প্রাচীন বাংলার বীরযোদ্ধাদের বীরত্বের স্মারক "আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।ঢাক মৃদঙ্গ ঝাঁঝর বাজে॥বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।ঢুলি গেল সেই কমলাপুলি॥কমলাপুলির টিয়েটা।সুয্যিমামার বিয়েটা॥আয় লবঙ্গ হাটে যাই।ঝালের নাড়ু কিনে খাই॥ঝালের নাড়ু বড় …
প্রাচীন বাংলার বীরযোদ্ধাদের বীরত্বের স্মারক
"আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাক মৃদঙ্গ ঝাঁঝর বাজে॥
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাপুলি॥
কমলাপুলির টিয়েটা।
সুয্যিমামার বিয়েটা॥
আয় লবঙ্গ হাটে যাই।
ঝালের নাড়ু কিনে খাই॥
ঝালের নাড়ু বড় বিষ।
ফুল ফুটেছে ধানের শীষ॥"
এই শিশুপাঠ্য ছড়াটি আমরা ছোটবেলায় হয়তো সবাই পড়েছি। কিন্তু নিতান্ত সাধারণ এই ছড়াটিই প্রাচীন বাংলার বীরযোদ্ধাদের বীরত্বের স্মারক হয়ে আছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ছেলেভুলানোর ছড়া’ গ্রন্থে বলেছেন, আগডুম বাগডুম ছড়াটির প্রথম কয়টি ছত্রে আসলে বিবাহযাত্রার বর্ণনা আছে। আগে অভিজাত পরিবারের বিবাহের শোভাযাত্রা ছিল যুদ্ধযাত্রারই পরিবর্তিত রূপ। কারণ একসময় জোর করে মেয়েদের তুলে আনা হতো। আজও কিছু অবাঙালি বিয়েতে ঘোড়ায় চেপে হাতে তলোয়ার নিয়ে বরের কনেবাড়ি যাওয়ার রীতি আছে। এই ছড়াটিতে সেই বিবাহযাত্রারই একটি রূপের বর্ণনা পাই আমরা। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিমত করেছেন।
ধারণা করা হয়, এই ছড়া মূলত প্রাচীন বঙ্গের দুটি মহাপরাক্রমশালী সম্প্রদায়ের যুদ্ধযাত্রাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল। তাদের একটি ডোম ও অন্যটি বাগদি সম্প্রদায়। এর মধ্যে ডোম সম্প্রদায়ের মানুষদের এখন বসবাস পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা, বীরভূমসহ সংলগ্ন পশ্চিমাঞ্চলে। কিন্তু বাগদিদের দেখা আমরা অনায়াসেই পেয়ে যাই বাংলাদেশের ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলে। বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চলে বাগদিরা এখনো রয়ে গেছেন তাদের সংস্কৃতি আঁকড়ে।
ঐতরীয় ব্রাহ্মণে ও প্রাচীন ভারতীয় পুরাণগুলিতে পূর্ব ভারতের কয়েকটি অবৈদিক জাতির উল্লেখ আছে। সেগুলি হল: বঙ্গ, বগধ ও চের। এদের মধ্যে বগধজাতির বাস ছিল বাংলার দক্ষিণভাগে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, এই বগধ জাতি থেকেই বাগদি কথাটির উৎপত্তি। বলা হয়, দ্রাবিড় বংশোদ্ভূত এই যোদ্ধা জাতিই একসময় বাঘ-সাপ-কুমির-কামটের সঙ্গে লড়াই করে সুন্দরবন কেটে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট অঞ্চলে প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিলেন।
বাংলার বিখ্যাত বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রাচীন যশোহর সাম্রাজ্যের মহারাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের সেনাবাহিনীতে বাগদি সৈন্যরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের সহায়তার জন্য ছিল ডোম সেনারা। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ যে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকাসহ গেজেট প্রকাশ করেছে, সেই তালিকায়ও ৩৪ নম্বরে আছে বাগদি সম্প্রদায়ের নাম।
গবেষকদের মতে, প্রাচীনকালে বাংলায় রাজারাজড়াদের যুদ্ধযাত্রার অগ্রণী যোদ্ধা ছিল বাগদি সম্প্রদায়, আর তাদের সাথে ছিল ডোমযোদ্ধারা। তাদের যুদ্ধযাত্রাই বর্ণিত হয়েছে এই ছড়ায়। যুদ্ধের শোভাযাত্রার সবার আগে (আগডুম), দুই পাশে (বাগডুম) পদাতিক এবং অশ্বারোহী (ঘোড়াডুম) ডোমসৈন্যরা থাকত। ঢাক, মৃদঙ্গ, ঝাঁঝর প্রভৃতি বাদ্যের সঙ্গে পা মিলিয়ে সৈন্যরা পথ দিয়ে এগিয়ে যেত। তাছাড়া, তখনকার রাজারা বছরের কোন সময়ে যুদ্ধযাত্রা করতেন তার বিবরণও এতে রয়েছে। ছড়া অনুযায়ী, ডোম সৈন্যবাহিনী যখন কমলাপুলি অতিক্রম করছে তখন ‘সুয্যিমামার বিয়ে’ অর্থাৎ সকাল হচ্ছে। প্রসঙ্গত, বিপক্ষ সৈন্য কর্তৃক যাত্রারত ডোমসৈন্যদের খাদ্যে বিষপ্রয়োগের কথাও উদ্ধৃত পংক্তিগুলিতে আছে। লবঙ্গ নামক নিযুক্ত চর সৈন্যদের খাদ্যরূপে প্রাপ্ত ঝালের নাড়ু পরীক্ষা করে বিষের সন্ধান পেয়েছে। আর এত সব ঘটনা যখন ঘটছে তখন ফুটেছে ধানের শীষ। অর্থাৎ বর্ষার শেষ শরতের শুরু। সুতরাং ধারণা করা যেতেই পারে যে শ্রাবণের শেষ ভাদ্রের শুরুতে এমন কোনো সুপ্রাচীন যুদ্ধযাত্রা ঘটেছিল।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পাল সাম্রাজ্যের রাজা রামপালের আমলে (আনুমানিক ১০৭৫ খ্রিঃ) উত্তরবঙ্গে বরেন্দ্রভূমিতে দিব্বোক ও তাঁর ভাই ভীমের নেতৃত্বে কৈবর্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করতে রামপাল বৃহৎ বঙ্গের সামন্তচক্রকে একত্রিত করে বিদ্রোহ প্রতিহত করেছিলেন। আর এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন বাগদি আর ডোমসৈন্যের দল। অনেকে মনে করেন, এই ছড়াটি সেই সময়কার যুদ্ধযাত্রারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আবার অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মধ্যে পড়া ঐতিহাসিক নগরী সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামের বাগদি জাতির রূপা রাজার সঙ্গে বঙ্গ অঞ্চলের অধিপতি হরিবর্মার যুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে বাগদি সেনারা অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। চর্যাপদের আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা ‘বেনের মেয়ে’ গ্রন্থে আমরা ‘আগডুম বাগডুম’ ছড়ার একটি কাছাকাছি আদি রূপ পাই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, প্রাচীন বঙ্গে যুদ্ধযাত্রার সময় মুখ্য যোদ্ধারা ছিল বাগদি। তাদের নেতৃত্বেই ডোম গোয়ালা কৈবর্ত প্রভৃতি যোদ্ধা যুদ্ধযাত্রা করতেন।
অমিত পরাক্রমশালী এই বাগদি জাতির সেই আদি জৌলুস এখন আর নেই। পূর্বে বংশপরম্পরায় গঙ্গা-পদ্মার উত্তর-পশ্চিমে বসবাস করলেও পরবর্তীতে ক্রমশ দক্ষিণে সরে আসে। একসময় প্রাচীন বঙ্গের ভাটির দিকে গঙ্গা নদীর পলি জমে ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হলে এই প্রাচীন অস্ট্রালয়েড নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী মৎসজীবী সম্প্রদায় হিসেবে এখানে এসে বসতি গড়ে তোলে।
সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি গড়ার অন্যতম এই কারিগররা এখন সেখানে টিকে আছে ভীষণ অবহেলার মাঝে। এমনকি সুন্দরবন অঞ্চলের লোককৃষ্টি সংস্কৃতির ধারকবাহকও হলো এই বাগদিরা। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় সুন্দরবনের রক্ষাকারী দেবী বনবিবির সন্তান হিসেবে। বনবিবিকে আশ্রয় করে ঝুমুর যাত্রা, দুখে যাত্রা, বনবিবির পাঁচালি, পালা, গাজী-কালুর পালা আজও ধরে রেখেছে বাগদিরা। এ ছাড়ার বাংলার ঐতিহ্যবাহী মনসার পালা, কীর্তন, রামায়ণ গীতসহ সংস্কৃতির আরও নানা অনুষঙ্গেরও চর্চাকারী তারা। কিন্তু সামাজিক নিগ্রহের জন্য তাদের অনেকেই আজ বাগদি পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন।
No comments