Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পঁচিশ বছর আগের সেই দিন ১৯৯৭ ,কলকাতা বইমেলা- অনির্বাণ চৌধুরী -

পঁচিশ বছর আগের সেই দিন ১৯৯৭ ,কলকাতা বইমেলা-অনির্বাণ চৌধুরী -সময় তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে। তার প্রবাহে মুছে যায় কত পুরোনো ছাপ। সময়ের পলিতে ঢাকা পড়ে যায় কত কিছু। তবু এমন কিছু অক্ষর থেকে যায় , সময়ের উত্তাল ঢেউ বা গতির নির্মমতাও তার …

 


পঁচিশ বছর আগের সেই দিন ১৯৯৭ ,কলকাতা বইমেলা-

অনির্বাণ চৌধুরী -

সময় তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে। তার প্রবাহে মুছে যায় কত পুরোনো ছাপ। সময়ের পলিতে ঢাকা পড়ে যায় কত কিছু। তবু এমন কিছু অক্ষর থেকে যায় , সময়ের উত্তাল ঢেউ বা গতির নির্মমতাও তার কাছে পরাজিত হয়। 

 

           একটি দুঃস্বপ্নের আবার সেই সঙ্গে এক পরম মমতা- ভালোবাসার  রজত জয়ন্তী পূর্ণ হয়ে গেল বড় নীরবে । সময়ের ধারা আজও অনেকের মন থেকেই তা মুছে দিতে পারেনি। 


          পঁচিশ বছর আগের সেই দিন। 1997 ,কলকাতা বইমেলা। সেবার বইমেলার থিম ফ্রান্স। লুভ্যর মিউজিয়ামের অনুসরণে তৈরি হয়েছিল ফ্রান্সের মণ্ডপ। মেলার উদ্বোধন করতে এসেছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক জাঁক দেরিদা। শুভ উদ্বোধন হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ভয়াবহ একটি মুহূর্ত  জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মতো আছড়ে পড়ল মুখর বইমেলার প্রাঙ্গণে। বইমেলার পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ দিন। একটি খাবারের দোকানে অসাবধানতাবশত আগুন লাগল। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সে আগুন । মেলার মাঠের মধ্যে মজুত থাকা দমকল কাজ করলো না। দমকল অফিসে খবর গেলেও তা আসতে আসতে মেলার দুই-তৃতীয়াংশ পুড়ে ছাই। সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া প্রকাশকরা বাক্যহারা, চোখে তাদের জল। সারা মাঠ ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে এসেছে দমকলের কয়েকটি ইঞ্জিন। এ পর্যন্ত ছিল হাহাকার, হতাশার চিত্রনাট্য । কিন্তু এই আঁধারের গায়ে গায়ে তারার আলো ফোটানোর জন্য পরম মমতার এক কাহিনী তৈরি হওয়া তখনও বাকি ।


              তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুকে মাঠ ভর্তি জল-কাদায় আসা থেকে নিরস্ত করে একাই এলেন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এসেই তিনি গেলেন পাবলিশার্স গিল্ডের সভাপতি সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের কাছে। সবিতেন্দ্রবাবুর লেখা থেকেই জানা যায় ,এরপর কী ঘটল । বুদ্ধবাবু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'এখন কী করবেন ,ভানুবাবু ?' সবিতেন্দ্রবাবু বললেন,' দিন তিনেকের মধ্যে সাদামাটা করে যদি সব স্টল সাজিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আবার মেলা চালু করা যেতে পারে।' বুদ্ধবাবু বললেন, ' কিন্তু বই পাবেন কোথায় ? বই তো সব পুড়ে গেছে।'  সবিতেন্দ্রবাবু বললেন, 'বেশিরভাগ বই থাকে দপ্তরী বাড়িতে। তিনদিন সময় পেলে সবাই কিছু কিছু বই বাঁধিয়ে নেবেন। স্টল ভাড়া না নিয়ে যদি আবার বিক্রির সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে প্রকাশকরা কিছুটা ক্ষতি সামলাতে পারবেন।' সবিতেন্দ্রবাবুর লেখা থেকেই জানা যায়, সেখানে উপস্থিত ছিলেন  আনন্দ পাবলিশার্স -এর প্রয়াত কর্মাধক্ষ্য বাদল বসু। তিনিও এই কথা সমর্থন করলেন। এরপর বুদ্ধবাবু তাঁদেরকে রাইটার্সে চলে আসতে বলেন। সরকারি নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করেন ডেকোরেটরের লোকজন।  বুদ্ধবাবু প্রতিদিন মেলার মাঠে এসে কাজের অগ্রগতি দেখতে শুরু করলেন। পোড়া পোড়া গন্ধ যাতে না পাওয়া যায় তার জন্য তিনি প্রচুর ফুলের টব দিতে বলেন। 


         তিনদিনের মধ্যে মাঠ সুন্দরভাবে প্রস্তুত হয়ে গেল। আবার স্টল বসল। গমগম করে উঠল মেলা প্রাঙ্গণ। ভস্মশয্যা থেকে প্রাণ পেয়ে উঠে দাঁড়াল কলকাতা বইমেলা।  সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, দিব্যেন্দু পালিত প্রমুখ সাহিত্যিকদের সাথে নিলামে বই বিক্রি করলেন বুদ্ধবাবু স্বয়ং। স্মারক হিসেবে সেই বই কিনে নিলেন অনেক বইপ্রেমী। সেই অর্থ দিয়ে সর্বশান্ত প্রকাশক ও বই বিক্রেতাদের জন্য একটি সাহায্য তহবিল খোলা হলো।  বুদ্ধবাবুর উদ্যোগে সরকার এই সাহায্য তহবিলে অর্থ সাহায্য করল।  ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশক ও বই বিক্রেতারা আনুপাতিক হারে সাহায্য পেলেন। 


       বুদ্ধবাবু সেদিন এগিয়ে না এলে হতোদ্যম প্রকাশক ও বই বিক্রেতাদের কী যে হতো ,তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রচারের উচ্চকিত চোখ ধাঁধাঁনো অসহ আলোয় নয়, ভালোবাসার অন্তরদীপনে সেদিন বুদ্ধবাবু ভস্মীভূত বইমেলাকে পুনর্জন্ম দান করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যিনি কোনোদিন বইমেলার উদ্বোধন করেননি , মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অসাধারণ একটি বক্তৃতা করেছিলেন  একবার কলকাতা বইমেলায়। আজও  সেই বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ অন্তরে বাজে । শেষে রবীন্দ্রনাথকে কোট করে তিনি বলেছিলেন, 


        'ফুরায় যা , তা ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে, পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে, জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।'


           আজ তিনি অন্তরালে । কিন্তু মুছে যায়নি সে ইতিহাস। সময়ের নিয়মে বইমেলা কলেবরে বেড়েছে। কিন্তু তার প্রতি ভাঁজে জড়িয়ে রয়েছে সেদিনের ভালোবাসার নীরব মৌন স্পর্শ। আজ শুধু তাই ভস্মীভূত  সেই মুহূর্তগুলির রজতজয়ন্তী  নয় , তার গায়েই তৈরি হয়েছিল নক্ষত্রখচিত আলোকভরা এক উপাখ্যান। আজ তারও রজতজয়ন্তী।


No comments