মা সর্বমঙ্গলা বর্ধমানেশ্বরী-তমাল দাশগুপ্ত
মা সর্বমঙ্গলার উল্লেখ সপ্তদশ শতকে রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে পাওয়া যাচ্ছে: বর্ধমানে বন্দো দেবী সর্বমঙ্গলা। সপ্তদশ শতকের আগেই সেক্ষেত্রে সর্বমঙ্গলা প্রসিদ্ধ ছিলেন। সুকুমার সেন বলেন যে সপ্…
মা সর্বমঙ্গলা বর্ধমানেশ্বরী-তমাল দাশগুপ্ত
মা সর্বমঙ্গলার উল্লেখ সপ্তদশ শতকে রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে পাওয়া যাচ্ছে: বর্ধমানে বন্দো দেবী সর্বমঙ্গলা। সপ্তদশ শতকের আগেই সেক্ষেত্রে সর্বমঙ্গলা প্রসিদ্ধ ছিলেন। সুকুমার সেন বলেন যে সপ্তদশ শতক থেকেই বর্ধমানের স্থানেশ্বরী হিসেবে মা সর্বমঙ্গলা পূজিত হচ্ছেন।
কিন্তু মায়ের বর্তমান পীঠস্থানটি সপ্তদশ শতকের পরে নির্মিত। যুক্তিসঙ্গত অনুমান করা যায়, মা সর্বমঙ্গলা এই অঞ্চলে বর্তমান মন্দির নির্মিত হওয়ার আগে থেকেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। কারণ রূপরামের পরেই দেখি মানিকরামও তাঁর ধর্মমঙ্গলে মা সর্বমঙ্গলার স্তুতি করেন।
বর্ধমান রাজ কীর্তিচন্দ্র ১৭০২-১৭৪০ সালের মধ্যে কোনও এক সময় কাঞ্চন নগরে মায়ের প্রতিমার বর্তমান অধিষ্ঠান মন্দিরটি স্থাপন করেন। কিন্তু মায়ের মূর্তিটি প্রাচীন, এটি বাহির সর্বমঙ্গলা মৌজায় চুনারী পুষ্করিণী থেকে পাওয়া গেছিল।
সম্ভবত মধ্যযুগে মুসলমান আক্রমণের সময় মূর্তিটি পুকুরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিংবদন্তী অনুযায়ী পালসেনযুগে গদাধর নামে এক রাজা এখানে মা সর্বমঙ্গলার উপাসনা করতেন।
মা সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি কষ্টিপাথরের তৈরি (১১ ইঞ্চি × ৮ ইঞ্চি) অষ্টাদশভুজা সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা। মূর্তির নীচে কিছু লেখা আছে, সে লিপি আজ পর্যন্ত পাঠোদ্ধার করতে পারেন নি কেউ। অনেকে লিপির দুর্বোধ্যতা হেতু মূর্তির খ্রিষ্টপূর্ব যুগের প্রাচীনত্ব অনুমান করেন, কিন্তু ব্যবহৃত লিপিটি প্রাচীন বা গুহ্য হলেই মূর্তি খ্রিষ্টপূর্ব যুগের হয় না। মায়ের এই মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী রূপ পালসেনযুগের নির্মাণ, তাতে সন্দেহ নেই।
মায়ের মহিষমর্দিনী রূপ অতীব প্রাচীন এবং খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকেই উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া যায়। কিন্তু সেই মহিষমর্দিনী থেকে বিবর্তিত হয়ে মহিষাসুরমর্দিনী রূপ কোনোমতেই সপ্তম শতাব্দীর আগে কোথাও পাওয়া যায় নি। অপর দিকে মায়ের সিংহবাহিনী রূপের সংশ্লেষ কুষাণ যুগের আগে ঘটেনি। মায়ের এই দুই রূপ একত্রিত হয়ে সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী দশভুজা মূর্তি পাওয়া যায় পালযুগ থেকে। অষ্টাদশভুজা দুর্গার উপাসনার প্রচলন সেনযুগে ছিল, ছবি আগে দিয়েছি, আজও দিলাম। আমি দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনীর আইকোনোগ্রাফিক বিবর্তন নিয়ে আগে এই পেজেই লিখেছি।
শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুযায়ী মা অষ্টাদশভুজার ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়, তাঁকে মহালক্ষ্মী বলা হয়েছে (মহালক্ষ্মী সিংহবাহিনী হন)। এই অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর হাতে নিম্নোক্ত আয়ুধগুলি থাকে: জপমালা, কুঠার, গদা, শর, বজ্র, পদ্ম, ধনু, কমণ্ডলু, দণ্ড, শক্তি, অসি, ঢাল, শঙ্খ, ঘন্টা, সুরাপাত্র, শূল, পাশ, সুদর্শনচক্র।
জয় মা বর্ধমানেশ্বরী সর্বমঙ্গলা!
© Tamal Dasgupta
মা সর্বমঙ্গলার চিত্র এবং মেট মিউজিয়ামে রক্ষিত সেনযুগের অষ্টাদশভুজা দুর্গার চিত্র ইন্টারনেট থেকে।
No comments