কবি, ঔপন্যাসিক এবং শিক্ষাবিদমল্লিকা সেনগুপ্ত (জন্মঃ- ২৭ মার্চ, ১৯৬০ – মৃত্যুঃ- ২৮ মে, ২০১১)
তিনি আপোষহীন রাজনৈতিক ও নারীবাদী কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখনির গুণে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর লেখা ইতিমধ্যেই বিভি…
কবি, ঔপন্যাসিক এবং শিক্ষাবিদ
মল্লিকা সেনগুপ্ত (জন্মঃ- ২৭ মার্চ, ১৯৬০ – মৃত্যুঃ- ২৮ মে, ২০১১)
তিনি আপোষহীন রাজনৈতিক ও নারীবাদী কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখনির গুণে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর লেখা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯৮ ভারত সরকারের জুনিয়র রাইটার ফেলোশিপ পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ১৯৯৮সালে সুকান্ত পুরস্কার, ২০০৬সালে বাংলা একাদেমি এ্যাওয়ার্ড এবং ফেলোশিপ ফর লিটারেচার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। ইতিহাসের ব্রাত্য নারী চরিত্ররা প্রায়ই তাঁর লেখায় পুনর্জীবিত হয়েছেন। সমসাময়িক কবি সংযুক্তা দাসগুপ্তের ভাষায় "তার কবিতায় নারীস্বত্বা কেবলমাত্র অন্তর্ভূতি সচেতনতা হিসেবেই থেকে যায় না, সেটা প্রস্ফুটিত হয় সমস্ত প্রান্তিক নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ।" ২০০১সালে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর শেষ উপন্যাস ছিল ‘কবির বৌঠান’। দিল্লির সাহিত্য আকাদেমির বাংলা বিভাগের সদস্য ছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের অভিন্ন সঙ্গী, গভীর বন্ধুত্ব ছিল কবি কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে। কবি কৃষ্ণা বসু বলেছেন কেউ কেউ আমাদের দুজনকে বলতো একই পাখির দুটি ডানা বলে। বহু অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে গিয়েছি। মেয়েদের বেদনার কথা, বঞ্চনার কথা ও খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতো। ও’র কবিতায় স্থান পেতো ইতিহাসে সমাজে নারীর অবস্থান, আজকের সমাজজীবনে ব্যাক্তি মানুষের অবস্থান, আমাদের অতীতের সঙ্গে গভীর শিকড়ের সম্পর্ক ইত্যাদি। সাহিত্য পত্রিকা ‘ভাষানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। ৯০-এর দশকে সানন্দা পত্রিকাতেও কবিতার সম্পাদনার কাজ করেছেন।
মল্লিকা সেনগুপ্তর জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। তাঁর কবি জীবন শুরু ১৯৮১ সালে এবং সেই থেকে তিনি ১১টি কবিতার বই, দুটি উপন্যাস এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা কেন্দ্রে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ৯০ এর দশকে তিনি অপর্ণা সেন সম্পাদিত 'সানন্দা' পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করতেন। স্বামী সুবোধ সরকারের সাথে তিনি 'ভাষানগর' নামক একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
তিনি ২০টিরও বেশি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। কিছু সাহিত্য ভাবনার বইও লিখে গেছেন। ১৯৮৩সালে মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’ শীর্ষক প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই প্রথম বইটিতেই তাঁর কবিতাগুলোর ভাবনা ছিল সামাজিক পটভূমিকায় নরনারীর সম্পর্ক। এরপর ১৯৮৮সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিভাস প্রকাশনার ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’। এছাড়াও ‘হা-ঘরে ও দেবদাসী’, ‘অর্ধেক পৃথিবী’, ‘মেয়েদের অ-আ-ক-খ’,‘কথামানবী’, ‘দেওয়ালীর রাত’, ‘আমরা লাস্য আমরা লড়াই’, ‘পুরুষকে লেখা চিঠি’, ‘পুরুষের জন্য একশো কবিতা’, ‘বৃষ্টিমিছিল বারুদমিছিল’ প্রভৃতি নানা স্বাদের কবিতার বই তিনি লিখে গেছেন। কবিতা পড়তে আমেরিকা, কুইলান, জার্মানি, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ গিয়েছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত।
২০০৫সালে তাঁর প্রথম ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর চিকিৎসা করে প্রায় সাড়ে ৪বছর সুস্থতার সঙ্গেই কাজ করে গেছেন।
তথ্য সংগৃহীত - প্রতাপ সাহা (https://www.facebook.com/pratapcsaha)। ধন্যবাদ।
..........
বিশেষ বই
কথামানবী [কবিতা]
পুরুষকে লেখা চিঠি
আমাকে সারিয়ে দাও ভালবাসা
সীতায়ন [উপন্যাস]
ভাষা
ভাষা মানে তুমি আমি
ভাষা মানে বাংলা
ভাষা মানে বরাকর
থেকে ভাতজাংলা
বাজারের দোকানের
রাস্তার এ ভাষা
কবিতার স্লোগানের
বচসার এ ভাষা
বাংলায় কথা বলি
বাংলায় ছন্দ
তাই নিয়ে এত কথা
এত কেন দ্বন্দ্ব !
আমাদের বেঁচে থাকা
দাঁড়াবার ভঙ্গি
আমাদের শিকড়ের
পিপাসার সঙ্গী
আজ যদি সেই ভাষা
পথে পথে ভিখারি
যদি তাকে তাড়া করে
নিষ্ঠুর শিকারি
তবু ঘুম ভাঙবে না
পশ্চিমবঙ্গী !
একবার জেগে ওঠো
যুদ্ধের সঙ্গী |
অনাবাসির চিঠি
মন খারাপের বিকেলবেলায়
একটি মেয়েকে মনে পড়ে যায়
দেশে ফেলে আসা সেই সুখস্মৃতি
ভোলা তো গেল না প্রথম পিরিতি
এ দেশে আরাম এ দেশে ডলার
ছেলে মেয়ে বৌ ফিরবে না আর
এখন এখানে নামছে শেকড়
জমিও কিনেছি দু-এক একর
...
এখানে সুখের ঘর বানিয়েছি
তবু মনে হয় কি যেন হল না
বুক খাঁ খাঁ করে, বলো না বলো না
সুখপাখিটিকে হারিয়ে ফেলেছি ।
মারের আগমন
সুগন্ধ পুরুষ এক এসেছে আমার দরজায় |
তাঁকে ভালবাসি কি না কী করে বুঝবো ?
চিত্রিত শার্দুল এক এসেছেন এই হিমঘরে
রূপবান না হলেও সে তো স্বয়ংশাসিত এক মহারাজ
চুপিচুপি চুরি করে সে এখানে থাকতে এসেছে
উজ্জ্বল পোশাকে তার সন্মোহন, অভিমান, রাগ
প্রশস্ত দরজাবাহু এসেছেন মৃত্যুরূপী মার
ওই কূপে ঝাঁপ দিলে মৃত্যু নিশ্চিত
এ কথা জেনেও আমি উঁকি দিই, রামধনু দেখি
দেখি রাত্রির গোলাপ, একটি একটি করে পরত খুলছে
শেষে শুধু বাকি থাকে পুরুষ কেশর
মহাকাল আসছেন আজ রাতে বরফ চৌকাঠে |
ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি
পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে
ফ্রয়েডবাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি
প্রকৃতি সদয় নয়
পুরুষ সদয় নয়
সন্তান সদয় নয়
মেয়েদের প্রতি শুধু ফ্রয়েড সদয় !
এই দয়া কে চেয়েছে ! চিত্রাঙ্গদা ! জোন অব্ আর্ক !
সিমোন দ্য বোভোয়া না শ্যামল দ্রৌপদী !
“পেনিস-এনভি” বলে একটি শব্দ
পৃথিবীতে এনেছেন ফ্রয়েড সাহেব
ওই যে বাড়তি শুধু পুরুষের থাকে
ওই নাকি মেয়েদের কমতি বানায়
তাই তারা শিশুকালে টলমল করে
বালিকা বয়সে তাই শিবলিঙ্গ আকন্দে সাজায়
খেলাঘর ভরে ওঠে পুতুলে ও বাসনকোসনে
কারণ সে নাকি তার মায়ের প্রতিভূ |
অন্যদিকে রোহিতের জন্য থাকে শৌর্যপ্রস্তুতি
জংলাসবুজ উর্দি মার্কিন সেনারা তার ঘরে
ছোটায় মেশিনগান, ট্রা রা রা রা শব্দে সুগঠিত
হয়ে ওঠে পুরুষের আক্রমণ
শাণিত নখরে যদি গাল চিরে দেয়
দিদিমারা খুশি হয় বারতি বীরত্বে |
ওই যে বাড়তিটুকু শরীরের, ওই ছাড়পত্র
ওই তাকে পৃথিবীর মালিক বানাবে
রোহিত মালিক হবে কোন পৃথিবীর ?
যেখানে রোহিতা তার সহকারী ! অধম লিঙ্গ !
ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে খোলা তলোয়ার
বিশ্ববিজয়ে যাবে সম্রাট রোহিত
আর তাকে যুদ্ধ সাজ পরাবে তার মা বোন বউ
এই শুধু চেয়েছেন আপনি ফ্রয়েড !
উল্টোদিক থেকে যদি ঘোটকীর পিঠে কোনও নারী যোদ্ধা আসে
সে কী অস্ত্র ফেলে দেবে ভীষ্মের মতন—
“নারীর বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরবো না”
অর্থাত নারীকে আমি দেব না অস্ত্রের অধিকার—
এই লিঙ্গরাজনীতি আদি পুরুষের
ফ্রয়েড আপনি নিজে বাড়তির দলে বলে ধরেই নিলেন
মেয়েরা কমতি, তাই পুরুষের প্রতি তারা ঈর্ষাকাতর !
আমার শৈশবে কোনও লিঙ্গঈর্ষা কখনও ছিল না
আত্মপরিচয়ে আমি সম্পূর্ণ ছিলাম
আজও আমি দ্বিধাহীন সম্পূর্ণ মানুষী
তৃতীয়বিশ্বের এক স্পর্শকাতর কালো মেয়ে
আজ থেকে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে
কে অধম কে উত্তম বাড়তি কে কমতি কোনটা—
এই কূট তর্কের মিমাংসা করবার ভার
আপনাকে কে দিয়েছে ফ্রয়েড সাহেব !
চোখ
কিছুতেই বোঝে না সে ভালবাসা শিয়রে এসেছে
বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট সাদা আলো
ভালবাসা সন্তর্পণে সেখানে এসেছে |
আঁচল উড়তে দেখে যুবকটি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে উড়ে আসা ঘোড়া দেখে—
গবেষণাগারে ফেলে এসেছে সে আতস চশমা
আকুলতা স্পর্শ করে তাকে
তবু সে চেনে না চোখ, যে নয়নে তার জন্য রহস্য জমেছে ।
বালিকা ও দুষ্টু লোক
স্কুলবাসের বাচ্চা মেয়ে
সবার শেষে নামে
সঙ্গীগুলো বিদায় নিলে
তার কেন গা ঘামে !
বাসের কাকু বাসের চাচা
কেমন যেন করে
হঠাত গাড়ি থামিয়ে দিয়ে
আমায় নিয়ে পড়ে
কাকু জেঠুর মতন নয়
দুষ্টু লোক ওরা
মাগো আমার বাস ছাড়িয়ে
দাও না সাদা ঘোড়া !
দুষ্টু কাকু দুষ্টু চাচা
থাকুক না তার ঘরে
বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কেন
অসভ্যতা করে !
এই পৃথিবী সাদা কালোয়
মন্দ এবং ভাল
তবু কেন এই জীবনে
ঘনিয়ে এল কালো ?
আমার কিছু ভাল্লাগে না
স্কুলের বাসে ভয়
মাগো তোমার পায়ে পড়ি
ওই বাসে আর নয়
আমাকে আর কিছুতেই যেন
না ছুঁতে পারে ওরা
আমাকে দাও সবুজ মাঠ
পক্ষীরাজ ঘোড়া |
………………………..
No comments