Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

‘তন্ত্রের দেবদেবী’

‘তন্ত্রের দেবদেবী’দেবতা যে মানুষ সৃষ্টি করেছে - এ কথা সকলে মেনে নাও নিতে পারেন, তবে মানুষই যে দেবতাদের সৃষ্টি করেছে এই তথ্য সম্পর্কে কোন মতবিরোধ হবার কথা নয়। দেবতা মানুষের ‘মূর্ত-কল্পনা’। দেবতার সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনের ভয়, ব…

 




‘তন্ত্রের দেবদেবী’

                                                                                                         

                                     

                                   

দেবতা যে মানুষ সৃষ্টি করেছে - এ কথা সকলে মেনে নাও নিতে পারেন, তবে মানুষই যে দেবতাদের সৃষ্টি করেছে এই তথ্য সম্পর্কে কোন মতবিরোধ হবার কথা নয়। দেবতা মানুষের ‘মূর্ত-কল্পনা’। দেবতার সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনের ভয়, বিস্ময় ও ভক্তি থেকে অর্থাৎ তাঁর মনের স্বভাবজ চিন্তাসূত্রে। কিন্তু দুই ধর্মের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলেও যে নতুন নতুন দেবতার সৃষ্টি হতে পারে, সেটা বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রশাস্ত্র প্রমাণ করে দিয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের ‘বজ্রযান’ তন্ত্রের আমলেই এই প্রতিযোগিতা প্রবলতম হয়ে দেখা দিয়েছিল। ইতিহাস বলে যে মোটামুটিভাবে দশম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সেই আমল ছিল। এর প্রধান কারণ হল সেকালের বাঙলার অপূর্ব ভাস্কর্য ও শিল্প। বজ্রযানের দেবতাদের মূর্তকল্পনা, পাথরে ও ধাতুতে যে পরম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিল, ইতিহাসে কদাচিৎ সেটার কোন তুলনা পাওয়া যায়। সেই সৌন্দর্যের কিছু কিছু নিদর্শন এখনো ‘কলকাতা’, ‘ঢাকা’, ‘রাজশাহী’ ও ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’-এর যাদুঘরে রয়েছে; আর রয়েছে ‘বিক্রমপুর’, ‘দিনাজপুর’ ও ‘কুমিল্লা’য়। সৌন্দর্যের এমন মূর্ত নিদর্শনগুলি গড়ে ওঠার ফলে হিন্দুতন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে বজ্রযান এগিয়ে গিয়েছিল, সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। কারণ এর ফলে যে বৌদ্ধতন্ত্রের দিকে সাধারণ মানুষ বেশি ঝুঁকে পড়েছিল আর বৌদ্ধবিহারে যে বেশি ভক্তের সমাবেশ হয়েছিল, সেই কথা সমকালীন পুঁথিতে পাওয়া যায়। শূন্য বা অমূর্ত দেবতার অমন মনোরম মূর্ত কল্পনার জন্য তখন বেশ উদ্ভট সাফাই গাওয়া হত। এর প্রমাণ রয়েছে ‘অদ্বয়বজ্র সংহিতা’য়; পুঁথিটি দশম শতকে লেখা হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, জৈনধর্মীদের মুখেও সেই একই সাফাই পাওয়া যায়। তাঁদের তীর্থঙ্করদের মূর্তিগুলি অমূর্তেরই স্মারক চিহ্ন। কিন্তু ‘যক্ষ-যক্ষিণী’গুলি কি? এ সম্পর্কে তাঁরা অবশ্য নিরুত্তর। নতুন নতুন দেবতার পরিকল্পনায় বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে ওই পাল্লা দেওয়াটা বহুদিন ধরে চলেছিল। যদি কোনো বৌদ্ধবিহারের পাশাপাশি সেই যুগে কোনো হিন্দু মন্দির থাকত, আর এমন একদল ভক্ত থাকত যাঁরা ওই দুটি জায়গাতেই যাতায়াত করতেন, তাহলে তাঁদের অবশ্যই অবাক লাগত। কারণ ওই সময়ে আজ যে দেবতাকে হিন্দু মন্দিরে দেখা যেত, পরের দিনই তাঁকে বৌদ্ধবিহারে দেখতে পাওয়া যেত! তবে হয়ত অন্য পোশাকে ও বৃত্তিগত বিভিন্নতার মধ্যে। আবার পরের দিন হয়ত বৌদ্ধমূর্তির অশোভন বৃত্তির কাহিনী হিন্দু মন্দিরে প্রকাশ পেত। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে এমনভাবে বহুবার দেবতাদের অদল বদল ঘটেছিল। কাজেই, আজও বৌদ্ধদেবতাদের মধ্যে পাওয়া যায় হিন্দুত্বের ছাপ, আবার হিন্দু দেবতাদের কারো কারো মধ্যে আবিষ্কৃত হয় বৌদ্ধ প্রেরণা। বৌদ্ধ দেবদেবীর কথা এখন পুরাবৃত্তের আওতায়। সেই সব দেবতাদের এখন আর বিশেষ কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না, তাই তাঁরা আর সাধারণ মানুষের কাছে জীবন্ত নন। কিন্তু হিন্দু দেবদেবীরা মানুষের কাছে আজও জাগ্রত; তাঁদের মূর্তিগুলিও মানুষের কাছে পরিচিত। আমাদের গৃহস্থালী ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে তাঁদের স্থানও বিশিষ্ট। বলা বাহুল্য যে, এই ক্ষুদ্র আলোচনার মধ্যে সকল দেবদেবীর কথা বলা সম্ভবপর নয়। একটি অধ্যায়ের মধ্যে একখানা পুরো পুঁথির তথ্য শেষ করা সম্ভবপর নয়। প্রথমে বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবদেবীদের কথা দিয়ে শুরু করা যাক।

‘তারা’ বৌদ্ধতন্ত্রের নামজাদা দেবী। তাঁকে ‘বোধিসত্ত্ব’ ‘অবলোকিতেশ্বরের পত্নী’ বলে গণ্য করা হয়। তাঁর অপর নাম ‘অষ্টমহাভয় তারা’। কোন কোন মহাভয় তিনি দূর করেন? ‘অগ্নিভয়’, ‘দস্যুভয়’, ‘বন্ধনভয়’, ‘মজ্জনভয়’ অর্থাৎ জলে ডোবার ভয় ইত্যাদি, এমন কি ‘সর্পভয়’ও। এই সব ভয় সেকালের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অতিশয় প্রত্যক্ষ ও সম্ভাব্য ছিল। তারাদেবীকে আবার ‘মৃত্যুবঞ্চনা তারা’ও বলা হত। ভাবা হত, তারাদেবীর পূজকের নাকি মৃত্যু নেই - তিনি অমর। তাঁর নিজের তো বটেই, এমন কি তাঁর পূজকেরও এত দাপট ছিল যে হিন্দুদের কোনো দেবতাই তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেন নি। এমন যে তারা দেবী, তাঁকে কে না মেনে পারেন? হিন্দুরা এখন সেই তারাদেবীকে নিজেদের তন্ত্রের ‘দশমহাবিদ্যা’র মধ্যে স্থান দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। শাক্ত ধর্মালম্বীরা বলেন, তারা ‘ব্রহ্মময়ী’। হয়ত এ জন্যই প্রসিদ্ধ শাস্ত্রকার ‘নীলকণ্ঠ’ বলেছিলেন, শক্তিপূজা মায়ার আবরণে ঘেরা ব্রহ্মেরই পূজা। তারাদেবীর পুনরায় দর্শন পাওয়া যায় হিন্দু তন্ত্রশাস্ত্রের দশমহাবিদ্যার কথায়।

বৌদ্ধ বজ্রযানের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় দেবতা হলেন ‘লোকেশ্বর’ বা অব ‘লোকিতেশ্বর’। তিনি ‘বোধিসত্ত্ব’ অর্থাৎ তিনি তখনো ‘বুদ্ধত্ত্ব’ বা ‘নির্বাণ’ লাভ করেন নি; তবে ঠিক সেটার পূর্বাবস্থায় পৌঁছেছিলেন। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে উপনিষদের কাল থেকে হিন্দুরা দেবত্ব সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে চলছিল, বৌদ্ধেরাও সে মতেরই সমর্থক ছিলেন। এর কারণ হল, তাঁদের দেবদেবীরা তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিন্দু দেবদেবীদের প্রতিচ্ছায়া। সেই মতটি কি? সেটা হল, ‘দেবত্ব’ ক্ষণস্থায়ী; চিরস্থায়ী নয়, সেটা ‘ব্রহ্মত্ব’ নয়। দেবতাদের শক্তির তারতম্য রয়েছে, আর তাঁদের স্থানচ্যুতি ও পতনের সম্ভাবনাও রয়েছে।

বৌদ্ধ দেবতাদের মধ্যে ‘হেরুকা’ও সুপ্রসিদ্ধ। কয়েকজন বৌদ্ধ দেবী অমূর্তভাবের প্রতীক। যেমন, ‘একজটা’, ‘নৈরাত্ম্য’ প্রভৃতি। বৌদ্ধ দেবতা ‘মরীচি’ রথে চড়েন; তাঁর সেই রথ টানে সাতটি ‘বরাহ’ বা শূকর। হিন্দুদের ‘মার্তণ্ডের’ বা সূর্যের রথের মত সেই রথ ‘সপ্তাশ্ব’ নয়। মরীচির দোর্দণ্ড প্রতাপ; তাই সকল হিন্দুদেবতাও তাঁর স্তুতি করেন। মরীচিকে হিন্দুদের সূর্যদেবতার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতেই একই বলা চলে। তাঁদের নামের মধ্যে মিল বের করাও হয়ত অসম্ভব কিছু নয়। রামায়ণের বিখ্যাত স্বর্ণমৃগ মারীচ এক রাক্ষসের মায়ারূপ ছিলেন। মরীচিপুত্র ছিলেন ‘কশ্যপ’। আবার বহুপরিচিত সূর্যপ্রণামে রয়েছে “কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং”। কিন্তু সে সব তথ্য জোড়া দেওয়া গবেষকদের কাজ, লেখকের নয়। তাই অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। বৌদ্ধদের ষটকর্মের এককর্ম বশীকরণের অধিষ্ঠাত্রীদেবী হলেন ‘কুরুকুট্টা’। বিক্রমপুরের ‘বজ্রযোগিণী’ এখন ‘ছিন্নমস্তা’ নাম নিয়ে হিন্দু তন্ত্রের দশমহাবিদ্যার অন্যতমা। হিন্দুদের ‘গণপতি’ বা ‘গণেশ’ বৈদিক দেবগোষ্ঠীর দেবতা। তিনি হিন্দুদের ‘পঞ্চোপাসক’দের মধ্যে একজন পরম আরাধ্য দেবতা। গণপতি এখনো হিন্দুদের বাড়ীতে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ‘সর্বসিদ্ধিদাতা’ বলে পূজিত হন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মেও আছেন। তবে সেখানে তাঁর অবস্থানের বদল ঘটেছে। তাঁকে বৌদ্ধ দেবসভায় আসন দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র অবমাননা করার জন্য, সম্মাননার জন্য নয়।

বৌদ্ধ ও হিন্দু দেবসভার বিবরণ দাখিল করে এখানে কিছু কিছু মনোরঞ্জক গল্প সৃষ্টি করা চলে বটে, কিন্তু সেগুলো সাধারণজনের কাছে স্পষ্ট হবে না; কারণ বৌদ্ধ দেবসভা ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে সে-সব দেবতারা বহুকাল পূর্বে শূন্যে বিলীন হয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পরে অবশ্য হিন্দু দেবসভায় স্থান পেয়েছিলেন, যদিও ভিন্নরূপে। প্রথম যুগে সেই দেবতাদের পরিকল্পনায় বৌদ্ধপ্রভাব থাকলেও পরবর্তীকালে সে প্রভাবের চিহ্নমাত্র ছিল না। পুরাবৃত্তের পাতা থেকে বৌদ্ধদের দেবদেবীর আকার, প্রকার, কার্যকলাপ ইত্যাদি উদ্ধৃত করার প্রয়োজন এখানে নেই। তাই এখন তান্ত্রিক দেবদেবীদের মধ্যে যাঁরা আমাদের বহু পরিচিত, তাঁদের সম্বন্ধে কিছু বলাই বাঞ্চনীয়।

তাঁদের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাঙলায়, যিনি সর্বাপেক্ষা জীবন্ত ও ভয়ঙ্কর হয়েও নিতান্ত আপনজন বলে গণ্য হন, তিনি হলেন ‘দেবী কালিকা’। কলকাতার কালীঘাটের কালী ভারতবিখ্যাত দেবী। রক্ষাকর্ত্রীরূপে তাঁর মাহাত্ম্য অতুলনীয়। সারা ভারতবর্ষে এমন কোনো স্থান নেই যেখান থেকে তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে গিয়ে কালীদর্শন করে তাঁর কাছে নিজের নিজের প্রার্থনা জানান না। সিদ্ধপুরুষ শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের ইষ্টদেবী দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীও বহুবিশ্রুত। সমস্যা হল, দেবী কালিকার প্রথম পরিকল্পনা বৌদ্ধদের ছিল, নাকি ভারতবর্ষের আদিবাসীদের মধ্যে থেকে শুরু হয়েছিল, সেটা নিয়ে আজও নিয়ে মতদ্বৈধ রয়েছে। কিন্তু তিনি যে কোন হিন্দুর ঘরে জন্মান নি, সে তথ্য স্পষ্ট। কারণ দেবী কালিকা ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত’ ‘চণ্ডী’রই রোষ-সংস্করণ অর্থাৎ চণ্ডীদেবীর ক্রোধজাত নবরূপ। কিন্তু চণ্ডীদেবী নিজেই তো ‘বিন্ধ্যবাসিনী শবরী’, অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিবাসী শবর জাতির ইষ্টদেবতা। ‘মহাযানী বৌদ্ধেরা’ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে শবরীকে তাঁরা শবরদের গৃহেই পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের কাছে তিনি দু’জন ধ্যানী বুদ্ধজাত - তাঁদের একজন হলেন ‘অক্ষোভ্য’, অন্যজন হলেন ‘অমোঘসিদ্ধি’। কিন্তু বৌদ্ধদের দাবি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি, আরো কিছু বাকি রয়েছে। ‘অশ্বঘোষ’ লিখিত ‘বুদ্ধচরিত’ একটি নামকরা প্রামাণিক ঐতিহাসিক পুঁথি। অশ্বঘোষের কাল ছিল খ্রীস্টিয় প্রথম শতক অর্থাৎ বুদ্ধদেবের তিরোধানের পাঁচ বা ছ’শো বছর পরে। সেই পুঁথিটি চীনা ভাষাতেও অনূদিত হয়েছিল। সেই অনুবাদে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা থেকে মনে হয় যে, ভগবান বুদ্ধেরও কালী-দর্শন ঘটেছিল, তবে সেখানে তাঁর কার্যকলাপ ছিল ভিন্নতর। বুদ্ধের সেই কালীদর্শনের চিত্রটি হল - ‘বোধিদ্রুমে’র নিচে ভগবান বুদ্ধ ধ্যানে নির্বাণ বা বুদ্ধত্বলাভের জন্য বসেছিলেন। তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য এসেছিলেন ‘মার’ অর্থাৎ যে দেবতা সে-সব কাজে পটু ছিলেন (‘মার’-এর আভিধানিক অর্থ ‘কামদেব’ও বটে)। তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একজন নারীকে; তাঁর নাম ‘মা-কিয়া-কালী’ (হয়ত ‘মেঘকালী’ বা ‘মহাকালী’); মহাকালীর হাতে ‘খর্পর’ অর্থাৎ মাথার খুলি। তিনি এসে বোধিসত্ত্বের ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়েছিলেন; তারপরে নানা ছলাকলা দিয়ে তাঁকে কামমোহিত করবার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চেষ্টা নিষ্ফল হতেই মার তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের ‘ত্রিশূলাদি’ দিয়ে বোধিসত্ত্বকে আক্রমণ করবার অনুমতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মহাকালীর কার্যকলাপ সেখানে স্বর্গের অপ্সরা ‘ঊর্বশী’, ‘মেনকা’, ‘রম্ভা’ প্রমুখের পর্যায়ের ছিল। যাই হোক, বিদ্বজ্জনেরা অনুমান করেন যে, ‘ত্রিশূলধারী শিব’ ও ‘খর্পরধারিণী শিবশক্তি বা কালী’ অশ্বঘোষের কালেও সুপরিচিত ছিলেন। বৌদ্ধতন্ত্রই হয়ত কালীকে তাঁর স্থায়ী আসন দিয়েছে। বৌদ্ধদের হাতে পড়ে, ‘মহাকালী’ বা কালীই ‘তারা’ রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন; পরে শাক্তদের দলে ভিড়ে ‘তারা’ হয়েছিলেন ‘ব্রহ্মময়ী’। এ-সব রহস্য সমাধানের ভার অভিজ্ঞদের হাতে তুলে দিয়ে দেবী কালিকার আখ্যানে মনোনিবেশ করাই উচিত হবে।

বাংলা ও বাংলার বাইরে বহু জায়গাতেই বিভিন্ন নামে দেবী কালিকার পূজা হয়। কিন্তু যে নামেই তাঁর মূর্তি গড়া হোক না কেন, সেগুলো সবই ভয়ঙ্করী ও বিভীষিকাময়ী। দেবী কালিকা সর্বত্রই ধ্বংসের বা প্রলয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর মূর্তি গড়া হয় মাটি, পাথর বা কোনো ধাতু দিয়ে। নিত্য পূজার জন্য দেবী স্থাপিত হন মন্দিরে আর দেবীর কুলপূজা ও মানত পূজা করা হয় বৃক্ষতলে, নাটমন্দিরে বা সাময়িক পটাবাসে। যে যে বিভিন্নরূপে ও নামে দেবী কালিকার পূজা হয় সেটার একটা মোটামুটি তালিকা এরকম - (১) ‘দক্ষিণাকালী’, (২) ‘সিদ্ধকালী’, (৩) ‘গুহ্যকালী’, (৪) ‘ভদ্রকালী’, (৫) ‘শ্মশানকালী’, (৬) ‘রক্ষাকালী’, ‘মহাকালী’, (এই ছয়টির পরে ‘উগ্রকালী’ ও ‘চামুণ্ডাকালী’র উল্লেখসহ ‘অষ্টবিধ কালী মূর্তির পূজা’ একাধিক তন্ত্রে বিহিত হয়েছে) (৭) ‘দেওয়ালী’ (৮) ‘রটন্তী’, (৯) ‘ফলাহারিণী কালী’। এঁদের মধ্যে বর ও অভয়দায়িনী বলে ‘দক্ষিণাকালী’ই সর্বাধিক জনপ্রিয়। কেউ কেউ বলেন যে, তিনি তাঁর ডান পা আগে বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বলে তাঁকে ‘দক্ষিণা’ বলা হয়; কেউ কেউ বলেন যে তিনি কল্যাণময়ী অনুকূল ও দাক্ষিণ্যযুক্ত বলে তাঁর এই নাম হয়েছে। তিনি ভীষণ দর্শনা; তবে তাঁকে দেখে দেখে আমরা নিতান্ত অভ্যস্ত বলে আমাদের কাছে তাঁর সেই ভয়ঙ্করী মূর্তি ততটা প্রকট হয় না বটে, কিন্তু যাঁরাই সেই মূর্তি প্রথম দেখবেন, তাঁরা সবাই নিশ্চয়ই ভাববেন, দেবীর একি বিকট রূপ! কিন্তু ভুললে চলবে না যে, কালী বিশ্বপ্রকৃতির সংহার-মূর্তি; তিনি ভূমিকম্প, প্রবল ঝড়, বা মহামারীর মতই প্রলয়ঙ্কর। তাঁর গায়ের রং দুর্যোগের মেঘের মতই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। তাঁর গলায় নরমুণ্ডমালা, দেহের অন্যত্রও সেই একই অলঙ্কার; শবের অঙ্গবিশেষ তাঁর কর্ণাভরণ, তাঁর মেখলা বা কোমরের অলঙ্কার মৃতদেহের হাত দিয়ে তৈরী। তাঁর চারটি হাত; দুটি ডান, দুটি বাঁ। দুটি বাঁ হাতের একটিতে সদ্যো নিহত মানুষের বা দানবের মাথা, অন্যটিতে রক্তাক্ত খড়্গ। দুটি ডান হাতের একটির ভঙ্গী বরদানের অন্যটির অভয় দানের। তাঁর মুখের দু’দিক থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে; মনে হয় যেন এখনই রক্তপান করে উঠলেন! তিনি শ্মশানবাসিনী। তাঁর তিনটি চোখ, সেগুলো এত উজ্জ্বল যে সেগুলোর সঙ্গে কেবলমাত্র নবোদিত সূর্যের তুলনা করা চলে। তিনি ‘করাল-বদনা’ ও ‘দন্তরা’, অর্থাৎ প্রকাণ্ড ও বিকট তাঁর দাঁত। স্তনদ্বয় উন্নত ও নিতান্ত স্থূল। তিনি বিবসনা; মহাকাল বা শিবের দেহের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর চারদিকে চিৎকারের ভঙ্গীতে মুখ ব্যাদান করে রয়েছে অসংখ্য ‘শিবা’ বা শৃগালী। এই ভয়ঙ্করী মূর্তিতেই তিনি আমাদের মানসপটে গেঁথে রয়েছেন। অথচ এই ভীমা সংহার-মূর্তিতেই তিনি সারা পূর্বাঞ্চলে সর্বাপেক্ষা কল্যাণময়ী দেবী বলে পূজিতা। কিন্তু যে রূপে আমরা এখন তাঁর পূজা করি, সেটি তাঁর আদিম রূপ নয়। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণের’ ‘দেবীমাহাত্ম্যে’ তাঁর যে রূপ বর্ণনা রয়েছে তার সঙ্গে আধুনিক রূপের গরমিল রয়েছে। কি সেই আদিম রূপ? ‘মার্কণ্ডেয়পুরাণ’ বলছে -


“ততঃ কোপং চকারোচ্চৈরম্বিকা তানরীন্ প্রতি।

কোপেন তস্যা বদনং মসীবর্ণমভূত্তদা॥

ভ্রূকুটীকুটিলাত্তস্যা ললাটফলকাদ্ দ্রুতং।

কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিধারিণী॥”


‘চণ্ড’ ও ‘মুণ্ড’ - এই দুটি অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে দেবী চণ্ডীর মুখ রোষে রক্তবর্ণ ও ভ্রূকুটি-কুটিল হল। তাঁর ললাট অর্থাৎ কপাল থেকে বেরিয়ে এল এক মহাশক্তি - তিনিই কালী। তাঁর হাতে তাঁর খড়্গ, পাশ ও গদা। তাঁর পরনে বাঘের চামড়া আর গলায় অলঙ্কাররূপে নরমুণ্ডের মালা। তাঁর চোখ রক্তবর্ণ ও কোটরগত, জিহ্বা লোল, লকলকে অর্থাৎ এদিক থেকে ওদিকে ঘুরছে। তাঁর অট্টহাসি চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের পরবর্তীকালে রচিত ‘কালিকা পুরাণের’ মতে দেবী ‘দুর্গা’ বা ‘সতী’ই পরজন্মে কালীরূপে ‘শিবশক্তি’ হয়েছিলেন। বর্তমানে এটা প্রায় সর্বজন-স্বীকৃত যে দেবী কালিকার এই আধুনিক রূপ ‘কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ’ সৃষ্ট। এই রূপটি তাঁর ধ্যানলব্ধ বলে কথিত। তাঁর কাল, অর্থাৎ মোটামুটিভাবে পঞ্চদশ শতকের চতুর্থ পাদ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যকাল পর্যন্ত; অনেকে বলেন, ১৪৮৫ সাল থেকে ১৫৩৩ সাল পর্যন্ত ছিল। সেই হিসেবে প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে দেবী কালিকার এই আধুনিক রূপের ধ্যান আমরা করছি। আগমবাগীশের লেখা প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ‘তন্ত্রসার’; তাতে তিনি অতল তন্ত্রসাগর খুঁজে খুঁজে ডুবুরীর মত নানা মণিমুক্তা সংগ্রহ করে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে তন্ত্রসার তন্ত্র চর্চার জন্য একটি অতি মূল্যবান প্রামাণিক পুথি; তান্ত্রিকদের পক্ষে বা তন্ত্র চর্চাকারীদের জন্য সেটি নিত্য প্রয়োজনীয়। সেই পুঁথিতে ‘কালীতন্ত্রের’ উল্লেখ করে আগমবাগীশ দেবী কালিকার আধুনিক রূপের কথাই উল্লেখ করেছিলেন - “করালবদনাং ঘোরাং … চতুর্ভুজাং, মুণ্ডমালা বিভূষিতাং, মহামেঘ প্রভাং শ্যামাং, পীনোন্নত পয়োধরাং, শ্মশানালয়বাসিনীং, কালী সর্বকাম সমৃদ্ধিদাম্।” এখানে শুধু কালীর ‘বীজন্যাসের’ বা ‘প্রাণায়ামাদি’সহ ধ্যানগম্য রূপের কাঠামোর কথাই বলা হল; আগে যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে তা এই ন্যাসেরই হুবহু প্রতিকৃতি। মহামারী থেকে রক্ষা পাবার জন্য সর্বজনীন ‘রক্ষাকালী’ ও ‘শ্মশানকালী’র পূজা করা হয়। ‘রটন্তী’ পূজা হয় মাঘ মাসে আর ‘দেওয়ালী’ পূজা হয় দুর্গাপূজার পরবর্তী প্রথম কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। দেওয়ালীর প্রচলন খুব বেশি দিন আগে ঘটেনি। কিংবদন্তী রয়েছে যে, নদীয়ার মহারাজা ‘কৃষ্ণচন্দ্রের’ আদেশে সেই পূজা বঙ্গদেশে চালু হয়েছিল; এই কথা ঠিক হলে সেটা মাত্র দু’শো-আড়াইশো বছরের কথা। ‘ফলাহারিণী’ পূজা হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। শনি ও মঙ্গলবার দেবীপূজার পক্ষে প্রশস্ত। সাধারণতঃ মধ্য রাত্রে পূজায় বসতে হয়। তন্ত্রসারে উদ্ধৃত কালীতন্ত্র মতে বাঙলার নিজস্ব পূজার পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। এই দেবীপূজায় পশুবলি প্রায় অপরিহার্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কুলবিধানকে মান্য করে, পশুর বদলে অন্য কিছু বলি দেওয়া হয়। পশুবলিতে প্রশস্ত হল মোষ ও ছাগ; তবে শেষেরটিকেই এখন প্রায় একমাত্র বলির পশু বলা চলে। হিন্দু তন্ত্রমতে দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা হলেন কালী। তারপরে রয়েছেন - ‘তারা’, ‘ষোড়শী’, ‘ভুবনেশ্বরী’, ‘ভৈরবী’, ‘ছিন্নমস্তা’, ‘বগলা’, ‘ধূমাবতী’, ‘মাতঙ্গী’, ‘কমলা’ বা ‘ত্রিপুরসুন্দরী’। তাঁরা সবাই তন্ত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তাই এই সিদ্ধিদাত্রীদের সম্পর্কে কিছু কিছু কথা বলবার প্রয়োজন রয়েছে।

বৌদ্ধদের তারা ও হিন্দুদের কালীমূর্তির মধ্যে বিশেষ কোনো প্রভেদ নেই। তবে বৌদ্ধ তারা-দেবী ‘দিগম্বরী’ নন; তাঁর পরনে ‘বাঘের চামড়া’ থাকে। এছাড়াও তাঁদের মধ্যে আরো বেশ কিছু প্রভেদ রয়েছে। দশমহাবিদ্যার ‘তারা’ বা ‘তারিণী’ দেবীকে ‘নীলসরস্বতী’ও বলা হয়। কারণ তিনি বাকশক্তি দেন। তিনি উগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন বলে তাঁকে ‘উগ্রতারা’ও বলা হয়। তিনিও শ্মশানবাসিনী, শিবরূপী শবের ওপরে দণ্ডায়মানা, ত্রিনয়নী। তাঁর তিনটি চোখই প্রস্ফুটিত ইন্দীবর বা সদ্য ফোটা নীলপদ্মের মত। তাঁর বর্ণ শ্যাম, নরের মুণ্ডমালাই তাঁর ভূষণ, এমনকি কেশের শোভাবর্দ্ধনেও সেগুলোকেই তিনি ব্যবহার করেন। তিনিও চতুর্ভুজা; তাঁর দুটি ডান হাতে রয়েছে খড়্গ, বাঁ হাতের একটিতে খর্পর, অন্যটিতে একটি সদ্য ফোটা পদ্ম। তিনি ভীমা হলেও, করালবদনা নন, তাঁর মুখের দু’ধার দিয়ে রক্তও ঝরে না। কালীর উন্মত্ততা তাঁর মধ্যে নেই। তিনি রাজদ্বারে, সভাতে, বিবাদে ও বাণিজ্যে - সর্বকর্মেই জয়ী করেন। তাঁর পূজা হয় শশ্মশানে, শূন্যালয়ে, চতুষ্পথে অর্থাৎ চৌরাস্তায়, শবাসনে, মুণ্ডাসনে, আকণ্ঠ সলিলে, রণভূমিতে, যোনিতে ও বিজন বনে। তবে তাঁর পূজার জন্য সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত স্থান হল ‘একলিঙ্গ শিবমন্দির’। ‘একলিঙ্গ’ কাকে বলে? যেখানে পঞ্চক্রোশের মধ্যে একটি ছাড়া দ্বিতীয় কোন শিবলিঙ্গ থাকে না, তাঁর-ই নাম একলিঙ্গ।

মহাবিদ্যা ‘ষোড়শী’র ধ্যানরূপ হল -


“বালার্কমণ্ডলাভাসাং চতুৰ্বাহুং ত্রিলোচনাম।

পাশাঙ্কুশ শরাংশ্চাপং ধারয়ন্তীং শিবাংশ্রয়ে॥”


তাঁর প্রভা নবোদিত সূর্যের মত। তাঁর চারটি হাত; হাতে রয়েছে পাশ অর্থাৎ বন্ধনাস্ত্র, অঙ্কুশ অর্থাৎ ডাঙ্গশ, তীর ও ধনু। তিনিও ত্রিনয়নী - শিবের নাভিকমলের ওপরে তিনি বসে রয়েছেন। ইনি আলুলায়িতা কুন্তলা অর্থাৎ মুক্তকেশী, তরুণী, ও রূপসী। তাঁর গলায় সুশোভন হার ও মাথায় স্বর্ণমুকুট।

রত্ন-সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা, বহু রত্নভূষণে ভূষিতা ‘ভুবনেশ্বরী’ রূপে ও ঐশ্বর্যে সত্যি ভুবনেশ্বরী। তিনি রক্তবর্ণা, মুকুটধারিণী ত্রিভুবনের অধীশ্বরীরূপে রক্তকমলের ওপরে নিজের ডান পা রেখে, বাঁ পা রেখেছেন নিজের ডান ঊরুতে। তাঁরও চারটি হাত, চোখ তিনটি। ডান হাতে বর ও অভয় মুদ্রা, বাঁ হাত দুটিতে পাশ ও অঙ্কুশ। ভুবনেশ্বরী সর্ব ঐশ্বর্য ও পরম শক্তিদায়িনী।

ভুবনেশ্বরীর সাথে ‘ভৈরবী’ মূর্তির পরম সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি ‘উদ্ভানুসহস্রকান্তিমরুণক্ষৌমাং’ ‘রক্তালিপ্তপয়োধরাম্’। তিনি বসেছেন পদ্মের ওপরে, পদ্মে ডান পা-টি রেখে, ঠিক ভুবনেশ্বরীর ভঙ্গীতে। তিনিও ত্রিনয়না; তাঁর চোখগুলি অতুলনীয় সুন্দর। প্রভায় তিনি ষোড়শীকেও হার মানান। তাঁর পরনে থাকে ‘ক্ষৌমবাস’ অর্থাৎ ‘রেশমি বস্ত্র’ বা ‘তিসির ছাল থেকে তৈরী কাপড়’। তাঁর পয়োধরে রক্তের দাগ; রত্নালঙ্কারে তিনি ভুবনেশ্বরীর সমকক্ষ। তাঁরও চারটি হাত; হাতে কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই - রয়েছে জপের মালা ও কাপড়। তিনিও মুক্তকেশী, রত্নমুকুটধারিণী, ও পদ্মবনবাসিনী। ভুবনেশ্বরীর গলায় কোন মুণ্ডমালা নেই, তাঁর রয়েছে।

‘ছিন্নমস্তা’ নামটি এসেছে ছিন্ন মস্তক বা মাথা থেকে। রূপকল্পনায় এ দেবীটি অত্যদ্ভুত; তিনি নিজের হাতে নিজের মাথা কেটে রক্তপান করছেন! এদিক থেকে তিনি অনন্যা। তিনি জাতে বৌদ্ধ, কিন্তু পরিচয়ে হিন্দু। তিনি ‘প্রত্যালীঢ়পদা’ অর্থাৎ তাঁর বাঁ পা প্রসারিত আর ডান পা সংকুচিত। তাঁর দুটি হাত; একটিতে ধরেছেন নিজের কাটামুণ্ড অন্যটিতে খড়্গ। তিনি বিবসনা। নিজের গলদেশ থেকে যে রক্তধারা ঝয়ছে তা পান করছেন তিনি নিজেই, তাঁর ছিন্ন মস্তকের মুখ দিয়ে। একই সাথে সে রক্তপান করছেন তাঁর দু’জন সঙ্গিনী। তাঁদের একজনের নাম ‘বর্ণিনী’, অন্যজনের নাম ‘ডাকিনী’। বর্ণিনী রয়েছেন দেবীর ডানদিকে; তাঁর কেশ আলুলায়িতা, এক হাতে খর্পর, অন্য হাতে খড়্গ। তিনি বিবসনা। দেবীর বাঁ দিকে রয়েছেন ডাকিনী। তিনিও কৃষ্ণবর্ণা, মুক্তকেশী ও বিবসনা। তাঁরও হাতে খর্পর ও খড়্গ। প্রলয়ের কালে তিনি সমগ্র বিশ্বজগৎ অনায়াসে গ্রাস করতে পারেন - এমনি তাঁর শক্তি। দেবীর গায়ের রং জবাফুলের মত লাল। তাঁর মাথায় (অর্থাৎ ছিন্নশিরে) সর্পাবদ্ধ মণি, তিনটি চোখ, গলায় পদ্মের মালা। তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন ‘মদন’ (কামদেব) ও ‘রতি’ - এই দম্পতির ওপরে। তাঁরা শায়িত রয়েছেন একটি ফোটা পদ্মের মধ্যে। বর্ণিনী ও ডাকিনী দাঁড়িয়েছেন সেই পদ্মটিরই দুটি পাঁপড়ির ওপরে।

মুক্তকেশী দেবী ‘বগলামুখী’ শত্রু পরিপীড়নে ব্যস্ত। তিনি দ্বিভুজা; বাঁ হাতে শত্রুর জিহ্বা টেনে ধরেছেন আর ডান হাতে তাঁকে গদা দিয়ে আঘাত করছেন। তিনি রত্নসিংহাসনের ওপর বসে রয়েছেন। ‘পীতাম্বরাভরণমালা বিভূষিতাঙ্গীং’ অর্থাৎ তাঁর পরনে হলদে শাড়ি, মালায় বিভূষিত দেহ। তিনি ‘চলৎকনককুণ্ডলোল্লসিত চারুগণ্ডস্থলীং’ - তাঁর সুন্দর কপোল বা গাল সোনার দোদুল কর্ণাভরণে আরো শোভাময় হয়েছে। তিনি গৌরাঙ্গী, বিম্বাধরা অর্থাৎ তাঁর ঠোঁট পাকা তেলাকুচার মত লাল রঙয়ের। বগলামুখীর শরণ নিতে হয় কখন? চৌরসঙ্ঘে, প্রহরণ সময়ে, বন্ধনে, ব্যাধিতে, স্তম্ভনে, বিবাদে, রিপুবধসময়ে। তাঁর পূজার মন্ত্র ব্রহ্মাস্ত্রের মত অব্যর্থ - স্তম্ভনে অমোঘ, এমন কি সেই মন্ত্রে পবনেরও গতিরোধ করা চলে।

মহাবিদ্যা ‘ধূমাবতী’র চিত্রে পাওয়া যায় মহা ঐশ্বর্যময়ী দেবীদের ঠিক বিপরীত ছবি। তাঁর ধ্যানরূপ হল -


“বিবর্ণা, চঞ্চলা রুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা।

বিমুক্তকুন্তলা রূক্ষা বিধবা বিরলদ্বিজা॥ 

কাকধ্বজরথারূঢ়া বিলম্বিত পয়োধরা। 

সূর্পহস্তাতিরূক্ষাক্ষী ধৃতহস্তা বরান্বিতা॥

প্রবৃদ্ধঘোণা তু ভৃশং কুটিলা কুটিলেক্ষণা।

ক্ষুৎপিপাসার্দ্দিতা নিত্যং ভয়দা কলহপ্রিয়া॥”


সংক্ষেপে, তিনি মলিন, চঞ্চল, ক্রুদ্ধ, উগ্র, নিষ্ঠুর, স্বামিহীনা, বিগত-যৌবনা, খল-স্বভাবা, সদা ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর ও সর্বদা কলহে তাঁর অভিরুচি। ময়লা একখানা কাপড় পড়ে চড়েছেন রথে - সে রথের চূড়ায় বসে রয়েছে একটি কাক। তাঁর হাতে রয়েছে একখানি সূৰ্প অর্থাৎ কুলা! এ হেন ‘গুণশালিনী’ দেবীকে কি পরমাশক্তির প্রতীক বলে মানা যায়? হয়ত মনে দ্বিধা আসে। কিন্তু তিনি যে-মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, সেই মন্ত্রের ব্যবহার হয় শত্রুদলনে, উচ্চাটনে ও বিদ্বেষণে। হয়ত ষটকর্মের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে তাঁর রূপকল্পনা করা হয়েছে, কিন্তু কি কারণে তিনি মহাবিদ্যার দলে ঠাঁই পেয়েছেন তা বলা দুষ্কর। কেবলমাত্র এটাই বলা যায় যে, তিনি ‘তামসী শক্তির প্রতীক’।

ধ্যানরূপে ‘মাতঙ্গী’ বা ‘মাতঙ্গিনী’ দেবী হলেন -


“শ্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং

ত্রিনয়নাং রত্ন সিংহাসন স্থিতাং।

বেদৈর্ব্বাহুদগুৈরসি খেটক

পাশাঙ্কুশধরাম্॥”


দেবী মধ্যযৌবনা ও তপ্তকাঞ্চণবর্ণা, ত্রিনয়নী, রত্ন-সিংহাসনে বসে রয়েছেন। তাঁর চারটি হাত; হাতে অসি বা খড়্গ, খেটক বা দণ্ড, পাশ ও অঙ্কুশ। তাঁর সাধনায় সাধকের অগ্নিস্তম্ভন, জলস্তম্ভন ও বাক্যস্তম্ভনের শক্তি জন্মায়। বিবাদে, শাস্ত্রে ও কবিত্বে পরম অধিকার জন্মে। তাঁর পূজায় ভোগ্যদ্রব্যের মধ্যে মৎস্য, মাংস ও পায়েস সর্বশ্রেষ্ঠ।

মহাবিদ্যা ‘কমলা’ পদ্মবনের রানী। তাঁকে স্নান করাচ্ছে চারটি হাতি - তারা সোনার ঘড়াতে করে অমৃত নিয়ে এসেছে। তাঁর হাত চারটি, তাতে রয়েছে বর ও অভয় আর দুটি পদ্ম; কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই। তাঁর পরনে ক্ষৌম বসন, গায়ে অপূর্ব ও অসংখ্য রত্নালঙ্কার; পদ্মাসনে, পদ্মের ওপরে তিনি বসে রয়েছেন। সোনার মতই তাঁর দেহকান্তি। তাঁর সাধনায় সাধকের সম্পদ ও সৌভাগ্যবৃদ্ধি হয়। ‘শ্রী’ - এই একাক্ষর বীজই লক্ষ্মীদেবীর মন্ত্র ।

বৌদ্ধতন্ত্রের কালী, সরস্বতী ও ভদ্রাকালী - এই তিনটি দেবীই মহাদেবী তারার প্রতিচ্ছায়া। বঙ্গদেশে অধুনা যে সরস্বতী পূজা হয়, সেটা ঠিক পৌরাণিক সরস্বতীর পূজা নয়; সেটা অনেকটা তান্ত্রিক। এ মন্তব্যের একটি প্রধান কারণ সরস্বতী পূজার মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সেই মন্ত্রটি হল - “ওঁ সরস্বত্যৈ নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমোহনমঃ” - অর্থাৎ এখানে সরস্বতী ও ভদ্রকালীকে এক করে দেখা হচ্ছে। তন্ত্রমতে সরস্বতী “শুক্লাম্বরধরাং দেবীং শুক্লাভরণভূষিতাং” - তাঁর আভরণ ও ভূষণ সবই ধবল বা শুভ্র। দেবী পুস্তকহস্তা, হাস্যময়ী, ‘কুমতিধ্বান্তবিধ্বংসমীডো’, কবিদের সিদ্ধিদাতা। তাঁর অন্য নাম ‘ভারতী’। তন্ত্রমতে ‘সারস্বতকল্পে’র নামান্তর হল ‘বাগীশ্বরীপূজা’। বাগীশ্বরীর প্রভা সূর্যমণ্ডলের জ্যোতিঃপুঞ্জের মত। তাঁর হাতে বর ও অভয় মুদ্রা, তিনি পুস্তকধারিণী। তাঁর পূজায় জাড্য দূর হয়, মেধা বৃদ্ধি পায়; সাধক বাকসিদ্ধ ও কবিশ্রেষ্ঠ হন। শিব তন্ত্রের পরম দেবতা। তাঁর সঙ্গে বিষ্ণুও। মোটের ওপরে পঞ্চোপাসক হিন্দুকে, অর্থাৎ ‘বৈষ্ণব’, ‘শৈব’, ‘শাক্ত’, ‘সৌর’ ও ‘গাণপত্য’ উপাসক - সবাইকে ঘিরে রেখেছে তন্ত্র।

এখন বাঙলার প্রধান বার্ষিক পূজা অর্থাৎ শারদীয়া দুর্গা পূজার কথা বলে এই প্রসঙ্গের ছেদ টানা যাক। ‘দুর্গতিনাশিনী দুর্গা’রও জন্ম হয়েছিল বন্যদের ঘরে; সেই বন্যদের নাম ছিল ‘শবর’, ‘বর্বর’, ‘পুলিন্দ’ ইত্যাদি। মহাভারতের বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গার স্তব করেছিলেন। সেই স্তবটি যে হরিবংশ গ্রন্থে উদ্ধৃত আৰ্য্যা স্তবেরই রূপান্তর মাত্র তা প্রায় নিঃসন্দেহেই বলা চলে। সেই দুটি স্তবেই দেবী -


“শবরৈর্বর্বরৈশ্চৈব পুলিন্দৈশ্চ সুপূজিতা।”

“কুক্কুটৈশছাগলৈৰ্মেষৈঃ সিংহৈ বাঘ্ৰৈঃ সমাকুল।”

“সূরামাংস বলিপ্রিয়া।”


দেবী ‘বিন্ধ্যপর্বতে’ থাকেন; শবর, বর্বর, পুলিন্দ প্রভৃতি বহু (বা অনার্য) জাতিরা তাঁকে পূজা করেন। তাঁর বাসস্থানের আশপাশে থাকে কুক্কুটের অর্থাৎ মোরগ-মুরগীর দল, ছাগল, মেষ, সিংহ, বাঘ প্রভৃতি। দেবীর মাথায় ময়ূরের পাখা। দেবী অপর্ণা অর্থাৎ (ব্যাখ্যা বিশেষে) বিবসনা - গাছের পাতা বা ছালও তাঁর পরণে নেই। তিনি তিনটি নামে শবর জাতির ইষ্টদেবতা। সেই তিনটি নাম হল - ‘শবরী’, ‘পর্ণশবরী’ ও ‘নগ্নশবরী’। মদ, মাংস ও বলি - এই তিনটি দেবীর প্রিয় বস্তু। দেবী তাঁর সেবকদের যুদ্ধক্ষেত্রে, অগ্নিদাহে, নদীতীরে, কান্তারে, প্রবাসে, রাজরোষে, চোরের ভয় ও শত্রু ভয় থেকে রক্ষা করেন। বৌদ্ধেরা তাঁকে শুদ্ধ করে ‘পর্ণশবরী’ থেকে একেবারে দেবী ‘তারা’য় রূপান্তরিত করেছেন; অন্যদিকে হিন্দু পৌরাণিকেরা তাঁকে ‘চণ্ডী’রূপে নিজেদের পূজার বেদীতে বসিয়েছেন। ক্রমে দেবী তারা স্থান পেয়েছেন মহাবিদ্যার দলে আর দেবী চণ্ডী রূপান্তরিত হয়েছেন দেবী দুর্গায়। দু’য়েরই পূজা হয় পুরোপুরি তান্ত্রিক মতে; এমন কি, তন্ত্রদীক্ষা যাঁর হয়নি তিনি তারা বা দুর্গা পূজার কোনো কাজই করতে পারেন না, পূজা তো নয়-ই। বাংলায় শরৎকালে মহা জাঁকজমক করে দেবী দুর্গার পূজা হয়, বিশেষকরে বারোয়ারী পূজা। সেটা বাৎসরিক। তাই বলে যে তাঁর নিত্যপূজা কোথাও হয় না, তা কিন্তু নয়। সেটাও হয় গৃহস্থের ঠাকুরঘরে বা সর্বজনীন মন্দিরে। নানারূপে তাঁর পূজা হয় - ‘দুর্গা’, ‘নবদুর্গা’, ‘শূলিনী’, ‘বনদুর্গা’, ‘জয়দুর্গা’ ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে। আদিমরূপে দেবী দুর্গা চতুর্ভূজা। তিনি সিংহের পিঠে বসে রয়েছেন। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, ধনু ও বাণ। সর্বাঙ্গে তাঁর নানা অলঙ্কারের ছড়াছড়ি। শূলিনীর রং কালো, তাঁর হাত আটটি; হাতে রয়েছে শূল, বাণ, খড়্গ, চক্র, গদা, পদ্ম, ধনু ও পাশ। তিনি ত্রিময়না, কপালে অর্ধচন্দ্র। শত্রুদলনে তিনি ভয়ঙ্করী। তাঁর সঙ্গিনী চারজন - তাঁদের সবারই হাতে গদা বা কারো কারো মতে খড়্গ ও খেটক। রূপে বনদুর্গা ভয়ঙ্করী। তিনি মোটামুটি লৌকিকদেবী অর্থাৎ গ্রাম্যদেবী। তাঁর খ্যাতি আঞ্চলিক। বিবাহ প্রভৃতি শুভকার্যের পূর্বে মঙ্গলকামনায় তাঁর পূজা দেওয়া হয় - কোথাও মানতও থাকে। জয়দুর্গার পূজা বেশি প্রচলিত নয়। তাঁর পূজা-প্রণালী শবর-গন্ধী। তাঁর পূজার সঙ্গে যোগ রয়েছে নগ্ন নৃত্যের, এমনকি দেবীর প্রতি অশ্লীল বাক্য প্রয়োগের রীতিও রয়েছে! দেবীর রং মেঘের মত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ; কপালে অর্ধচন্দ্র, চারিটি হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল। তিনি ত্রিনয়না এবং সিংহারূঢ়া। তাঁকে মাছ পুড়িয়ে ভোগ দেওয়া হয়।

দেবী ‘জগদ্ধাত্রী’ও দেবী দুর্গারই অন্যতর রূপ। তাঁর পূজা হয় কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে। তিনিও সিংহের পিঠে বসে রয়েছেন, তাঁর হাতও চারিটি। কিন্তু তাঁর গলায় ঝোলানো রয়েছে একটি ‘সাপের পৈতে’ অর্থাৎ ‘উপবীত’ - যেটি তাঁর ব্রাহ্মণত্ত্বের প্রতীক। বাস্তবে, এই দেবী অতীতে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ গৃহে পূজা পেতেন।

এখন প্রতি বছর দেবী মহিষমর্দিনীর রূপে বাংলায় আসেন। এই রূপ তাঁর মহিষাসুর বধের কাহিনীর সঙ্গে গাঁথা। মহাভারতেও দেবীকে ‘মহিষাসৃক্‌প্রিয়া’, অর্থাৎ মহিষের রক্ত তাঁর প্রিয়, বলা হয়েছে। হয়ত এই বিশেষণটি থেকেই পুরাণের মহিষাসুরের উৎপত্তি ঘটেছে; চণ্ড, মুণ্ড, শুম্ভ, নিশুম্ভ ক্রমে পেছনে পড়ে গেছে। এই মহিষাসুরমর্দিনীর রূপেই তিনি সপরিবারে বাঙালী পিতার আলয়ে আসেন। দেবীর রূপ এখন মহিষাসুরমর্দিনী ভিত্তিক হলেও তাঁর রং, ভঙ্গী, বেশভূষা প্রভৃতিতে প্রতি বছরই অনেক পরিবর্তন ঘটছে। বারোয়ারী পূজা যত বাড়ছে, তত বেড়ে যাচ্ছে এই পরিবর্তন। অনেক মূর্তিতে দেখানো হচ্ছে যে দেবী সপরিবারে যুদ্ধ করছেন! বাঙালী গৃহস্থের পারিবারিক পূজায় দেবীর রূপ পরিবর্তন বিশেষ ঘটেনি কিন্তু বারোয়ারী পূজায় তাঁর নব নব রূপ প্রাপ্ত হয়েছে। এর একমাত্র না হোক, প্রধান কারণ হল, বারোয়ারী পূজা এখন পুরোপুরি একটা সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। জাতির পক্ষে এই পরিবর্তনকে অশুভ বলে মনে করবার কারণ নেই। দেবীর বোধন হয় ষষ্ঠী তিথিতে - বিসর্জন হয় দশমীতে। মাঝের তিনটি দিন তাঁর পূজা হয়; এর মধ্যে অষ্টমী পূজাই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। পূজার মধ্যে এক মহাপর্ব হল মহাস্নান। সেই স্নানের উপচারের বৈচিত্র্য বহু। তাতে প্রয়োজন নানা বস্তুর; ঠাণ্ডা জল, গরম জল, শঙ্খের জল, গঙ্গাজল, সাগরের জল, সরস্বতী নদীর জল, বৃষ্টির জল, ঝর্নার জল, পঞ্চগব্য, পঞ্চামৃত, পঞ্চকষায়, চিনিপানা, চন্দন-জল, হাতির শুঁড়ে খোঁড়া মাটি, শূকরের পায়ে খোঁড়া মাটি, ষাঁড়ের শিং-এ খোঁড়া মাটি, বেশ্যালয়ের মাটি, উঁইপোকার ঢিপির মাটি, চড়ার মাটি, গঙ্গামাটি, নদীতীরের মাটি, সমুদ্রের মাটি, গোয়ালের মাটি, চৌরাস্তার মাটি - কি নেই? লোকে কথায় বলে, এ যেন দুর্গোৎসবের ঘটা! দেবীর প্রতিমা বিসর্জন পর্বে এখনও শবর-জাতীয় আদিম, অসুন্দর প্রথা কিছু কিছু রয়েছে। এখনও কোথাও কোথাও কাদা মাটি ছড়ানো হয়, নানা অশ্লীল কার্যকলাপও দেখা যায়! কিন্তু সে সব অশোভন চাঞ্চল্যের শুভ নিবৃত্তি হয় শান্তিজলে।

দেবী দুর্গার আর একটি রূপ হলেন ‘গন্ধেশ্বরী’। গন্ধেশ্বরীর পূজা করে ‘স্বর্ণবণিকেরা’ অর্থাৎ যাঁরা বাংলার প্রকৃত বৈশ্যসম্প্রদায় - বাণিজ্যে, বিশেষ করে বহির্বাণিজ্যে, যাঁরা এদেশকে একদা সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর পূজা হয় পহেলা বৈশাখ, অর্থাৎ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে। তিনি ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর মাথায় জটা, শিরোভূষণ অর্ধচন্দ্র, বর্ণ অতসী ফুলের মত হলুদ, হাত দশটি। ডান হাতে ওপর থেকে পরপর রয়েছে ত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, তীক্ষ্ণ বাণ ও শক্তি; বাঁ হাতে রয়েছে ওপর থেকে খেটক, ধনু, পাশ, অঙ্কুশ ও ঘণ্টা বা কুড়াল। অবশ্য তাঁর তন্ত্রোক্ত রূপের সাথে এর কোন মিল নেই!

                                     


No comments