দোলনচাঁপা-পুষ্পিতা ভৌমিক
__"তোমার রংতুলি গুলো সব ব্যাগের মধ্যে ভরে দিয়েছি শহরের বাবু। আবার কবে আসবে তুমি এই গ্রামে? শহরে ফিরে আমার কথা তোমার মনে থাকবে তো বাবু?"; ভারাক্রান্ত স্বরে দোলনচাঁপা জিজ্ঞাসা করে তরুণ চিত্রশিল্পী…
দোলনচাঁপা-পুষ্পিতা ভৌমিক
__"তোমার রংতুলি গুলো সব ব্যাগের মধ্যে ভরে দিয়েছি শহরের বাবু। আবার কবে আসবে তুমি এই গ্রামে? শহরে ফিরে আমার কথা তোমার মনে থাকবে তো বাবু?"; ভারাক্রান্ত স্বরে দোলনচাঁপা জিজ্ঞাসা করে তরুণ চিত্রশিল্পী কমলেন্দু সান্যালকে।
___"শোনো দোলন কোন ভয় নেই তোমার। আমি বাড়িতে সবকিছু বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাব কলকাতা শহরে। ওখানে আমার বউ পরিচয়ে মাথা উঁচু করে থাকবে তুমি। তাছাড়া তুমি এত সুন্দর সেলাইয়ের কাজ পারো। কতো সুন্দর নকশিকাঁথা, আড়িকাঠের কাজ এগুলো শাড়ির উপর ফুটিয়ে তুলতে পারলে সত্যিই অসাধারণ হবে। তোমার নিজেরও অনেক নামডাক হবে শহরে।আমি যথাসাধ্য দেখছি আমার চেনাপরিচিত লোকজনদের বলে। সবকিছু গুছিয়ে খুব তাড়াতাড়ি আসবো তোমাকে নিয়ে যেতে। এখন একটু কাছে এসো সুন্দরী। যাবার আগে তোমার শরীরে আমার আদর এঁকে দিই।"; দোলন ওরফে দোলনচাঁপাকে নিজের বুকের খুব কাছে টেনে নিতে নিতে বলে কমলেন্দু। অন্তরঙ্গ হয় ওরা দুজনে। লালমাটির দেশে ছবি আঁকতে গেছিলেন আর্ট কলেজের শিল্পী কমলেন্দু সান্যাল।
একটি আন্তর্জাতিক চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন উনি যার বিষয় গ্রামের পটভূমিতে একটি গ্রাম্য মেয়ের জীবনযাত্রার নানান ভঙ্গিমা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এক পরিচিতর মারফৎ খবর নিয়ে কমলেন্দু নিজের গন্তব্য ঠিক করেছিলেন বীরভূম। ওখানে এক অখ্যাত গ্রামে কিছুদিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কমলেন্দুবাবু। সেখানেই এই দোলনচাঁপাই হয় ওনার ছবির নায়িকা। যদিও গ্রামের দিকে এগুলো কেউ বিশেষ সুনজরে দেখেনা। কিন্তু শহরের বিশাল নামকরা শিল্পী এবং দোলনকে উনি বিয়ে করবেন এসব বলেকয়ে দোলনের মা বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন কমলেন্দু। দোলন গরীব ঘরের মেয়ে, কলকাতায় বড়ঘরে বিয়ে হবে, নামকরা শিল্পীর বউ হবে শুনে কমলেন্দুকে খুব সহজেই গ্রাম্য সরলতায় বশে ভরসা করেছিলেন দোলনের মা আর বাবা। কিন্তু তারপর যা হয় আর কী! শহরে ফিরে আসার পর থেকে শ্যামলা গায়ের কাজলা মেয়ে দোলনের কথা আর মনে থাকেনি কমলেন্দুর। বরং বলা ভালো মনে রাখতে চাননি।ফেরার আগে মোটা অঙ্কের বেশ কিছু টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন দোলনের বাড়ির লোকের হাতে। ব্যস ওতেই দায়িত্ব, কর্তব্য চুকে গেছে বলে দিব্যি আত্মতুষ্টির পাখায় পাল তুলে দিয়ে এগিয়ে চলছিলেন কমলেন্দু। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছাবার তাগিদে নিজের দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে। তারপর ভাগ্যদেবীর সুপ্রসন্নতায় আর নিজগুণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন কমলেন্দু।নিজের মনেই তখন সব পেয়েছির আত্মসুখ অনুভব করতেন শিল্পী মিস্টার সান্যাল। বিদেশেই এক চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়ে উনি প্রেমে পড়লেন বিদেশিনী রোমি ডিসুজার।উত্তাল প্রেমের পর বিয়েটাও হল কমলেন্দুর। কিন্তু তারপর আমি স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশি দেরি হলনা। রুচি, মানসিকতার অমিল এসব নানা অজুহাত, ঝামেলা মিলিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কটা একদম তলানিতে এসে ঠেকল। অবশেষে বিচ্ছেদের পথে হাঁটতেই হলো। শারীরিক এবং মানসিক সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় দশ বছর পর নিজের দেশে নিজের শহরে ফিরলেন মিস্টার কমলেন্দু সান্যাল।
কয়েকদিন এখানে কাটানোর পর কমলেন্দু মনে মনে ঠিক করলেন এভাবে চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে না বসে থেকে নিজের পুরনো আর্ট স্টুডিওটাকে আবার নতুনভাবে চালু করতে হবে। সেই মতই উনি কাজকর্ম ছবি আঁকা শুরু করেন পুরোদমে।টাকাপয়সার তো ভালোই দরকার আছে জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে। বিদেশে বিচ্ছেদ নিয়ে নানারকম নিয়মকানুনের বেড়াজালে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে কমলেন্দুর। হাতে বিশেষ কিছুই নেই। তাই নিজের ছবি বিক্রি হবার আশায় শহরের একটি আর্ট গ্যালারিতে নিজের চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন কমলেন্দু। মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাকে বলে আর কী! একদিকে ওনার মত নামি শিল্পীর শহরে প্রত্যাবর্তনের খবরটা গুণীমহলে ফলাও করে জানানো আর সেই সাথে টাকা রোজগার। বেশ কয়েক দিন হল প্রদর্শনী চলছে। এমন সময় হঠাৎ একদিন কমলেন্দুর এক পরিচিত ব্যক্তি ফোন করে বলেন,"শুনুন কমলেন্দুবাবু একজন মহিলা আপনার বেশ কিছু ছবি কিনতে চাইছেন। চিত্র প্রদর্শনীতে আপনার আঁকা ওনার মনে ধরেছে।ভালোই দাম দেবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। সেই জন্যই ফোন করছি।"
কমলেন্দু বলেন,"হ্যাঁ ছবি বিক্রির জন্যই তো এতকিছু করা। ঠিক আছে কিন্তু কোন মহিলা, কোথায় থাকেন উনি, কী নাম ওনার?"
জবাবে ভদ্রলোকটি জানান,"যতটুকু ভদ্রমহিলাটি জানিয়েছেন সেটা হলো ওনার নাম দোলনচাঁপা। উনি এই শহরেই সেলাই জানা মেয়েদের নিয়ে "নিবেদন" নামে একটি সংস্থা চালান। চুড়িদার পিস আর শাড়িতে কাঁথা কাজ, আড়িকাঠের আরো নানা রকম সেলাই করেন ওনারা।খুব নামডাক আছে ওনাদের। শহরের অনেক নামিদামি দোকান ওদের বিক্রি করে, খুব ভালো দরে বিক্রি হয় ওদের শাড়ি আর চুড়িদার। আপনাকে ওনার ফোন নাম্বারটা দিচ্ছি। নিজে কথা বলে নিন। এর থেকে বেশী আমি আর কিছু জানিনা মিস্টার সান্যাল। রাখছি এখন।"
ফোনটা রেখে দিয়ে ভিতর ভিতর একটা চাপা উত্তেজনা তৈরী হয় কমলেন্দুর ওই দোলনচাঁপা নামটা ঘিরে।তারপর মনে মনে উনি ভাবেন এক নামে কতজনই তো থাকতে পারে তবে কেনোই বা এতদিন পর শুধু সেই দোলনের মুখটা মনে আসছে ওনার? যাইহোক ওই নম্বরে ফোন করেন কমলেন্দু জিজ্ঞাসা করেন,"হ্যালো আপনি কি নিবেদন সংস্থার মালিক দোলনচাঁপা কথা বলছেন? আমি শিল্পী কমলেন্দু স্যানাল বলছি। একজনের থেকে শুনলাম আপনি আমার ছবি কিনতে চান।"
উল্টোদিক থেকে ভেসে মহিলার গলা,"হ্যাঁ আমিই নিবেদনের মালিক বলা ভাল মালকিন। আপনি ঠিকই শুনেছেন আমি আপনার ছবিগুলো কিনতে আগ্রহী কমলেন্দুবাবু। আসলে আমার অফিসে অন্দরসজ্জার কাজে কিছু ছবি লাগবে তাই ভাবলাম যদি আপনার থেকে নেওয়া যেতো। আচ্ছা একটা কথা যদি খুব অসুবিধা না হয় তাহলে আজ একবার আপনি আমার অফিসে আসুন।আসলে আমি নিজেই যেতাম আপনার ওখানে কিন্তু একটু অসুবিধা হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না মুখোমুখি ঠিকমত দরদামে পোষালে তবেই তো নেব ছবিগুলো। সেইজন্যই আলোচনা করতে চাইছি। সেরকম হলে আমি আপনার ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
কিছুটা অর্থের জন্য আর কিছুটা কৌতূহলের বশে রাজি হয়ে যান মিস্টার কমলেন্দু সান্যাল। সময়মত পৌঁছান "নিবেদনের"অফিসে। দেখেন বেশ কিছু মেয়ে ওদের নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলছে তাদের শিল্প। এইসময় একজন মহিলা এসে বলে,"দোলনচাঁপা ম্যাডাম ওনার চেম্বারে আপনাকে ডাকছেন।"
শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরটায় ঢুকে চমকে যান মিস্টার কমলেন্দু সান্যাল। থতমত খেয়ে ঢোক গিলে কোনোমতে বলেন,"একি দোলন তুমি?এতদিন পর? এখানে কী করে এলে? তোমাকে এভাবে দেখব ভাবতেই পারিনি কখনো,এসব কী করে হলো...!"
__"অবাক হয়ে গেলেন তো মিস্টার সান্যাল? আগে ধীরেসুস্থে বসুন। বলুন চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস কোনটা নেবেন? আসলে কী বলুন তো মনের ভিতরের তাগিদ থাকলে মানুষ সব পারে। আর বিশেষ করে মেয়েরা হল দশভূজা ঘর বাহির নিপুণভাবে সামলে চলে প্রতিদিন। যেমন রান্নাবান্না,ঘর গৃহস্থালির কাজ করে তেমন আবার প্রয়োজন হলে বাইরের দুনিয়াতেও পা রাখে। এই যেমন আমার কথা ধরুন। আপনি তো মিথ্যে কথার জালে ফাঁসিয়ে রেখে বেরিয়ে এসছিলে আজ থেকে দশ বছর আগে। শহরে এসে অনেক বহু খুঁজেছি কিন্তু আপনার সঠিক ঠিকানা না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। আপনি গ্রামে আমার মা, বাবাকে মিথ্যে ঠিকানা দিয়ে এসছিলেন। শহরে এসে অনেক বলেকয়ে এরওর দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে একজন স্বহৃদয় ব্যক্তির সাহায্যে শিল্পের জন্য ঋণ পাই আমি। ওনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। শহরের সব মানুষ যে খারাপ হয়না সেটা ওনাকে দেখার পর বুঝতে পেরেছি। সে যাইহোক তারপর আস্তে আস্তে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়ে আমার এই সাফল্যের উত্তরণ। আজ অনেক মেয়ে এখানে তাদের সন্মান নিয়ে কাজ করে। না, বিয়ে আমি করিনি আর করবোনা। আপনার সাথে অন্তরঙ্গতার সুবাদে সেদিন যে আমার মাতৃজঠরে এসছিল সেই ছেলের এখন নয় বছর বয়স। ওর নামেই সংস্থার নাম রেখেছি "নিবেদন"। আপনি সেদিন মিথ্যা কথা বলে আমাকে ফাঁসিয়েছিলেন কিন্তু আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিলনা। আর আমি মনে করি ভালোবাসা ভগবানের আশীর্বাদ। তাই ছেলেটাকে ভগবানের পায়ে নিবেদন করেছি যাতে একজন ভালো মানুষ হতে পারে ও।"এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে দোলন। চুপচাপ মাথা নীচু করে কথাগুলো শুনছিলেন কমলেন্দু। এবার ধীরে ধীরে বলেন,"একবার কি দেখা করা যায় নিবেদনের সাথে?"
দোলন কাটা কাটা ভাবে উচ্চারণ করে,"আমি দুঃখিত কমলেন্দুবাবু। আপনার আর আমার সম্পর্কটা এখন প্রফেশনাল লেনদেনের মতো।নিবেদনকে বড় করে তুলতে আপনার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন হবেনা আমার। আমি মাথা উঁচু করে যা রোজগার করছি সেটা আমার অহঙ্কার। মা আর ছেলের বেশ চলে যাচ্ছে তাতে। আপনার আমাকে প্রয়োজন ছিল সেদিন। আমার ছবি দিয়ে সেদিন আপনি নাম কিনেছিলেন গুণী শিল্পী হিসেবে। কিন্তু নিবেদনের আত্মপরিচয় হবে আমি মানে ওর মা দোলনচাঁপার নামে।আমার অফিসের কার্ডটা আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে আজ ছবিগুলোর দাম ঠিক করতে না পারলে কালকের মধ্যে জানিয়ে দেবেন। নইলে অন্য কোনো শিল্পীর সাথে যোগাযোগ করতে হবে আমাকে। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। এখন আসুন। নমস্কার।"
নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসেন মিস্টার সান্যাল। বোবা দৃষ্টিতে মেলে ভাবেন এভাবেও ফিরে আসা যায় তাহলে। একটা চরম অপরাধবোধ এসে কমলেন্দুর এতদিনকার তিলতিল করে জমানো অহঙ্কারের মুখে আঘাত হানলো। দোলনচাঁপা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ছাইচাপা আগুন থেকে বেরিয়ে এসে স্বপ্নের ফিনিক্স পাখির উড়ানের কথা।।
ছবি:সংগৃহীত
No comments