Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জিওর্দানো ব্রুনোর পুড়িয়ে মারার দিন - শুচিস্মিতা মিশ্র

জিওর্দানো ব্রুনোর পুড়িয়ে মারার দিন   - শুচিস্মিতা মিশ্র

জিওর্দানো ব্রুনোর পুড়িয়ে মারার দিন   - শুচিস্মিতা মিশ্রআজ থেকে ৪২২ বছর আগের কথা।১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি।হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল রোমের বধ্যভ…

 

জিওর্দানো ব্রুনোর পুড়িয়ে মারার দিন   - শুচিস্মিতা মিশ্র



জিওর্দানো ব্রুনোর পুড়িয়ে মারার দিন   - শুচিস্মিতা মিশ্র

আজ থেকে ৪২২ বছর আগের কথা।১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি।হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল রোমের বধ্যভূমিতে ( campo de' fiori)।যাতে বিজ্ঞানের কথা, সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কথা জনসমক্ষে শেষ বারের মতো বলতে না পারেন, তাই শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল জিভ। তারপর জ্বলন্ত পুড়িয়ে মারা হল এই অসমসাহসী, যুক্তিবাদী, সত্যনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষটিকে। সুযোগ দেওয়া হয়েছিল - যদি এখনো নিজের ভুল স্বীকার করে নেন,বাইবেলের বিরুদ্ধাচরণ না করেন তবে মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। কিন্তু টলানো যায়নি সেই পুরুষটিকে যিনি পরীক্ষা,পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে কোপারনিকাস এর মতবাদই ঠিক। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে নির্দিষ্ট কক্ষপথে অন্যান্য গ্রহগুলির মতো,আর সূর্য স্থির। বলছি জিওর্দানো ব্রুনোর কথা। 


গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামী  ক্লডিয়াস টলেমী এই মতবাদ প্রচার করেন যে - আকাশ ও পৃথিবী উভয়েই গোলাকার ও ঘূর্ণায়মান ব্রম্ভান্ডে পৃথিবী স্থির। ততকালীন সমাজে পবিত্র বাইবেল আশ্রিত খীস্ট্রীয় যাজক সম্প্রদায়ের কাছে সূর্য আরাধ্য দেবতা হিসেবে পূজিত হত,সুতরাং দেবতা কোন গ্রহকে পরিক্রমণ করতে পারেনা - এমনই ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। জোর্তিবিজ্ঞানী নিকোলাস কোপারনিকাস সর্বপ্রথম গাণিতিক সূত্র প্রয়োগ করে,যুক্তিনির্ভর সূর্যকেন্দ্রিক ব্রম্ভান্ড তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং বলেন পৃথিবী গতিশীল গ্রহ - তার আহ্নিক  ও বার্ষিক গতির ব্যাখ্যাও দেন। লেখেন" দ্য রিভোল্যুশনিবাস" গ্রন্থ।


১৫৪৮ সালে ইতালির নেপোলসের কাছে নোলা তে জন্মগ্রহণ করেন ফিলিপ্পো ব্রুনো,পরবর্তীতে যিনি নাম নেন জীওর্দানো ব্রুনো।প্রখর বুদ্ধি ,অনুসন্ধিৎসু মন আর  প্রবল জানবার আগ্রহ নিয়ে ব্রুনো প্রায়ই আসতেন গ্রন্থাগারে। এমনই এক দিন নতুন বই খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন কোপারনিকাস এর লেখা সেই বিখ্যাত বই "দ্যা রিভোল্যুশনিবাস"।জানলেন নতুন কথা - সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্ব। কিন্তু প্রায় ৪০০ বছর আগে দাঁড়িয়ে এই তত্ত্ব মেনে নেওয়ার আগে ব্রুনো যুক্তি দিয়ে বিচার করে,পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন  যে কোপারনিকাস সঠিক। চুপ করে থাকলেন না বিজ্ঞানমনস্ক যুবক।চার্চের পাদ্রী হয়েও প্রচার করতে লাগলেন সূর্য স্থির ও তার চারপাশে ঘুরছে গ্রহ উপগ্রহ।বাইবেল বিরোধিতার অপরাধে পোপের যাজক সম্প্রদায়ের রোষানলে পড়লেন,ডাকা হল বিচার সভা (ইনকুইজিশন)।শুভানুধ্যায়ীরা বারণ করলেন এসব প্রচার না করতে কিন্তু অচল ,অনড়, স্থিরচিত্ত ব্রুনো কর্ণপাতও করলেন না এইসব কথায়। বন্ধুদের সাহায্যে আল্পস পর্বতমালা পেরিয়ে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড , পরে এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রচার করতে লাগলেন। বিজ্ঞানের সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়াসী ব্রুনোর কথায় আকৃষ্ট হলেন কৌতূহলী মানুষজন। তিনি বললেন,বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন শেষ নেই,পরিধি নেই, কোন কেন্দ্র নেই।সূর্যের মতো অসংখ্য নক্ষত্রের চারিদিকে ঘুরছে তাদের গ্রহরা, যা বহুদূরে আছি বলে আমাদের চোখে পড়ে না।ধর্মভীরু মানুষরাও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। তিনি খিস্ট্রিয় ধর্মবিশ্বাসের ধারনা কে বিজ্ঞানের আলোকে বিচার করতে আহ্বান জানালেন আপামর জনগণকে। যিশুর জন্মের অলৌকিকতার গল্প যে সত্য নয়,স্বাভাবিক ভাবেই  আর পাঁচটা শিশুর মতো তাঁর জন্ম হয়েছে এই সত্য প্রচার করলেন। পোপ,পাদ্রীরা প্রমাদ গুনলেন। এমন চলতে থাকলে কেউ ধর্ম মানবে না,নরকের ভয় পাবেনা তাহলে পাদ্রীদের দাপট চলবে কি করে! তাই ধর্ম প্রাসঙ্গিকতা হারাবে এমন সত্যকে প্রতিষ্ঠা হতে দেওয়া যাবে না।ষড়যন্ত্র করে ডেকে আনা হল ব্রুনোকে ইতালিতে। জন্মভূমির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করতেন এই যুক্তিবাদী মানুষটি।ফাঁদে পা দিয়ে দিলেন। বন্দী হলেন পোপের প্রহরীদের হাতে। রাখা হল সিসার ছাদের ঘরে, গ্রীষ্মে ওই ঘর হয়ে উঠত গরম চুল্লি,দেওয়া হত অতি সামান্য খাবার ও জল,চলত অকথ্য নির্যাতন। মুক্তির প্রলোভন ও ছিল,বলতে হবে বাইবেল সত্য,অন্যথায় মৃত্যুদণ্ড। একটুও ভয় পাননি ব্রুনো,প্রত্যাখ্যান করলেন মুক্তির লোভ।বললেন" আপনারা রায় ঘোষনা করেছেন,শুনে আমার যতটা ভয় হচ্ছে,তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছেন আপনারা।"তিনি এটাও বলেছিলেন রায়দানকারীরা হয়তো আরো কিছুদিন বাঁচবে কিন্তু এই নির্মম ,জঘন্য কাজের জন্য ইতিহাস তাদের নিন্দা করবে,কখনো ক্ষমা করবে না।


আজ যখন ধর্মের নামে মানুষের মনে পরস্পরের প্রতি ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে,শিক্ষাক্ষেত্রে জোতিষশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তি ঘটছে,বিজ্ঞান কংগ্রেসে হচ্ছে অপবিজ্ঞানের প্রচার,পুরানকে বিজ্ঞান বলে চালানোর অপচেষ্টা,আর সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য মৌলবাদীদের হতে খুন হতে হচ্ছে নরেন্দ্র দাভোলকার, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশের মতো মুক্তমনা মানুষদের, সম্প্রতি কোভিড সময়কালে- রোগ নিরাময়ের উপায় হিসেবে অসংখ্য কুসংস্কার ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত(গোমূত্র থেকে ভাবিজি পাঁপড়) , তখন মনে হয় ৪০০ বছর আগের সেই কালো দিন আজও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছে কিন্তু মানুষের মনন জগৎকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জঘন্য অপচেষ্টা আজও বর্তমান। প্রায় ৪০০ বছর আগে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন যে ব্রুনো,মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও যিনি সত্যের প্রতি অবিচল ছিলেন আসুন তার মৃত্যুর দিন দিকে দিকে ছড়িয়ে দিই বিজ্ঞানমনস্কতার বার্তা,যুক্তিবাদের চিরন্তন সংজ্ঞা,আর ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারমুক্ত জীবনের জয়গান।


No comments