মা জহুরা কালী: ত্রিমুখ গৌড়েশ্বরী -তমাল দাশগুপ্ত
◆ মা কোথায় অধিষ্ঠিত? ইংরেজবাজার শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে যদুপুর-২ গ্রামপঞ্চায়েতের গোবিন্দপুর মৌজার জহুরাতলা কালীমন্দিরে মা অবস্থান করেন। জেলা মালদা।
★ মায়ের থান কত পুরোনো? লোকমুখে ক…
মা জহুরা কালী: ত্রিমুখ গৌড়েশ্বরী -তমাল দাশগুপ্ত
◆ মা কোথায় অধিষ্ঠিত? ইংরেজবাজার শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে যদুপুর-২ গ্রামপঞ্চায়েতের গোবিন্দপুর মৌজার জহুরাতলা কালীমন্দিরে মা অবস্থান করেন। জেলা মালদা।
★ মায়ের থান কত পুরোনো? লোকমুখে কথিত আছে সেনযুগে বল্লাল সেনের সময় থেকে এই জায়গায় মা কালী পূজিত হচ্ছেন। পুরোনো মূর্তিটি মুসলমান আমলে মাটির স্তূপে ঢেকে দেওয়া হয় আক্রমণ এড়াতে। মা বর্তমান মন্দিরে বর্তমান রূপে উপাস্য হচ্ছেন নবাবী আমল থেকে, প্রায় তিনশ বছর আগে এই অঞ্চলে ভগ্নদশাগ্রস্ত পুরোনো গৌড়ের গড়ে গজিয়ে ওঠা ঘন অরণ্যে সাধনা করতেন তেওয়ারী পদবীর এক কালীসাধক। তিনি জহুরা চণ্ডীর দিব্যদর্শন লাভ করে এখানে পুজো শুরু করেন, গড়ের চূড়ায় বিস্তৃত প্রাঙ্গণে বেদী স্থাপন করে জহুরা চণ্ডীমাতার উপাসনা শুরু হয়। যদিও মা আজ সর্বত্র জহুরা কালী নামেই পরিচিত।
■ মায়ের মূর্তিকল্প কেমন? মা রক্তবর্ণা, লোলজিহ্বা, বরাহদন্তিকা, ত্রিনেত্রা, করালবদনা।
মায়ের মূর্তিটি মুসলমান আমলে মাটির স্তূপে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। পুনরায় পুজো যখন শুরু হল, ওই সিঁদুরমাখা মাটির স্তূপের ওপরে মায়ের তিনটি মুখ তৈরি করা হয়।
মায়ের তিনটি মুখ নিঃসন্দেহে তন্ত্রের ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার দ্যোতনা বহন করে। এছাড়াও, মায়ের তিনটি মুখ প্রাচীন বাঙালি অর্থাৎ গৌড়ীয় জাতির তিনটি প্রধান ভৌগলিক অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে: বরেন্দ্র, রাঢ়, বঙ্গ।
● মায়ের এই নামের অর্থ - খুব সম্ভবত গৌড়কালী বা গৌড়চণ্ডী থেকে মধ্যযুগে জহুরাকালী বা জহুরাচণ্ডী নাম এসেছে।
মধ্যযুগে মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মাত্রেই সরকারি বয়ানে ডাকাত আখ্যা পেত। ডাকাত শব্দটা এসেছে ডাক লুন্ঠন থেকে, সরকারি খাজনা এই ডাকমাধ্যমে পাঠানো হত, এবং সেটাকে লুট যারা করত, তাদেরই ডাকাত বলা হত। বাঙালি ডাকাতরা অনেকেই কালীপুজো করতেন, কাজেই জহুরাকালীও তাঁদের দ্বারা উপাস্য হবেন আশ্চর্য নয়। ডাকাতদের লুণ্ঠিত (অথবা পুনরুদ্ধারকৃত, ডিপেন্ডিং অন পারস্পেকটিভ) ধনরত্ন থেকেই নাকি মায়ের এই নাম। কিন্তু আরবি শব্দ জবাহর (ধনরত্ন) থেকে জহুরা আসার কথা নয় ভাষাতত্ত্বের নিয়মে, যদিও কয়েকজন গবেষক জহুরা শব্দের ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে আরবি জবাহর অবধি চলে গেছেন, এখানে ডাকাতরা ধনরত্ন লুকিয়ে রাখতেন এবং মায়ের পুজো করতেন, সেখান থেকে নাম।
প্রসঙ্গত মুসলমানরা মধ্যযুগে গৌড় লিখতে বা বলতে পারতেন না ফার্সি ভাষায়, কাছাকাছি যা পারতেন সেটা হল গোর। যার অর্থ কবর। এজন্য গৌড় নামটা তারা ব্যবহার করতে চাইতেন না পারতপক্ষে, সুখময় মুখোপাধ্যায় বলেন। এমন অসম্ভব নয় যে গৌড়ের সমার্থক শব্দ হিসেবে এরকম জহুরা ধরনের শব্দ এ সময় চালু হয়ে থাকবে। আরবি ভাষার জ এবং ফার্সি ভাষার গ পরস্পর স্থান পরিবর্তন করে প্রায়শ, কাজেই গৌড় থেকে জহুরা অসম্ভব নয়।
◆ মায়ের পুজো কখন? সারা বছরই মঙ্গল ও শনিবারে মায়ের পুজো হয়, কিন্তু বৈশাখ মাসের প্রথম শনি/মঙ্গলবার থেকে শেষ শনি/মঙ্গলবার অবধি মায়ের বাৎসরিক পুজোয় এখানে মহা ধুমধাম হয়, অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে মহাসমারোহে উৎসব ও মেলা বসে। তবে মায়ের পুজোয় অন্নভোগ হয় না এখানে। বাতাসা, সন্দেশ আর জবাফুলেই মা সন্তুষ্ট হন।
ছবি ইন্টারনেট থেকে।
বলা দরকার, পশ্চিমবাংলায় অন্য কয়েকটি স্থানেও মা জহুরা কালীর মন্দির আছে। সর্বত্র মূর্তিকল্প মালদার অনুরূপ, স্তূপের উপর মায়ের ত্রিমুখ স্থাপিত। মা আমাদের গৌড়েশ্বরী। তাই তাঁর জয়ধ্বনিতে প্রাচীন গৌড়ের সুখস্মৃতি জাগরুক হয়। তাঁর ত্রিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমাদের আবহমানকালের তন্ত্রাশ্রয়ী ধর্মের প্রাচীন গরিমা পরিস্ফুট হয়।
জয় মা, জয় মা, জয় মা।
No comments