Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

কবি অমৃত মাইতির ৭৯ তম জন্মদিন-ভাস্করব্রত পতি

কবি অমৃত মাইতির ৭৯ তম জন্মদিন-ভাস্করব্রত পতি

"আমার কোনো হাত নেই / যা দুমুঠো খাদ্য দেবে // আমার কোনো খেলনা নেই / যা সন্ত্বানহারাকে সান্ত্বনা দেবে // আমার কোনো হৃদয় নেই / যা মানুষকে আশ্রয় দেবে // আমার কোনো জীবন নেই / যা মৃত্…

 




 কবি অমৃত মাইতির ৭৯ তম জন্মদিন-ভাস্করব্রত পতি



"আমার কোনো হাত নেই / যা দুমুঠো খাদ্য দেবে // আমার কোনো খেলনা নেই / যা সন্ত্বানহারাকে সান্ত্বনা দেবে // আমার কোনো হৃদয় নেই / যা মানুষকে আশ্রয় দেবে // আমার কোনো জীবন নেই / যা মৃত্যুকে ঠেকাবে // আমার কোনো চোখ নেই / যে শ্মশানে দুফোঁটা জল ফেলবে।"



জীবনকে এভাবে দেখতে পছন্দ করেন যিনি, তিনি তাঁর যে হাতের আঙুল ছুঁইয়ে অক্ষরের জাল বোনেন, ঠিক সেই হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ঘাম রক্তে জবজবে দেহে মিছিলে স্লোগানে হাঁটতে হাঁটতে অন্যায়ের জাল ছিন্ন করতে মুখর হয়ে ওঠেন। তিনি একাধারে কবি। অন্যদিকে রাজনৈতিক সমাজসেবী। অবলীলায় বলা যায় "মিছিলে হাঁটা কবি"। তিনি বাংলা সাহিত্যের অমৃতকুম্ভের সন্ধানে থাকা অমৃতসুধা মাখা 'কবি অমৃত মাইতি'।



আজ ১৩ ই মার্চ। কবির ৭৯ তম জন্মদিন। কোলাঘাটের ড্রাইভ ইন রেস্টুরেন্টে ঘরোয়া ভাবে পালন হলো কবির জন্মদিন। গান, কবিতা কথালাপ আর জন্মদিনের কেক কেটে দিনটির উদযাপনে আমন্ত্রিত ছিলাম আমি। ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা -- কবি শতায়ূ হোন। 


১৯৪৫ সালের ১৩ মার্চ পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের শিবরামপুরে অমৃত মাইতির জন্ম। কবি অমৃত মাইতিরও জন্মের প্লাটিনাম জুবিলি। পিতা প্রতাপচন্দ্র মাইতি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পেয়েছিলেন তাম্রপত্র। তাই জন্মলগ্ন থেকেই পিতার কাছে শুনেছেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বহু কাহিনী। যা তাঁর লড়াই আন্দোলনের মুকুটের পালক। এর ফলে তিনি নিজেকে একজন খাঁটি সমাজসেবী হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন। একসময় তাঁর বাবার মাথার দাম ইংরেজ শাসকরা ধার্য করেছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবে অনুমেয় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঠিক কতখানি মাথাব্যাথার কারণ ছিলেন।


এই কবিই তাঁর "জীবন এক অভিজ্ঞতা" তে নিজের সম্পর্কে এক মূল্যায়ন করতে গিয়ে অকপটে এবং অনায়াসেই লিখতে পারেন, "ভুল করলে ভুলের মাশুল দিতে হয়। ক্রমাগত ভুল করলে তাকে বলা হয় অবাস্তব অর্বাচীন। ভুলের মধ্যে থাকে শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা। আমি তেমন একজন মানুষ। বাস্তববাদী, পাশাপাশি অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। আমার আবেগ আমাকে অনেক ভালো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহায্য করে। আমার আবেগ অতিমাত্রায় বিশ্বাসী। মানুষকে বিশ্বাস করা আবেগের একটি অন্যতম ধর্ম। বারবার মনে হয় মানুষের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি কাজ। ভুল হয়ে যায় ভুল করে ফেলি বিশ্বাসকে জড়িয়ে ধরি। অমানবিক বন্ধু ভয়ংকর শত্রু। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে। মানুষ চিনতে ভুল হয় বার বার। যার যা প্রাপ্য তাকে বেশি দেওয়া হয়ে যায় অনেক সময়। তার প্রয়োজনে সে আসে কাছে। তার চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে, সে তো চলে যাবে ঠিক। কারণ সে তো থাকতে আসেনি। কিন্তু যাওয়ার সময় সে রক্ত ঝরিয়ে দিয়ে যায়। এই সমস্ত অকৃতজ্ঞ অমানবিক অনেক মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। মানুষ নাকি ঠকে শিখে। আমার কোনো শিক্ষাই হয়নি আজও। এ যেন আমার বিপন্নের পাশে না বুঝেসুঝে বিশ্বাস করে দাঁড়ানোর বদ অভ্যাস।"

 

আদ্যন্ত বামপন্থী রাজনৈতিক ভাবনায় দীক্ষিত। সেইসাথে শিল্প সংস্কৃতি নিবিষ্ট এক অনন্য 'মানুষ রতন'।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করা এই লড়াকু নেতাটি একাধারে সাধারণ মানুষের জন্য সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়া বামপন্থী নেতা। রক্তে ধ্বনিত হয় 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'! আর অন্যদিকে কলমঠেলা কবি। প্রেমের কবি, জীবনের কবি, যৌবনের কবি, হৃদয়ের কবি, রসের কবি, আগুনের কবি, অন্তরের কবি, প্রতিবাদের কবি, বিক্ষোভের কবি। সর্বোপরী মানুষের কবি। তাঁর কলমে উৎসারিত হয় ---"জীবনের চেয়ে দামী কিছু আছে ভেবে / ঘাম রক্তে পিচ্ছিল করেছি মাটি / বিবর্ণ অন্ধকারে অনেক ইচ্ছে / তাই ঘাম রক্তে পিচ্ছিল করেছি মাটি"। 


লড়াই আন্দোলনের মধ্যে উৎসারিত আলো তাঁর জীবন থেকে বার্ধক্য। তেভাগা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ভূপাল পাণ্ডার কোলে উঠে তাঁর বেড়ে ওঠা। সেখানেই যেন সংগ্রামের জন্য মন্ত্রপূত সমিধ হয়ে উঠেছিলেন। জীবনে অসংখ্য কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৭ এর শেষ দিকে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙার চক্রান্তের প্রতিবাদে মুখর হয়ে কারাবরণ করেছেন। সাধারণ মানুষের পেটের, মনের, বেঁচে থাকার এবং অতৃপ্তির ক্ষুধা তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছেন অন্তরাত্মা দিয়ে। আর সেই ক্ষুধা পাঠককূলকে উপলব্ধি করিয়েছেন কবিতায় -- "এত ক্ষুধা, কাকে বলি সে কথা / সুখের পর পুনরায় কাঙালিপনা / একটি কবিতার পর / পুনরায় ব্যস্ত হয়ে ওঠা / সবসময় কি অতৃপ্তির ক্ষুধা / কাকে বলি এ কথা / সামাজিক ছায়াচিত্র / আচ্ছন্ন করে হৃৎপিণ্ড / চোখের সীমানা বাড়তে থাকে / মনের আকাশে অবাধ অগাধ / যাযাবর জীবনের নিরাময়হীন রোগ / এত ক্ষুধা, কাকে বলি সে কথা"।


বামপন্থী আন্দোলনের জন্যে শাসকদলের চক্রান্তের সম্মুখীন হয়েছেন। বাম আন্দোলনে থেকেও কখনো কখনো বামপন্থী কিছু নীতির বিরুদ্ধেও হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদে মুখর। নন্দীগ্রামের রোমহর্ষক ঘটনা তিনি সমর্থন করতে পারেননি। তবে শিল্পায়নের বিরোধীতা না করেও তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, "নন্দীগ্রামের মাটিতে শিল্প গড়ে উঠুক এ আকাঙ্ক্ষা মানুষের নেই একথা ঠিক নয়"। তেমনি তিনি চোখে চোখ রেখে বলতে পেরেছেন, "নন্দীগ্রামের বেশিরভাগ মানুষই প্রান্তিক চাষি ও গরিব। এখন যা চলছে তা কি শ্রেণিসংগ্রাম? এসব কথা অনেকের অপছন্দ। সাতাত্তর সাল থেকে একই ভাঁড়ার ঘর থেকে চাল নিয়ে এক ই হাঁড়িতে ফুটিয়ে একান্নবর্তী পরিবার হয়ে আছি। ভাগ করতে হলে পুরো হাঁড়িটাই ভাঙতে হয়। জেনে রাখা ভালো, সাত পয়সার সঙ্গে তিন পয়সা যোগ করলে দশ পয়সা হয়। তিন পয়সা না দিলে সাত পয়সাও মূল্যহীন হয়ে যায়"। নিজের জন্মস্থান নন্দীগ্রামের মানুষজনকে নিয়ে রাজনীতি করে ফায়দা তোলাকে সমর্থন করতে পারেননি তিনি। আজও তাঁর বুক কাঁদে যখন তাঁর মনে হয়, "ছুটছে সেই কিশোর / মনের সমস্ত দরজা তার খোলা / বুকের শ্বাস প্রশ্বাসে ঝড়ের পূর্বাভাস / আকাঙ্ক্ষার খেদ ও ক্রন্দন সহচর তার / কতবার শ্মশান সম্রাটের সঙ্গে দেখা হয়েছে -- / সব অবসাদ পিপাসা হারায়"। কবি দীপ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "কাজের মানুষ মাটির মানুষ প্রাণ ভরা উচ্ছ্বাস / নন্দীগ্রামে বাঁচিয়ে রাখেন জীবনানন্দ দাশ"।


অমৃত মাইতির রচনায় বারবার এসেছে জীবনানন্দ দাশের প্রতিচ্ছবি। সখের চালতাফুল, ভিজে শিশিরের জল, হালভাঙা নাবিক, কিশোরীর লাল পা, ধানসিঁড়ি নদী হয়ে উঠেছে নন্দীগ্রামের এই ভূমিপুত্রের লেখনীর আকর। যা তাঁকে মেদিনীপুর থেকে বিদেশ বিভুঁইয়তে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছে। বাংলা ভাষায় তাঁর সপাট লেখনিতে উবে গিয়েছে দুই দেশের সীমানা। ভারত এবং বাংলাদেশের বোদ্ধা সমাজে তিনি হয়ে উঠেছেন জীবনানন্দ চর্চার আধুনিক সাহিত্যিক। 'জীবনানন্দের বিপ্লবী চেতনা' মূর্ত হয়েছে তাঁর কলমের আগায়। ঠিক যেভাবে জীবনানন্দ অন্ধকারে আত্মমগ্ন থেকে ধূষর রোমান্টিসিজমের জগতে ডুবে থাকতেন বেদনা ভোলার সহজ পদ্ধতি হিসেবে, ঠিক তেমনই অমৃত মাইতি মাঝে মাঝে এই পঙ্কিল অন্তঃসারশূন্য চেতনাহীন জগতের মোহ ভুলতে আশ্রয় নিয়েছিলেন খোদ জীবনানন্দকে। আর অকপটভাবে লিখে ফেলেন, "ভালোবাসার জন্য চোদ্দ হাজার মাইল হেঁটেছি / পায়ে পায়ে ফসলের মাঠ পেরিয়ে / বনানীর বিভ্রান্তির পথ বেয়ে / পাথরের নুড়িতে আছাড় খেয়ে -- আবার উঠেছি / ভালোবাসার জন্য চোদ্দ হাজার মাইল পথ হেঁটেছি।" আসলে বনলতা সেন তাঁর কবিতা লেখার জারক রস। অক্ষরকর্মীর আবাসভূমি। যে ভূমিতে জন্ম নেয় স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের সংমিশ্রণে -- "হাত বাড়াই -- সে হাত ধরে / ভালোবাসার কারুকাজ। / কুর্নিশ করে অশ্রু ফোঁটা / কুসুম জানে ফোটার প্রয়াস"। জন্ম নেয় অজস্র হাহাকার, আনন্দ, ভালোবাসার যৌথ গদ্য। আর বনলতা সেনকে চোখের তারায় ও মনের কোনায় রেখে যে কবিতা উত্তোলিত হয় মনন থেকে, চিন্তন থেকে, সেই কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে ফুটে ওঠে অপরূপ এক রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি। "প্রেম ও নির্জনতা" কবিতায় বনলতা সেনের স্রষ্টাকে সম্মান জানিয়ে অমৃত লাভের আশায় কবি লেখেন, "হাতে নাই বা থাকলো একতারা / কন্ঠে প্রবাসীর গান / যদি থাকে / যে কোনো ভোরে / চলে যাওয়া ভালো"।


অমৃত মাইতির গ্রন্থতালিকায় রয়েছে -- বর্ণময় অমৃত, কবিতায় বানভাসি, জলের আক্রোশ ও আহ্লাদের সাথে, পাড় ভাঙে প্রতিদিন, নৌকো আটকে রাখো কেন, প্রজ্ঞার আকাশে সহজ সমীকরণ, ভালোবাসি পদ্মার পানি, প্রবাসী পাখির গান, বাদাম বালিকা প্রেম ও চেতনার কবিতা, প্রেম ও চেতনার কবিতা, কাঁচঘর, সব অক্ষর পাথর হয়ে যাবে, কবিতার জন্য তুমি, একলা চলাই পথ, জেগে ভেতরের মানুষ, ধানসিঁড়ি কি নদী, অনুগত মধ্যরাত, মানুষ কি ইনস্ট্রুমেন্ট?, প্রবন্ধ সংগ্রহ, কলসপাতা, কামিনি কেন ফুটলো ও অন্যান্য গল্প, অন্ধকারে একা, ভোরের গদ্য, Facebook থেকে পেজবুক, আমি নদী পাখি, একলা চলাই পথ,  জীবনধারা, নীলধূসর, কখনো আকাশ কখনো মেঘ, প্রসঙ্গ মার্কসবাদ ও আর. এস. পি., নির্বাচিত অমৃত মাইতি ইত্যাদি। ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের মুখেও ঝরে পড়ে মেদিনীপুরের এই অজপাড়াগাঁয়ের কবিকে নিয়ে শ্রদ্ধা। সুদূর কানাডার মন্ট্রিয়লের একুশে বইমেলাতে ২০১৯ এ সংবর্দ্ধিত হন একমাত্র তিনিই। আর বাংলাদেশের বুকে তো তিনি 'ঘরের কবি'! অমৃত মাইতির কাছে পৃথিবীতে দুটি তীর্থক্ষেত্র সমাদৃত। একটি আন্দামানের সেলুলার জেল, আর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম!


তিনিই একমাত্র কবি যাঁর ভাণ্ডারে রয়েছে ১৫ টি দীর্ঘ কবিতা লেখার বিরল কৃতিত্ব। সবচেয়ে ছোট দীর্ঘ কবিতা ২৩০ লাইনের। আর সবচেয়ে বড় দীর্ঘ কবিতা ১১১১ লাইনের! বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জাহিদুল ইসলামের চোখে তিনি হয়ে উঠেছেন "মিছিলে হাঁটা কবি"। মিছিলের মতো দীর্ঘ হয় তাঁর কবিতার ভাব। আর এই মিছিলেই মেলে লড়াই আন্দোলনের যাবতীয় শক্তি। যে শক্তি জন্ম দেয় অক্ষরের। আর সিক্ত করে মিছিলে হাঁটা কবির কল্পনাকে। আর তাতেই লিখে ফেলেন -- "দেহ বেচে যে মেয়েগুলো / ভোর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে / আমি তাঁদের নোনা জল / জিভ দিয়ে চাটি"।


গত করোনা পরিস্থিতিতেও কবির কাব্যসাধনা থমকে যায়নি। বরং বারবার মূক মুখে মুখর হয়েছে কবিতার স্কেলিটন। কবিতার হাড্ডি মজ্জা সহ শোনিত ধারায় রঞ্জিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। সেই ২০২০ সালের ৭ ই আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত নিয়ম করে কবিতার উপঢৌকন নিয়ে "ফেসবুক লাইভ"! কখনও সেখানে উচ্চারিত হয় বস্তুবাদী বিবেকানন্দ, গণচেতনায় রবীন্দ্রনাথ, মুজিবুর রহমান, আবার কখনও 'কবিতা পিরামিড নির্মান নয় - অভিজ্ঞান'। সপ্তাহে দুদিন বা তিনদিন নিয়ম করে লাইভে নিয়ে আসেন কবিতার অ্যানাটমিক্যাল কাটাছেঁড়া। নন্দীগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠো ল্যাবরেটরিতে বসে মুঠোফোন জুড়ে মুঠো মুঠো অক্ষরের শাব্দিক উচ্চারণ -- "একটি কুঁড়ি যদি বিকশিত হতে না পারে / তার কি দোষ? / একটি কুঁড়ি যদি কোনো ঘাসফড়িং কেটে দেয় / তার কি দোষ? / একটি কুঁড়ি যদি কোনো অর্বাচীন ছিঁড়ে দেয় / কুঁড়ির কি দোষ? / একটি বিকশিত ফুল / যদি মালা হতে না পারে / তখন তো ফুলেরই আফশোষ!"


বর্তমানে আর. এস. পি. র পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক। সেইসাথে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলী এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এটাই শুধু তাঁর পরিচয় নয়। তিনি যে পায়ে মিছিলে হাঁটেন, সেই পায়ে নড়বড়ে সত্তরেও সবুজ খেলার মাঠে ফুটবল নিয়ে ড্রিবল করতে পারেন। আদ্যন্ত মিশুকে এই বামপন্থী মানুষটি গতানুগতিক চরিত্রের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। যাঁর সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, মন খুলে ঠাট্টা করা যায় আর হৃদয় নিংড়ে সাহিত্য চর্চা করা যায়! 'নিরস তরুবর' সুলভ জননেতা নন। 'শুষ্কং কাষ্ঠং' সুলভ রাজনৈতিক নেতাও নন। তিনি আসলে "তেমন ডাক যদি আসে ঝাঁপিয়ে পড়ব ঠিক / হয়তো কখনো এমন প্রতিজ্ঞা / করেছিলাম নিজের কাছেই / সাহস আর পুরুষকারের সাথে / কপটতা করবোনা নিশ্চয়ই / কথার কাছে কথা রাখবোই"।


সদ্য প্রকাশিত "মানুষ কি ইনস্ট্রুমেন্ট" বইতে প্রশ্ন তুলেছেন "উচ্চবিত্তদের চাহিদা আর আনন্দের খোরাক মেটাতে সমগ্র জনসমাজ আর কতদিন ব্যবহৃত হবে ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে?" আর কবির ভাবনায় এই ভুলভুলাইয়া সমাজ পরিবর্তনে দরকার স্পার্টাকাসের মতো কোনো চরিত্রের উত্থান। যে পারে মানুষকে ইনস্ট্রুমেন্টে পরিণত হওয়া থেকে উদ্ধার করতে। তাই তিনি সাদা কাগজে কালি ছিটিয়ে হুংকার দেন, "মানুষ এখন উন্নত ধরনের পালিশ করা ঝকঝকে ক্রীতদাস। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে কিছু অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু সে অধিকার পুঁজিপতিরা বা সরকার চাইলে ক্ষুন্ন করা হবে। আপনার ভোটাধিকার আছে কিন্তু আপনি প্রয়োগ করতে পারবে না। সময় হলে স্পার্টাকাস ঠিক আসে সমাজের বুকে। এক সময় মানুষকে কেনা হতো। এখন মানুষের মগজকে কিনে নেওয়া হচ্ছে। একদিন যাঁদেরকে যন্ত্র হিসেবে ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁরা সবাই স্পার্টাকাসের চরিত্র খুঁজে পাবে। মানুষ নিজেই শক্তিশালী। প্রত্যেকের মধ্যে স্পার্টাকাসের চরিত্র আছে। নিজেকে বিকশিত করার জন্য সংস্কারমুক্ত হতে হবে। না হলে যুগ যুগ ধরে আমরা ইনস্ট্রুমেন্টে পরিণত হয়ে থাকবো।"


শেষ পাতে একটাই কথা -- যাঁহার মূর্তি অমৃততুল্য অর্থাৎ স্নিগ্ধ, তিনিই তো ‘অমৃতমূর্তি'। তাঁর বিচরণভূমিই আজ তাঁকে চিহ্নিত করেছে ‘অমৃতফেণী' কিংবা ‘অমৃতমণ্ডা’-র জগতে। তাঁর যাবতীয় কীর্তি যেন সেই সমুদ্র হইতে সুধামন্থন তথা ‘অমৃতমন্থন' থেকে উঠে আসা ‘অমৃতাহ্ব’। আজ তাই ‘অমৃতভাষী’ অমৃত মাইতিকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে অমৃতকরণের মাধ্যমে। কাশীবিলাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশিত (১৩০৮) ‘দুর্গাপঞ্চরাত্রি’ অনুসারে বলা যেতেই পারে -- “শঙ্খপাত্রে দধি দুৰ্ব্বা পুষ্প দিয়া তথি / ধেনুমুদ্রা দিয়া তথি করিলা অমৃতি”।

No comments