অবসাদ কাটাতে রঙিন মাছ
নানা মানুষের নানা শখ। আর এই শখের লম্বা তালিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় রঙিন মাছ পোষা। তথ্য বলছে, গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়তার নিরিখে ফোটোগ্রাফির পরই রয়েছে রঙিন মাছ পালনের নেশা। চিকিৎসক থেকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যাকে…
অবসাদ কাটাতে রঙিন মাছ
নানা মানুষের নানা শখ। আর এই শখের লম্বা তালিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় রঙিন মাছ পোষা। তথ্য বলছে, গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়তার নিরিখে ফোটোগ্রাফির পরই রয়েছে রঙিন মাছ পালনের নেশা। চিকিৎসক থেকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছেদের পাখনা মেলে খেলে বেড়ানোর দৃশ্য অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে। কমায় উচ্চ রক্তচাপ। মন ভালো করে দেয়।
বর্তমানে ২৮৮ ধরনের রঙিন মাছ আমাদের দেশে জনপ্রিয়। এর মধ্যে ২৬১ প্রজাতির মাছ ডিম পাড়ে। ২৭ প্রজাতির মাছ সরাসরি বাচ্চা দেয়। এক-একটি মাছের স্বভাব চরিত্র এক-একরকম। কেউ একা থাকতে ভালোবাসে। কারও আবার সঙ্গী হারালে মনখারাপ করতে করতে মারা যায়। শুধু যে শখ কিংবা ঘরের শোভা বর্ধনকারী তা নয়। রঙিন মাছকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে চলছে মোটা টাকার বাণিজ্য। চাহিদা বাড়ায় রঙিন মাছের বাচ্চা উৎপাদনে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে রাজ্যে।উত্তর কলকাতার গ্যালিফ স্ট্রিটে প্রতি রবিবার রঙিন মাছের হাট বসে। মেরিনা কার্প থেকে ক্যাট ফিশ, প্যারোট ফিশ, গোল্ডফিশ, অ্যাঞ্জেলের মতো রঙিন মাছ কিনতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। শুধু রঙিন মাছ কেন, অ্যাকোরিয়াম থেকে অ্যাকোরিয়াম সাজানোর নুড়ি, রঙিন মাছের খাবার সবই মেলে এখানে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে মলি-গাপ্পির পাশাপাশি অ্যাঞ্জেল, গোল্ডফিশ, জাপানি কই কার্প সহ বিভিন্ন রঙিন মাছের বাচ্চা উৎপাদন করা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে।আমদানি করা হচ্ছে জেনেটিক্যালি ইমপ্রুভড রঙিন মাছ। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এইসব মাছের বংশবৃদ্ধিতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। এমনকী কোনও তারতম্য ঘটছে না রঙের।
প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের কথা। শখের বশে মাছ পোষা প্রথম শুরু করেছিল সুমেরিয়ানরা। তবে গোড়ার দিকে মাছ পোষার তালিকায় রয়েছে মিশরীয়রাও। জাপানেও বহু বছর আগে শুরু হয় শখের মাছ পালন। রোমান সাম্রাজ্যের রাজারা অতিথিদের ঘরে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মার্বেল পাথরের তৈরি বড় পাত্রে সাগরের বার্বেল মাছ রাখতেন। চীনের সম্রাট হংউ ঘর সাজাতে গিয়ে গোল্ডফিশের প্রেমে মজেছিলেন। প্রাচীন ইরাকেও ঘরে মাছ পোষার চল ছিল। প্রায় হাজার বছর ধরে চীন ও জাপানে ঘর সাজানোর অঙ্গ হিসেবে গোল্ডফিশ ও কই কার্প বাহারি মাছ খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা ধরনের রঙিন মাছ রয়েছে। যেমন ধরা যাক, ব্ল্যাক মলি। দেখতে কালো। কিন্তু তাতে কী। অত্যন্ত প্রিয়। সব সময়ই সাঁতার কাটতে থাকে। দল বেঁধে থাকে। অন্যদের সঙ্গে থাকতে তেমন একটা আপত্তি নেই। এমনিতে শান্ত স্বভাবের। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর খুবই ক্ষুধার্ত থাকে। খিদের চোটে অনেক সময় নিজের বাচ্চাদেরও খেয়ে নেয়। মলির মতোই চলনবলন গাপ্পির। মূলত ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিলের মাছ। বিচিত্র রং। চোখগুলো একটু বড়। ঠোঁটটা উপরের দিকে ওঠা। মেয়েদের চেয়ে পুরুষের বাহার বেশি। সাইজেও একটু বড়। মেক্সিকোর মাছ সোর্ডটেল। ধরা হয় মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালা এদের স্বদেশ। চেহারায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট। নানা রঙের হয়। তবে চোখ টানে সবুজ ও লালের মিশ্রণ। পুরুষের লেজটা অনেকটা তলোয়ারের মতো। দল বেঁধে থাকতে বেশি পছন্দ করে। প্লেটির আদি বাড়িও মেক্সিকো। হলুদ রঙেরই বেশি দেখা যায়। ঝগড়াঝাটি, অশান্তি একদম না-পসন্দ অ্যাঞ্জেলের। জীবন্ত খাবারই প্রিয়। অন্য মাছের সঙ্গে থাকতে আপত্তি নেই। তবে নিজেদের জুটিতে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। টেক্সাস সিক্লাইডের জন্মস্থান টেক্সাস। শরীরটা তেলাপিয়া মাছের মতো চ্যাপ্টা। দেহে অসংখ্য নীল ছোপ। সঙ্গে ঢেউ খেলানো দাগ। পাথর বিছানো জলাশয় পছন্দের। পাথরের নীচে লুকিয়ে ডিম পাড়ে। মা-বাবা উভয়েই ডিম ও বাচ্চা পাহারা দেয়। রয়েছে ফায়ার মাউথ সিক্লাইভ মাছ। এদের মাথা বড়। উপরের ঠোঁট বাঁকা। গায়ের রং নীলচে ধূসর, বাদামি। গায়ের চামড়া বেগুনি। পুরুষের গলা ও মুখের নীচে লাল। অন্য মাছের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তবে সবাই যে সেটা করে তা কিন্তু নয়। যেমন, ফাইটিং ফিশ। এদের নিজের ঘর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড। লেজের পাখনা গোলাকৃতি। পিঠের পাখনা বেশ লম্বা ও উঁচু। পুরুষরা রংবাহারি। তবে একে অন্যকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। দেখলেই মেজাজ সপ্তমে ওঠে। তেড়ে যায়। সেকারণে একটি অ্যাকোয়ারিয়ামে কখনও দু’টি পুরুষ ফাইটিং ফিশ রাখা যাবে না। তা হলেই চরম গোল বাঁধবে। এদের মেয়েরা অবশ্য ঝগড়াঝাটি করে না। সমগোত্রীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে অসুবিধা হয় না। প্রিয় খাবার জলাশয়ের নীচের শ্যাওলা। তৈরি করে দেওয়া খাবারেও অরুচি নেই।
তবে শুধু যে বিদেশি মাছই অ্যাকোরিয়ামে ঠাঁই পাচ্ছে তা নয়, বাংলাদেশ তো অ্যাকোয়ারিয়াম বন্দি করে ফেলেছে কালা মৌরি, চম্পা, রঙিলা, চাঁপা, কামিলার মতো মাছেদের। তালিকায় রয়েছে কাউয়া, দুইধ্যা, শিং ওয়ালা বিচ্ছু, হাউলা, হিচিরি, উড়াল বিচ্ছুরাও। যেমন দুষ্টুমিষ্টি নাম, তেমনই তাদের বাহার। অনেকগুলিরই বাসস্থান সাগর। কিন্তু এখন তাদের দেখা মিলছে ডাইনিংহলে কিংবা বেডরুমে।
রঙিন মাছেদের নিয়ে মজার সব গল্প শোনালেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার শস্য শ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (মৎস্য বিজ্ঞান) ড. স্বাগত ঘোষ। বললেন, ফাইটার মাছ একদম যেন সিংহের মতো কেশর ফুলিয়ে মারামারি করে। রেগে গেলে রীতিমতো গাল ফোলাতে থাকে। আবার শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় যেভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে ক্যানভাস, ঠিক তেমনই জলের মধ্যে নকশা বানিয়ে ডিম পাড়ে অ্যাঞ্জেল। একেবারে পালকের মতো দেখতে ফেদার ফিশ। আরোয়ানা মাছের স্বভাব আবার অদ্ভুত। ডিম পেড়ে এরা মুখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চা হওয়ার পরও তা এদের শরীরের সঙ্গে অনেকদিন পর্যন্ত লেগে থাকে।
মজার শেষ নেই। কেউ যেমন ডিম পেড়ে লুকিয়ে রাখে। রাত-দিন পাহারা দেয়। কেউ আবার ডিম পাড়তে জলের মধ্যেই পাখির মতো বাসা তৈরি করে। ব্লু গোরামি মাছ জলের মধ্যে বড় একটা বুদবুদ বা ব্লাডারের মতো তৈরি করে। ডিমগুলো এর ভিতরে থাকে। আর ব্লাডারটি ভেসে থাকে জলের উপর। টেট্রা মাছের স্বভাবটা আবার অদ্ভুত। এরা জলের কিনারায় কোনও গাছ থাকলে তার ঝুলন্ত পাতায় ডিম পাড়ে। তার পর মাঝেমধ্যে জলের ঝাপটা দিয়ে ভিজিয়ে রাখে সেই ডিম। পাথরের নীচেও অনেক সময় ডিম পাড়ে। তবে যাই হোক না কেন, ডিম ফুটে বাচ্চা না-হওয়া পর্যন্ত সমানতালে জল ছিটোতে থাকে। অনেক মাছ রয়েছে, যারা একা একাই বড় হয়ে ওঠে। বাবা-মা ন্যূনতম খেয়ালটুকু রাখে না। ডিম পেড়েই তাদের দায়িত্ব শেষ। যেমন, রেড ফিন শার্ক, নিওন টেট্রা, গোল্ডফিশ। কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষা সংস্থানের (কলকাতা) প্রধান বিজ্ঞানী ড. বিজয়কালী মহাপাত্র বলছেন, গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে বছরে ৪৫০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থের ব্যবসা চলছে রঙিন মাছকে ঘিরে। যার মধ্যে ৮৫ শতাংশ আয় হচ্ছে মিষ্টি জলের মাছ থেকে। ব্যবসার বাকি ১৫ শতাংশ সামুদ্রিক মাছেদের দখলে।
No comments