Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পাঁচ সহস্র বছরে উপমহাদেশের ইতিহাসে পঞ্চানন শিবের পঞ্চমূর্তি -তমাল দাশগুপ্ত

পাঁচ সহস্র বছরে উপমহাদেশের ইতিহাসে পঞ্চানন শিবের পঞ্চমূর্তি -তমাল দাশগুপ্ত 
শিবরাত্রি আমাদের দীর্ঘদিনের তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতার এক অভিজ্ঞান ও চর্যা। তন্ত্রের ইতিহাসে শিবের এই পাঁচটি নথিবদ্ধ মূর্তিরূপের এক সুপ্রাচীন উদযাপন ঘটতে দেখি। 

 




পাঁচ সহস্র বছরে উপমহাদেশের ইতিহাসে পঞ্চানন শিবের পঞ্চমূর্তি -তমাল দাশগুপ্ত 


শিবরাত্রি আমাদের দীর্ঘদিনের তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতার এক অভিজ্ঞান ও চর্যা। তন্ত্রের ইতিহাসে শিবের এই পাঁচটি নথিবদ্ধ মূর্তিরূপের এক সুপ্রাচীন উদযাপন ঘটতে দেখি। 


১. হরপ্পা সভ্যতার "পশুপতি"। ইনি যোগাসনে উপবিষ্ট। ইনি পশু ছাড়াও চিত্রিত হন (ইসলামাবাদ মিউজিয়ামের সীল দ্রষ্টব্য)। ইনি মহিষের শৃঙ্গ ধারণ করেন, সেটি সম্ভবত মহিষমেধের সঙ্গে সম্পর্কিত। হরপ্পা সভ্যতায় মাতৃধর্মের উৎসবে মহিষমেধ প্ৰচলিত ছিল, যেখান থেকে হরপ্পা-পরবর্তী যুগের মহিষমর্দিনী এসেছেন। হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃকা উপাসক ধর্মের পুরোহিত বা শ্রমণ ছিলেন এই "পশুপতি", এই মর্মে আধুনিক গবেষকরা একমত। 


সুকুমার সেন বলেন যোগী শব্দের আদি অর্থ হল যিনি পুজোর যোগান দেন, এবং যিনি ঈশ্বরের সহযোগী অনুচর। এই অনুচর অনুষঙ্গেই আজও আমাদের জগদকারণ মায়ের পাশে যোগিনীরা অবস্থান করেন।


এই অর্থে হরপ্পা সভ্যতার এই মূর্তিটিকে আদিযোগী বলেই উল্লেখ করা উচিত। 


হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রধর্মের পুরোহিত বর্ণিত হন এই "পশুপতি" সীলে। এঁকেই পরবর্তী কালে শিব বলে কল্পনা করা হয়েছিল।


২. হরপ্পা সভ্যতায় সবথেকে বেশি পাওয়া গেছে সন্তানকোলে মাতৃমূর্তি। হরপ্পা সভ্যতার অবসানের দুহাজার বছর পরে চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় এই সন্তানকোলে মাতৃকার মূর্তির বিশেষ উপস্থিতি দেখি। এই মূর্তির চিত্র আগে পেজে দিয়েছি, যা সন্তান শিবকে কোলে নিয়ে আদি-তারা মূর্তি ভাবা যায়।


অতএব এটি শিবের দ্বিতীয় রূপ। মাতৃকার সন্তান।


প্রসঙ্গত অম্বিকার ভ্রাতা হিসেবে রুদ্রের উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে, তবে এই রূপে কোনও মূর্তি পাওয়া যায় নি, কেবলমাত্র স্ক্রিপচার আছে। প্রসঙ্গত একদা দুর্গা বা মহামায়াকে বাসুদেব কৃষ্ণের ভগ্নী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। চন্দ্রকেতুগড় থেকে একানংশা ও কৃষ্ণের মূর্তি পাওয়া গেছে, যেটা খুনসুটি করা ভাই বোনের মূর্তির ন্যায়। এই ধারাতেই অম্বিকা ও রুদ্র ভ্রাতা ভগ্নী আখ্যা পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই।


অতএব এটি শিবের আরেক রূপ। জগন্মাতার ভ্রাতা। যেহেতু এই রূপের মূর্তিকল্প নেই তাই পৃথক গণনা করছি না


৩. শশাঙ্কযুগে গৌড়বঙ্গে এবং ভারতের অন্যত্রও তন্ত্রধর্মীয় উদ্যোগে শিব ও নীলাবতীর বিবাহ উৎসব মহা ধুমধাম করে উদযাপন শুরু হয়, এবং বৈশাখী নববর্ষের সূচনা হয়। যা আজকে আমরা বঙ্গাব্দ বলি, তা এই শিব ও নীলাবতী বিবাহের উদযাপন থেকে আগত। অনেক অত্যুৎসাহী সেকুলার বিশ্বমানব ধর্মমুক্ত মানবতার উৎসব বলে পয়লা বৈশাখে জুলুস বের করে থাকেন। তাদের এই জুলুস তাদেরকেই মুবারক জানিয়ে, এবং সেই আশ্চর্য বিশ্বমানবতা সসম্মানে মাথায় রেখে আমরা বলতে চাই, এই পয়লা বৈশাখ একেবারেই ধর্মীয় উৎসব। চৈত্রশেষে শিব ও নীলাবতী/নীলচণ্ডীর বিবাহের উৎসব উদযাপন করতে গিয়ে এই বৈশাখী নববর্ষের সূচনা।


অতএব এটি শিবের তৃতীয় রূপ, এই রূপে তিনি বর্তমানে সুপরিচিত হলেও মনে রাখতে হবে এমনকি ষষ্ঠ শতকে শ্রী শ্রী চণ্ডী লেখার সময়েও শিবের সঙ্গে দুর্গার কোনও বিশেষ সম্পর্ক নেই, শিব সেখানে অনেক দেবতাদের একজন। কিন্তু শশাঙ্কযুগে এই শিব শক্তি সাযুজ্য স্থাপনের ফলে পালযুগে এসে দেখি প্রচুর উমা মহেশ্বর মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে শিবের এই উমাপতি রূপ অতীব জনপ্রিয়।


৪. তারা উপাসক পালসম্রাট ধর্মপালের আদলে পালযুগে মহাকাল ভৈরব মূর্তি তৈরি হতে থাকে। ধর্মপালের দেহের ঊর্ধ্ব অংশ দীর্ঘ ছিল, তিনি লম্বোদর ছিলেন, এবং শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত মুখমণ্ডলের অধিকারী ছিলেন, তাঁর পদযুগল তাঁর দেহের উপরিভাগের তুলনায় কিছুটা খর্ব ছিল। এই সবকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায় মহাকাল মূর্তিতে। মহাকাল মূর্তিকে বজ্রযান ধর্মে ধর্মপাল নামেও ডাকা হয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুই উপাস্য ছিলেন জ্ঞাননাথ-মহাকাল ও তারা। ধর্মপাল/মহাকাল সমস্ত শক্তিপীঠে মাতৃকার দ্বারপাল ভৈরব হিসেবে পূজিত হতে থাকেন, পালযুগে মহাকাল ভৈরবের উপাসনা বিশেষভাবে প্রবল হয়ে ওঠে। আজকে বাংলায় শিবের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে চিহ্নগুলি দেখি, সেই স্ফীত উদর, গোঁফ ও দাড়ি সাধারণভাবে পালযুগের মহাকালের রূপ।


নৃমুণ্ডমালিনী হয়ে পদতলে শব দলন করেন মহাকালী। এই মূর্তিকল্প থেকেই পুরুষ রূপ মহাকাল। পালযুগে মা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপের উত্থানের পিছনে মহাকাল উপাসনার প্রগাঢ় অবদান আছে। এজন্য অনেক শতাব্দী পরে শাক্ত কবি গেয়েছেন, কালী কেবল মেয়ে নয়, কখনও কখনও পুরুষ হয়।


৫. এই পালযুগেই চামুণ্ডা/চর্চিকা মূর্তির পাদদেশে শবটি শিবের আখ্যা পেতে থাকে। মা কালীর পায়ের তলায় শবটি এভাবেই শিবের স্থান পায়।


গৌড়বঙ্গে শিবের সর্বাধিক জনপ্রিয় রূপ বর্তমানে এটিই। মা কালীর পদতলে শবশিব মূর্তি।


জয় আদিযোগী! জয় আদি পুরোহিত! জয় তারাসুত! জয় নীলাবতীস্বামী! জয় ধর্মপাল মহাকাল! জয় শবশিব! জয় শিবশম্ভু। তাঁর ডমরুর শব্দ দিকে দিকে ধ্বনিত হোক, মায়ের পদতলে তাঁর অপরূপ মূর্তির ছটা দশদিকে দিগদিগন্ত আলোকময় করুক। ওঁ নমঃ শিবায়।


পালযুগের দশভুজ মহাকাল ভৈরব মূর্তি, কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে আছে। কিছুদিন আগে মা যশোরেশ্বরী কালী প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মায়ের ভৈরব সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের সঙ্গে ভৈরবের এই ছবিটি দিয়েছিলাম।


জয় জয় মা।

No comments