Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পত্রিকা সম্পাদনা ও সাংবাদিকতার পিতৃপুরুষ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

পত্রিকা সম্পাদনা ও সাংবাদিকতার পিতৃপুরুষ  রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
প্রতি দিনের এই ব্যস্ত-ছুটন্ত সময়ে কত কিছুই, কত মুখ ভুলে যাই । আবার যাইও না তাদের, যারা বেচে থাকেন তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে, সঞ্চারিত আদর্শ আর মূল্য…



পত্রিকা সম্পাদনা ও সাংবাদিকতার পিতৃপুরুষ  রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


প্রতি দিনের এই ব্যস্ত-ছুটন্ত সময়ে কত কিছুই, কত মুখ ভুলে যাই । আবার যাইও না তাদের, যারা বেচে থাকেন তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে, সঞ্চারিত আদর্শ আর মূল্যবোধের মধ্যে । ‘ভুলে যাওয়া মুখ’ শিরোনামের এই ধারাবাহিকে সেই ভুলে যাওয়া মুইখগুলি চিনে নেওয়ার প্রয়াস করছি । চতুর্থ পর্বে এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসের প্রথম ধ্রুবতারা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে চিনেছিলাম । এই পর্বে এদেশের সাংবাদিকতা ও পত্রিকা সম্পাদনা জগতের আর এক কিংবদন্তি কথা । তিনি ভারতের সাংবাদিকতা ও পত্রিকা সম্পাদনার হিমালয়প্রতীম ব্যক্তিত্ব রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় । পত্রিকা সম্পাদনা সাহিত্য ও মানবিক বোধের এক বিরল সংমিশ্রণ ছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে’ আজকের ভোগবাদী প্রজন্মের কাছে তাঁর মত ঋষিকল্প জীবন কেই বা কল্পনা করবে ! এই পর্বে তাঁরই কথা ।

জন্ম মহাবিদ্রোহের সাত বছর পরে, মৃত্যু স্বাধীনতার চার বছর আগে । অর্থাৎ আমাদের জাতীয়তাবাদের উন্মেষলগ্ন থেকে তার চরম প্রকাশের বিস্তীর্ণ সময়টাই তাঁর জীবনকাল । তিনি উনিশ শতকের বাংলার বুদ্ধির জাগরণকালের বিশিষ্ট কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব – রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় । সেই সময়টা কথা ভাবা যাক । বাংলার সারস্বতভূমিতে নক্ষত্রের কি আলোকদূতি – জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কামিনী রায়, অবলা বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন । বাংলার সারস্বতভুমির সে এক মহা সৃজনকাল । অন্যদিকে জাতীয়য়াবাদী চেতনার বিকাশ । এই আবহে তাঁর জন্ম । তিনি ভারতের সাংবাদিকতা ও পত্রিকা সম্পাদনার হিমালয়প্রতীম ব্যক্তিত্ব রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ।

শুধু সাংবাদিক বা ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ণ রিভিউ’ পত্রিকা সম্পাদক বললে কিংবদন্তীতুল্য রামানন্দ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না ।  রবীন্দ্রনাথ সবুজ পত্র পত্রিকায় লিখেছিলেন “সুদীর্ঘকাল আমার ব্রত যাপনে আমি কেবল যে অর্থহীন ছিলেম তা নয়, সঙ্গহীন ছিলেম ; ভিতরে বাহিরে বিরুদ্ধতা ও অভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণ একা সংগ্রাম করে এসেছি । এমন অবস্থায় যাঁরা আমার এই দুর্গম পথে ক্ষণে ক্ষণে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছেন, তাঁরা আমার রক্তসম্পর্কগত আত্মীয়ের চেয়ে কম আত্মীয় নন, বরঞ্চ বেশি । বস্তুত আমার জীবনের লক্ষ্যকে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার দৈহিক জীবনকেও সেই পরিমানে আশ্রয় দান করেছেন । সেই আমার অল্প সংখ্যক কর্মসুহৃদদের মধ্যে ‘প্রবাসী’ সম্পাদক অন্যতম । আজ আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি” । এহেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল । ‘নটীর পূজা’ প্রবাসীকে না দিয়ে মাসিক বসুমতীকে দেওয়ার কারণে রামানন্দ ব্যথিত হয়েছিলেন । প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন “আপনি  অতঃপর আমাকে বাংলা ও ইংরাজি কোন লেখা দিবেন না । ‘বিচিত্রা’ ও ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে ঐ দুটি পত্রিকার সঙ্গে, কিছুটা পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে । অভিমানাহত রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে লেখেন “ আমি আপনার লেখা হইতে বঞ্চিত থাকিবার প্রতিজ্ঞা করিলাম …… ‘মডার্ণ রিভিউ’এর জন্যও অনুগ্রহ করিয়া অতঃপর আমাকে কোন লেখা দিবেন না” ।

রামানন্দর কর্মজীবন ছিল বহুধা বিস্তৃত – শিক্ষকতা, পত্রিকা সম্পাদনা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রচার  ও স্বাদেশিকতা । রামানন্দর শিক্ষকতা কিংবা সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে তাঁর সাহিত্য-গবেষণা কীর্তি তার সাংবাদিক ও পত্রিকা সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে থেকে গেছে । তাঁর রচিত-অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আরব্যোপন্যাস,রাজা রবি বর্মার জীবনী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ,সচিত্র অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত,টুওয়ার্ডস হোম রুল, রামমোহন রায় অ্যান্ড মডার্ন ইন্ডিয়া, দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর ইত্যাদি ।

উনিশ শতকের নবজাগরণ কালে কেশবচন্দ সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী সহ ব্রহ্মসমাজের অনেকেই পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । জ্ঞান-বিদ্যা চর্চা, সমাজ সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে এই সব পত্রিকা প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল । রামানন্দর সামনে সেই আদর্শ ছিল । শিবনাথ শাস্ত্রী প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক হেরম্বচন্দ্র মৈত্র ছিলেন রামানন্দের শিক্ষক । তিনি রামনন্দকে ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জারের সহ-সম্পাদক পদে আহ্বান করলেন । এখানে রামানন্দ লেখালেখি করতেন । ১৮৯১এর মাঝামাঝি কিছু ব্রাহ্ম হিতসাধক তরুণ নিরন্ন পীড়িত মানুষের সেবাব্রতের আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন ‘দাসাশ্রম’ নামে এক সেবাপ্রতিষ্ঠান । রামানন্দও ছিলেন সেই তরুণ দলে । ১৮৯২এ রামানন্দ বের করলেন তাদের সেবাপ্রতিষ্ঠানের মুখপত্র ‘দাসী’ । তাঁর সম্পাদনা গুণে ‘দাসী’ শুধুমাত্র সেবাপ্রতিষ্ঠানের মুখপত্র হয়েই থাকলো না, সেকালের সাহিত্য সাধকদের আকর্ষণ করে আর সমকালীন সামাজিক ঘটনাবলীর প্রকাশ করে পত্রিকাটিকে বিশিষ্ট মর্যাদা দান করেছিলেন রামানন্দ । একথাও বলা হয় যে ‘দাসী’ই হল ‘প্রবাসী’র সূতিকাগৃহ, যে প্রবাসী রামানন্দকে কিংবদন্তী করেছিল । একই সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে ‘সাধনা’ পত্রকা প্রকাশ হতে থাকে যার মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । পত্রিকাটির চতুর্থ বর্ষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন । কিন্তু তা সত্বেও ‘সাধনা’ চারবছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় ১৮৯৫তে ।

পরের বছরে রামানন্দ ‘দাসী’ পত্রিকার দায়িত্ব ত্যাগ করে প্রকাশ করেন ‘প্রদীপ’ পত্রিকা পৌষ ১৮৯৬ তে । ‘প্রদীপ’ পত্রিকায় রামানন্দ গল্প, কবিতার সঙ্গে  ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান – জ্ঞানবিদ্যার সবকটি বিষয়ই আশ্রয় পেলো সে পত্রিকায় । পত্রিকার সূচনায় সম্পাদক রামানন্দ লিখেছিলেন “শিক্ষা ও চিত্ত বিনোদন উভয়ের যথযথ সংমিশ্রনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আমরা ‘প্রদীপ’ সম্পাদনা ও পরিচালনার চেষ্টা করিব” । এবং রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্ররচনার প্রকাশের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিলেন রামানন্দ ‘প্রদীপ’ পত্রিকা থেকেই । ১৯০১এ তিনি ‘প্রদীপ’এর সম্পাদনার দায়িত্ব ত্যাগ করে এপ্রিল ১৯০১ থেকে প্রকাশ করেন ‘প্রবাসী’ এবং তার সাত বছর পরে ইংরাজি পত্রিকা ‘মডার্ণ রিভিউ’ । ‘প্রবাসীর’ প্রকাশকালে তিনি এলাহাবাদে কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত । প্রবাস থেকে পত্রিকার আত্মপ্রকাশ বলে নাম দিয়েছিলেন ‘প্রবাসী’ ।

‘প্রবাসী’ হয়ে উঠেছিল বাঙালি সমাজের প্রতিনিধি স্বরূপ পত্রিকা । প্রবাসীতে লিখতেন সে যুগের প্রায় সমস্ত সাহিত্যি, প্রাবন্ধিকরা । প্রবাসী প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে রামানন্দ বলেছিলেন (১) প্রথম শ্রেণির লেখকদের রচনাসম্ভারের নিয়মিত প্রকাশ, (২) প্রত্যেক লেখককে সামান্য হলেও কিছু সম্মান দক্ষিণা দেওয়ার রীতি প্রবর্তন করা এবং (৩) সর্বোপরি পত্রিকাকে স্বদেশীভাব ও ভাবনা প্রচারের বাহন করে তোলা । এই উদ্দেশ্য থেকে তিনি কোনদিন সরে যাননি । কে না লিখেছেন প্রবাসীতে ? জগদীশচন্দ্র বসু, স্বর্ণকুমারী দেবী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, জলধর সেন, রাজশেখর বসু, সজনীকান্ত দাস, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, মেঘনাদ সাহা, জগদানন্দ রায় প্রমুখ এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এপ্রিল ১৯০১ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে প্রকাশিত ‘প্রবাসী’ বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে প্রবাদ-প্রতীম হয়ে আছে । ১৯৪৩এ রামানন্দের মৃত্যুর পরেও প্রবাসীর কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু বেশীদিন চালানো সম্ভব হয়নি । বস্তুত রামানন্দের মৃত্যুএ সাথে ‘প্রবাসী’ যুগেরও অবসান হয় ।

রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশে রামানন্দ ছিলেন স্থিতধি । রবীন্দ্রনাথের গোরা, জীবনস্মৃতি, শেষের কবিতা, মুক্তধারা, রক্তকরবী, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, সত্যের আহবান, শিক্ষার মিলন, এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে শেষ জন্মদিনের অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’ পর্যন্ত সব প্রবন্ধাবলীর প্রকাশের স্থান ছিল ‘প্রবাসী’ । বস্তুত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামানন্দর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা শুধুই পত্রিকা সম্পাদক – লেখকের সম্পর্ক ছিল না, ছিল উভয়ের আত্মিক স্পম্পর্ক । ১৯১১ থেকে ১৯৩১ সময়কালে বিভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে কাটান । ১৯২৫এ রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে বিশ্বভারতীর অবৈতনিক অধ্যক্ষ্যও হয়েছিলেন অল্প সময়ের জন্য । রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে বলেছিলেন আপনি যদি সময়মত আমাকে ঘুস না দিতেন তাহলে কোন মতেই ‘গোরা’ লেখা হত না। নিতান্ত অতিষ্ঠ না হলে আমি অধিকাংশ বড় বা ছোট গল্প লিখতুম না’ । বলা বাহুল্য তাঁর অতিষ্ঠতা মানে লেখার জন্য রামানন্দের তাগাদা । এইভাবে তিনি লেখকদের কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিতেন । কলকাতা টাউন হলে রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিন পালনের উদ্যোক্তা ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসূ , আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় । রবীন্দ্র সম্মাননায় প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘গোল্ডেন বুক অফ টেগোর’ যেখানে লিখেছিলেন গান্ধীজি, জগদীশচন্দ্র বসু, রমারঁলা ও আইনস্টাইনের মত ব্যক্তিত্ব ।

আমরা জানি জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহে থাকাকালীন লালন ফকির এবং অন্যদের বাউল গান সংগ্রহ করেন। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে রামানন্দ ‘প্রবাসী’তে হারামণি নামে একটি বিভাগ চালু করেন যেখানে রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত বাউল গানগুলি স্বরলিপি সহ প্রকাশ হয়েছিল । গগন হরকরার আ্মি কোথায় পাবো তারে, আমার মেনের মানুষ যে রে’ সহ কুড়িটি বাউল গান প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল ।

প্রবাসীর প্রথম সংখ্যা থেকেই পত্রিকার পৃষ্ঠায় বহুবর্ণের চিত্র ও ভাস্কর্যের প্রকাশ প্রবাসীর বৈশিষ্ট্য ছিল । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বখ্যাত ছবি ‘সুজাতা ও বুদ্ধ’, ‘বজ্রমুকুট ও পদ্মাবতী, ‘বিরহী যক্ষ’, ‘ভারতমাতা’, ‘লঙ্কায় বন্দিনী সীতা’ ইত্যাদি প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল । মাসিক পত্রিকায় রঙ্গীন চিত্রের প্রকাশে রামানন্দই ছিলেন পথিকৃত । প্রবাসী পত্রিকার আর একটি বৈশিষ্ট্য রামানন্দ নির্মাণ করেছিলেন, তা হল বিজ্ঞান সম্পর্কিত লেখা, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও গবেষণার বৃত্তান্ত প্রকাশ ও তাদের চিন্তা-ভাবনার প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল প্রবাসী । রামানন্দর স্বদেশ প্রীতি ও জাতীয়তাবোধ তাঁকে এই কাজ করতে প্রেরণা দিয়েছিল । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার বহু মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রবাসীর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল । ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় রামানন্দ লিখেছিলন “ কেহ যদি জিজ্ঞাসা করেন এ বৎসর আমাদের দেশে সর্বপ্রধান স্বদেশী ঘটনা কি ঘটিয়াছে, আহা হইলে আমরা কি উত্তর দেবো ? … সর্বপ্রধান স্বদেশী ঘটনা বিজ্ঞানাচার্য জগিদীশচন্দ্র বসুর ‘উদ্ভিদের সাড়া’ (plant response) নামক গ্রন্থ প্রকাশ । লিখেছিলেন “আমাদের সর্বপ্রকার মানসিক শক্তি ইংরেজের চেয়ে কম, এই ধারণা যত বদ্ধমূল হইবে আমরা ততই রসাতলে যাইব । জ্ঞানে, মানসিক শক্তিতে আমরা যত স্বাধীন হইব, সেই প্রকারে আমাদের সর্বপ্রকার অন্যবিধ পরাধীনতা কমিয়া আসিবে । … আচার্য বসুর গ্রন্থকে কোন কোন ইংরেজ সমালোচক বিজ্ঞান জগতে বিপ্লব বা যুগান্তর সংঘটক বলিয়াছেন” । এই ছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের স্বাজাত্যবোধ । এই তীব্র দেশাভিমান থেকেই ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’এর পাতায় সকালীন ঘটনাবলীর ওপর সুস্পষ্ট ও নির্ভিক অভিমত ও তীক্ষ্ণ সমালোচনা প্রকাশ করতেন । স্পষ্টবাদী রামানন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মত ব্যক্তিত্বেরও কঠোর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি । রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট দিয়েছিল । প্রবাসীর পাতায় রামানন্দ তীব্র শ্লে্ষাত্মক সমালোচনায় লিখেছিলেন “যখন ইংলন্ডে তাঁহার ইংরাজি রচনা বাহির হইয়া গেল, তিনি নোবেল প্রাইজ পাইলেন, তখন ‘রূপান্তরিত’ রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাহিত্যাচার্য বলিয়া স্বীকৃত হইলেন । তখন আশুবাবুই ভাইস-চ্যান্সেলর” ।

রামানন্দ ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বা তাদের কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলি কখনোই ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হয়ে ওঠেনি । প্রবল স্বাদেশিকতাবোধসম্পন্ন রামানন্দ কখনোই সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতর গন্ডীতে আবদ্ধ থাকেননি । তাঁর ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় যেমন জওহরলাল নেহেরুর রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনই যায়গা পেয়েছিল স্বামী নিগমানন্দর আধ্ম্যাত্মিক লেখা ‘ঠাকুরের চিঠি’ । তিনি কংগ্রেসের অধিবেশনে উপস্থিত থাকতেন , জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী-চরমপন্থী মিলনের পক্ষে সওয়াল করতেন । ১৯৩৯এ সুরাটে নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন আবার ১৯৪১এ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণেরর বিরুদ্ধে বামপন্থী লেখক শিল্পীরা  যে জনমত সংগঠনে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সঙ্গেও ছিলেন তিনি । বামপন্থী তরুণ লেখক সোমেন চন্দ্রর হত্যার প্রতিবাদে ১৯৪২এ কলকাতায় যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক সম্মেলন হয়, সেই সম্মেলনে পৌরহিত্য করেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ।

১৯৪১এর অগস্টে পরম সুহৃদ রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন, আর দুবছর পরে অল্প কিছুদিন রোগ ভোগের পর, ছোট মেয়ে সীতা দেবীর বাড়িতে ১৯৪৩এর ৩০শে সেপ্টেম্বর, ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় নির্ভিক দেশপ্রেমিক কর্মযোগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ।

No comments