কুণ্ডলিনী শক্তি ও শিবআজ আলোকপাতের বিষয় কুণ্ডলিনী-শক্তি, ষটচক্র ও ভগবান শিবের উপর। বিষয়টা সত্যি খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই সম্পূর্ণ পোস্টটা একটু সময় নিয়ে মন দিয়ে পড়তে অনুরোধ করছি সকলকে।
যারা আধ্যাত্ম মার্গে আছেন কিংবা এই পথের পথিক…
কুণ্ডলিনী শক্তি ও শিব
আজ আলোকপাতের বিষয় কুণ্ডলিনী-শক্তি, ষটচক্র ও ভগবান শিবের উপর। বিষয়টা সত্যি খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই সম্পূর্ণ পোস্টটা একটু সময় নিয়ে মন দিয়ে পড়তে অনুরোধ করছি সকলকে।
যারা আধ্যাত্ম মার্গে আছেন কিংবা এই পথের পথিক অথবা এই সব নিয়ে সর্বক্ষণ চর্চা করে থাকেন তারা অবশ্যই কুণ্ডলিনী-শক্তি বা ষটচক্র শব্দ গুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তবে যারা এই সমস্ত নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা করে না কিংবা এসবের সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্টভাবে জড়ায়না তাদের না জানাটাই স্বাভাবিক।
তাই আজ ব্যাপারটা সকলের উদ্দেশ্যে পোস্টের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
অবশ্য বলে রাখা প্রয়োজন, এই ষটচক্র বা কুলকুণ্ডলিনী নিয়ে আলোচনা করলে, কিছু আধ্যাত্ম ভাষা ব্যবহার হয় যেগুলো সাধারণের পক্ষে গ্রহণ করাটা কতটা স্বাভাবিক তা আমার জানা নেই। তবে অবশ্যই চেষ্টা করব সহজ সরল ভাষায় সমস্তটা ব্যাখ্যা করবার।
ঈশ্বর দর্শন, মোক্ষলাভ, সর্বোপরি মুক্তি লাভের জন্যই সকল সাধকেরা ঈশ্বরের আরাধনা এবং সাধনা করে থাকেন।
সাধনার বিভিন্ন স্তর আছে, আছে বিভিন্ন কঠিন কঠিন পন্থা। তবে সাধক ভেদে সাধনার পদ্ধতিও আলাদা।
আর সেই কারণেই তান্ত্রিক, যোগী, নাগা, অঘোরী, ঋষি ইত্যাদি বিভিন্ন রকম সাধকদের কথা আমরা কমবেশি শুনে থাকি। এদের প্রত্যেকেরই সাধনার রীতিনীতি আলাদা আলাদা। তবে সকলের উদ্দেশ্যে কিন্তু ঈশ্বর দর্শন এবং মুক্তি লাভ। মানে পথ আলাদা আলাদা হলেও গন্তব্যস্থান এক
ঈশ্বর কিন্তু বাইরে কোথাও নেই তিনি প্রত্যেকটা মানুষের প্রত্যেকটা জীবের অন্তরে ঈশ্বর বিরাজমান। এটা চিরসত্য। তবে কেউ তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে কেউ পারে না।
ঈশ্বরকে ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাকেই সাধনা বলা হয়।
পুজো-পাঠ, হোম-যজ্ঞ,জপ যা কিছু করা হোক না কেন ঈশ্বরের প্রতি সমস্ত সাধনার শেষকথা যোগ সাধনা অথবা যোগ মার্গ।
আমাদের শরীরের ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন চক্র যেগুলোকে সঠিক পদ্ধতিতে জাগিয়ে তুলতে পারলেই হয় ঈশ্বর উপলব্ধি হয় ঈশ্বর দর্শন এবং সাধকের সাধন পথের শেষে মুক্তি লাভ ঘটে।
আমাদের সমাজে রয়েছে বিভিন্ন মন্দির মসজিদ কিন্তু প্রকৃত দেবালয় বা মন্দির যদি কিছু হয় সেটা হলো আমাদের দেহ।
এই দেহের মধ্যে আদতে কি আছে, কত কোটি কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আছে, একজন প্রকৃত উচ্চকোটির সাধক ছাড়া সাধারণ মানুষের তা কল্পনার অতীত।
আজ সেই শরীরে অবস্থিত ষটচক্রের উপর আলোকপাত করতে চলেছি।
সাধনপথে একজন সাধকের কাছে ইড়া-পিঙ্গলা এবং সুষুম্না এই তিন নারী অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই ষটচক্র।
অতি প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যোগী ঋষিরা এই চক্রের ওপর বিভিন্ন পুঁথিতে ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। অত্যান্ত শক্তিশালী এই ছয় চক্র জীবের শরীরে অবস্থান করে।
সুষুম্না (মেরুদন্ড/spinal cord) আমাদের গুহ্যদ্বার এর কিছু উপর থেকে আরম্ভ হয়ে একদম মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণ দেহটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
এই সুষুম্নাকাণ্ড কেই ঘিরে এই মহাশক্তিশালী চক্র-গুলো অবস্থান করছে। চক্রগুলোর আকৃতি কিছুটা ফুলের মত পাপড়িযুক্ত। তবে তবে এই চক্র বা ফুলের পাপড়ি গুলো বন্ধ অবস্থায় থাকে। যেগুলোকে সাধনা এবং বিভিন্ন যোগমার্গ দ্বারা একটার পর একটা জাগিয়ে তুলতে হয়।
তবে অবশ্যই সঠিক গুরু এবং সৎ গুরুর কৃপা ছাড়া এই অত্যন্ত শক্তিশালী চক্রগুলো কে, জাগানো সম্ভব নয়। ঈশ্বর লাভ মুক্তি তো দূরের কথা।
আচ্ছা এবার চক্রে আসি --
১. মূলাধার চক্র
এই চক্রের অবস্থান আমাদের সুষুম্না কান্ডের (spinal cord) একদম শুরুতে।
যারা এই সাধনপথে আছে, অথবা যারা নিয়মিত মেডিটেশন ও যোগ চর্চা করেন তারা অবশ্যই জানবে অশ্বিনীমুদ্রার কথা।
অশ্বিনী মুদ্রায় গুহ্যদ্বার কে ভিতরের দিকে সংকুচিত করলে, ঠিক যতটা পর্যন্ত সংকুচিত হয় সেখানেই অবস্থান এই মূলাধার চক্রের।
অত্যান্ত শক্তিশালী এবং নিগূঢ় বিদ্যা আরোহীত রয়েছে এই চক্রে।
এই চক্রের মোট..... ৪টি পাপরি
অধিষ্ঠাত্রী দেবতা..... ব্রহ্মা
অধিষ্ঠাত্রী শক্তি........ ডাকিনী
অধিদেবতা............... গণেশ
বীজের বাহন....... ঐরাবত
তত্ত্ব................পৃথ্বী
তীর্থ........ ব্রহ্মতীর্থ বা পুষ্করতীর্থ
এই চক্রর সাধনায় জয় লাভ করলে বা এই চক্র জাগরিত হলে, সাধক নিজের ইচ্ছায় ঘ্রাণশক্তি কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
২. স্বাধিষ্ঠান চক্র
আমাদের genital organ এর পিছন দিকে অর্থাৎ মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে এই চক্রের অবস্থান।
এই চক্রটি ও কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী একটি চক্র।
চক্রের পাপড়ি সংখ্যা....৬টি
অধিষ্ঠাত্রী দেবতা....…. বিষ্ণু
অধিষ্ঠাত্রী শক্তি........ রাকিনী
অধিদেবতা.......... আদ্যা শক্তি
চক্রের বাহন......... শ্বেত মকর
তত্ত্ব ............... জল
তীর্থ .............. স্বর্গ-তীর্থ
সাধকের এই চক্র জাগ্রত হলে, সাধকের জিব্বা বা স্বাদ ইত্যাদির প্রতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সম্পূর্ণ জিভ organ এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়। ফলে সাধকের কথাবাত্রার খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির মাধুর্য অনেক বেড়ে যায়।
৩. মনিপুর চক্র
আমাদের নাভি ঠিক পিছনের দিকে এই চক্রের অবস্থান। এটিও কিন্তু শরীরের একটি ভীষন শক্তিশালী চক্র।
চক্রের পাপড়ি সংখ্যা....১০টি
অধিষ্ঠাত্রী দেবতা....…. রুদ্র
অধিষ্ঠাত্রী শক্তি........ লাকিনী
অধিদেবতা.......... সূর্য
চক্রের বাহন......... মেষ
তত্ত্ব ............... তেজ
তীর্থ .............. দেবতীর্থ
এই চক্রের সাধক জয়লাভ করলে বা এই চক্র জাগ্রত হলে সাধকের দৃষ্টিশক্তি লক্ষ গুণ বেড়ে যায়। সাধক নিজের ইচ্ছামত দৃষ্টি শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। রাতের অন্ধকারেও দিনের আলোর মত চারিদিক দেখতে পারে।
৪ অনাহত চক্র
এই চক্রটির অবস্থান হল হৃদপিন্ডের পিছন দিকে সুষুম্না কান্ডের অভ্যন্তরে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, যারা physics বা science এর ছাত্র তারা ভালো জানবে 'কোন বস্তুতে আঘাত করলে, তার শব্দ কম্পন যদি ২০বার হয় সেখান থেকে শব্দ উৎপন্ন হয়।' তবে তার জন্য আঘাতের প্রয়োজন।
কিন্তু আমাদের শরীরের ভিতরে বিভিন্ন শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ায় কোন আঘাত ছাড়াই হৃদয়ে ধুক ধুক শব্দ উৎপন্ন হয়। যেহেতু আঘাত বা আহত ছাড়াই শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে সেই কারণে এই চক্রের নাম অনাহত চক্র।
আবার পুরোহিতরা মানস পুজোর সময়ও 'অনাহত ধ্বনির ঘন্টা' ব্যবহার করে থাকে।
চক্রের পাপড়ি সংখ্যা....১২টি
অধিষ্ঠাত্রী দেবতা....…. ঈশ
অধিষ্ঠাত্রী শক্তি........ কাকিনী
অধিদেবতা.......... বিষ্ণু
চক্রের বাহন......... কৃষ্ণ মৃগ
তত্ত্ব ............... বায়ু
তীর্থ .............. নাদতীর্থ
এই চক্র উন্নতি লাভ করলে, সাধকের ত্বকের বা চামড়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে। দেহে আসে উজ্জ্বল রশমির মত তেজ। স্পর্শ শক্তিতে সাধক জয়লাভ করে।
৫. বিশুদ্ধ চক্র
আমাদের বুকের হার এবং গলার মাঝখান স্থানের ঠিক পিছনে সুষুম্না কান্ডে এই বিশুদ্ধ চক্রের অবস্থান। এখানে সমস্ত কিছু শুদ্ধতা অবস্থান করে তাই একে বিশুদ্ধচক্র বলা হয়।
চক্রের পাপড়ি সংখ্যা....১৬টি
অধিষ্ঠাত্রী দেবতা....…. সদাশিব (অর্ধনারীশ্বর)
অধিষ্ঠাত্রী শক্তি........ শাকিনী
অধিদেবতা..........শিব
চক্রের বাহন......... হাকিনী
তত্ত্ব ...............আকাশ
তীর্থ ..............হরিদ্বার বা হরদ্বার
এই চক্রে উন্নতি করতে পারলে সাধক শ্রবণেন্দ্রিয় তথা শ্রবণশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে।
৬. আজ্ঞা চক্র
আমাদের কপাল এবং দুই ভ্রুর মাঝখানে এই চক্রের অবস্থান।
এই চক্রের পাপরি ২টি বা দ্বিদল পদ্ম।
এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা..... পরম শিব
শক্তি....... হাকিনী
এই চক্র সম্পর্কে বিভিন্ন ঘরানা তথা নানা মুনির নানা মত।
বিস্তর তর্ক রয়েছে এই চক্র নিয়ে।
আজ্ঞা চক্র.... আজ্ঞা=order
মানে যেই চক্র আদেশ বা আজ্ঞা দিয়ে থাকে তাকেই আজ্ঞা চক্র বলা হয়।
কোন বস্তুকে আজ্ঞা দেয়?
উপরে যে পাঁচটি চক্র সম্পর্কে আলোচনা হল এদের আজ্ঞা দেয় বা নিয়ন্ত্রণ করে এই আজ্ঞা চক্র।
আবার বিজ্ঞানও বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে তাই বলছে, যেটা হাজার হাজার বছর আগে মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন।
আমাদের মাথাই আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কথা সম্পূর্ণ শরীর কে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই আজ্ঞা চক্রকে Leader of five organs বলা হয়।
উপরে যে আমরা চক্রগুলো পেলাম যেগুলো আমাদের চক্ষু, কর্ণ,নাসিকা, জিহ্বা,ত্বক পঞ্চ ইন্দ্র কে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই চক্রগুলো বা পঞ্চ ইন্দ্রিয়র উপর নেতৃত্ব দেয় বা আজ্ঞা দেয় আজ্ঞাচক্র।
এর পরেই চক্রশেষ। তবে আরেকটি চক্র আছে যেটা ঠিক আমাদের ব্রহ্মতালুতে মানে যেখানে টিক্কি রাখা হয় সেখানে সেই মহা চক্রের অবস্থান তা হলো ''সহস্রার''।
তবে যেহেতু এই চক্র উন্মুক্ত থাকে বা খোলা থাকে তাই একে চক্র হিসেবে ধরা হয় না। এখানে স্বয়ং পরমব্রহ্ম পরম শিবের অবস্থান।
আসলে শক্তি বা ইষ্ট দেবী এই কুণ্ডলিনী চক্র ঘুমিয়ে থাকে সাধন ক্রিয়ার ফলে সাধক যখন একটি একটি করে চক্র ভেদ করে সহস্রারে পরম শিবের সাথে সেই শক্তির মিলন ঘটাতে পারে, তখন সাধকের মোক্ষলাভ ঘটে।
আমাদের শরীরে এই ষটচক্র ছাড়াও ৭২হাজার নারী রয়েছে। প্রত্যেকটা নারীতে একজন করে যোগিনীর অবস্থান রয়েছে। আরো অনেক কিছু রয়েছে। সদ্গুরু ছাড়া এবং সঠিক সাধনা ছাড়া এই উপলব্ধি হয় না।
আমি যতটা সংক্ষেপে বলে গেলাম আদতে ও তার থেকে অনেক অনেক অনেক গুন কঠিন এই চক্র সাধনা।
চূড়ান্ত ধৈর্য চূড়ান্ত শৃঙ্খলা.... এবং অভ্যাসে পটু না হলে, এই ষটচক্র সাধনা বা কুণ্ডলিনী সাধনার চিন্তাও মাথায় আনতে নেই। আর অবশ্যই সঠিক ও সৎ যোগগুরু।
আজ এটুকুই থাক আবার অন্য কোন একদিন কুণ্ডলিনী চক্র সম্পর্কে আরও নিগূঢ় তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
No comments