Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

‘অরবিন্দ চিন্তায় বঙ্গ মনীষীরা’- রানা

‘অরবিন্দ চিন্তায় বঙ্গ মনীষীরা’- রানা১৮৭২ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখে মর্ত্যকায়ায় যাঁকে দেখা গিয়েছিল, ১৯৫০ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে তাঁরই মহাপরিনির্বান ঘটেছিল। সেই আবির্ভাব ও তিরোভাবের দুই কোটির মাঝখানে, ১৮৭২-৭৯ পর্যন্ত সাতবছর তাঁর বাল…

 




‘অরবিন্দ চিন্তায় বঙ্গ মনীষীরা’- রানা

১৮৭২ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখে মর্ত্যকায়ায় যাঁকে দেখা গিয়েছিল, ১৯৫০ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে তাঁরই মহাপরিনির্বান ঘটেছিল। সেই আবির্ভাব ও তিরোভাবের দুই কোটির মাঝখানে, ১৮৭২-৭৯ পর্যন্ত সাতবছর তাঁর বাল্য ও কৈশোরের যুগ ছিল, ১৮৭৯-৯৩ এই চৌদ্দ বছর তাঁর বিলাতে প্রবাস বা শিক্ষার যুগ ছিল, ১৮৯৩-১৯০৬ সাল পর্যন্ত তাঁর বরোদাবাস বা আন্তর প্রস্তুতির যুগ, ১৯০৬-১৯১০ এই চার বছর তাঁর কলকাতা বাস ও কর্মযোগীর যুগ ছিল, আর সবশেষে ১৯১০-৫০ এই চল্লিশ বছর তাঁর আত্মসমাহিতির যুগ ছিল। উপরোক্ত সীমার মধ্যেই মানুষ ও স্বাদেশিক অরবিন্দ, কবি ও দার্শনিক অরবিন্দ, সাধক ও যোগী অরবিন্দ প্রকাশ পেয়েছিলেন।

‘রাজনারায়ণ বসু’ সেকালের প্রগতিপরায়ণ বাঙালী সমাজের একজন সুযোগ্য নেতা ছিলেন। বাংলায় তখন পশ্চিমের সংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষা ও দীক্ষার ঢেউ জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল, জোয়ারে ডুবু-ডুবু নবীন বাংলার মন বিলাতের দিকে আলোর জন্য তাকিয়ে ছিল, নিবাত নিষ্কম্প একটি দীপশিখার জন্য বাংলার চিত্ত তখন আকুল ছিল। সেই প্রবল আলোড়নের তপ্ত কটাহে শুধু ‘ডিরোজিয়ো’ বা ‘রিচার্ডসনের’ ছাত্রেরাই নন, অনেকদিনের অনেককিছু সমাজ-বিন্যাসের রীতি-নীতিও ভেসে গিয়েছিল। বাংলার ইতিহাসে সেই সমুদ্র-মন্থনের ধার করা নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেনেসাঁস’ বা ‘নবজাগৃতির যুগ’। সেই যুগেরই একজন মানুষ ছিলেন ‘ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ’, তিনি ছিলেন রাজনারায়ণের জামাতা। তাঁরই তৃতীয় পুত্র ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। কৃষ্ণধন তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণভাবে সাহেব করে তুলবেন, এটাই ছিল তাঁর আশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ৷ এরপরে একটা সময়ে তখনকার দিনের ইঙ্গবঙ্গ সমাজের সেই মধ্যমণি তাঁর সন্তানদের নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে নিজের সন্তানদের তিনি বিলাতে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে উচ্চশিক্ষিত করিয়ে নিয়ে আসবেন। ভারতে তখন সেই যুগের রেশ চলছিল, যখন মনে হত যে, পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস রাষ্ট্রবোধের চেতনাই শুধু একমাত্র কাম্য নয়, বোধহয় বিধিনির্দিষ্ট পথও। সেই যুগের পিতারা স্বপ্ন দেখতেন যে তাঁদের পুত্রসন্তানেরা ‘আই. সি. এস.’ হবেন, সে যুগের মায়েরা কল্পনা করতেন যে তাঁদের কন্যারা কোন ত্র্যক্ষরধারীপতি পাবেন। তাই ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষের কামনা ছিল যে, তাঁর ‘অরো’ বা অরবিন্দও একজন জাঁদরেল গোছের আই. সি. এস. অফিসার হবেন। তাই তৎকালীন বাঙালী সমাজ, বাঙালী চিন্তাধারা ও ভারতীয় হাবভাব থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত করে, দার্জিলিং কনভেন্টে পড়িয়ে, সাতবছর বয়সে তাঁকে তিনি বিলাতে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু চোদ্দ বছর পরে যে মানুষটা বিলেত থেকে আই. সি. এস. না হয়ে ফিরে এসেছিলেন, বম্বের ‘এপোলো’ বন্দরে দেশের মাটিতে পা দিয়ে তিনি কোন ভোগভূমি নয়, একটা ভূমাময়ী অচঞ্চলা ভারতবর্ষের ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাতে তাঁর মন আনন্দে ভরে উঠেছিল, তাঁর হৃদয় শান্ত স্তব্ধ ও সমাহিত হয়েছিল। এই ঘটনাকে কি বলা উচিত? সম্পূর্ণ অন্য ধরণের পরিবেশে মানুষ হয়ে যাঁর বাংলা না জানার কথা ছিল, যিনি নিজে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কিছু লিখতেন না, সেই তিনি পরবর্তীকালে কেমন করে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের কথা, এবং মধুসূদনের কাহিনী লিখেছিলেন। তখন শ্রীঅরবিন্দের কম্বুকণ্ঠে শুনতে পাওয়া গিয়েছিল - “Let Bengal be true to her own soul.” শ্রীঅরবিন্দকে বাল্যে যে ক’দিন এদেশে কাটাতে হয়েছিল, সেই ক’দিন তাঁকে ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ আই. সি. এস-এর মহামহিমময় ভবিষ্যতের জন্য তৈরী করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাঁরা তিনভাই (বিনয়ভূষণ ও মনোমোহন পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিখ্যাত অধ্যাপক ও কবি হয়েছিলেন) পড়েছিলেন দার্জিলিং লরেটো কনভেন্টের মত সাহেবি কেতার ইংরেজি স্কুলে। মাত্র সাত বছর বয়সেই অরবিন্দকে ‘হোমে’ বা বিলাতে পাঠানো হয়েছিল; উদ্দেশ্য ছিল যে, তিনি যেন উপযুক্ত আবহাওয়ায় বর্ধিত হয়ে সুশিক্ষা লাভ করতে পারেন। পরবর্তী চৌদ্দবছর ধরে তিনি বিলাতে ছিলেন, ম্যাঞ্চেষ্টারের গ্রামার স্কুল থেকে লণ্ডনের সেন্টপলস, সেন্টপলস থেকে কেমব্রিজের কিংস কলেজ - এই ছিল তাঁর শিক্ষার রাজ্য। তারপরে তিনি আই. সি. এস. পরীক্ষা দিয়েছিলেন, লোভনীয় চাকরীর আশ্বাস পেয়েছিলেন, কিন্তু রঙিন হাতিয়ার হাতে নকল ঘোড়সওয়ার হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি ঐ ঘোড়ায় চরবার পরীক্ষাই দেননি। তাঁর সেই সিদ্ধানে সেদিনের তরুণ নওজোয়ানেরা হায় হায় করে উঠেছিলেন, কিন্তু সবার অলক্ষ্যে তাঁর জন্য ভাগ্যলক্ষ্মী আকাশ-পথের আরেক জায়গায় জয়ের মালা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অরবিন্দ আই. সি. এস. না হওয়ার জন্য তাঁর পিতার মনে যে কী নিদারুণ আঘাত লেগেছিল, সেটা যাঁরা তাঁর পারিবারিক ইতিহাস শুনেছেন বা পড়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন। অনেকেই বলেন যে, সেই শোকেই শ্রীঅরবিন্দের পিতার দেহান্তর ঘটেছিল। ১৮৯৩ সালে শ্রীঅরবিন্দ ভারতে ফিরে এসে বরোদায় চাকরী নিয়েছিলেন। তখন তিনি তরুণ যুবক ছিলেন। পরে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন যে, বিলেত থেকে ভারতের মাটিতে পা দিয়েই তাঁর মনে এক অদ্ভুত ভাবান্তর উপস্থিত হয়েছিল; তিনি যেন দেখতে পেয়েছিলেন যে, এক ভূমাময়ী অচঞ্চলা যেন দিগন্তরে নিজের আঁচল বিস্তার করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অরবিন্দ ইংল্যাণ্ডে থাকবার সময়ে চৌদ্দবছর বয়সেই তাঁর মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আজও অনেকেই জানেন না যে, শ্রীঅরবিন্দ শুধুমাত্র একজন মহাযোগী ও স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন না, তিনি একজন বড় কবিও ছিলেন। অবশ্য তিনি কবিতা লিখতেন ইংরেজি ভাষায়, এবং তাঁর ব্যবহার করা সেই ইংরেজি ভাষা গ্রীকোলাতিন ভাবের সমবায়ে গঠিত ক্লাসিক্যাল গুরুগম্ভীর ভাষা ছিল। বাল্যকালেই তাঁর কবিজীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। ১৮৮৭ সালে সেন্টপলস বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণী সভায় ‘Wordsworth’ লিখিত ‘To the Cuckoo’ শিরোনামের কবিতাটি আবৃত্তি করে এসে তিনি সেই রাতেই নিজে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যেটির প্রথম চরণ ছিল - “Sounds of the awakening world” - পৃথিবী জাগছিল, ঘুম ভাঙছিল, আর কিশোর কবি কোকিলের ডাকে সেটারই পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। সেদিন থেকে আরম্ভ করে তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন পর্যন্ত তিনি একটানা কবিতা লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর কবিতার ভাবে ভাষায় ঝংকারে বর্ণ-বৈচিত্র্যে উপমায় শুধু যে তথ্য ও তত্ত্বেরই সমাবেশ দেখা যায় তা নয়, একটা আন্তর অনুভূতির স্পর্শও পাওয়া যায়। কোকিলের ডাকে যে বালক-কবি জেগে উঠেছিলেন, নিজের সারা জীবনের সাধনার পরে সেই চিরতরুণ কবিই সাধকের অসংশয়িত কণ্ঠে অমেয় আশার বাণী শুনিয়ে গিয়েছিলেন - “And in her bosom nursed a greater dawn.” বরোদাবাসের চৌদ্দ বছরটা তাঁর কাছে বাণীসাধনার যুগ ছিল; ওই সময়ে তিনি বেদবেদান্ত, তন্ত্র, উপনিষদ, গীতা, পুরাণ, ইংরেজি, সংস্কৃত, বাংলা, ফরাসী, গ্রীক, ল্যাটিন পড়েছিলেন ও বুঝেছিলেন। সেই সময়ে তিনি কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ লিখেছিলেন, নিজের অন্তরে ধ্যানের নির্দেশ পেয়েছিলেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৮৯৪ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন। সেই সময়ে একুশ-বাইশ বছর বয়সী যুবক অরবিন্দ, যাঁর জীবনের চৌদ্দ বছর বিলাতে শুধু ইউরোপীয় সাহিত্যচর্চায় কেটেছিল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যাঁর মোটেই পরিচয় হয়নি, সেই তিনি বঙ্কিমপ্রয়াণের মাত্র তিনমাসের মধ্যেই বঙ্কিম সাহিত্য ও সাধনা সম্বন্ধে যে গভীর, সুষ্ঠু ও সুযুক্তিপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন, তাতে তাঁর অর্ন্তদৃষ্টি ও রসবোধ দেখে সত্যিই আশ্চর্য হতে হয়। অনেকেই ভাবেন যে, শ্রীঅরবিন্দ বাংলা জানতেন না; কিন্তু মূল বাংলা গ্রন্থ না পড়লে তাঁর লেখা সেই সমালোচনাগুলি কখনোই অতটা সুন্দর হওয়া সম্ভব হত না। সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর লেখা সেই সাতটি প্রবন্ধ আজও জ্বলজ্বল করছে। আবার তখনকার দিনের কংগ্রেসকে তিনি আরো সাতটি প্রবন্ধে সেদিনের আবেদন-নিবেদনের ম্লান দীপের মালাকে কেটে খান-খান করে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রবন্ধগুলির একত্রিত নাম হল - ‘New Lamps for the Old’, অর্থাৎ পুরানো প্রদীপের বদলে নবদীপালি মালা জ্বেলে দাও। সেই সময়েই তিনি ‘মার্তিলার গান’, ‘উর্বশী’, ‘প্রেম ও মৃত্যু’, ‘পার্সিউস দি ডেলিভারার’ প্রভৃতি লিখেছিলেন। ১৯০৬ সালে শ্রীঅরবিন্দ কলকাতায় পদার্পন করে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদের’ (যাদবপুরের) প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন। তখন সারাদেশ জুড়ে বাংলাকে খণ্ডিত করবার বিরুদ্ধে ঝড় বয়ে চলেছিল। তেমন দিনেই শ্রীঅরবিন্দ বাংলায় ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু সেটা শুদু তাঁর ফিরে আসা ছিল না, সেটা ছিল তাঁর আবির্ভাব। পরবর্তী চার বছর তিনি কলকাতায় ছিলেন। ‘সন্ধ্যা’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘যুগান্তর’, ‘কর্মযোগী’ নিয়ে একজন সাদাসিদে সাধারণ মানুষ, আঠারো ঘণ্টা করে দিনে খেটেও যিনি ক্লান্ত হতেন না, সারাদিন লিখেও যিনি অবসন্ন হতেন না, যিনি লোককে তাঁর কথার ভোজবাজীতে শুধু চমকিয়ে দেননি, তিনি নিজেই কর্মযোগীর এক বিরাট প্রতীক ছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে যে, ১৮৯৪ সালের এপ্রিল মাসে যখন বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছিল, অরবিন্দ তখন সদ্য বিলেত ফেরত ২১-২২ বছরের একজন যুবক ছিলেন। তখন তিনি বোরোদায় অন্তরের ধ্যানের নির্দেশে বাণীর সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সেদিনের সেই তরুণ তাপস, যিনি তখন নিজেকে বৃহত্তম পরিণতির জন্য প্রস্তুত করছিলেন, নিজের গভীরতম অনুভূতির জন্য তিনি বঙ্কিমের অন্তর্নিহিত মন্ত্রদৃষ্টিকে দেখতে পেয়েছিলেন, এবং অসংশয়িত চিত্তে বন্দেমাতরমের ঋষিকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বঙ্কিমের মৃত্যুতে কবি শ্রীঅরবিন্দ লিখেছিলেন - হে বঙ্গ জননী, কাঁদো কাঁদো -

“Thy tears fall fast …

The golden light, the fragrance heaven rears,

The fragrance and the light forever shed

Upon his lips immortal who is dead.”

অর্থাৎ, বঙ্কিমের ওষ্ঠাধর আজ নীরব বটে, নীরব তাঁর রবাব বীণা, কিন্তু স্বর্গের সৌরভ আর অম্লান দ্যুতি পড়েছে তার উপর। তারপরে আবার তিনি লিখেছিলেন,

“How hast, thou lost, O month of honey and flowers,

The voice that was thy soul.”

অর্থাৎ, হে মধুমাস, তুমি কেমন করে হারালে সেই মধুময় বাণীর হোতাকে যা তোমার আত্মারই প্রতীক।

“He changed at will and made soul moving books

From the hearts of men and women’s honied looks.”

অর্থাৎ, স্ত্রীলোকদের মধুময় দৃষ্টি আর অন্তরময় পুরুষদের হৃদয় থেকে রসবস্তু আহরণ করে বঙ্কিম পাত্রপাত্রীদের গড়লেন, আত্মামাতানো বই লিখলেন। তরুণ মনের উচ্ছ্বাসে শ্রীঅরবিন্দ তাঁর বঙ্কিম-প্ৰশস্তিতে গেয়ে উঠেছিলেন -

“O plains, O hills, O rivers of Sweet Bengal,

O land of love and flowers, the spring-bird’s call

...

Your heart was this man’s heart. Subtly he knew

The beauty and divinity in you.”

অর্থাৎ, হে আমার মধুর বাংলার শ্যামবনানী নদীগিরিকন্দর ফুলের দেশ, প্রেমের দেশ, জাগ্রত বসন্তের বার্তাবহেব দেশ, তোমার অন্তরের গূঢ় কথাটি বঙ্কিম আহরণ করেছিলেন, তিনি জেনেছিলেন তোমার সৌন্দর্য ও দেবত্বের বিভূতি। তবে শুধুমাত্র কবিতা দিয়েই তিনি বঙ্কিম-তর্পণ করেন নি। আগেই বলা হয়েছে যে, বঙ্কিম প্রয়াণের তিনমাসের মধ্যেই তিনি বঙ্কিমসাহিত্য ও সাধনা সম্বন্ধে গভীর, সুষ্ঠু ও সুযুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর সেই প্রবন্ধগুলি ইংরেজিতে লেখা হলেও, সেগুলোর প্রতি ছত্রে প্রমাণ রয়েছে যে, বঙ্কিমের মূল বাংলা রচনা না পড়লে তাঁর রসবিচার কিছুতেই অত সুন্দর হতে পারত না। অরবিন্দের আগে এবং পরেও বঙ্কিমমানস সম্বন্ধে বহু গবেষণা হয়েছে, বহু বিদগ্ধ আলোচনা হয়েছে, কিন্তু শ্রীঅরবিন্দের লেখা তরুণ বয়সের সেই বঙ্কিম আলোচনা মাঝে মাঝে তীব্র হলেও আজও প্রামাণিক ও বিচারসহ। ওই সময়ে বঙ্কিমকে নিয়ে তিনি সাতটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে একটি করে প্রবন্ধ, বঙ্কিমের মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যেই তিনি সেই লেখাগুলো আরম্ভ করেছিলেন।

(১) Youth and College Life - ১৮৯৪ সালের ১৬ই জুলাই।

(২) The Bengal He lived in - ২৩শে জুলাই।

(৩) His Official Career - ৩০শে জুলাই।

(৪) His versatility - ৬ই আগস্ট।

(৫) His Literary History - ১৩ই আগস্ট।

(৬) What He did for Bengal - ২০শে আগস্ট।

(৭) Our hope in the future - ২৭শে আগস্ট।

অরবিন্দের সাতটি প্রবন্ধের বিষয়-নির্বাচনেই দেখা যায় যে, শ্রীঅরবিন্দ বঙ্কিমের সাহিত্যসৃষ্টি, তাঁর কবিমানস, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, তখনকার দিনের সমাজের কথা, বহুমুখী প্রবণতা ও ভারতের অনাগতদিনের আশার কথা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তবে সবচেয়ে উদাত্তসুরে তিনি যা বলেছিলেন, সেটা হল, বঙ্কিম কি আশার বাণী নিয়ে এসেছিলেন ও কি মৃতুঞ্জয়ী মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের বঙ্কিম সম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলিতে তিনি শুধু বঙ্কিমকেই দেখেন নি, বঙ্কিম যে যুগে, যে মাটিতে, যে বীজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি সেগুলিকেও বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর সেই বিশ্লেষণ কোন ঘটনাপঞ্জীর বিশ্লেষণ ছিল না, সেগুলো ভাববিশ্লেষণও ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিরাট পরিধিতে শুধু তখনকার দিনের সামাজিক পরিস্থিতি, গ্রাম্য আবেষ্টনীই তাঁর লেখায় স্থান পায়নি, তিনি নবজাগরণের নতুন ব্যাখ্যাও করেছিলেন। প্রতীচীর জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, মানবতা বোধ, সেবার আদর্শ তখন কেমন করে শিক্ষিত মানুষের মনকে চঞ্চল করে তুলছিল, তিনি সেকথাও বলেছিলেন। এমনকি তিনি তখনকার সেই যজ্ঞের ঋত্বিকদের - ‘রামমোহন’, ‘রাজনারায়ণ’, ‘দেবেন্দ্রনাথ’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘রাজেন্দ্রলাল’, ‘মধুসূদন’, ‘তরু দত্ত’ প্রভৃতির সম্যক আলোচনাও করেছিলেন। তবে তিনি ‘কেশবচন্দ্র সেন’ ও ‘কৃষ্ণদাস পাল’কে মোটেই আমল দেন নি। রামমোহন সম্বন্ধে তিনি যে অপেক্ষাকৃত নীরব ও কেশবচন্দ্র সম্বন্ধে তিনি যে অপেক্ষাকৃত উদাসীন ছিলেন - একথা মনে হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। শ্রীঅরবিন্দ তাঁর যৌবনে অত্যন্ত কঠিন সমালোচক ছিলেন, তখন তাঁর ভাষার তীব্রতায় চিন্তার তীব্রতা প্রকাশ পেত। তবে সেটার পিছনের কারণ কাউকে তাঁর ‘নস্যাৎ’ করবার ভাব ছিল না; সেটা একটা আদর্শের প্রতি তাঁর উৎকট অনুরাগ ছিল, এবং তাঁর সেই আদর্শ ছিল দেশমাতার প্রতি অনুরাগ ও বিজাতীয়তার পরিহার। ব্রাহ্মধর্মের ‘eclecticism’- র দিকটা, পাশ্চাত্ত্যের অনুকরণে সমাজসেবার আদর্শ, কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের নীতি, তাঁর উগ্র মনকে কখনোই নমনীয় করতে পারেনি। বরং সেই সময়ে ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘New Lamps for the Old’ প্রবন্ধগুলিতে তিনি সেই মনোভাবকে দৈন্যপীড়িত, আদর্শবজিত বলে তীব্র কশাঘাত করেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, তখন তাঁর কবি-কল্পনায় ‘Perseus the Deliverer’-এর মত এক বিরাট ত্রাণকর্তা খেলা করছিলেন, যিনি দেবতাকেও স্বাধীন করতে পারতেন, যিনি মানুষকে সব দিক দিয়ে ঊর্ধ্বে আরো ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারতেন - “Till her dim soul awakes into the light.” তাই বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম’ তাঁর কাছে দেবতার আশীর্বাদের মতই প্রতিভাত হয়েছিল। বঙ্কিমের বহুমুখী প্রতিভাকে বিশ্লেষণ করে তিনি নব্যবাংলার গূঢ়তম রূপটিকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন; শিল্পীর চোখ দিয়ে বঙ্কিম ও মধুসূদনকে তিনি নতুন করে দেখেছিলেন। বাংলা ভাষায় তাঁদের প্রথমজন গদ্যের নতুন রীতি এসেছিলেন, আর দ্বিতীয়জন পদ্যে নতুন ছন্দ দিয়েছিলেন। গৌড়জনকে তাঁরা মধুপান করিয়েছিলেন। বঙ্কিম নিজেই মধুসূদন সম্বন্ধে একদা বলেছিলেন, “জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও, তাহাতে নাম লেখো শ্রীমধুসূদন”। আর শ্রীঅরবিন্দ মধুসূদন সম্বন্ধে লিখেছিলেন -

“Poet who first with skill inspired did teach

Greatness to our divine Bengali speech.”

নব বাংলার আদিম কবি বলে তিনি তাঁকে অভ্যর্থনা করে বলেছিলেন -

“The God himself of the enchanting flute

The God himself took up his pen and wrote.”

অর্থাৎ, কবির লেখনী দিয়ে সেই বংশীধারী বিচিত্র দেবতাই এই অপূর্ব কাব্য মধুসূদনকে দিয়ে লিখিয়েছেন। মধুসূদনের কথায় তিনি লিখেছিলেন, “As we read the passage of that titanic personality over a world too small for it, we seem to be listening again to the thunder scenes in Lear or to some tragic piece out of Thucydides or Gibbon narrating the fall of majestic nations or the ruin of mighty kings. No sensitive man can read it without being shaken to the very heart.” তিনি বলেছিলেন যে, কোন চিন্তাশীল মানুষই সে সব পড়ে মনে মনে নাড়া না খেয়ে থাকতে পারেন না। বঙ্কিম সম্বন্ধে একথাও তিনি বলেছিলেন যে, বিদ্যাসাগরী ডিক্টেটরশিপের নাগপাশ ভেদ করে বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যকে নতুন হাতিয়ার দিয়েছিলেন। অবশ্য বঙ্কিমের অনুপ্রেরণার মূলে ‘আগস্ট কোমতের’ নিরীশ্বরবাদ, মানবপূজা, সমাজসেবার আদর্শ যে অনেকখানি জুড়েছিল - সেকথা এখন সৰ্ববাদীসম্মত। অনেকেই মনে করেন যে, তাঁর ‘অনুশীলনতত্ত্ব’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘আনন্দমঠের’ তথ্য অনেকটা কোমতের মতো। তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’কেও অনেকে সেই মতাবিষ্ট বলেন। শ্রীঅরবিন্দ লিখেছিলেন, “The clear serenity of the man showed itself in his refusal to admit asceticism among the essentials of religion.” রবীন্দ্রনাথ শ্রীঅরবিন্দকে যখন দ্বিতীয় তপস্যার আসনে অপ্রগলভ স্তব্ধতায় দেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, মধ্যযুগের খ্রীষ্টান সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে তিনি জীবনকে রিক্ত শুষ্ক করাই চরিতার্থতা বলেননি। আবার এই কথাই শ্রীঅরবিন্দ বঙ্কিম সম্বন্ধে বলেছিলেন। ‘The Bengal He lived in’ প্রবন্ধে সদ্য ইংল্যাণ্ড ফেরত উচ্চশিক্ষিত তরুণ শ্রীঅরবিন্দের যে মানসিক সৌন্দর্য ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। গত শতাব্দীর পঞ্চম-ষষ্ঠ দশকের সমাজকে তিনি এই বলে অভিহিত করেছিলেন - “A society electric with thought and loaded to the brim with passion” - বাংলার নবজাগরণ যেন তাড়িত চৌম্বক শক্তির মত, যার আকর্ষণ দুর্নিবার - সেখানে নতুন প্রেরণা রয়েছে, সে-প্রেরণায় উচ্ছ্বাস রয়েছে, সে-উচ্ছ্বাসে বহু অনাবশ্যক ফেনা জমেছে একথা সত্যি, কিন্তু সেটার মধ্যে বেগ ও আবেগ রয়েছে - সেই ‘pagan abandon’-এর মধ্যে ছিল শক্তি ও উন্মাদনা, যা মানুষকে জাগিয়ে তোলে ও উদ্বুদ্ধ করে, শুধু সেটাকে সংহত সংযমিত করে নিতে হয় - ঠিক যেমন করে বন্যার জল পলিমাটি দিয়ে দেশকে উর্বর করে তোলে। তিনি সেই যুগকে ‘A miniature renaissance’-এর যুগ হিসাবে দেখেছিলেন; সেখানে পুনরভ্যুত্থান হচ্ছিল, কিন্তু সেটার পরিধি ছিল স্বল্প, সেটার বিকাশের রঙ্গভূমি ছিল সীমা-নিবদ্ধ। তাই তিনি লিখেছিলেন, “From this meeting of a foreign art and civilisation with a temperament differing from the temperament which created them, there issues, as there usually does issue from such meeting, an original art and an original civilisation. Originality does not lie in rejecting outside influences but in accepting them as new mould into which our own individuality may run. This is what happened in Bengal.” বাঙালী এক নতুন শিক্ষাদীক্ষা সভ্যতা শিল্পকলার সংস্পর্শে এসেছিল, সেই মিলনের ফলে তাঁর চেতনারাজ্যে এক নতুন স্রোত এসেছিল, যা যা গড়ে উঠেছিল, সেটাকে শুধু অনুকরণ বলা চলে না, সেটা মৌলিকও ছিল - কারণ মৌলিকত্বে বাইরের প্রভাব থাকবে না তা নয়, কিন্তু নিজের বৈশিষ্ট্যে সেটাকে রূপান্তরিত করে নিতে হবে, এবং সেটাই হবে বাংলার নিজস্ব। অরবিন্দের সময়ের বাংলায় সেই রসায়নই ঘটেছিল। মানুষের মনে যখন এমন একটা ধারণা এসে গিয়েছিল যে, ইংরেজির সব কিছুই ভালো আর বাংলার সব কিছুই খারাপ, তখন বঙ্কিম আর

মধুসূদনই বাংলাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্কিম সম্বন্ধে তাঁর শেষ কথা ছিল - “And when posterity comes to crown with her praises the Makers of India, she will place her most splendid laurel not on the sweating temples of a place-hunting politician nor on the narrow forehead of a noisy social reformer but on the serene brow of that gracious Bengali, who never clamoured for places or power but did his work in silence for love of his work, even as nature does, and just because he had no aim but to give out the best that was in him, was able to create a language, a literature and a nation.” অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন স্থিতধী সেদিনকার সেই অখ্যাতনামা তরুণের সত্যদর্শন ভাবীকাল সাদরেই বরণ করে নিয়েছিল। পদলোলুপ রাজনৈতিককে বা বাক্যবাগীশ সংস্কারকের গলায় সে বরমাল্য দেয়নি - অনাগত মহাকাল তাঁকেই বরণ করে নিয়েছিল, যিনি নিঃশব্দে লোকচক্ষুর অন্তরালে নীরবে কাজ করে গিয়েছিলেন, নিজের অন্তরের শ্রেষ্ঠ রত্নগুলিকে সবার জন্য বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন - যে স্রষ্টা একটা ভাষা, একটা সাহিত্য, একটা জাতিকে সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। সেদিনের তরুণ অরবিন্দ এই বলেই প্রবীণ বঙ্কিমকে প্রণাম জানিয়েছিলেন। বঙ্কিম তাঁর কাছে ঋষি ছিলেন, এবং বন্দেমাতরম তাঁর কাছে ছিল মন্ত্র। এরই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯০৭ সালে ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে শ্রীঅরবিন্দ লিখেছিলেন, “Tha Rishi is different from the Saint. His life may not have been distinguished by superior holiness nor his character by an ideal beauty. He is not great by what he was himself but by what he has expressed. A great and vivifying message had to be given to a nation or to humanity; and God has chosen this mouth on which to shape the words of the message. A momentous vision had to be revealed; and it is his eyes which the Almighty first unseals.” তাই বঙ্কিম মন্ত্রদ্রষ্টা, জাতির স্রষ্টা তো বটেই; আর তার চেয়েও বড় কথা যে তিনি মাকে ভারতবাসীর মনে, ভবানীর মন্দিরে, দেশ-মাতৃকার পাদপীঠে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। “The third and Supreme Service of Bankim to his nation was that he gave us the vision of Our Mother.” সেটা একটা “bare intellectual idea” ছিল না, সেটা ছিল “the mere recognition of the desirability of freedom”; সেটা ছিল একটা জাতির অন্তরমন্থিত তুর্য্যনাদের প্রতীক - স্বদেশপ্রীতির জীবন্ত মন্ত্ৰ ৷ “The Mother had revealed herself” - মা যেখানে নিজেকে প্রকাশিত করেছেন, সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা যে মা, যাঁর বাহুতে রয়েছে শক্তি, যাঁর হৃদয়ে রয়েছে ভক্তি। আরেক মহাকবির ভাষায় -

“ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ

তোর দুই নয়নে স্নেহের হাসি ললাটনেত্র আগুন বরণ।”

তাইতো তিনি অকুণ্ঠিতচিত্তে বলতে পেরেছিলেন যে, নব্য বাংলা বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাঠ নেবে। আজও সত্যদ্রষ্টা সাধকের সেই বাণী সত্যি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথাও উল্লেখ্য। তখনকার প্রাচীনেরা বঙ্কিমের রচনাকে সসম্মান আনন্দের সঙ্গে অভ্যর্থনা করেন নি। যে বঙ্গভাষা বা সাহিত্যকে বঙ্কিম বাল্য থেকে যৌবনে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে শক্তি সঞ্চার করেছিলেন, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ লিখে তার রসসাহিত্যকে নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন, তিনি ভাষার নিপুণ কর্মকার ও চরিত্র অঙ্কনে সুপটু ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলতেন যে, সাহিত্যে বঙ্কিম সাহিত্যে কর্মযোগী ছিলেন। তাঁর কল্পনা ছিল, কিন্তু কাল্পনিকতা ছিল না। উদ্দাম ভাবের আবেগে তাঁর কল্পনা কোথাও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ছুটে যায় নি।

“এ বঙ্গের চিত্তক্ষেত্রে চলিতেছে সম্মুখের টানে,

নিত্য নব প্রত্যাশায় ফলবান ভবিষ্যতের পানে।”

বঙ্কিমে এই ফলবান ভবিষ্যতকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, আর শ্রীঅরবিন্দ দেখেছিলেন সেই ভবিষ্যতের মন্ত্রকে আর তার হোতাকে।

বঙ্কিমী কীর্তির কথা বলতে গিয়ে শ্রীঅরবিন্দ মধুসূদনের সম্বন্ধেও অতিপ্রশস্তির ভাষা প্রয়োগ করেছছিলেন। তবে তাঁর আলোচনা বিচারসহ ও সুষ্ঠু ছিলেন। মধুসূদনের ক্ষেত্রে শ্রীঅরবিন্দের নিজের কথা ‘পশুপতি ভট্টাচার্যের’ অনুবাদেই এরকম - “বাংলা ভাষার সুরটি যদিও মধুর ও মনোরম ছিল, কিন্তু তা ছিল যেন একতারা যন্ত্রের একটানা সুরের মত। শুধু প্রাচীন কবি ভারতচন্দ্র ছাড়া অন্য কোন প্রতিভাশালী ওস্তাদ এ যন্ত্র নিয়ে বেশী নাড়াচাড়া করেননি। গদ্য সাহিত্যের মধ্যে কেবল বেতাল-পঞ্চবিংশতি ও বিক্রমাদিত্যের উপাখ্যান ছাড়া বিশেষ কোন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ছিল না, আর বাংলা কাব্যগুলিরও মধ্যে সেই একটানা মাধুর্যরস ছাড়া আর বিশেষ কিছুই মিলত না। পৌরুষের দৃঢ়তা, সূক্ষ্মতা, প্রসারতা, বিচিত্রতা এ সব কিছুই তার মধ্যে মিলত না। তারপরে দেখা দিলেন মধুসূদন ও বঙ্কিম, গ্রীককবি টারপেণ্ডার এবং অর্ফিউসের মতো অবতীর্ণ হয়ে তাঁরা সেই একতারা যন্ত্রটিতে বাঁধলেন নতুন নতুন তন্ত্রী। যে ভাষা ছিল এককালে নুয়েপড়া ধরনের নারীভাষা, মধুসূদনের হাতে তাই হয়ে উঠল এক তেজদৃপ্ত দেবভাষা, তাই হ’ল বীরত্বব্যঞ্জক মহাকাব্যের ভাষা, যাকে মাধ্যম করে দুর্দাম ঝড়ঝঞ্ঝাও নিজেদের বক্তব্যগুলি বজ্রনিনাদে ব’লে যেতে পারে; সমুদ্রগর্জনের অনুকরণে এই ভাষাতেও তিনি পরমাশ্চর্য বাগবিন্যাস করে সকলকে চমৎকৃত করতে থাকলেন।” শ্রীঅরবিন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত ও অন্যান্য সাহিত্যিকেরা বাংলা সাহিত্যকে উচ্চ আদর্শের পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। “কিন্তু বিদ্যাসাগর যতই জ্ঞানী ও সূক্ষ্মদর্শী হোন তিনি শিল্পী ছিলেন না; অক্ষয়কুমার দত্ত যা কিছু লিখতেন তা কেবল তাঁর সাময়িক পত্রিকার পাঠকদের কাছেই আদর পেত; বাকি সকলের প্রকৃত সাহিত্যিক মৌলিকতা বিশেষ কিছু ছিল না। ভাষাকে প্রাণ দিতে ও তার রূপান্তর আনতে হলে যাদুকরের মতো একটা যে সহজাত শক্তি থাকা দরকার, সেই শক্তি এঁদের কারুরই মধ্যে ছিল না।” সেই শক্তি ছিল বঙ্কিমের, মধুসূদনের, রবীন্দ্রনাথের ও শরৎচন্দ্রের মধ্যে। তাই যখন মধুসূদনের কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, “তখন দেশে এমন এক সাড়া পড়ে গেল, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় এলিজাবেথীয় যুগের ইংলণ্ডে মার্লো কর্তৃক রচিত Tamburlaine নামক নাটকটি প্রকাশিত হওয়াতে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সে হিউগো কর্তৃক Hernani নামক নাটকটি প্রকাশিত হওয়াতে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয় তারই সঙ্গে।” এই প্রসঙ্গে একটা কথা কাব্যালোচনায় অবান্তর হলেও উল্লেখযোগ্য। অনেকের মনেই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, শ্রীঅরবিন্দ এবং তাঁর দেখাদেখি তাঁর ভক্ত স্তাবক অনুরাগী শিষ্যশিষ্যারা ভারতের অন্য কোন মহাপুরুষ বা মনীষীকে আমল দেননি বা এখনো দিতে চান না। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে মধুসূদন, বঙ্কিম এবং তখনকার দিনের তরুণ রবীন্দ্রনাথ আরো তরুণ অরবিন্দের কাছে যে উদার প্রশস্তি পেয়েছিলেন, সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। তবে রামমোহন সম্বন্ধে তিনি উদাসীন ছিলেন, এবং দয়ানন্দ, রাজনারায়ণ ও দেবেন্দ্রনাথকে তিনি উচ্চে স্থান দিয়েছিলেন, এই অভিযোগও করা হয়ে থাকে। ১৮৯৪ সালে তিনি যে কথাই লিখুন না কেন, ১৯১৫ সালে আরো পরিণত বয়সে তিনি দয়ানন্দের প্রসঙ্গে রামমোহন সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “Rammohan Roy, that other great soul and puissant worker who laid his hand on Bengal and shook her to what mighty issues-out of her long and indolent sleep.” রামমোহন যে ঘুমন্ত বাঙালীকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিলেন, একথা অস্বীকার করবে কে? ‘মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে’ সম্বন্ধে প্রথমে তিনি তীব্র সমালোচক হলেও পরে একথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন - “What would Maharastra of today have been without Mahadev Govinda Ranade and what would India of today be without Maharastra.” অন্যদিকে তিলক, দয়ানন্দ ও বিবেকানন্দ সম্বন্ধে তাঁর মন যে প্রশস্তিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতো, সেকথা প্রায় সকলেই জানেন। সাধনার ক্ষেত্রেও স্বামিজীর কাছে তিনি ঋণী ছিলেন, সেকথা নিজেই স্বীকার করে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “We perceive his influence still working gigantically, we know not well how, we know not well where, in something that is not yet formed, something leonine, grand, intuitive, upheaving that has entered the soul of India.” রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে তিনি এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, অনেক সময়ে তিনি নিজের অত্যুৎসাহী ভক্তদের বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, বা তাঁদের এই বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন যে, তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে বোঝেন না। তাঁর মত ছিল যে, শ্রীরামকৃষ্ণ ‘spiritual pigmy’ নন, বরং ‘a colossal spiritual capacity’ - যিনি বারে বারে বিভিন্ন যোগের পথ দিয়ে সেই পরম ঐক্যেই মতেই উপনীত হয়েছিলেন, “extracting substance out of it with an incredible rapidity, always to return to the heart of the whole matter.” শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, খ্ৰীষ্ট, শংকর, চৈতন্য, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ ও শ্রীঅরবিন্দের যোগ সম্বন্ধে অনেক সময়ে তুলনামূলক উক্তি করা হয়। মনে রাখতে হবে যে, তিনি নিজেই বলেছিলেন, “I shall not be surprised or perturbed if one day I am reported to have declared, on the authority of ‘advanced’ or ‘unadvanced’ Sadhaks, that Buddha was a ‘poseur’ or that Shakespeare an overrated poetaster or Newton a third rate College Don without any genius. In this world all is possible. Is it necessary for me to say that I have never thought and cannot have said anything of the kind, since I have at least some faint sense of spiritual values.”

                                    

No comments