সব তীর্থ বার বার...গঙ্গাসাগর একবার?
সব তীর্থ বার বার...গঙ্গাসাগর একবার, এ কথা শেষ হয়েছে এখন সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই কপিল মুনি আশ্রম এ পুজো দিয়ে ফেরা যায়। তবে মেলার সময় নয় অন্য যেকোনো সময় গিয়েই কপিলমুনির আশ্রম এ পুজো দ…
সব তীর্থ বার বার...গঙ্গাসাগর একবার?
সব তীর্থ বার বার...গঙ্গাসাগর একবার, এ কথা শেষ হয়েছে এখন সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই কপিল মুনি আশ্রম এ পুজো দিয়ে ফেরা যায়। তবে মেলার সময় নয় অন্য যেকোনো সময় গিয়েই কপিলমুনির আশ্রম এ পুজো দেওয়া এবং সেখানে ভারত সেবাশ্রম সংঘ থেকে বহু সংস্থা রয়েছেন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আসুন জেনে নেবো সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার কেন?
স্কন্দপুরাণ অনুসারে দান, ধ্যান, পূজার্চনা, তীর্থভ্রমণ, কঠোর তপস্যা ও যাগযজ্ঞ—সবক’টির মিলিত পুণ্যফল একবার গঙ্গাসাগরে অবগাহনের সমান। মহাভারতে দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য একটিবার মাত্র গঙ্গাসাগর স্নানে। গঙ্গা পতিতোদ্ধারিণী। বেনারসে গঙ্গার জল ও স্থলে মোক্ষ। আর গঙ্গাসাগরে মোক্ষ জল-স্থল-অন্তরীক্ষের সর্বত্র।
পুরাণে গঙ্গা ও গঙ্গাসাগর
শুধু পুরাণ কেন, বেদেও গঙ্গা যথেষ্ট মহিমান্বিত। ঋকবেদের একটি সূত্রে যমুনা, সরস্বতী, শতুদ্রী, পরুষ্ণী, আসিক্লী, মরূৎবৃধা, বিতস্তা, সুষমা প্রভৃতি নদীর সঙ্গে গঙ্গাও সমাসনে সমাদৃতা। সায়নাচার্য জহ্নুকুলজা বলে জাহ্নবী বা গঙ্গাকে অভিহিত করছেন। ঋকবেদের মন্ত্রে (৩/৫৮/৬) জাজ্বল্যমান জাহ্নবী। ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার কমণ্ডলু উৎসারিত হয়ে গঙ্গার মর্তাবতরণ। তবে বিভিন্ন পুরাণে গঙ্গার মর্তে আগমনের বিষয়টি কিঞ্চিৎ ঘোলাটে, স্ববিরোধিতায় ভরা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা বিষ্ণুর তিন ভার্যা। তাঁরা নাকি কলহপ্রিয়, পরস্পরকে অভিসম্পাতে ব্যস্ত। তাদের অপ্রাকৃত চুলোচুলিতে অবশ্য মানুষই সবচেয়ে বেশি লাভবান। পারস্পরিক অভিশাপের গুনাগারে তিন ভার্যাই ধরাধামে নদীরূপে অবতীর্ণা। গঙ্গা, সরস্বতী ও লক্ষ্মী (বা পদ্মা)-র অকৃপণ বারিধারায় সুজলাং-সুফলাং-শস্যশ্যামলাং ধরিত্রী।
কিন্তু ব্রহ্মার কমণ্ডলুতে গঙ্গার উপবেশনের রহস্যটা কী? সে এক মজার কাহিনি। দেবর্ষি নারদ নিজেকে কোকিলকণ্ঠী ভাবতেন। জগতে তাঁর তুল্য বিদগ্ধ সঙ্গীতরসিক নাকি বিরল! এমনটাই তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল। অহংকারে তাঁর মাটিতে পা পড়ত না। যদিও নারদের সঙ্গীতশিক্ষা ছিল অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত। রাগ-রাগিণীর বিনম্র সুর-লহরী বারেবারেই হোঁচট খেত তাঁর কাংস-বিনিন্দিত কণ্ঠে। নারদের আসুরিক সঙ্গীতচর্চায় অতিষ্ঠ রাগ-রাগিণীরা ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়তে লাগলেন অসুস্থ, বিকলাঙ্গ। এক সকালে নারদ তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখলেন তালগোল পাকানো অবস্থায় পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছেন চঞ্চল-কোমল-শীতল-নির্মল সব রাগ-রাগিণীরা। রাগ-রাগিণীদের দুরবস্থার কারণ অনুসন্ধানে নারদ জানতে পারলেন তাঁর অপরিশীলিত সঙ্গীতের ব্যাকরণ বহির্ভূত গায়নেই রাগ-রাগিণীদের এমত দুরবস্থা। একমাত্র মহাদেব শঙ্করই পারেন গান গেয়ে তাঁদের শাপমুক্তি ঘটাতে। প্রমাদ গুনে নারদ ছুটলেন কৈলাসে, হাতে পায়ে ধরে দেবাদিদেবকে রাজি করালেন গান গাইতে।
নারদের সকরুণ মিনতিতে ও রাগ-রাগিণীদের সঙ্কটমোচনে মহাদেব রাজি হলেন গান গাইতে। কিন্তু শর্ত দিলেন তিনি যখন গাইবেন, তখন কেবল দু’জন শ্রোতা— ব্রহ্মা ও বিষ্ণু সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবেন। গান শুরু করলেন জটাজুটধারী মহাদেব। মহাদেবের উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের কানাকড়িও বুঝতে পারলেন না ব্রহ্মা। কিন্তু মহাদেব শঙ্করের গায়কির মোহিনী মূর্ছনা বিষ্ণুর কর্ণের মধ্যে দিয়ে মরমে পশিল। বিষ্ণুর সারা শরীর গলে জল, সেই বানভাসি জল পরিশেষে বিষ্ণুর পায়ের বুড়ো আঙুলকে দ্রবীভূত করে ফেটে বেরিয়ে গোটা স্বর্গেই ডেকে আনল বিধ্বংসী প্লাবন।
দেবতারা পড়লেন আতান্তরে। ব্রহ্মা সাবধানে, পরম স্নেহে, দ্রবীভূত বিষ্ণু শরীরকে সঙ্গোপনে তাঁর কমণ্ডলুতে ভরে রাখলেন। সেই দ্রব বিষ্ণু-সত্তাই মা গঙ্গা। বিষ্ণুর পা বা পাদপদ্ম থেকে উৎসৃত হওয়ায় গঙ্গার অপর নাম বিষ্ণুপদী। কিন্তু কমণ্ডলুবন্দি গঙ্গার ধরাধামে আগমন ঘটল কীভাবে? সগর-পুত্রদের শাপমুক্তির প্রয়োজনে, ভগীরথের কঠোর তপস্যায় গঙ্গার অবতরণ কনক-সুমেরু গুহায়। সেখানকার প্রস্তরীভূত শিলারাশি ভেদ করে প্রকাণ্ড নাদে বিভিন্ন জনপদকে কখনও ডুবিয়ে কখনও ভাসিয়ে গঙ্গা অবশেষে মিলিত হলেন বঙ্গোপসাগরে। সাগরের সঙ্গে গঙ্গার পবিত্র মিলনস্থানটিই আজকের গঙ্গাসাগর।
সগর রাজ ও গঙ্গাসাগর
অযোধ্যার ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সগর। ভাগবত মতে, সগর যখন মাতৃ-জঠরে তখন তাঁর মা যাদবীকে বিষ খাওয়ানো হয়। গর্ভের সন্তান সগরকে হত্যাই ছিল উদ্দেশ্য। ঔর্ব্ব মুনির কৃপায় প্রসূতি ও নবজাতক সে যাত্রায় রক্ষা পান। ‘গর’ বা বিষের অনুষঙ্গে জন্মগ্রহণ বলে নাম ‘সগর’। কৈশিনী আর সুমতি সগরের দুই স্ত্রী। বিনতানন্দন গরুড় সুমতির ভাই, সগররাজের শ্যালক। সুমতির গর্ভে জন্ম ষাট হাজার পুত্রসন্তানের। কৈশিনীর গর্ভে একটিমাত্র অকালকুষ্মাণ্ড পুত্র অসমঞ্জের জন্ম। চরিত্রে সামঞ্জস্যহীনতার অভাবেই নাম অসমঞ্জ। অত্যাচারী, প্রজাপীড়ক হিসাবে অসমঞ্জ ইতিহাসে কুখ্যাত। রাজা সগর অসমঞ্জকে অচিরেই ত্যাজ্যপুত্র করেন। অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান ছিলেন একেবারে বাবার বিপ্রতীপ। ধীর-স্থির-বিনয়ী, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। রাজা সগরের অত্যন্ত আস্থা-ভাজন। সগর অশ্বমেধ যজ্ঞে ব্রতী হলেন। সেনাধিপতি অংশুমান। অশ্বমেধের যজ্ঞাশ্ব ভুবন জয় করে নির্বিঘ্নে ফিরে এল অযোধ্যায়। অর্থাৎ যজ্ঞ সফল, সুসম্পন্ন। এবার অশ্বটিকে বলি দেওয়ার পালা বা আলম্ভন। তাহলেই স্বর্গের প্রবেশদ্বার হবে সগরের জন্য উন্মুক্ত। দেবতাদের সঙ্গে একাসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করবেন পুঁচকে মানুষ সগর!
দেবরাজ ইন্দ্রের গা রি রি করে উঠল। অশ্বমেধ যজ্ঞ ভেস্তে দিতে ঘোড়াটিকে চুরি করে ইন্দ্র পাতালে কপিলমুনির আশ্রমে লুকিয়ে রাখলেন। কথিত রয়েছে, অনন্তনাগের মতো কপিলমুনিও সসাগরা ধরিত্রীকে ধারণ করে আছেন। এদিকে যজ্ঞ লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার দুশ্চিন্তায় রাজা সগর মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করলেন। স্বর্গে প্রবেশের চাবিকাঠি হাতের মুঠোয় এসেও ফস্কে যাবে। হবে না মোক্ষ লাভ! ক্রোধান্ধ সগররাজ সত্বর তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে যজ্ঞাশ্ব পুনরুদ্ধারে পাঠালেন। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হৃত যজ্ঞাশ্বের হদিশ মিলল না। রাজা তখন তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে পাতাল ঢুঁড়ে অশ্বের সন্ধানে ঝাঁপাতে আদেশ দিলেন। হল্লা পাকাতে পাকাতে পাতাল প্রবেশের পর সগর-সন্তানেরা হাজির হল কপিলমুনির শান্ত-নিরুপদ্রব আশ্রমে। নির্বিবাদী কপিলমুনি ধ্যানমগ্ন, ঘোড়া চুরির বিন্দুবিসর্গেও তিনি অবগত নন। দেবরাজ ইন্দ্রও অশ্বমেধের ঘোড়াটিকে কপিলমুনির আশ্রমে বেঁধে রেখে পিঠটান দিয়েছেন। সগর সন্তানরা ভাবল, চোর তাহলে কপিল মুনিই। সুতরাং দে ব্যাটাকে উত্তমমধ্যম।
হতবাক, স্তম্ভিত কপিল। কিছুই বুঝতে পারছেন না। ষাট হাজার দুর্বিনীত উচ্ছৃঙ্খল ছোকরার বেয়াদপিতে রুষ্ট কপিল রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাদের সকলকে ভস্ম করে দিলেন। মাস, বর্ষ পার হয়ে গেল সগর রাজার ষাট হাজার সন্তান ভোজবাজির মতো উবে গেল! শোকাচ্ছন্ন, অনুতপ্ত, বিনিদ্র সগররাজ তাঁর নাতি অংশুমানকে বললেন যাও তো দাদুভাই, খোঁজ নাও তোমার পিতৃব্যদের। চিরুনি তল্লাশির পর কপিলমুনির আশ্রমে অংশুমান তাঁর কাকাদের মর্মান্তিক পরিণতির কথা জানতে পারলেন। অশ্বটিকে নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে ফিরে দাদু সগরকে সবিস্তার হৃদয়বিদারক সেই ঘটনার বিবরণ দিলেন। অশ্ব ফিরে পাওয়ায় অশ্বমেধ মারফত যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল। কিন্তু পুত্রশোকে কাতর সগর স্বর্গদ্বারের আকিঞ্চন ছেড়ে দিনরাত বিলাপ করতে থাকলেন। বীতশোক সগরের কাছে প্রাধান্য পেল পুত্রশোকের কৈবল্য, স্বর্গের সঞ্জীবনী সুধা নয়।
সগররাজের দুরবস্থায় বিচলিত শ্যালক গরুড়, দেবতাদের সুপরামর্শে একটি উপায় বাতলালেন। বললেন স্বর্গে অবরুদ্ধ গঙ্গাকে মর্তে আনতে পারলেই শাপমুক্তি ঘটবে সগর সন্তানদের। সে যে বড় দুরূহ কাজ! ত্রিশ হাজার বছর অতিবাহিত, সগররাজ পরলোকগত। পরিশ্রম, পরিকল্পনা, অধ্যবসায়, স্তব-স্তুতির আতিশয্যে অংশুমান ততদিনে বিদায় নিয়েছেন ধরাধাম থেকে। আরদ্ধ কাজ অসম্পূর্ণ অদ্যপি। সিংহাসনে আসীন অংশুমান পুত্র দিলীপ। তিনিও রণেভঙ্গ দিয়েছেন। আসরে নামলেন দিলীপপুত্র ভগীরথ। মন্ত্রের সাধন অথবা শরীর পাতনকে সংকল্প করে ভগীরথ শুরু করলেন ব্রহ্মাভজনা। ব্রহ্মা তুষ্ট হলেই গঙ্গা কমণ্ডলুমুক্ত হয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করতে পারেন। দীর্ঘ ক্লেশকর তপস্যায় সন্তুষ্ট ব্রহ্মা গঙ্গাকে মর্তে অবতরণের অনুমতি দিলেন।
কিন্তু গঙ্গার প্রবল স্রোতধারাকে রুখবে কে? প্রলয়ঙ্কর স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে যে গোটা পৃথিবীই! একমাত্র দেবাদিদেব মহেশ্বর পারেন জটাজালে গঙ্গাকে কিছুকাল আবদ্ধ রাখতে। সুতরাং ভগীরথ শরণাপন্ন মহাদেবের। জটাজালে অবরুদ্ধ ভীমপ্রলয়ী গঙ্গার জলধারা কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলে শিব জটার একপাশ চিরে গঙ্গাকে মুক্ত করে দেন, ভগীরথ গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন মর্তাভিমুখে। গঙ্গা সমর্পিতা হন সাগরের প্রশস্ত বুকে, গঙ্গাসাগরে। যেখানে অতৃপ্ত, বিদেহী ষাট হাজার সগরসন্তান হা-পিত্যেশ করে করে বসে আছেন গঙ্গোদকের। অবশেষে তিন পুরুষ পার করে ভগীরথের কঠোর তপস্যায়, গঙ্গার পূত-পবিত্র বারিধারায় সিঞ্চিত হয়ে সগর-পুত্রদের ঘটে শাপমুক্তি। স্বর্গে মন্দাকিনী, পাতালে ভোগবতী আর মর্তে গঙ্গা বা ভাগীরথীর সঙ্গে অযোধ্যার রাজা সগর বংশের যোগ নিবিড়।
অযোধ্যার নাম গঙ্গাসাগরের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় মকরস্নানের প্রণামীর পুরোটাই চলে যায় অযোধ্যার ‘রামানন্দীয় নির্বাচনী আখড়া’ বা ‘হনুমানগড়ি’ চটিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরও গঙ্গাসাগরের বিশাল তীর্থকর থেকে আজও পুরোপুরি বঞ্চিত। ঘটনার ঘনঘটার শেষ কিন্তু এখানেই নয়। ভগীরথ যখন সন্তর্পণে গঙ্গাকে পথপ্রদর্শন করে নিয়ে চলেছেন গঙ্গাসাগর অভিমুখে তখন সামান্য অসতর্কতায়, গঙ্গার প্রবল স্রোতে জহ্নু মুনির আশ্রমটি গেল ভেসে! যজ্ঞের সমুদয় উপকরণ, আহৃত ফলমূল অচানক বিনা নোটিসে ভেসে যাওয়ায় ক্রোধান্ধ জহ্নুমুনি এক চুমুকে গঙ্গার সম্পূর্ণ জলরাশি নিঃশেষ করে ফেললেন। মাথায় হাত ভগীরথের! অনন্যোপায় ভগীরথ শুরু করলেন জহ্নু তোষণা। তৃপ্ত মুনিবর জানু চিরে গঙ্গাকে স্ব-মহিমায় মুক্তি দিলেন। ভগীরথতনয়া গঙ্গা হলেন জাহ্নবী।
মাঘ থেকে আষাঢ় মাসে সূর্যের গতিপথ উত্তরায়ণ অনুসারী, পৌষ বা মকর সংক্রান্তি উত্তরায়ণে সমাপিত। উপনিষদ বা গীতার ভাষ্যে, উত্তরায়ণ হল দেবযান পথ আর দক্ষিণায়ন পিতৃযান। উত্তরায়ণ বা দেবযানে মৃত্যু অনাবৃত্তি বা মুক্তি। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা। দক্ষিণায়ন বা পিতৃযানে মৃত্যুর অর্থ পুনরাবৃত্তি, বন্ধন, বারে বারে শোক-তাপ-জরাক্লিষ্ট সংসারে ফিরে আসা।
কপিলমুনি ও গঙ্গাসাগর
সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা সাংখ্যাচার্য কপিল ছিলেন কর্দম প্রজাপতি ও মনুকন্যা দেবহৃতির পুত্র। ভাগবতের মতে, সাংখ্যদর্শনের জনক মহর্ষি কপিল স্বয়ং নারায়ণের অবতার। গীতায় কৃষ্ণ সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে কপিলকে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন (গীতা ১০/৬)। শ্বেতাশ্বেতর (৫/২) উপনিষদেও কপিল ব্রহ্মজ্ঞানী বলে উল্লিখিত। কপিলকে ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম জ্ঞানী-বিদ্বান-উপদেষ্টা বলে সাংখ্যবাদীরা মনে করেন। কপিল স্বশিক্ষিত স্বয়ম্ভু, তাই তাঁর কোনও গুরু নেই। রামায়ণ অনুসারে, বঙ্গোপসাগর সন্নিকটে বর্তমানের গঙ্গাসাগর মেলাপ্রাঙ্গণের কাছেই পাতালে সুগুপ্ত ছিল নাকি কপিলমুনির সুপ্রাচীন আশ্রমটি।
আনুমানিক ৪৩৪ শতাব্দীতে নির্মিত কপিলমুনির মন্দিরটির সন্ধান মেলে পুরাতত্ত্বীয় খননকার্যে। তারপর বেশ কয়েকবার সমুদ্রের প্রমত্ততায় উদ্বাস্তু হন কপিল। বর্তমানের মন্দিরটি নাকি সাতবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর ১৯৭১-এ (মতান্তরে ১৯৭৪) পুনর্নির্মিত হয়। মন্দিরে মধ্যমণি প্রস্তর-নির্মিত কপিল। কপিলের বাঁদিকে সগররাজ ও ডানে মা গঙ্গা অধিষ্ঠিতা। গঙ্গার কোলে দীপ্যমান ভগীরথ। সগররাজের বামে সিংহবাহিনী শ্রীবিশালাক্ষী এবং সর্ববামে অশ্বস্তেন ইন্দ্রদেব। স্বামী নির্মালানন্দের ‘গঙ্গামাহাত্ম্য ও গঙ্গাসাগর তীর্থের কথা’ অনুসারে তাই বলাই যায়, ‘একদিকে কলুষ-নাশিনী সুরেশ্বরী গঙ্গার সাগরসঙ্গতি, অন্যদিকে নারায়ণাবতার, মহাযোগী, মহাতপস্বী, বিশ্বের আদি মহাজ্ঞানী ভগবান কপিলের অধিষ্ঠান—দু’য়ে মিলে গঙ্গাসাগরের গুরুত্ব ও মহিমার পূর্ণ সমুদ্ভাস। তাই বলা হয়েছে—গঙ্গাসাগরের সর্বত্রই মোক্ষ— জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে।’
No comments