দুর্গাপূজা এখন বিশ্বসেরাঐতিহ্য উদযাপন কেবল অতীতের অনুকরণ নয়। ঐতিহ্য সতত পরিবর্তনশীল। বাংলার দুর্গাপুজো ঘিরে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি সেই বিবর্তনেরও স্বীকৃতি। এই বিবর্তন বাহির থেকে অন্তরের দিকে— আলোকসজ্জা, মণ্ডপ, প্রতিমার জাঁকজমক থেকে মা…
দুর্গাপূজা এখন বিশ্বসেরা
ঐতিহ্য উদযাপন কেবল অতীতের অনুকরণ নয়। ঐতিহ্য সতত পরিবর্তনশীল। বাংলার দুর্গাপুজো ঘিরে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি সেই বিবর্তনেরও স্বীকৃতি। এই বিবর্তন বাহির থেকে অন্তরের দিকে— আলোকসজ্জা, মণ্ডপ, প্রতিমার জাঁকজমক থেকে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের সম্পদে। বাংলার দুর্গাপুজো মঙ্গল আলোকেরই সন্ধান খোঁজে। বিশ্বজুড়েই।
এই বাংলায় থিমপুজোর জন্ম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। চেনা-অচেনা জায়গাগুলি সাময়িকভাবে বদলে তৈরি হয় এক কল্পলোক। বাংলার এক-একটি পুজোমণ্ডপ যেন জাদুবলে পরিণত হয় প্রাসাদ, মন্দির, কিংবা রাজস্থানি দুর্গে। আলাদিনের জিন রাতারাতি মরুভূমিতে শহর তৈরি করার মতো। রূপকথার কথকদের মতোই বাংলার শিল্পীরা সোনার গাছে রুপোর ফল ফলান অনায়াসে। বাংলা জুড়ে ছড়ানো-ছিটোনো নানা পাড়া বা গলি বা মাঠে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে যায় নিঃশব্দে। পুজোর সাজ এক অচেনা, অন্য বাংলা গড়ে তোলে। পাড়ার মানুষের আবেগ, অভিমান ও ক্ষমতা— একটা মিলিত উদ্যোগ, সব মিলিয়ে অভিনবত্বের ছড়াছড়ি। লক্ষ লক্ষ বাঙালি, অবাঙালি জাতিমত নির্বিশেষে রাস্তায় ঘুরে তাকে স্বাগত জানায়। অনুভব করি, এ একান্তই বাংলার আবেগ। বহু মানুষকে আপ্লুত করার অভিনব প্রক্রিয়া। নাগরিক অভিব্যক্তি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার হাত ধরে তার প্রকাশ। বিপুল প্রচার, লাগামহীন বিজ্ঞাপন আর তার শহরের গণ্ডিতে আটকে থাকতে চায় না— হতে চায় বিশ্বপর্যটনের আকর।
তারই মাঝে সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জনের এক প্রতিযোগিতা কয়েক দশক আগেই দুর্গাপুজোকে চড়া বিনোদনের থেকে পরিশীলিত, রুচিশীল সৃষ্টিশীলতার দিকে নিয়ে গিয়েছে। দুর্গোৎসব শিখিয়েছে, ধর্ম আলাদা হলেও উৎসব কিন্তু সবার। দীর্ঘদিনের এই সাংস্কৃতিক পরম্পরার স্বীকৃতিও মিলেছে ইউনেস্কোর হাত ধরে। কোন মণ্ডপে কত ভিড় হল তার পরিসংখ্যানেই আজ সর্বজনীনতার ভরসা-ফুর্তি। ২০২১ সালে ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ) তালিকায় দুর্গাপুজো স্থান পাওয়ার পর থেকেই বিদেশিরাও এরাজ্যে পুজোর আবহ ছুঁতে আসেন। পুজো দেখার এমন সুযোগ বিদেশি অতিথিদের জন্য এই রাজ্য সেরা বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে পারে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সুবাদে তাই আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিদেশি মুদ্রা আসবে, যার গুরুত্ব অনেক। কিন্তু সে সব বাদ দিয়েও দুর্গাপুজোর নগদ প্রাপ্তি যথেষ্ট। ভারতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ডিরেক্টর অ্যালিসন ব্যারেটের কথায়, ‘ক্রিয়েটিভ ইকনমি’র জন্য এই উৎসবের চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। ব্রিটিশ কাউন্সিল রাজ্য পর্যটন দপ্তরের সঙ্গে যৌথ গবেষণা করে জানিয়েছে, বাংলার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় তিন শতাংশ আসে দুর্গাপুজো থেকে। দুর্গাপুজোর সৃজনশীল অর্থনীতি প্রায় ৪০ কোটি টাকার ব্যবসা তৈরি করে। যা বাংলার মানুষকে সমৃদ্ধ করে। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়।
অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু লিখেছিলেন, দুর্গাপুজো কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হয়ে ওঠে। খুব সহজ ভাষায় তিনি বুঝিয়েছিলেন, সাম্যবাদীরা যতই খোলাবাজারের কনজিউমারিজমের বিরুদ্ধে থাকুক না কেন, এই চলতি ব্যবস্থায় কনজিউমারিজম কিন্তু সঞ্চিত সম্পদকেই বিনাশ করে। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো প্রকৃতপক্ষে এত বড় ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে যে, নানা ধরনের আর্থিক পরিষেবার পরিসর তৈরি হয়। বাজার অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, ‘মানি সার্কুলেশন’ হয়। উপভোক্তারা এই উৎসবের মরশুমে এবং দুর্গাপুজোর সময় যে খরচটা করে, সেটা তাদের সারা বছরের, এমনকী তার আগের মাসগুলির খরচের তুলনায় শতকরা ৩০ ভাগ বেশি।
পুজো এখন শুধু কুমোরটুলি, পটুয়াপাড়া, চন্দননগর, ডেকরেটরের গণ্ডিতে আটকে থাকে না। গ্রামবাংলার ধুঁকতে থাকা কুটির শিল্পগুলি প্রাণ ফিরে পায়। কুটির শিল্পের লালনভূমি থেকে ভাগ্য অন্বেষণে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া অনেকেই ফিরে এসেছেন নিজের গ্রামে। সারা বছর নিজের বাড়িতে থেকে তাঁদের অনেকের কাছেই বছরভরের রুজি রোজগারের পথ খুলে দিয়েছে থিম পুজো। সেই থিম পুজোর বাজেট ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন তিন কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। ১০ জন শিল্পী নিয়ে শুরু করা ওই সব পুজোয় এখন শিল্পী-সহশিল্পীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে একশোর কাছাকাছি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুসারী আরও হাজার মানুষ। আজ বাংলার আনাচকানাচে প্রতি শরতে গড়ে ওঠা এক-এক টুকরো শিল্প আরও একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইনস্টলেশনের অভিনবত্বকে। কখনও ঐতিহ্য মেনে, কখনও বা নতুনত্বের আহ্বানে শিল্পের উপকরণ হয়ে ওঠে বোতাম, সুতোর রিল, ফুলের সাজি থেকে শুরু করে বাঁশি, ফেলে দেওয়া বোতলের ঢাকনা, বাঙালি বধূদের হাতের শাঁখা-পলা। ত্রিমাত্রিক স্পেসকে আরও একটু অভিনব করে তোলার প্রয়াসে এভাবেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে শহর থেকে শহরতলি। ইনস্টলেশন শিল্প আসলে বাংলার মণ্ডপ-প্রতিমা শিল্পের ভাবনাকে আরও বড় আকারে নিয়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে।
তা ছাড়া মণ্ডপ ঘিরে যে মেলাটা হয়, সেটার কথা চিন্তা করুন। তাতে বেলুনওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, ভেলপুরিওয়ালা, নাগরদোলা— সবাই বাঁচার রসদ খুঁজে পান। কে না জানে, পেটরোগা বাঙালি পুজোর দিনগুলিতে বোধহয় দামোদর শেঠ হয়ে ওঠে! প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, ঠাকুর দেখা, তার ফাঁকে ভূরিভোজ। দুর্গা আর পেট— দুই পুজোর মৌতাতে মাতে বাঙালি। দুগ্গার হাত ধরেই লক্ষ্মী ফেরে হোটেল-রেস্তরাঁ ব্যবসায়ীদের ঘরে ঘরে। আসলে শারদোৎসব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বড় ব্র্যান্ডিং। কোনও
বড় উৎসবকে নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বার করে ব্যাপক অর্থে সামাজিক ও সর্বজনীন করে তোলার কাজটি মমতার আগে এভাবে কেউ করে দেখাননি। হয়তো ভেবেও দেখেননি। পুজোর বাংলায় আজ যে ধরনের বাণিজ্যের পরিসর তৈরি হয়, কয়েক বছর আগেও তেমন চোখে পড়ত না। সব মিলিয়ে তাই এই সব উদযাপনের একটি বৃহত্তর বাণিজ্যিক দিক রয়েছে। তথ্য বলছে, বাংলায় উৎসবের বাজারে গত বছর অন্তত চল্লিশ হাজার কোটির লেনদেন হয়েছে। যার সিংহভাগ সঞ্চারিত হয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। পুজোকে ঘিরে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে। নানা মানুষের নানা উপার্জন, পথে পথে জনসমাগম— বাংলায় এমন মানুষও আছেন, পূজার সময়েই যাঁদের গোটা বছরের রোজগারের সিংহভাগ করে নিতে হয়, বাকি মাসগুলিতে আয় নামমাত্র। পুজোর গুরুত্ব তাই অপরিসীম, বুঝেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজনৈতিক স্বার্থে দুর্গাপুজোর মতো বিশাল একটি সামাজিক উৎসবে সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ সব দলই খোঁজে। যার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগ, সেখানে এই চাওয়াটা যে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে স্বাভাবিক। যে যার মতো করে তার পথ খোঁজে। একইসঙ্গে উৎসবের পালে হাওয়া জুগিয়ে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করাও চলে সমানতালে। কিন্তু যাঁদের নিয়ে রাজনীতি, সেই সাধারণ মানুষ কি উৎসবের জৌলুসে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, প্রতিবাদী? যদি সেটা হতো, তা হলে উৎসবে শরিক হতে লক্ষ, হাজার মানুষ নিশ্চয়ই এভাবে পথে নামতেন না। এঁদের সবাই যে শাসকদলের সমর্থক, তা নয়। সবাই ‘দিদি’-র ভোটারও নন। দল-মত নির্বিশেষে সকলে একই আনন্দের অংশীদার।
এ বাংলার বুকে বাসা বেঁধে আছে হাজারো
গল্পের কোলাজ। সে গল্প কখনও মনে করিয়ে দেয় পথের বাঁকে ভুলে ফেলে আসা মাটির সোঁদা গন্ধ, কখনও বা চলতি পথের আধুনিকতার জয়গান। শরতের মিঠে-কড়া রোদ, কাশফুলের রাশ, নীল আকাশের হাতছানিতে ডাক দিয়ে বাঙালি মণ্ডপে মণ্ডপে গল্প বলে জীবনের। যে গল্পে ঠাঁই নেই কু-রাজনীতির। এ শুধু আনন্দের সময়। ভালো থাকার এবং ভালো রাখার সময়। কোনও মৃত্যু নেই, বিষাদ নেই, যন্ত্রণা নেই।
বাঙালি তো সেই আনন্দের অপেক্ষায় বাঁচে। বছরের চারটে দিনের জন্য আকুল চেয়ে থাকা— অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজোর একশো আট প্রদীপে কারও আগ্রহ থাকুক কি না-ই থাকুক, আলো মেলা মাইক নতুন জামা খাওয়াদাওয়া ঠাকুর দেখার ভিড়-হুল্লোড়ে কেউ অংশভাক হোক বা না-ই হোক। সময় আর তার অপেক্ষাকে বাঙালি নিয়ে গিয়েছে উদযাপনের পর্যায়ে। ‘পুজো আসছে’-র এই অপেক্ষাকেও উপভোগ আর উদযাপন না করতে পারলে তার বাঙালি জীবনটাই বৃথা! বাঙালি দুর্গাপুজোর অপেক্ষা করতে করতে শিল্পসৃষ্টি করে ফেলে, তার আগমনি গান এমন এক অনবদ্য বিচিত্র সৃষ্টি যা কেবল গাওয়া চলে এই ‘পুজো আসছে... পুজো আসছে’ সময়টুকুতেই। তাই তো পুজো
আসার অপেক্ষার মিঠে অজুহাতে আমরা পুজোর উদযাপনটা বাড়িয়ে নিয়েছি এক লপ্তে অনেকটা। এগিয়ে নিয়েছি ক্যালেন্ডারের পাতায়, একেবারে মহালয়ার দিন থেকেই। বাঙালির দুর্গাপুজো এই রকমই— তাতে নিষ্ঠা আছে, প্রথা আছে, কিন্তু তার বাড়াবাড়ি নেই। অহর্নিশি ছড়িয়ে পড়া হিংসা আর অস্থিরতাকে জয় করেই ছড়িয়ে পড়ে শান্তির অমোঘ বাণী।
রবীন্দ্রনাথ তো সেই কবে লিখে গিয়েছেন, ‘উৎসবের একটা প্রধান লক্ষণ প্রাচুর্য। এইজন্য উৎসব দিনে আমরা প্রতিদিনের কার্পণ্য পরিহার করি। দৈন্যের দিন অনেক আছে। আজ উৎসবের দিন।’
No comments