Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পঞ্চকবিদের অন্যতম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

পঞ্চকবিদের অন্যতম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চকবিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান ‘ধনধান্যে পু…

 




পঞ্চকবিদের অন্যতম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।


বাংলা সাহিত্যে পঞ্চকবিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’, ‘বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ’ গানগুলো আজো সমান জনপ্রিয়। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলো বাংলা সংগীত জগতে 'দ্বিজেন্দ্রগীতি' নামে পরিচিত। তিনি অনেকগুলো নাটক রচনা করেছিলেন। তাঁর নাটকগুলো সমালোচকগণ চার শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেন- প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'একঘরে', 'কল্কি-অবতার', 'বিরহ', 'সীতা', 'তারাবাঈ', 'দুর্গাদাস', 'রানা প্রতাপসিংহ', 'মেবার-পতন', 'নূরজাহান', 'সাজাহান', 'চন্দ্রগুপ্ত', 'সিংহল-বিজয়' ইত্যাদি। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত 'আর্যগাথা' (১ম ও ২য় ভাগ) ও 'মন্দ্র' বিখ্যাত। তাঁর রচিত বিখ্যাত ব্যাঙ্গ কবিতা ‘নন্দলাল’ এখনো বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় (১৮২০-৮৫) ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। তাঁর বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হতো। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। তাঁর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন সাহিত্যস্রষ্টা।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন জন্মালেন, তখন তাঁদের বাড়ি যেন নবরত্নসভা। বাবা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের দেওয়ান এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নামকরা গায়ক, লেখক। মা প্রসন্নময়ী অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দাদা-বৌদিরাও সাহিত্যব্রতী। তাঁদের পরিবার বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, দীনবন্ধু মিত্রের মতো মানুষের স্নেহধন্য। দীনবন্ধুর ‘সুরধনী’ কাব্যে দ্বিজেন্দ্রলালের বাবাকে ‘অমাত্য-প্রধান’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের ঠাকুরদা মদনগোপাল রায়ের নাম পাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে, যেখানে রায়গুণাকর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বর্ণনা দিচ্ছেন ‘রায় বকসী মদনগোপাল মহামতি’। এই মদনগোপাল রায় ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাপতি। এই সব পরিচয় দু’টি ইঙ্গিত দেয়। দ্বিজেন্দ্রলালের পরিবার অভিজাত। আর তাঁর পূর্বসূরিরা বৈষ্ণবরস এবং রাজসিক রসে জারিত ছিলেন। হয়তো সেই কারণেই দ্বিজেন্দ্রলালের একই সঙ্গে কীর্তন শুনলে নাচতে-কাঁদতে ইচ্ছে করত এবং তরবারি-ঝঙ্কৃত ঐতিহাসিক নাট্যরচনার দিকেও টেনে নিয়ে যেত।


ক্ষাত্র রসকে পাশ কাটাতে অবশ্য শুরু করেছিলেন তাঁর বাবাই। জীবিকার বাইরে তাঁর মন নিবদ্ধ ছিল সুর-শব্দে। তাঁর রচিত ‘গীতমঞ্জরী’, বাংলা-হিন্দি গান, ‘আত্মজীবন-চরিত’ সেই আভাসই দেয়। 


কোন পরিবেশে বড় হয়ে উঠছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল? ‘আমার পিতা একজন সুবিখ্যাত গায়ক ছিলেন। প্রতুষ্যে উঠিয়া তিনি যখন ভেঁরো, আশোয়ারি ইত্যাদির সুর ভাঁজতেন, আমি অন্তরালে থাকিয়া শুনিতাম।’ ছ’-সাত বছর বয়সে নিজের চেষ্টায় হারমোনিয়াম শিখে যাওয়া এবং ‘১২ বৎসর বয়ঃক্রম হইতে আমি গান রচনা করিতাম’। সুধীর চক্রবর্তীর গবেষণায় এটিও পাওয়া যায় যে, দাদার ফরমায়েশে ন’বছর বয়সেই তাঁর মৌলিক গান রচনায় হাতেখড়ি। এই গানগুলি তাঁর ‘আর্য্যগাথা’র প্রথম ভাগে প্রকাশিত হয়েছিল পরে। 


পড়াশোনার পাশাপাশি কবিতা ও গান রচনা চলছিলই। এবং চলছিল মার্গসঙ্গীতে অবগাহন। বিলেতে থাকাকালীন ‘লিরিকস অব ইন্ড’ নামে ইংরেজিতে লিখে ফেললেন একখানা কাব্যগ্রন্থ। প্রথম প্রথম বিলেতি সঙ্গীত তাঁকে ধাক্কা দিলেও পরে তা চর্চা করতে শুরু করলেন। পাশাপাশি তাঁর আগ্রহ তৈরি হল স্কট-আইরিশ গানেও। সে সব গান অনুবাদ করতে শুরু করলেন মাতৃভাষায়। এক অদ্ভুত রসায়ন তৈরি হল, যা রবীন্দ্রনাথেও ঘটেছিল। দু’জনেই সংস্কৃতজ্ঞ, দু’জনেই সে বয়সে ভারতীয় সঙ্গীতের মায়ায় আবদ্ধ। দু’জনেরই টান মায়ের ভাষায়। আর দু’জনেই বিদেশি গানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে হয় অনুবাদ, নয়তো প্রভাবিত গান রচনায় মেতে উঠলেন। ফলে যে নতুন ধারার পত্তন হল, সেটাই পরবর্তী বাংলা কাব্যগীতির কাঠামোকে বদলে দেবে


দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৭৮ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করেন এবং ১০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। একই কলেজ থেকে তিনি এফএ পাস করেন। এরপর হুগলি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ম্যালেরিয়াতে প্রায়ই ভুগতেন। এই কারণে শেষের দুটি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। এই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে কৃষিবিদ্যা ওপর লেখাপড়ার জন্য সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান। সেখানকার এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায় তিনি FRAS , MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রায় তিন বছর পর ১৮৮৬ সালে তিনি দেশে ফিরে এলে, তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা বিলেতে থাকার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রায়শ্চিত্ত করতে অস্বীকৃতি জানালে, তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়।


১৮৮৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে চাকরি জীবন শুরু করেন। এই চাকরির সুবাদে তিনি ভূমি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। ১৮৮৭ সালে প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর প্রথম সন্তান দিলীপকুমার রায়ের জন্ম হয়। তিনিও পিতার ন্যায় সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত। ১৮৯৮ সালে কন্যা মীরাদেবীর জন্ম হয়। ১৯০৩ সালে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে সুরবালা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাঁকুড়াতে বদলি হন। তিন মাস পরে সেখান থেকে বদলি হয়ে মুঙ্গেরে যান। এই সময় তিনি সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হন। এই সময় তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ক্যালভার্টের কাছে চিকিৎসা নেন এবং এক বছরের জন্য ছুটি নেন। এরপর ১৯১৩ সালের ২২ মার্চ তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার আগে তিনি 'ভারতবর্ষ' নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই পত্রিকা প্রকাশের ভার নিয়েছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স। এই পত্রিকার জন্য তিনি সহকারী হিসেবে নিয়েছিলেন অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। যদিও এই পত্রিকা প্রকাশের আগেই তিনি অসুস্থতা জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।


১৮৮৬-৮৭ সাল দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে। ১৮৮৬তে চাকরিজীবনে প্রবেশ আর পরের বছর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের মেয়ে সুরবালা দেবীকে বিয়ে করা। সে বিয়েতে যদিও কৃষ্ণনাগরিকেরা যোগ দেননি দ্বিজেন্দ্রলালের কালাপানি-অতিক্রমণের কারণে। কিন্তু দাম্পত্য দ্বিজেন্দ্রলালের কবি এবং সাঙ্গীতিক জীবনে নতুন দরজা খুলে দিল। সরকারি চাকরি তাঁকে বহু বদলির সম্মুখীন করেছে। গোটা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। এবং নতুন নতুন জায়গার প্রকৃতি এসে ধরা দিয়েছে তাঁর গানে। অন্য দিকে, সামাজিক প্রতিরোধ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে প্রহসনে, হাসির গানে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়, পত্নীপ্রেম তাঁকে গানের প্রেমিক করে তুলেছে সর্বার্থে। এরই মধ্যে তাঁর সখ্য তৈরি হয় আত্মীয় সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে। ডাকসাইটে গায়ক সুরেন্দ্রনাথ খেয়ালে লাগাতেন টপ্পার দানা। সেই টপ্পা-খেয়াল মনে ধরল দ্বিজেন্দ্রলালের। তবে এ সবই রসায়নাগারের উপকরণ মাত্র। যেমন হয় রসায়নাগারে, তেমনই হল। উপকরণ মিলেমিশে তৈরি করল নতুন বস্তু, যা সে সময়ে ‘দ্বিজুবাবু’র গান, পরবর্তী সময়ের ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’।


দাম্পত্যজীবন দ্বিজেন্দ্রলালকে প্রেমের গানের দ্বিজেন্দ্রলাল বানিয়ে তুলল। ষোলো বছরের দাম্পত্যে খুব বেশি গান যে লিখলেন প্রেমের, তা নয়। কিন্তু যা রচনা করলেন, তাতে গানের বিধাতা যেন নিজের হাতে স্বাক্ষর রেখে গেলেন। ওই সুজামুঠারই বাইশ-তেইশ বছরের সেটলমেন্ট কর্তা কাজে বেরোন আর তাঁর স্ত্রী বাড়িতে অপেক্ষায় মালা গেঁথে রাখেন প্রিয়তমের জন্য। আসামাত্র পরিয়ে দেন তাঁর গলায়। এমনই একদিন। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন - ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে/ এই সাধের মালাটি গেঁথেছি/ আমি পরাব বলিয়ে তোমারই গলায়/ মালাটি আমার গেঁথেছি’। কিন্তু মালা তো গাঁথলেন সুরবালা। আর কম্পোজ়ার সেখানে ‘আমি’ শব্দটি বসিয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়! হ্যাঁ, প্রণিধানযোগ্যই। বৈষ্ণব রসেরই উদ্রেক সম্ভবত। রাধাভাব! একই সঙ্গে এ গানের শেষের দিকে রয়েছে - ‘বঁধু, মালাটি আমার গাঁথা নহে শুধু/ বকুল কুসুম কুড়ায়ে/ আছে প্রভাতের প্রীতি, সমীরণ-গীতি/ কুসুমে কুসুমে জড়ায়ে’। এই গান প্রকৃতিকে প্রকৃতিতে মিলিয়ে দেয় যেন। নারীত্ব এখানে ফুল্লকুসুমিত দ্রুমদলশোভিত!


যুক্তধ্বনির ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। ‘আইল ঋতুরাজ সজনি’ গানের ওই অংশটির কথা ভাবা যাক - ‘মৃদুমন্দসুগন্ধপবনশিহরিত তব কুঞ্জভবন/কুহু কুহু কুহু ললিততানমুখরিত বনরাজি’। ধ্বনিমূর্ছনায় মাত করে দেওয়া গানকাঠামো। একই রকম ঝনঝন করে বেজে ওঠা গান টপখেয়ালে ‘এ কী মধুর ছন্দ’ - ‘এ কী মধুর মুঞ্জরিত নিকুঞ্জ/ পত্রপুঞ্জ মর্মর’। এখানে ছান্দসিক দ্বিজেন্দ্রলালের হাতে বাণী উচ্চারিত হচ্ছে অনেকটা এই ভাবে - ‘মধুর মুঞ্জ/ রিত নিকুঞ্জ’ কিংবা ‘মধুর/ মুঞ্জ/ রিত নি/ কুঞ্জ’।


কিন্তু এই সব গান শুনলেই মনে হয় না যে, এখানে সুরের কাঠামোর উপরেই ধ্যান বেশি? সেটাই স্বাভাবিক। এখানেই রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলালের গানের ভিত্তিগত পার্থক্য। রবীন্দ্রনাথের কথা-সুর একসঙ্গে গান তৈরি করত। ভাবই সেখানে বাকি দুই রথীর সারথি। দ্বিজেন্দ্রলাল সুরের কাঠামো তৈরি করে তাতে কথা বসাতেন। এমনও হয়েছে, নাটকে গানের জায়গা ফাঁকা রেখে দিয়েছেন, কিন্তু সুরের কাঠামোটিকে নাটকের ধাঁচের সঙ্গে মানানসই করে গড়ে তুলে, তার পরে কথা বসিয়েছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। দু’জনের ক্ষেত্রেই।


দ্বিজেন্দ্রলালের গানের আরও একটি বৈশিষ্ট্য, শূন্যে স্বপ্নজগৎ তৈরি করা। ‘ভীষ্ম’ নাটকে অম্বিকা-অম্বালিকা যেখানে গাইছে - ‘আমরা মলয়-বাতাসে ভেসে যাব/ শুধু কুসুমের মধু করিব পান/ ঘুমাব কেতকী-সুবাস-শয়নে/ চাঁদের কিরণে করিব স্নান/...তারায় করিব কর্ণের দুল/ জড়াব গায়েতে অন্ধকার/ বাষ্পের সনে আকাশে উঠিব/ বৃষ্টির সনে ধরায় লুটিব/ সিন্ধুর সনে সাগরে ছুটিব/ঝঞ্ঝার সনে গাহিব গান’। গ্রিক পুরাণকথার মতো, টেনিসনের সেই স্পেনের পর্বত দেখে এসে লেখা কবিতার মতো লোটোস বা লোটাস-খেকো মানুষের চরাচরের বাইরের মনতরঙ্গ যেন চিরবন্দি রয়ে গেল এ গানে।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান তিনটি ধারায় বিকশিত হয়েছে যথা, প্রেমের গান, স্বদেশী গান ও হাসির গান। এর মধ্যে তার প্রেমের গান সবচেয়ে আন্তরিক সৃজন, স্বদেশী গান সবচেয়ে জনপ্রিয়, হাসির গান সবচেয়ে মৌলিক ও অভিনব। তবে যথার্থ সচেতনতা ও সুর সংরক্ষণের অভাবে তার বেশির ভাগ গানের সুর এখন হারিয়ে গেছে। দ্বিজেন্দ্রগীতির কোন নির্ভরযোগ্য ও সুসম্পাদিত সংকলন নেই।


দ্বিজেন্দ্রলালের অন্তরে ছিল তীব্র স্বদেশাভিমান ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধ স্বভাব। সেই বেদনা থেকে উৎসারিত রচনা ‘হাসির গান’ বঙ্গসংস্কৃতিতে তার সবচেয়ে বড় দান। উচ্চারণের বৈপরীত্যে ও সুরের দেশি-বিদেশি মিশ্রণে সে গান অনবদ্য। হাস্যরসের সঙ্গীত রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল নিজস্ব একটি রীতি সৃষ্টি করেছিলেন। 


দ্বিজেন্দ্রলাল বাড়ি ছিলেন না। সন্তানসম্ভবা সুরবালা রক্তক্ষরণে দেহ রাখলেন। একাধিক সন্তানের মধ্যে বেঁচে ছেলে দিলীপকুমার, মেয়ে মায়া। তাঁদের জড়িয়ে বাঁচতে চাইলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। ১৯০৩ সালে দাম্পত্য নিভে যাওয়ায় অন্য মানুষ হয়ে উঠলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। একই সঙ্গে চলছে কর্মক্ষেত্রে বিরুদ্ধতা। পানাসক্ত হয়ে পড়লেন দ্বিজুবাবু। আড্ডায় ভাসিয়ে দিলেন নিজেকে। এবং প্রেমের গানের বদলে নাটক তাঁর হাত ধরল শক্ত করে। সে নাটক মূলত ইতিহাসাশ্রিত, স্বদেশচেতনায় জারিত। এরই মধ্যে আরও একটি সংযোগ। বঙ্গভঙ্গ-রোধী আন্দোলন। এক দিকে রবীন্দ্রনাথ পথে নামছেন, স্বদেশি গান বাঁধছেন। অন্য দিকে, দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশি নাটকে মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন দেশাত্মবোধ। ১৯০৫ সালে যার শুরু ‘প্রতাপ’ দিয়ে। তাঁর নাটকে একের পর এক সংযোজিত হতে থাকল স্বদেশি গান।


দেশাত্মবোধক গান রচনায়, সুর সংযোগ ও উদাত্ত কণ্ঠের গায়কীতে শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করতে দ্বিজেন্দ্রলালের জুড়ি ছিল না। আত্মীয় পরিজনদের অনুরোধে জ্বলন্ত স্বদেশপ্রেমের গান লিখে তাঁকে তা নষ্ট করে দিতে হয়েছিল। ইংরেজ সরকারের প্রখর দৃষ্টি তাঁর ওপর বরাবর ছিল। এই গানগুলো রক্ষা পেলে আরো উজ্জ্বল নানা দেশাত্মবোধক সংগীত বাঙালি উপহার পেত। দেশের জন্য, স্বাদেশিকতার টানে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রাণ অস্থির হয়েছে বারবার। মনের ভিতরকার স্বদেশপ্রেমের আঁচটুকু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে স্থির থাকতে দেয়নি। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবকুমার রায়চৌধুরীকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন ‘চাকরি জীবনে ক্রমাগত বদলি আমাকে যথার্থই যেন অস্থির করে তুলেছে। এত বদলি করছে কেন জান? আমার বিশ্বাস স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান, আর ঐ প্রতাপসিংহ নাটকই তার মূল। কিন্তু কি বুদ্ধি! এমনি একটু হয়রান করলেই বুঝি আমি অমনি আমার সব মত ও বিশ্বাসকে বর্জন করব?’। বিশ্বাস, প্রেম আর মনুষ্যত্বই একটা গোটা জাতিকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারে একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর মতে দ্বিজেন্দ্রলাল স্বজাতিকে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে যদি দেশের দৈন্য দূর করতে হয় তার জন্য আমাদের মনে ও চরিত্রে যোগ্য এবং সক্ষম হতে হবে, সবল হতে হবে। তাঁর দেশপ্রীতির চরমবাণী এই যে ‘আবার তোরা মানুষ হ’। হিংসা-কবলিত নেতৃ-অধ্যুষিত আমাদের এ সমাজে দেশ ও জাতি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলালের মূল্যায়ন আজো সমান প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। ‘সমাজ বিভ্রাট’ ও ‘কল্কি অবতার’, ‘বিরহ’, ‘পুনর্জন্ম’ এসব প্রহসন বা নক?শায় সামাজিক অসঙ্গতিকে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় কশাঘাত করেছেন তিনি। এই কশাঘাতের অন্তরালে রয়েছে দেশের প্রতি তীব্র মমত্ববোধ।


নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল সমসময়ে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বিখ্যাত। রবিবাবু নাটক লিখলেও দ্বিজুবাবুর নাটকে কাঁপছে রঙ্গমঞ্চ। একটি ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটে চলেছে। মঞ্চের কলাকুশলীদের কণ্ঠে চিৎকৃত-বিকৃত হয়ে উঠছে দ্বিজেন্দ্র-সুর। কেউ খেয়াল করছেন না। কবি নিজে তো ননই। পুত্রের স্মৃতিতে যেটুকু ছিল, পরে সেটুকুই ভরসা হয়ে উঠেছে তাই। তাঁর সঙ্কলিত গ্রন্থটি তাই বাঙালির পরম এক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আরও কিছু চেষ্টাও ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা দ্বিজেন্দ্রলালের সুর সমসময়ে সংরক্ষিত না হওয়া। স্বরলিপি তৈরির আকর্ষণ বোধ করেননি স্রষ্টা। তাঁর পুত্র নিজেও কিংবদন্তি সঙ্গীতপ্রতিভা। তিনি যখন বাবার গান গেয়েছেন, অল্পবিস্তর নিজের ভাবনারও অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেখানে। তাই দ্বিজেন্দ্রগীতির শুদ্ধ কাঠামো পাওয়া কঠিনই।


তিনি খ্যাতি পেলেন তাঁর হাসির গানে। অবশ্যই সে সব গানে প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য নয়। তাঁর শেষজীবনে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর গাওয়া গান রেকর্ড করেছিল। হাসির গানই। কিন্তু হাসির গানই কি দ্বিজেন্দ্রগীতির অভিজ্ঞান? মনে হয় না! এখানে গায়কির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। হাসির গান গাইবেন কে? তাঁর ‘নন্দলাল’ গানটির কথা ভাবা যেতে পারে। প্রবাসী বাঙালি সম্মেলনে দিলীপকুমার গানটি গেয়ে প্রশংসা কুড়োলেন।


দ্বিজেন্দ্রলাল মূলত অমর হয়ে আছেন তাঁর “ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” গানটির জন্য। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি তাঁর প্রতিবাদ তাঁর বহু দেশাত্মবোধক গানে প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর তিনি ইতিহাসাশ্রিত, প্রহসন, সামাজিক, পুরাণাশ্রিত নাটক লিখতে শুরু করেন৷ সব মিলিয়ে তিনি মোট একুশটি নাটক লিখেছেন। তাঁর লেখা ঐতিহাসিক নাটকগুলি ছিল ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩), ‘প্রতাপ সিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬), ‘নুরজাহান’ (১৯০৮),  ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) ‘সাজাহান'(১৯০৯) প্রভৃতি৷ জাতীয়তাবাদ  ঐতিহাসিক নাটকের মূল বৈশিষ্ট্য হলেও তিনি তাঁর লেখা ঐতিহাসিক নাটকে মৌলিকতার প্রমাণ রেখেছেন৷ ঐতিহাসিক নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল বিষয়বস্তু  হিসেবে গ্রহণ করেছেন পাশ্চাত্য ভাবধারাকে। তাঁর লিখিত সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘তারাবাঈ’।  এই নাটকের মূল বৃত্তান্ত রাজস্থান থেকে গৃহীত।  যদিও নাটকটি বঙ্গভঙ্গের আগে রচিত হয়েছিল তবুও এর মধ্যে স্বদেশপ্রেমের অভাব ছিল না। দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য প্রতিভাকে স্বদেশী আন্দোলন কতটা প্রভাবিত করেছিল তার সার্থক পরিচয় পাওয়া যায় ‘প্রতাপসিংহ’ নাটকে। স্বদেশী আন্দোলনের ভূমিকায় বীরশ্রেষ্ঠ প্রতাপ সিংহকে শৌর্য বীর্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি৷ রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে তিনি ‘দুর্গাদাস’ নাটকটি লেখেন। তাঁর লেখা ‘নুরজাহান’ নাটকটি তাঁর জনপ্রিয় নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম।  এই নাটকের নায়িকা নুরজাহানকে তিনি দোষ গুণের অন্তর্দ্বন্দ্ব মিলিয়ে অসামান্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।


'সাজাহান' দ্বিজেন্দ্রলালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। সাজাহানের অন্তর্দ্বন্দ্ব নুরজাহানের পরিপূরক৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সামাজিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘পরপারে’ (১৯১২) ‘ও বঙ্গনারী’ (১৯১৫)। তাঁর লেখা পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য - ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯১৪)। এছাড়া তিনি ‘একঘরে’ (১৮৮৯), ‘কল্কি অবতার’ (১৮৯৫),  ‘বিরহ’ (১৮৯৭), ‘আনন্দ বিদায়’ (১৯১২) প্রভৃতি প্রহসন রচনা করেন৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গভীর মনোযোগে সঙ্গে শেক্সপীয়ার, বার্নাড 'শ প্রভৃতি ইউরোপীয় নাট্যকারদের নাটক পড়তেন যে কারণে তিনি তাঁর নাটককে আধুনিক নাট্যরীতির ধাঁচে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। গিরিশ ঘোষের নাটকে যে ধর্মভাব ও আধ্যাত্মিকতার আবরণ ছিল বাংলা নাটককে তিনি তার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন৷


দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর নাটকে দেখিয়েছেন যে, হিন্দু-মুসলিম পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবােধ থাকলে মিলনে কোনাে অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু পারিপার্শ্বিক, সামাজিক ও অতীত ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ মােহ তাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পরস্পরের সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে শত্রুমিত্র জ্ঞান ভুলে গিয়ে, বিদ্বেষ বর্জন করে প্রকৃত মানুষ হয়ে পরস্পরকে ভাই বলে আলিঙ্গন করার মধ্যে নিহিত রয়েছে সত্যিকার মঙ্গল।


সেই উজ্জ্বল সময়কালে বহুমুখী প্রতিভা বাংলা বড় একটা কম দেখেনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিলে দ্বিতীয় নামটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে দু’বছরের ছোট দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ই রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে পড়েছিলেন বাঙালিরই কান-ভাঙানিয়া কৃৎকুশলতায়! পরে যার জন্য তাঁর জীবনীকার দেবকুমার রায়চৌধুরীর কাছে অনুশোচনাও করেছেন। বাবার অনুশোচনার কথা উঠে এসেছে ছেলে দিলীপকুমার রায়ের লেখাতেও। 


এ লেখাতে অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ জরুরি সেই বিতর্ককে টেনে আনার কারণ একটিই। এই বিষয়টিকে নিয়েই একটা বড় সময় বাঙালির সাহিত্যলোক মুখর থেকেছে এবং শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টি ও তাঁর ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ বা ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ গানের মতো কয়েকটিকে মনে রেখে তাঁকে বেমালুম ভুলে গিয়েছে! অথচ তাঁর রচনা, তাঁর পুত্রের লেখা কিংবা রবীন্দ্রনাথের রচনা এবং রবীন্দ্র-দিলীপ চিঠিপত্র ছত্রে ছত্রে এই দাবিই করে যে, তাঁকে বিস্মৃত হওয়ার অর্থ আত্মবিস্মরণই! এই সূত্রেই এ বিষয়ে আবারও ফিরতে হবে।


শ’পাঁচেক গান রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। প্রেমের, নাটকের, হাসির ও স্বদেশি গানই মুখ্য। এর মধ্যে সুর পাওয়া যায় মাত্র ১৩২টি গানের। নাটক লিখেছেন ২১টি। ইতিহাসাশ্রিত, প্রহসন, সামাজিক, পুরাণাশ্রিত। গান-কবিতা মিলিয়ে কিছু গ্রন্থ। ১৯০৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্যসভা ‘পূর্ণিমা মিলন’ বা ‘সাহিত্যিকী পৌর্ণমাসী সম্মিলন’। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা আসে তাঁরই মাথায়। 


এ সবের পাশাপাশি ছিল এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। যা তাঁকে বাঁচিয়েছে এবং মেরেওছে। বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে আসা দ্বিজেন্দ্রলাল হয়ে উঠলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সেখানে পদে পদে তাঁর স্বাধীনচেতা মন এমন এমন কাজ করতে শুরু করল যে, অচিরেই হয়ে উঠলেন কর্তৃপক্ষের চক্ষুশূল। মেদিনীপুরের সুজমুঠা পরগনার সেটলমেন্টের দায়িত্বে থাকাকালীন ঘটিয়ে বসলেন এক কাণ্ড। কৃষকদের খাজনা দিলেন কমিয়ে। রক্তচোখ দেখালেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। আর উল্টো দিকে কৃষকেরা তাঁকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বদলে ডাকতে শুরু করলেন ‘দয়াল রায়’ নামে। বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা হল। ছোটলাট এলেন পরিদর্শনে। বাঙালি কবি ছোটলাটকে কী বলেছিলেন? তাঁর ভাষায় - ‘আইন বিষয়ে তাঁহার অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়ে দেই’। ফলে যা হওয়ার, তাই হল! বিষয় গড়াল আদালতে। কোনও ক্রমে চাকরি বাঁচলেও পদোন্নতি রুদ্ধ হল। আর দ্বিজেন্দ্রলাল খুশি রইলেন এই ভেবে যে, ‘নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত বঙ্গদেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত’ হয়েছে। ইংরেজের চাকরি তাঁর ভাষায় ছিল ‘দাস্য’। শেষ দিকে মাথায় চেপে বসেছিল স্বেচ্ছাবসরের ভাবনা। 


কিন্তু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটই কি হতে চেয়েছিলেন তিনি? সম্ভবত নিজেও জানতেন না, কী হতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরে পড়াশোনার পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম এ। পরে ছাপরায় সামান্য কিছু দিনের শিক্ষকতা। তার পর মাথায় চাপল কৃষিবিদ্যা পড়ার নেশা। বাড়ির সঙ্গে তুলকালাম করে চলে গেলেন বিলেত। সেখানে অর্জন করলেন কৃষিবিদ্যায় তিনটি ডিগ্রি। কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন, তাঁকে একঘরে করা হয়েছে কালাপানি পেরোনোর জন্য। তত দিনে মা-বাবা প্রয়াত। কাজেই, জীবিকার সন্ধান তাঁর জরুরি ছিল। 


স্বাদেশিকতার অনুপ্রেরণা জোগাতে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলো রচিত হয়েছিল। জাতিপ্রেমের বাড়াবাড়ি যে অন্য দেশ বা জাতির প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারে এবং স্বজাতির প্রতি তীব্র অন্ধ অনুরাগ ও যুক্তিহীন আনুগত্য মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে এ আশঙ্কাও কবি দ্বিজেন্দ্রলালের মনে উঁকিঝুঁকি দিত। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এ ধরনের স্বদেশপ্রেমকে জলাঞ্জলি দেয়ার কথা বলেছেন বারবার। ‘মেবারপতন’ নাটকে মানসী চরিত্রটি জাতিপ্রেমের সংকীর্ণ চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বিশ্বপ্রেমের দিকে এগিয়ে গেছে। দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলো সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার অসন্তুষ্ট হলেও সরাসরি সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাঁর ‘মেবার পতন’ নাটকে পৃথিবীতে ধর্মের নামে রক্তপাতকে বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এই নাটক লেখার আর কিছুকাল পরে জাতীয়তাবোধের উন্মত্ততায় হিটলারের দানবীয় ধ্বংসলীলা আর পৈশাচিক তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছিল সারা পৃথিবী। বাংলা নাট্যসাহিত্য, কাব্য ও সংগীত জগতের এই অবিস্মরণীয় প্রতিভা ১৯১৩ সালের ১৭ মে প্রয়াত হন।


১৯০৫ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্যসভা ‘পূর্ণিমা মিলন’ বা ‘সাহিত্যিকী পৌর্ণমাসী সম্মিলন’। মৃত্যুর আগে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি। পরবর্তীকালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হলে তার আখ্যাপত্রে লেখাছিল ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রতিষ্ঠিত’। মৃত্যুর আগেই প্রথম সংখ্যার ‘সূচনা’ লিখে গিয়েছিলেন - ‘আমাদের শাসন-কর্ত্তারা যদি বঙ্গসাহিত্যের আদর জানিতেন, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও মাইকেল 'পিয়ারেজ' পাইতেন ও রবীন্দ্রনাথ 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত হইতেন’। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে কবিতা ও গানের সংকলন: হাসির গান (১৯০০), মন্ত্র (১৯০২), আলেখ্যা (১৯০,) এবং ত্রিবেণী (১৯১২) প্রভৃতি।


রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার তুলনা চলে না। কোনও অর্থেই নয়। রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়-মাধুর্য। কিন্তু সুরের ক্ষেত্রে মধুবাতাস দ্বিজেন্দ্রলালও। 


আর ফারাক যা রয়েছে, তা প্রধানত ভাবনার, স্থিতধী মানসিকতার, প্রকাশভঙ্গির। যেমন দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরছেন দু’জনেই। কিন্তু ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’র মতো অবিস্মরণীয় গানে দ্বিজেন্দ্রলাল বলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। আর রবীন্দ্রনাথ দেশমাটিতে বিশ্বমায়ের, বিশ্বময়ীর আঁচল দেখেন বলেই হয়তো ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানে প্রতিতুলনার দাবি না তুলে বলেন, ‘জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রাণীর মতন/ শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে’। একই সঙ্গে দু’জনেই আবার দেশের মাটিতেই জীবনের নির্বাপণ আকাঙ্ক্ষা করেন। একজন বলেন, ‘এই দেশেতেই জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি’। আর একজন - ‘ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে’।


তবুও অন্তরে দুই কবির যে মহামিলন ছিল একটি ঘটনায় তা প্রমাণিত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল বললেন আমাদের দেশ, আমাদের সরকার যদি সত্যকার সমঝদার হত, তবে রবীন্দ্রনাথকে তারা নাইট উপাধি দিত। ‘আমাদের শাসনকর্তারা যদি বঙ্গ সাহিত্যের আদর জানিতেন তাহা হইলে রবীন্দ্রনাথ আজ নাইট উপাধিতে ভূষিত হইতেন।’ এই লেখাটি লেখবার পরে যদি তিনি তিনটি মাসও জীবিত থাকতেন তা হলে দেখতে পেতেন রবীন্দ্রনাথের জয় ঘোষণায় বিশ্বলোক মুখরিত হয়েছে। তিনি 'নোবেল' পুরস্কার পেয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের উক্তি সার্থক হয়েছে।


আর দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের উক্তি 'সাময়িক পত্রে যে সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয়, তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি। আর যা ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র।'


এ সব কিছুর পরেও মনে হয়, প্রতিভার অপচয়ের নাম যদি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হয়, তবে আত্মবিস্মৃতির নাম বাঙালি। আজ কবির প্রয়াণ দিবসে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।


★ তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার : - সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত 'আধুনিক বাংলা গান', আশুতােষ ভট্টাচার্য - 'বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস', আনন্দবাজার পত্রিকা, ভোরের কাগজ, দেশে-বিদেশে, ফুলকিবাজ ডট কম, নব জাগরণ ডট কম, সব বাংলায়, বঙ্গদর্শন, ইন্টারনেট।

No comments