দেড় দশক আগে দুর্ঘটনায় স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর বিহ্বলতা কাটিয়ে শিখারানি মণ্ডল নিজের পায়ে দাঁড়াতে গ্রামীণ এলাকায় গড়ে তুলেছেন আধুনিক প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি। ভোর থেকে উঠে সাইকেলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে আনেন। ল্যাবে…
দেড় দশক আগে দুর্ঘটনায় স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর বিহ্বলতা কাটিয়ে শিখারানি মণ্ডল নিজের পায়ে দাঁড়াতে গ্রামীণ এলাকায় গড়ে তুলেছেন আধুনিক প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি। ভোর থেকে উঠে সাইকেলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে আনেন। ল্যাবে পরীক্ষার পর ফের সেই রিপোর্ট পৌঁছে দেন বাড়িতে।
সংস্থা গড়ে প্রায় ৩০০জন পিছিয়ে পড়া ও প্রতিবন্ধী তরুণী ও মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন মহিষাদলের মনোরমা মিশ্র। তাঁর মা ছিলেন দৃষ্টিহীন। ছোট থেকে প্রতিবন্ধীদের কষ্ট অনুভব করেছেন তিলে তিলে। কলেজে পড়াশোনা শেষ করেই প্রতিবন্ধী কল্যাণই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
রাজ্যের একমাত্র সফল মহিলা মাছচাষি হিসেবে হলদিয়ার দ্বারিবেড়িয়ার আরতি বর্মনকে পুরস্কৃত করে স্বীকৃতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। তিনি শুধু সফল মাছ চাষি নন, তাঁর খামারেই কর্মসংস্থান হয়েছে শতাধিক যুবকের।
শিখারানি মণ্ডল, মনোরমা মিশ্র এবং আরতি বর্মন। এই তিনজনের জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের কাহিনী গল্পের মতো। ধাক্কা খেয়ে বারবার ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তিনজনকেই। কবে বিশ্ব নারী দিবস আসে তাঁরা জানতেই পারেন না। এবারও জানতেন না। শুধু ৮মার্চ নয়, বছরের প্রতিটি দিনই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নারী দিবসের বার্তা দিতে চান তাঁরা। শিখা বলেন, ২০০৮সালে যখন আমার স্বামী দুর্ঘটনায় মারা যান, তখন দিশেহারা হয়ে পড়ি। ব্রজলালচক বাজারে আমার স্বামীর একটি প্যাথলক্যিাল ল্যাব ছিল। উনি নিজে ল্যাব টেকনিশিয়ান ছিলেন। শ্বশুরমশাই আমাকে উৎসাহিত করেন ল্যাব চালানোর জন্য। ল্যাব চালানোর জন্য প্রশিক্ষণও নিই।
মরিয়া লড়াই শুরু হয় শিখার। কঠিন পরিশ্রমে ছোট একটি অপরিচিত গ্রামীণ ল্যাব এখন ‘রানি ল্যাব’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। শিখার কাজের পদ্ধতি ঠিক কেমন? তিনি বলেন, রাতে গ্রাহকদের লিস্ট তৈরি করে নিই। ফোনে তাঁদের সময় বলে রাখা হয়। তারপর ভোর থেকে উঠে ২৫-৩০কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠাই।
শিখার মতো মহিষাদলের মনোরমাও সাইকেলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান প্রতিবন্ধী তরুণী কিংবা মহিলাদের আয়ের পথ দেখাতে। বিয়ের পর মহিষাদলের গোপালপুর গ্রামে এসে আরও কয়েকজনকে নিয়ে গড়েছেন মহিষাদল প্রতিবন্ধী মনোবিকাশ কেন্দ্র। প্রশিক্ষণ দেওয়া, ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা কিংবা প্রতিবন্ধীদের পণ্য বাজারে পৌঁছে দিয়ে অর্থের সংস্থান করার মতো সমগ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন অক্লেশে।
মনোরমা বলেন, মায়ের কষ্ট দেখে বড় হয়েছি, তাই এই কাজ করে আনন্দ পাই। মহিষাদলের ৫০-৬০টি গ্রামে ঘুরি সাইকেলে চেপে। মেয়েরা প্যাকেট মশলা, ধূপকাঠি, জুটের ব্যাগ, জুটের ঘরসাজানোর রঙিন হস্তশিল্পের সামগ্রী তৈরি করে বাড়িতে বসেই। হলদিয়ার বিভিন্ন সমবায় মার্কেটে এর দারুণ চাহিদা তৈরি হয়েছে।
স্বনির্ভর হতেই বিয়ের পর গ্রামে এসে প্রথমে স্বামীর সঙ্গে ছোট ব্যবসা শুরু করেন আরতি বর্মন। তমলুকের গরিব মৎস্যজীবী পরিবারে জন্ম হওয়ার সুবাদে মাছচাষ তাঁর রক্তে রয়েছে। ভোরে উঠে নিজেই কর্মীদের সঙ্গে জাল নিয়ে যান খামারে। সেখানে মাছ ধরার পর রুই, কাতলা মিনি ট্রাকে লোডিং হয়ে চলে যায় ভিনরাজ্যে। পুরো কাজ সামলান নিজের হাতে। হলদিয়ার মৎস্য আধিকারিক সুমনকুমার সাহু বলেন, দেশি ও নতুন প্রজাতির মাছচাষে আরতিদেবীকে রাজ্য সরকার ‘মীনমিত্র পুরস্কার’ দিয়েছে, কেন্দ্রীয় সংস্থা সিফাও তাঁর লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি এখন মহিলা উদ্যোগপতি হিসেবে রাজ্যের কাছে উদাহরণ।
No comments