বয়স্কদের ব্লাড সুগার এত ওঠানামা করে কেন?
পরামর্শে ডায়াবেটিস ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আশিস মিত্রকমবয়সিদের তুলনায় বয়স্কদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন। আর তার পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ—কিডনির কার্যকারিতাবয়সবৃদ্ধির সঙ্গে কিডনির কার…
বয়স্কদের ব্লাড সুগার এত ওঠানামা করে কেন?
পরামর্শে ডায়াবেটিস ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আশিস মিত্র
কমবয়সিদের তুলনায় বয়স্কদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন। আর তার পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ—
কিডনির কার্যকারিতা
বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে কিডনির কার্যকারিতা কমে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস থাকলে ও প্রথম থেকে সঠিকভাবে সুগার কন্ট্রোল না করা হলে কিডনি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করাও শক্ত হয়ে যায়। প্রশ্ন হল, সুগার নিয়ন্ত্রণে আছে বুঝবেন কীভাবে? সাধারণত প্রতি ৩ মাস অন্তর রোগীর এইচবিএ১সি পরীক্ষা করাতে হয়। সেই পরীক্ষায় এইচবিএ১সি ৭-এর নীচে থাকলে বুঝতে হবে তাঁর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেই আছে। ৭-এর বেশি থাকার অর্থ হল ওই রোগী অনিয়ম করেছেন।
রোগীর মনে প্রশ্ন উঠতে পারে— ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে কিডনির সমস্যার সম্পর্ক ঠিক কোথায়? আসলে ডায়াবেটিসের রোগীর চিকিৎসায় যে সমস্ত ওষুধ বা ইনসুলিন দেওয়া হয়, তাঁদের অনেকের কাজই হল ইউরিনের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীরের বাইরে বের করে দেওয়া। কিছু মেডিসিনের ক্ষেত্রে আবার শরীর দরকার মতো ওষুধ নিজের কাজে লাগিয়ে, বাড়তি অংশ কিডনির সাহায্যে ইউরিনের সঙ্গে বের করে দেয়। অর্থাৎ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিডনির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ডায়াবেটিসের রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের ওষুধ ও ইনসুলিন সেবন করতে হয়। এখন কোনও রোগীর কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে বাড়তি ওষুধ বা ইনসুলিন শরীরের মধ্যে জমে যায়। ফলে হুট করে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে যাওয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা এড়ানো যায় না।
শারীরিক সক্রিয়তা
এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ৮৫ থেকে ৯০ বছর বয়সিরাও সুগারের চিকিৎসা করাতে আসেন চিকিৎসকের কাছে। মুশকিল হল, বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একজন ব্যক্তির শারীরিক সক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে। ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা কমবয়সিদের মতো শারীরিকভাবেও সক্রিয় থাকতে পারেন না। এক্সারসাইজও করতে পারেন না। কারও হাঁটুর ব্যথা, কারও রয়েছেআবার হার্ট, ফুসফুস বা লিভারের সমস্যা। শুধু বয়সজনিত কারণেও অনেকের আর আগের মতো শরীরে বল থাকে না। জবুথুবু হয়ে পড়েন। আর আগের মতো বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। করোনার প্রকোপও সম্পূর্ণ দূর হয়নি। রাস্তায় বেরিয়ে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করার উপায় নেই। বেশি বয়সে মাস্ক পরে বাইরে হাঁটাহাঁটি করাও অস্বস্তি ও ক্লেশকর। এই ধরনের সমস্যা এড়াতে রোগীর উচিত সকালে বা রাতে খাওয়ার পরে ঘরের মধ্যেই মিনিট পনেরো হাঁটাহাঁটি করা। এতে খাবার ভালো হজম হয়, সুগারও ভালো নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ওষুধ
বয়স্কদের ওষুধ নির্বাচন করার সময় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সতর্ক থাকা দরকার। মাথায় রাখতে হবে যে ওষুধ রোগীকে দেওয়া হচ্ছে, তা যেন কোনওভাবেই ব্লাড সুগার ফল না করায়। এখনকার বহু আধুনিক ওষুধ হঠাৎ সুগার ফল আটকাতে পারে। সমস্যা হল ওষুধগুলি একটু দামি।
এছাড়া সুগার ফল বা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ সম্পর্কে চিকিৎসককেও অবগত থাকতে হবে। কখন বোঝা যাবে সুগার ফল করেছে? প্রতি ডেসিলিটার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৭০ মিলিগ্রামের এর নীচে নেমে গেলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কবলে পড়েছেন। ৫৫ থেকে ৭০ এই পর্যায়কে বলে লেভেল ১ হাইপোগ্লাইসেমিয়া। ব্লাড সুগার ৫৪-এর নীচে নেমে গেলে তাকে বলে লেভেল ২ হাইপোগ্লাইসেমিয়া। লেভেল ২ হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় রোগীর প্রাণ নিয়ে টানটানি পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
লক্ষণ
• হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় অস্বাভাবিক রকমের ঘাম হয়। মুশকিল হল আমাদের দেশে ১০ মাসই গ্রীষ্মকাল। তাই ঘাম হওয়া স্বাভাবিক বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু আশপাশে কেউ ঘামছেন না, অথচ সুগারের রোগী ক্রমাগত ঘেমে যাচ্ছেন, জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে, এমন হলে ধরতে হবে তা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণও হতে পারে।
• বুক ধড়ফড় করার উপসর্গও থাকতে পারে।
• রোগীর মাথা ঘোরার মতো লক্ষণও দেখা যায়।
এই ধরনের সমস্যাগুলির সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
এর চিকিৎসাকে বলে রুল অব ফিফটিন!
হাইপোগ্লাসেমিয়ার লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে ১৫ গ্রাম কার্বহাইড্রেট খাওয়াতে হবে। অর্থাৎ ৩ টেবিল চামচ চিনি জলে গুলে পান করাতে হবে রোগীকে। সবচাইতে ভালো হয় ৩ টেবিল চামচ গ্লুকোজ খাওয়াতে পারলে। তবে চিনি বা গ্লুকোজ হাতের কাছে না থাকলে ৬টি মিষ্টি বিস্কিট খেয়ে নেওয়া যায়। হাতের কাছে মিষ্টি চকোলেট থাকলে তাও রোগী খেয়ে ফেলতে পারেন একটি দু’টি।
চিনি বা গ্লুকোজ কিংবা চকোলেট খাওয়ার মিনিট পনেরো পরে ফের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা মাপতে হবে।
পনেরো মিনিট পরে সুগারের মাত্রা ৭০-এর উপরে উঠে যাওয়া উচিত। যদি না ওঠে তাহলে ফের ১৫ গ্রাম কার্বহাইড্রেট খাওয়াতে হবে। পুনরার ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
এভাবে দু’বার কার্বোহাইড্রেট খাওয়ানোর পরেও রোগীর ব্লাড সুগার ৭০-এর উপরে না উঠলে রোগীকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার চিকিৎসার জন্য রোগীকে বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা জরুরি। না হলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারেন।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আরও কিছু লক্ষণ
অনেকসময় রোগী মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন। সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। ঘুম ভেঙে খেয়াল করেন, মাথায় তীব্র ব্যথা হচ্ছে। বিছানার চাদরও জলে ভিজে গিয়েছে। এগুলিও কিন্তু হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ। আসলে ঘুমের মধ্যে রোগী আক্রান্ত হন লেভেল ১ হাইপোগ্লাইসেমিয়ায়। সেই অবস্থা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছে তাঁরই শরীরের কিছু প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। শরীরে স্টেরয়ড হরমোন, এপিনেফ্রিন, গ্লুকাগনের মতো প্রতিরক্ষা মূলক হরমোন ক্ষরিত হয়ে শরীরের নানা স্থানে জমে থাকা গ্লুকোজকে কাজে লাগিয়ে অবস্থা সামাল দেয়। রাত্রিকালীন হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ বেশি দেখা যায় ইনসুলিন নেওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে। সাধারণত রোগী রাত ২টা থেকে ৩টের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হন, দুঃস্বপ্ন দেখেন, ঘাম বের হয়। অতএব রোগী বা তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর এইসব উপসর্গ নজরে এলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক ইনসুলিন বা ওষুধের ডোজের পরিবর্তন করতে পারেন।
অনুলিখন: সুপ্রিয় নায়েক
No comments