সাধক কবি কমলাকান্ত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন: চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী সিদ্ধপীঠ-তমাল দাশগুপ্ত
সাধক কমলাকান্তের প্রথম জীবনে যেখানে সাধনা ও সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাঁর মাতুলালয় চান্না গ্রামের যে বিশালাক্ষী মায়ের থানে পঞ্চমুণ্ডি আসনে তিনি তন্…
সাধক কবি কমলাকান্ত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন: চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী সিদ্ধপীঠ-তমাল দাশগুপ্ত
সাধক কমলাকান্তের প্রথম জীবনে যেখানে সাধনা ও সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাঁর মাতুলালয় চান্না গ্রামের যে বিশালাক্ষী মায়ের থানে পঞ্চমুণ্ডি আসনে তিনি তন্ত্রের দুরূহ পথে গমন করে তন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন, সেই চান্না বিশালাক্ষী মাতা সম্পর্কে আলোচনা প্রায় হয় না বললেই চলে। এর কারণ হল প্রদীপ জ্বলে ওঠার আগে সলতে পাকানোর পর্বটি সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবহেলা করি, প্রজ্জ্বলিত শিখাটিই কেবল আমাদের কাছে আদরের বস্তু। অনেক পরিশ্রম, কঠোর সাধনা ও কৃচ্ছসাধনে যে ফলটি উৎপন্ন হয়, সে ফলের সম্পর্কে রসিকজন অবহিত হতে গেলে অবশ্যই ফলনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে খোঁজ নেবেন, কেবল ফল খেয়েই আশ কিন্তু তাঁদের মিটবে না। সেরকমভাবে শহর বর্ধমানে কমলাকান্ত কালীবাড়ি আমাদের সকলের কাছেই সুপরিচিত, আগে লিখেছি সেই পীঠস্থানমন্দির সম্পর্কে, কিন্তু শৈশবে কৈশোরে ও তারুণ্যে কমলাকান্তের সাধনভূমি চান্না গ্রাম, সেখানে যে মা বিশালাক্ষীর মন্দির বিরাজমান, এবং সেখানে পঞ্চমুণ্ডি আসনে কমলাকান্ত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, সেই স্থানটি আমাদের কাছে আগ্রহের বিষয়, চান্না বিশালাক্ষী কেবল কমলাকান্ত জীবনীর ফুটনোট হয়েই থেকে গেলে চলবে না। গাছের শেকড়কে অবহেলা করলে গাছের প্রতিই অবহেলা করা হয়, তাই চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী সম্পর্কে জানা মাতৃ-উপাসক বাঙালি মাত্রেই কর্তব্য।
পূর্ব বর্ধমানের গলসি ব্লকের চান্না গ্রাম। বর্ধমান থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার পথে পড়ে খানা জংশন। এই খানা জংশন থেকে উত্তর দিকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার গেলে পাওয়া যায় এই চান্না গ্রাম। এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খড়ি বা খড়্গেশ্বরী নদী। সাধক কমলাকান্ত জন্মেছিলেন বর্ধমানের অম্বিকা কালনায়, পিতৃহীন হয়ে মাতুলালয় চান্না গ্রামে চলে আসেন। এই গ্রামে তিনি শৈশব অতিবাহিত করেন, এবং শৈশব থেকেই এই গ্রামে বনের মধ্যে নির্জন বিশালাক্ষী মন্দির ছিল তাঁর প্রিয় সাধনস্থান, এখানে বসে তিনি গান রচনা করে মা বিশালাক্ষীকে শোনাতেন, প্রখ্যাত আছে। মন্দিরের পাশে শিমুল গাছের তলা ছিল তাঁর প্রিয় স্থান। যৌবনে এই চান্না গ্রামে থাকাকালীন তিনি বিবাহ করেন, প্রথমবার স্ত্রীবিয়োগও ঘটে এখানেই। এরপর কৌলসাধক কেনারাম চট্টপাধ্যায়ের কাছে তন্ত্রদীক্ষা নিয়ে তিনি চান্না বিশালাক্ষী মন্দিরে পঞ্চমুণ্ডি আসনে সাধনা শুরু করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন।
এখানে মা বিশালাক্ষী জাগ্রত, এই মর্মে অনেক কাহিনী প্রচলিত ছিল।
একবার রাতের বেলায় এই মন্দিরে মাছভোগ দিতে হবে, কমলাকান্ত তখনও ভোগের জন্য মাছ ধরতে পারেননি, কথিত আছে বাগদী রমণীর রূপে মা বিশালাক্ষী স্বয়ং এসে দুটি মাগুর মাছ দিয়ে গেছিলেন কমলাকান্তকে।
কিন্তু এই মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণরা বর্তমানে রাতে কেউ এই চত্ত্বরে আসেন না, রাতে আর মায়ের পুজো হয় না, কেবলমাত্র সকালে ফলমূল দিয়েই পুজো হয়, কোনও অন্নভোগ নয়, এবং রাতে যে আসেন না, সেটি সম্ভবত প্রতীকী কারণেই আসেন না, কারণ এ মন্দিরটি রাতের বেলায় আমাদের শেকড়ে আবহমানকালের তন্ত্রধর্মী সভ্যতার প্রাণবিন্দু মা এবং এই ভূমির পুত্রকন্যাদের কাছে ফেরত যায়, তখন আর বৈদিক পৌরাণিক বর্ণবাদী সনাতনীর অধিকার থাকে না।
বস্তুত এ কেবল ভাবের কথা নয়। এই সিদ্ধপীঠে মন্দিরের মধ্যে তথাকথিত মূর্তি নেই, আছে পাঁচটি ডিম্বাকৃতি মুখব্যাদানকারী লোলজিহ্ব দেবীমস্তক, এই পাঁচ মাতৃকার একত্রে পুজো হয় বিশালাক্ষী ধ্যানে। মন্দিরটিতে অবস্থিত মুণ্ডাকৃতি মূর্তিসমূহের সঙ্গে রাঢ় ভূমিতে বেদ-বহির্ভূত ধর্মঠাকুরের উপাসনার প্রবল সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। এবং এ মন্দিরের পাশেই মারাং বুরু মন্দির আছে। আষাঢ় মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে মা বিশালাক্ষীর পুজো হয় বিরাট ধুমধামে, সে পুজোর উৎসব শুরু হয় এই মারাং বুরু মন্দিরে অনেকগুলি শূকর বলি দিয়ে, তারপর মা বিশালাক্ষীর জন্য পাঁঠা বলি হয়। এই আষাঢ় নবমী তিথিতে চান্না বিশালাক্ষী মন্দির চত্ত্বরে মেলা বসে।
চান্না বিশালাক্ষী মন্দিরে পূজিত পাঁচটি মুণ্ড আকৃতির মাতৃপ্রতিমা সম্পর্কে বলা হয়, মা বিশালাক্ষী আসলে অষ্ট মাতৃকার সমাহার, সেই আটজনের মধ্যে পাঁচজন এই মন্দিরে বিরাজ করেন। এই পাঁচজন হলেন এনাক্ষী, দ্বিরাক্ষী, বিশালাক্ষী, রক্তাক্ষী ও সুলোচনা। এছাড়া পদ্মাক্ষী ও কোটরাক্ষী থাকেন সারুল গ্রামে, এবং ত্রিলোচনা বা বাশুলী আছেন চণ্ডীদাসের জন্মস্থানে।
এই মন্দিরে উপাস্য বিশালাক্ষীর ছবি তোলা বারণ। তাই বিরাজমান মা বিশালাক্ষী মাতৃকাগণের ছবি পাওয়া যায় না।
বিশালাক্ষী মন্দিরটি চান্না গ্রামের ঈশান কোণে। এই মন্দিরের বায়ু কোণে পুকুরপাড় সংলগ্ন পঞ্চমুণ্ডি আসনে কমলাকান্ত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। মন্দির চত্ত্বরে কমলাকান্তের একটি মূর্তি আছে, এবং এই গ্রামে তাঁর বাসস্থানেও তাঁর মূর্তি স্থাপিত আছে। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত চান্না বিশালাক্ষী মন্দিরের ছবি দিলাম।
এই চান্না এককালে অতীব দুর্গম স্থান ছিল। চান্নার কাছেই ওড়াগাঁয়ের ডাঙায় একবার কমলাকান্ত ডাকাতদের কবলে পড়ে গান বেঁধেছিলেন:
"আর কিছু নাই শ্যামা মা কেবল তোমার দুটি চরণ রাঙা
শুনেছি তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি অতএব হলেম সাহস ভাঙা।
জ্ঞাতি বন্ধু সুত দারা সুখের সময় সবই তারা
বিপদ কালে কেউ কোথা নাই ঘর বাড়ি ওড়াগাঁয়ের ডাঙা।"
চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দির বাঙালির তন্ত্রধর্মের অনির্বাণ শিখা, বাঙালির আবহমান শাক্তধর্মের অন্যতম সিদ্ধপীঠ।
চান্না গ্রামে কমলাকান্তের মূর্তি এবং বিশালাক্ষী মন্দিরের ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
No comments