, কোথাও আবার স্রেফ কালীপুজো, শক্তির আরাধনা। গোলাপকে যে নামে…

 



আত্মশুদ্ধির দীপাবলি


আজ নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া রাজনীতির কাটাছেঁড়া করার সময় নয়। গভীর অন্ধকার মুছে চারদিক উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করার সুখ প্রহর। কোথাও দীপাবলি, তো কোথাও দেওয়ালি, কোথাও আবার স্রেফ কালীপুজো, শক্তির আরাধনা। গোলাপকে যে নামেই ডাকো উদ্দেশ্য এক, উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় উত্তরণ। এই অদ্ভুত মিশেলই ভারতীয় সংস্কৃতির পরতে পরতে গাঁথা। আমাদের দৈনন্দিন যাপনের নির্ধারিত সিলেবাস এগয় এই বাঁধা গতেই। এই আলোর উৎসবে পাঁচ রাজ্যের ভোট, ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ কিংবা জিতে এলেও ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ করার পর ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মানুষটা নিজের তৈরি করা আইন ভেঙে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন কি না সেই আলোচনা আপাতত ব্রাত্য। আজ এই নিশীথে একটাই প্রার্থনা, শুধুই বাইরের নয়, মানুষের মনের ধূসর ছায়াটাও ঢেকে যাক উৎসারিত ঝর্ণাধারায়। অগ্নিসাক্ষী করে শপথ তো আসলে উচ্চকিত আলোরই সর্বজনীন জয়গান!

মানুষ যত সভ্য হবে, কেতাদুরস্ত হবে ততই মনের কুটিল গহ্বর আরও পঙ্কিল হতে বাধ্য। স্বার্থপর রাজনীতি, ঈর্ষাপরায়ণ সমাজনীতি ক্রমে আমাদের অন্ধকারের দিকে ঠেলবে। সর্বদা কুকথার স্রোত। ভোগবাদ, ঈর্ষা, ল্যাং মারামারি। উতোরচাপান। নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রীদের দুর্নীতি ও টাকা কামানোর পর্দাফাঁস দেখতে দেখতে জনগণ ক্লান্ত। ভোটমরশুম দেখায়, ক্ষমতা দখলের নেশায় কেমন মত্ত সবাই। মধ্যিখানে গিনিপিগ জনগণ। গরিবকে ঠকিয়ে নেতাদের মাত্র কয়েকবছরে পেল্লায় সম্পত্তি বানানোর বারোমাস্যায় ডুবে সবাই। দুর্নীতি যদি ‘কজ’ হয়, তার ‘এফেক্ট’ আরও ভয়ঙ্কর! এই মেগা ধারাবাহিকে কোথাও কোনও ছেদ নেই। কোনও স্ক্রিপ্ট ও নির্দেশনা ছাড়াই এ নাটক মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরির কৌশল, বিষাক্ত বিভাজন, আর তার মধ্যিখানেই আটকে মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ। এই আমাদের দিনআনা দিনখাওয়া পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা জীবনের চলমান জলছবি। তবু এই বিশেষ দিনে দু’টো মাটির প্রদীপ বেচে যে মহিলার ঘরে চুলা জ্বলে তারও তো দেওয়ালি। ওই ঘরে আলোর উৎসব মানে তো ফুলঝুরি, দোদমা, চকলেট কিংবা মোমবাতি নয়, নয় ধনতেরসে মনোহারি গয়না কেনার আহ্লাদ পূরণ, শুধু একটু ভাত ফুটনোর আগুনের বন্দোবস্ত করা। ওই উত্তাপ পুইয়েই গরিবের ঘরে আলো জ্বলে। ফেনা ভাতের শেষ বিন্দু পর্যন্ত চাটতে চাটতেই খুলে আসা টালির ফাঁক দিয়ে আমিরের হরেক কিসিমের আলোর বাজির কেরামতি দেখে সে। রাতভর। এভাবেই ফুরিয়ে যায় রং মশালের রাত, দিনের আলো ফুটতেই নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু। বাবুরা তখনও হ্যাংওভার বিলাসে আচ্ছন্ন।

ইদানীং বোধহয় চকমকি প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ঠাসা ভাষণ আর একঘেঁয়ে মন কী বাতের অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ হচ্ছে না। বডির সঙ্গে মনেও রেজিস্টেন্স তৈরি হয়েছে। হাল খারাপ দেখে নরেন্দ্র মোদিজি অবশ্য বিনি পয়সায় চাল গম দেওয়ার প্রকল্প আরও পাঁচ বছর চলবে বলে ঘোষণা করেছেন চলতি ভোট প্রচারের মধ্যিখানে। এই ঘোষণা নির্বাচনী বিধিভঙ্গের শামিল কি না, তা বিচার করুক নির্বাচন কমিশন। তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই পাইয়ে দেওয়ার ডোল-রাজনীতি রেকর্ড বেকারত্বের দেশে ভোট কুড়িয়ে আবার ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যেই। ওই ঘোষণাতে যত আলো, ততই অন্ধকার! শুধু দীপের নীচেই নয় চারিপাশে। মানুষ বোঝে গরিবকে আরও গরিব রাখার মধ্যেই ক্ষমতার কারবারিদের মোক্ষ লুকিয়ে। সঙ্গে অশিক্ষার অন্ধকার জিইয়ে রাখার প্রাণান্তকর প্রয়াস। মনে পড়ে সত্যজিৎবাবুর সেই অমোঘ সংলাপ ‘ওরা যত বেশি জানে তত কম মানে।’ ক্ষমতায় টিকে থাকার আজও এটাই মেড ইজি! কে না জানে প্রান্তিক মানুষের ঘরের এবং অবশ্যই মনের আঁধার দূর করার একটাই পথ—শিক্ষার প্রসার। ২২ ক্যারাটের সোনা কিংবা চকমকে হীরে অসামান্য হলেও তার কদর ধনীর দুলালের ঘরে। প্রকৃত শিক্ষাই পারে গরিবের শোষণ আর বঞ্চনায় স্বস্তির মলম লাগাতে।

ধনতেরসের হিসেব বলছে, একদিনেই ৫০ হাজার কোটির কাছাকাছি ব্যবসার কথা। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা খরচ ৬ লক্ষ কোটি টাকার সামান্য কম। আর শিক্ষার বাজেট এক লক্ষ কোটি টাকার সামান্য বেশি। তাই ধনতেরসের বাণিজ্যের অঙ্কটা মোটেই হেলাফেলার নয়। সোনাদানা হীরে জহরত এসবই আমির লোকেদের জন্য, একথা ষোলোআনা 

সত্যি। তা বলে উদাসীন হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে দার্শনিক সাজারও কোনও মানেই হয় না। 

প্রত্যন্ত গ্রামের যে ঘরে এখনও বিজলি পৌঁছয়নি, বিশুদ্ধ পানীয় জল বাড়ন্ত, সেখানে রত্নের দ্যুতি চমকায় না ঠিকই, কিন্তু সোনা পালিশ করে যে ছেলেটা এসময় একটু বাড়তি মজুরি পায় তার কাছে এই উদযাপনের মূল্য তো কম নয়! বাংলার বিশেষ কয়েকটা জেলা থেকে হাজারে হাজারে জুয়েলারি শ্রমিক মহারাষ্ট্রে যায় কাজের খোঁজে। নির্মাণ শ্রমিকরা যায় মুর্শিদাবাদ থেকে। চাহিদা বাড়লে তার ছিটেফোঁটা এইসব গরিব ঘরের উঠোনকেও আলোকিত করবেই। দীপাবলির এটাই মাহাত্ম্য।

টানা দু’বছরের কোভিড মন্দা, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, আসন্ন ভোট ঘিরে রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে ঢেকে দিয়ে এবার ধনতেরস ও দীপাবলিতে কেনাকাটা ভালো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে অর্থনীতির ইতিবাচক দিক। সবাই জানে, যাদের হাতে পয়সা তারাই দামি জিনিস কেনাকাটা করে। কিন্তু সামগ্রিক বেচাকেনা বাড়লে একেবারে প্রান্তিক গরিব মানুষটাও উপকৃত হয়। কারণ কর্মসংস্থান বাড়ে। উজ্জ্বল আলোর সামান্য রেশ গরিব মহল্লাতেও ছড়িয়ে যায়। আর আমিররা দেখে রিটার্ন। বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে কতটা লাভজনক হয়েছে। সেই সুবাদে কোভিড উত্তর সময়ে সোনায় লগ্নির দিকে ঝুঁকেছে তারা। কারণ একবছর আগে ধনতেরসে ১০ গ্রাম সোনার দরের নিরিখে তাঁদের লাভ হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। গত কুড়ি বছরে হলুদ ধাতুর দাম বেড়েছে দশগুণ। গত পাঁচ বছরে বৃদ্ধিটা দেড়গুণেরও অনেকটা বেশি। নিরাপদ লগ্নির সেই হাতছানিই গত কয়েক বছরের মুখ ব্যাজার করা মার্কেট সেন্টিমেন্টকে চাঙ্গা করেছে।

এবারের দীপাবলি আর এক সুখ সন্দেশও বয়ে আনছে। তা হচ্ছে, উৎসব মরশুম মিটলেই বেজে যাবে ভোটের বাদ্যি। সরকারি দপ্তরগুলির প্রচারের ডালি সাজিয়ে বাজেট চূড়ান্ত করে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। তার উপর অযোধ্যার মন্দির নিয়েও একটা হাইপ তোলার চেষ্টা হবে নতুন বছরের শুরুতেই, যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়াবে কেন্দ্রের সরকার। সরকারি খরচ বাড়ার অর্থ বাজারে টাকার জোগান বাড়বে। নানা যোজনা বা প্রকল্প নিয়ে গ্রামেগঞ্জে গরিব মানুষের দুয়ারে পৌঁছে যাবেন নেতা মন্ত্রীরা। ভোটের ইস্যু কী, কার হাতে দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত, কে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে বাজিমাত চায়, এইসব দু’শো কূটকচালিকে পিছনে ফেলে একটাই ইতিবাচক উজ্জ্বল আলোর ঝিলিক সব অন্ধকার ঢেকে দেবে, তা হচ্ছে বাজারে সামগ্রিক টাকার জোগান বৃদ্ধি। পোস্টার, ব্যানার কাটআউট বানায় যে ছেলেটা, সেও দু’পয়সা রোজগার করবে। রোড শোয়ের গাড়ি ভাড়া দেবে যে ব্যবসায়ী সে টাটা বিড়লা নয়, এলাকারই ছোট ব্যবসায়ী। মাইক লাউডস্পিকার কিংবা মোটা ফুলের মালার চাহিদা বাড়ার অর্থ হরেক ব্যবসারই বসন্ত। একটাই আশা, মূর্তিপুজো শেষ হলেই নেতা পুজোর আলোয় অর্থনীতি এগবে। ভোটের ফল বেরলে অকাল দেওয়ালিও তো দস্তুর! 

এবছর বর্ষা ভালো হয়েছে। চাষবাসের খবরও এপর্যন্ত ভালোই। দুর্গাপুজো, দশেরাতে তার প্রভাব পড়েছে বাজারে। দেওয়ালি, ধনতেরসেও কেনাকাটা ভালো হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদেরই। তার উপর আগামী কয়েক মাস ৩৫ থেকে ৪০ লক্ষ বিয়ে আছে। অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি পরিবার এতে যুক্ত। লেনদেনের পরিমাণ মোটেই কম হবে না। সেই সুবাদেই আগামী ছ’মাস অর্থনীতি মোটের উপর ইতিবাচকই থাকবে বলা যায়। তবে তার মধ্যেও চোখ রাঙাচ্ছে বেকারত্ব এবং নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার সঙ্কট। সরকার স্টার্টআপ ও নানাবিধ ব্যবসায় উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু সবাই তো ঋণ নিয়ে ব্যবসা করার মানসিকতা নিয়ে জন্মায় না। সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পড়েছে মুশকিলে। সরকারি চাকরিতে আউটসোর্সিং ক্রমাগত বাড়ছে। সরাসরি চাকরি হওয়া কঠিন। আগামী নির্বাচনের আগে আরও কয়েক দফা চাকরি মেলা, নিয়োগপত্র হাতে তুলে দেওয়ার নাটক যে মঞ্চস্থ হবে মোদিজির সৌজন্যে তা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তার সুফল সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে তো? না, ভোট মিটলেই সব ভুলে আবার সেই তিমিরেই আশ্রয় খুঁজে নেওয়া। দশ লক্ষ সরকারি পদ ফাঁকা, তা পূরণ করবে কে?

এই ক্ষণিক আলো আর অন্ধকার সামলাতে সামলাতেই কেটে যায় মধ্যবিত্তের জীবন। শেষে যোগফল সেই শূন্য জেনেও কত আপ্রাণ ছোটাছুটি। শেষে ঠোক্কর খেতে খেতেই এসে পড়ে বাৎসরিক আলোর উদযাপন। গলাটা গম্ভীর করে বলি, আজকের দীপ উৎসব সবার জীবনে আনন্দ আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসুক। দূষণ এড়িয়ে গ্রিন বাজির ফুলকি, আর দুর্নীতিমুক্ত আলোর চকমকিতে যাবতীয় নেতিবাচক ভাবনা পিছনে চলে যাক। জন্ম হোক নতুন আশা, আর সবুজ স্বপ্নের। আলো আর উত্তাপের ছোঁয়ায় আত্মশুদ্ধি ঘটুক আমাদের বোধ, চেতনা এবং অনুভবের।

No comments