Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পালোয়ান স্বামীজি- গুঞ্জন ঘোষ

পালোয়ান স্বামীজি- গুঞ্জন ঘোষ
দত্তবাড়ির উঠোনে জোরদার ‘কপাটি’ খেলা জমে উঠেছে। বাড়ির ছেলেরা তো আছেনই পাড়ার আরও কয়েকটি ছেলে যোগ দেওয়ায় সবাই মিলে কুড়ি-পঁচিশজন হবেই। দু’দিকে দুটি দল। মাঝখানে গোয়াল থেকে আনা খড় পাকিয়ে একটা সীমানা টা…

 



পালোয়ান স্বামীজি- গুঞ্জন ঘোষ


দত্তবাড়ির উঠোনে জোরদার ‘কপাটি’ খেলা জমে উঠেছে। বাড়ির ছেলেরা তো আছেনই পাড়ার আরও কয়েকটি ছেলে যোগ দেওয়ায় সবাই মিলে কুড়ি-পঁচিশজন হবেই। দু’দিকে দুটি দল। মাঝখানে গোয়াল থেকে আনা খড় পাকিয়ে একটা সীমানা টানা হয়েছে। একদলের মধ্যমণি বিলে। বিলের দলেরা হারছে। এবার স্বয়ং দলপতি তাল ঠুকে ঢুকে পড়লেন বিপক্ষদলের কোর্টে। মুখে বুলি—

‘চুরে  ঠ্যাং,

সোনা দিয়ে বাঁধাবো ঠ্যাং।

মারব ঠ্যাঙ্গের বাড়ি,

পাঠাবো যমের বাড়ী।।’

বিলের বিপক্ষের ঘরে ঢোকা মানে চার-ছ’টাকে ছুঁয়ে ‘মোর’ করে স্বঘরে ফিরে আসা। এই নিয়ে কখনও কোনও বিতর্ক হলে তিনিই মীমাংসা করে মিটিয়ে দেন। যেসব বুড়োরা ঠাকুরদালানে, রকে কিংবা সিঁড়িতে বসে হুঁকো খেতে খেতে ছেলেদের খেলা দেখেন, তাঁরা আবার চিমটি কেটে বলেন, ‘বিলের মুরুব্বি করা অভ্যাস, মুরুব্বিগিরি করতে না পারলে থাকতে পারে না।’

বাংলার নিজস্ব লোকক্রীড়া এই ‘কপাটি’ই আধুনিক কাবাডি। কিশোর বিলে যে কতরকম খেলায় পারদর্শী, তুখোড় খেলোয়াড় ছিলেন তা ভাবলে অবাক লাগে। তখনকার দিনে গাব্বু, পিল, ঘরপার, চিক, বেগদা এইসব ছিল খেলা। এগুলি মার্বেল দিয়ে খেলতে হতো। বিলে এইসব খেলাতেই দক্ষ। মার্বেল খেলাটা অনেকটা গুলি খেলার মতো। যার যত টিপ খেলায় তার তত জিত। বিলের ছিল সাংঘাতিক টিপ। তাঁর মতো লক্ষ্যভেদ করতে কেউ পারতেন না। এক-একদিনে তিনি একাই সব প্রায় তিরিশ-চল্লিশটা মার্বেল জিতে নিয়ে যখন খেলা ছাড়তেন, তখন হেরে যাওয়া বন্ধুরা তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদত!

বিলে তখন নরেন্দ্রনাথ বিএ পাশ করে বাবা বিশ্বনাথ দত্ত আর কাকা তারকনাথের সঙ্গে হাইকোর্টে বেরতে শুরু করেছেন। সেদিন ছিল রবিবার হঠাৎ দেখলেন, ছেলেরা মার্বেল খেলছে। সাক্ষী তাঁর মেজভাই মহেন্দ্রনাথের কমেন্ট্রি—‘মারবেল লইয়া বলিল, দেখ আমার হাতের টিপ দেখবি। এই বলিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গাব্বু গিল খেলিতে লাগিল। তাহার পর খানিকক্ষণ ঘরপাক খেলিল। অনেকে বসিয়া মারে, কিন্তু বীরেশ্বর দাঁড়াইয়া মারিতে লাগিল।’

বিলে যখন নয়-দশ বছরের বালক, সেই বয়স থেকে  পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলোর প্রতিও ছিল সাঙ্ঘাতিক আকর্ষণ। খেলার সঙ্গী পেলেই সবকিছু ভুল হয়ে যেত। রুটিনও ছিল অদ্ভুত—দিনের বেলায় খেলে বেড়ানো আর রাতে ঘরের দোর এঁটে পড়াশোনা। তখন ক্রিকেট খেলার এত চল ছিল না। কপাটি, ব্যাটম্বল (ব্যাট অ্যান্ড বল) আর মার্বেল খেলা নিয়েই হতো ধুন্ধুমার। বিলে জলখাবারের পয়সা জমিয়ে হয় মার্বেল কিংবা নতুন ব্যাট বা বল কিনতেন। ব্যাটম্বল খেলায় তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। ছুটোছুটি, হুটোপাটি, লাফালাফি, ঘুষোঘুষি এই সব খেলা ছিল অতি প্রিয়। একদিন কপাটি খেলতে খেলতে বালক বিলে পড়ে গেলেন। চেপে ধরল তার খেলার সঙ্গীরা। চাপাচাপিতে একটা ইটের টুকরো কপালে লেগে ঢুকে গেল।  কপালে রক্ত দেখে সঙ্গীরা বিলের কপাল থেকে খোয়াটা বের করে দিল। 

কিন্তু ক্ষতস্থানের দাগ চিরকালের জন্য রয়ে গেল। পরবর্তীকালে স্বামীজির গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দ ছোট ছেলে দেখলে আহ্লাদ করে বলতেন, ‘দেখি, দেখি, তোর কপালে কাটা দাগ আছে কি না? কাটা দাগ থাকলে বড় মানুষ হবি। জানিস, স্বামীজির কপালে কাটা দাগ ছিল!’

নরেন্দ্রনাথের বাল্যকালের খবর দিতে গিয়ে তাঁর মেজভাই মহেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘সিমলা পাড়ায় যেখানে ট্রেনিং একাডেমি হয়েছে —এটা আগে কাঁসারিপাড়ার যোগেন পালের জিমনাস্টিক আখড়া ছিল। অনেকে গিয়ে ওখানে কুস্তি, জিমনাস্টিক শিখত। ট্রাপিজ, প্যারালাল বার প্রভৃতি সব টাঙানো ছিল। নরেন্দ্রনাথ গিয়ে খুব কুস্তি জিমনাস্টিক করত। সকলেই গিয়ে লেঙ্গট মেরেছে, খেলবার জন্য তৈরি হয়েছে, হয়তো বিলের যেতে কিছু দেরি হয়েছে, সকলেই আগড়ওলা দোরের দিকে চেয়ে আছে, খেলতে যেন কারো মন নেই। আর যেমনি বিলে গেল, সকলেরই ভিতরে যেন একটা শক্তি এল। সব ছেলেরা উঠে হৈ রৈ করে খেলতে লাগল। যেন জন্মেছে সর্দার। উপস্থিত না থাকলে খেলা জমত না।’

মহেন্দ্রনাথ আরও জানিয়েছেন, ‘নবগোপাল মিত্রের জিমনাস্টিকের আখড়ায় কসরত করবার সময় বিলে ট্রাপিজে যে দোল মারত, তা ভয়াবহ। একবার বিলে ও তাঁর বন্ধুরা মিলে একটা ট্রাপিজ খাটানোর ব্যবস্থা করছিল। খুঁটিটা ভীষণ ভারী, অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কেউ সেটা তুলতে পারছিল না। মজা দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন ইংরেজ নাবিক ছেলেদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। খুঁটিটা বেশ ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল। কিন্তু হঠাৎ সেটা দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেল আর নাবিকের কপালে লাগল জোর আঘাত। নাবিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন। 

কপাল ফেটে রক্ত পড়তে লাগল। একেই দুর্ঘটনা, তার উপর ইংরেজ; তাই পুলিসের ভয়ে সবাই পালিয়ে গেল। কিন্তু বিলে আর দু-একজন বন্ধু পালাল না। তাঁরা নাবিকের চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে তার কপালে ফেট্টি বাঁধল। কিছুক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরলে বিলেরা ধরাধরি করে কাছাকাছি ট্রেনিং একাডেমি স্কুলে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করল।’ এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া   যায় স্বামীজির উপস্থিত বুদ্ধি ও বিপদের   সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে কীভাবে কাজ করতেন। 

স্বামীজি বেশ নৌকা চালাতে পারতেন। ছুটির দিনে নিজে নৌকা চালিয়ে দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। এমনকী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রবল ঝড়ের সময়েও তিনি নির্ভয়ে গঙ্গায় নৌকা চালিয়ে যেতেন। বিশ্বনাথ দত্ত বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘যাতায়াতের একখানা গাড়ি করে গেলেই তো হয়। এরকম ঝড়-তুফানে গঙ্গা দিয়ে যাবার কী দরকার? রাম তো টানা গাড়ি করে যায়। একেই বলে ডানপিটে ছেলের মরণ গাছের আগায়। এরকম ডানপিটেমি করার কী দরকার?’       

স্বামীজি যখন ভারত পরিক্রমা করছিলেন, মাদ্রাজে থাকাকালীন তিনি সন্ধেবেলায় সমুদ্রতীরে বেড়াতে যেতেন। একদিন বেড়াতে বেড়াতে তিনি সুব্রহ্মণ্যম আয়ারকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কুস্তি লড়তে জানো?’

সুব্রহ্মণ্যম আয়ার ‘জানি’ বলতেই স্বামীজি সেই সমুদ্রতীরে তাঁর সঙ্গে কুস্তি লড়তে শুরু করলেন। কলকাতার হোগলকুড়ের নামকরা অম্বু গুহর আখড়ায় কুস্তি লড়া যে কখনও ভোলেননি, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট। তাঁর পেশির দৃঢ়তা আর পাকা কুস্তিগীরের মতো ব্যায়ামকৌশল দেখে আয়ার স্বামীজির নাম দিলেন, ‘পালোয়ান স্বামী!’ 

এই ডানপিটে, সাহসী ছেলের বিক্রমের কথা যেন লিখে শেষ করা যায় না।  আমেরিকায় থাকার সময় একদিন তিনি এক নদীর ধারে একলা বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন, কয়েকটি ছেলেপুলের উপর দাঁড়িয়ে নদীর জলে ভেসে যাওয়া কয়েকটা ডিমের খোলার দিকে গুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু কেউই সেই খোলাটাকে বিদ্ধ করতে পারছে না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বামীজি সেই দৃশ্য দেখছেন আর হাসছেন। তাঁকে হাসতে দেখে ছেলেরা রেগে গেল। তারা স্বামীজিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল, ‘ওহে বাপু, কাজটা যত সহজ মনে করছ, তত সহজ নয়। এসো দেখি, একবার এদিকে। দেখি তোমার কেমন নিশানা।’ 

স্বামীজি তাদের কাছ থেকে বন্দুকটি নিলেন এবং লক্ষ্য ঠিক করে পর পর বারোটা গুলি ছুঁড়লেন এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, বারোটা ডিমের খোলাই গুলিবিদ্ধ করলেন! ছেলেরা তো অবাক। তারা ভাবল স্বামীজি নিশ্চয় অনেকদিন ধরে বন্দুক ছোড়া অভ্যাস করেছেন। স্বামীজি হাসতে হাসতে তাদের বললেন, ‘আমি একজন ধর্মপ্রচারক মাত্র, বন্দুকের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আসল ব্যাপারটা হল মনঃসংযম। আর কিছু নয়!’

জিনিয়াসদের সব কিছুই অতুলনীয়। ধর্মকর্ম, ক্রীড়াকর্ম — সে সবই যেন তাঁর কাছে ছিল সহজ স্বাভাবিক। সাধারণের কাছে যা কষ্টসাধ্য স্বামীজির কাছে তা ছিল আয়াসসাধ্য! 

No comments