জগন্মাতা শীতলা: আশ্চর্য ষোলটি তথ্য- তমাল দাশগুপ্ত
মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে হাওড়ার শালকিয়া অঞ্চলে মা শীতলার স্নানযাত্রা মহাসমারোহে পালিত হল। এখানে মা শীতলা সপ্তভগ্নীরূপে উপাস্য, বড়মা সহ সাত বোনের পৃথক পৃথক মন্দির থেকে এই যাত্রা শুরু …
জগন্মাতা শীতলা: আশ্চর্য ষোলটি তথ্য- তমাল দাশগুপ্ত
মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে হাওড়ার শালকিয়া অঞ্চলে মা শীতলার স্নানযাত্রা মহাসমারোহে পালিত হল। এখানে মা শীতলা সপ্তভগ্নীরূপে উপাস্য, বড়মা সহ সাত বোনের পৃথক পৃথক মন্দির থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে গঙ্গাতীরে পৌঁছয়। এ এক বিখ্যাত ও প্রাচীন উৎসব, লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে এই বাৎসরিক শোভাযাত্রায়। আজ আমরা মা শীতলা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানব যা আমাদের মাতৃউপাসক বাঙালি জাতির আবহমানকালের ধর্মকে বুঝতে সাহায্য করবে।
প্রথমেই বলি, শীতলা জগন্মাতা। তাঁর নানা বৈশিষ্ট্যের সমাহার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তিনি দুর্গা কালী জগদ্ধাত্রীর মতোই সর্বব্যাপী, তিনিই একক জগদকারণ জগন্মাতা, কিন্তু সন্তানের মঙ্গলকামনায় বহুরূপে নানাভাবে আমাদের পালন করেন, যদিও বর্তমানে তাঁর একটি নির্দিষ্ট রোগবিনাশিনী রূপেই মূলত আমরা তাঁকে পুজো করি।
১. মা শীতলা বসন্তের আগমনে রোগব্যাধি থেকে নিরাময় করেন। তাঁর বাহন গাধা, কারণ আয়ুর্বেদ অনুযায়ী গাধার দুধ মানব শরীরে বসন্ত রোগের অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি ঘটায়। এমনকি বসন্ত হওয়ার পরেও গাধার দুধে রোগজ্বালা প্রশমিত হয়।
২. স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী মা শীতলা শিশুদের রক্ষা করেন। এক্ষেত্রে তিনি উপমহাদেশের সবথেকে প্রাচীন মাতৃকাদের একজন, ষষ্ঠীর সঙ্গে সমার্থক। হরপ্পা সভ্যতায় সবথেকে বেশি যে মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে, তা হল সন্তানকোলে মায়ের প্রতিমা। হরপ্পা থেকে চন্দ্রকেতুগড় থেকে পালযুগ থেকে আজকের বাংলা, সন্তানকোলে মায়ের এই রক্ষাকর্ত্রী মূর্তিটি গত পাঁচ সহস্র বছর ধরে আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃধর্মীয় সভ্যতার ধ্রুব দ্যোতনা বহন করে চলেছে।
৩. শিশুরা বিস্ফোটক বা বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে মা শীতলা রক্ষা করতেন। অস্যার্থ, মা শীতলার নাম করে বৈদ্যের আয়ুর্বেদিক ঔষধ সেবন করার প্রথা ছিল বসন্ত আদি রোগ ব্যাধি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে। বসন্তের আগমনের ঠিক আগেই এজন্য মা শীতলার পুজোর প্রথা। বসন্ত পঞ্চমী বা সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন পালিত হয় শীতলা ষষ্ঠী হিসেবে। মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে শালকিয়ার শীতলা যাত্রা আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতার এক প্রাচীন মহোৎসব।
৪. প্রসঙ্গত মন্দির থেকে মায়ের মূর্তি নিয়ে নিকটের জলাধার বা নদী অবধি গণ-শোভাযাত্রা হল উপমহাদেশের একটি পুরোনো প্রথা। পরবর্তী কালে রথযাত্রার মত উৎসবের উৎস হল এই প্রথা।
৫. শীতলা জলদেবী, তিনি নদীমাতৃক সভ্যতার পূজিত মাতা। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী গঙ্গা হলেন শীতলামৃতবাহিনী, আবার শীতলাকেও অমৃতবর্ষিণী বলা হয়েছে। অন্যদিকে স্তবকবচমালা অনুযায়ী মা শীতলার পুজো জলমধ্যে অনুষ্ঠিত করার নিদান পাওয়া যায়। শীতলা কাজেই মা জাহ্নবী গঙ্গার সঙ্গেও সমার্থক হয়ে যান।
৬. শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুযায়ী মা চণ্ডীর উপাখ্যান শুনলে তা বালক-বালিকাদের জন্য শান্তিকারক। স্পষ্টই এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু মা শীতলার: স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী শীতলা শিশুদের শান্ত করেন। অতএব মা শীতলার একটি ভূমিকা এখানে চণ্ডীর সমার্থক।
৭. ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি অনুযায়ী মা শীতলার ধ্যানমন্ত্র এরকম।
তাঁর মাথায় কুলো অলঙ্কারের মত শোভা পায়। তিনি দেবতাদের দ্বারা সর্বদা স্তুত হচ্ছেন। তাঁর বাম হাতে কুম্ভ, ডান হাতে সম্মার্জনী বা ঝাঁটা। তাঁর মুখ মেঘের মত। তিনি গর্দভবাহিনী। তিনি দিগ্বাস ধারণ করেন অর্থাৎ দিগম্বরী। তিনি সংসারদুঃখনাশিনী।
ওই গ্রন্থে মায়ের প্রণাম মন্ত্রতেও অনুরূপ বিবরণ। মা রাসভবাহনা, দিগম্বরী, এক হস্তে ঝাঁটা অন্য হাতে কলস, এবং তাঁর মস্তকের অলঙ্কার হিসেবে কুলো।
স্পষ্টই কুলো ও কলস আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতার চিহ্ন। ঝাঁটা দিয়ে মা আমাদের মালিন্য ও ব্যাধি দূর করেন।
৮. স্কন্দপুরাণেও মায়ের ধ্যানমন্ত্র হুবহু অনুরূপ। মায়ের দিগম্বরী রূপ অবশ্যই মায়ের সঙ্গে জগৎপ্রসবিনী জগন্মাতার সাযুজ্য স্থাপন করে। মা আমাদের প্রসব করেন বলেই নগ্নিকা। সমগ্র বিশ্বচরাচর জুড়ে তিনি, দিগদিগন্তে তিনি ব্যাপ্ত, তাই তাঁর আচ্ছাদন সম্ভব নয়।
৯. স্কন্দপুরাণ মা শীতলাকে সর্বরোগভয়বিনাশিনী আখ্যা দেয়, অতএব তিনি ভিষকশ্রেষ্ঠ, অতএব এখানে তিনি সরস্বতীর সঙ্গে তুলনায়িত হতে পারেন, কারণ বেদ অনুযায়ী সরস্বতীও সর্বরোগ উপশম করেন। শীতলা হলেন বসন্তের অগ্রদূত, তিনি এজন্য প্রায়ই বাসন্তী বর্ণা। তাঁর শ্বেতরূপের মূর্তিও পূজিত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই সরস্বতীর সঙ্গে মিল।
১০. তাঁর হাতে পূর্ণ কুম্ভ বা কলস তাঁর সঙ্গে মা লক্ষ্মীর সাদৃশ্য কল্পনা করে। বস্তুত স্কন্দপুরাণ বলেছে যে মা শীতলার উপাসনা করলে দারিদ্র্য থাকে না। স্পষ্টই তিনি লক্ষ্মীরূপিণী।
১১. দশমহাবিদ্যার অন্যতম ধূমাবতীর হাতে কুলো থাকে। মা শীতলা তাঁর মস্তকের অলঙ্কার হিসেবে কুলো ধারণ করেন। চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলে প্রাপ্ত খ্রিষ্টপূর্ব কালের প্রাচীন গঙ্গারিডাই মাতৃমূর্তির অনুষঙ্গেও কুলো পাওয়া গেছে। কুলো আমাদের সভ্যতার প্রাচীন প্রতীক। কুলো শস্যমাতৃকার দ্যোতনা বহন করে।
১২. বৌদ্ধ তন্ত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবী হারীতির সঙ্গেও মা শীতলার মিল আছে বলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সিদ্ধান্ত করেছিলেন। উভয়েই শিশুদের রক্ষা করেন এবং সন্তানের রক্ষার্থে মায়ের অসীম তিতিক্ষা ও মমতার বাণীর মূর্ত প্রকাশ ঘটে তাঁদের প্রতিমায়।
১৩. আরেক জনপ্রিয় প্রাচীন মাতৃকা পর্ণশবরী, যিনি চণ্ডীর এক পুরোনো রূপ, তাঁর সঙ্গেও মা শীতলার সাযুজ্য পাওয়া যায়। বিক্রমপুরে একটি পর্ণশবরী মূর্তি পাওয়া গেছে যেখানে মাতৃমূর্তির পদতলে একটি গুটিবসন্তে আক্রান্ত মনুষ্যমূর্তি আছে।
১৪. মা মনসার সঙ্গে শীতলার কিছু সাদৃশ্য আছে। দিনাজপুর জেলায় গর্দভে আসীন মনসা মূর্তি পাওয়া গেছে এবং বীরভূম জেলায় কোথাও কোথাও শীতলা ও মনসা অভিন্ন রূপে পূজিত। মনসা ও শীতলা দুজনেই জলদেবী।
১৫. যেমন শক্তিপীঠ রক্ষার্থে ভৈরব মূর্তি থাকে, শীতলাপীঠে জ্বরাসুর বিরাজ করেন প্রায়ই। ভৈরব প্রকৃতপক্ষে দেবীর অনুচর, তেমনই জ্বরাসুর মায়ের ভৃত্য। জগন্মাতার থেকে বিশ্বচরাচর উৎপন্ন হয়েছে এজন্য সবাই তাঁর সন্তান। তারাপীঠের শিশু শিব এজন্যই এত মনোহর।
১৬. দেবী মাহাত্ম্য অনুযায়ী কাত্যায়নী দুর্গার এক রূপ হলেন শীতলা, যিনি জ্বরাসুরকে পরাজিত করে তাকে ভৃত্যরূপে স্থান দেন।
জয় জয় মা। জয় মা শীতলা। জয় বড় মা।
শালকিয়ার সাত বোন শীতলার মধ্যে একজনের চিত্র সংবাদ সমাচার ওয়েবসাইট থেকে। সাত বোনের একটি কোলাজ ছবি কমেন্টে দিলাম।
No comments