রটন্তী কালীপুজো মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়-তমাল দাশগুপ্তরটন্তী কালীপুজো মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে এইদিনে কৃষ্ণ ও কালীর অভিন্নতা রটেছিল (সেই থেকে রটন্তী)। এ সংক্রান্ত কাহিনীটি ব্রহ্মাণ্…
রটন্তী কালীপুজো মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়-তমাল দাশগুপ্ত
রটন্তী কালীপুজো মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে এইদিনে কৃষ্ণ ও কালীর অভিন্নতা রটেছিল (সেই থেকে রটন্তী)। এ সংক্রান্ত কাহিনীটি ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, বিদগ্ধ মাধব নাটকের শেষ অংশ সহ বিভিন্ন গ্রন্থে পাই, যেখানে রাধাকৃষ্ণের কুঞ্জে আয়ান ঘোষের আগমনে কৃষ্ণের কালীরূপ উদ্ভাসিত হয়েছিল।
ছবিতে দেখছেন কেওড়াতলার (কলকাতায় কালীঘাটের কাছেই কেওড়াতলা মহাশ্মশান) কৃষ্ণকালী মন্দিরে বিরাজমান মা। এ মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আদি গঙ্গা। মন্দিরটি আজ থেকে দেড়শ বছর আগে আনন্দ ঋষি নামে এক সাধক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এই মন্দিরে কৃষ্ণকালী মায়ের সাধনা করেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে জানা যায়, এছাড়াও অনাথানন্দ নামেও আরেকজন সাধক এখানে ছিলেন।
এই বিগ্রহ শ্যামবর্ণা। পেছনে দুই হাতে খড়্গ ও বরাভয়। সামনে দুটি হাতে বাঁশি। মায়ের গলায় মুণ্ডমালা ও ফুলের মালা। এ মন্দিরে প্রত্যেক পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিতে বিশেষ পুজো হয়, এছাড়া কার্তিকী অমাবস্যার পুজো ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। মন্দিরের ঠিকানা ১১৩ কেওড়াতলা মহাশ্মশান রোড, কলকাতা ২৬।
আজ রটন্তী কালীপুজো উপলক্ষে বাঙালি জীবনে ঐতিহাসিক শাক্ত বৈষ্ণব সংশ্লেষের সাত নথি রইল। মাতৃধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বিষ্ণুভাগবত/বৈষ্ণব ধর্ম অতি প্রাচীন কাল থেকেই যুগে যুগে মাতৃকার সর্বোচ্চ স্থান নির্ধারণ করে।
১. হরপ্পা সভ্যতা থেকেই চক্র হল মাতৃকার প্রতীক, তন্ত্রাশ্রয়ী উপাসনায় ব্যবহৃত মাতৃযন্ত্র। এই চক্র প্রতীকটি বৈষ্ণব ধর্মেরও দ্যোতনা বহন করে, সেজন্য মহাভারতে দেখি যে বৃষ্ণি বাসুদেব এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পৌণ্ড্রক বাসুদেব উভয়েই চক্র ধারণ করেন।
২. মহাভারতে (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে লিপিবদ্ধ) অর্জুনকৃত দুর্গাস্তবে দেখি, মা দুর্গাকে বাসুদেবের ভগ্নী আখ্যা দেওয়া হয়। বস্তুত একানংশার সঙ্গে কৃষ্ণ বলরাম উপাসনার ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে ওঠে, এবং আদিযুগে প্রথম যখন মথুরা অঞ্চলে কৃষ্ণ বলরাম সহ পঞ্চ বৃষ্ণি বীরের উপাসনা শুরু, সেই সময় প্রবল জনপ্রিয় মাতৃকা একানংশার পূজার মধ্যেই কৃষ্ণ উপাসকরা নিজেদের ধর্মকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় একানংশা অন্যতম জনপ্রিয় মাতৃকা ছিলেন, একশৃঙ্গা এক মায়ের অনেক মুর্তি পাই সেখানে। তাঁর সেই মূর্তিকল্পনা পরে অবশ্যই বৈদিক পৌরাণিক আর্যাবর্ত শাস্ত্রে আর পাওয়া যায় নি, হারিয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসবিদ মাত্রেই জানেন যে কৃষ্ণ উপাসনার শুরুতে একানংশা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ইনিই পরে মহামায়া বা সুভদ্রা প্রভৃতি নামের মধ্য দিয়ে কিছুটা অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন, কিন্তু একানংশা ছিলেন সর্বময়ী জগদকারণ প্রকৃতি, সেই ঐশ্বর্য বশতঃ তিনি দুর্গা বলে সম্বোধিত। মা একানংশার অতীত স্মৃতি খুঁজে বের করতে বৈষ্ণব ধর্ম আমাদের বিশেষ সহায়ক।
৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী লিপিবদ্ধ হয়েছিল ষষ্ঠ শতকে। এখানে দেখি মা দুর্গা কেবলই নারায়ণী বলে সম্বোধিত। বস্তুত শিবের সঙ্গে আলাদা কোনও সম্পর্ক নেই মায়ের, যখন শ্রী শ্রী চণ্ডী রচিত হচ্ছে। সে সম্পর্ক আরও পরে শশাঙ্কযুগে কল্পিত হবে। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্ম প্রথম থেকেই আদ্যা নিত্যা জগন্মাতাকে নারায়ণী অর্থাৎ কিনা নারায়ণের স্ত্রীরূপ মনে করত, এজন্যই তিনি বাসুদেবভগ্নী বলেও কল্পিত।
৪. যে সময় বাঙালির মধ্যে সহজ আন্দোলন হল পালযুগের শেষে, একই সঙ্গে কালী ও রাধাকৃষ্ণ জনপ্রিয় হলেন। বস্তুত রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গান ও বাঙালির সহজ তান্ত্রিক ধর্ম পরস্পর অভিন্ন। পঞ্চম শতকের পর থেকেই সারা ভারতের বৈষ্ণব ধর্মের ভরকেন্দ্র সরে আসে পূর্ব ভারতে, গৌড় ও বঙ্গে। প্রমাণ করা যায়, গুপ্তসাম্রাজ্য অন্তে ভারতজুড়ে গৌড়ের উত্থান, আবহমানকালের তন্ত্রধর্মীয় সভ্যতার পুনরুত্থান, রাধাকৃষ্ণ প্রেমগাথার প্রচলন এবং সর্বময়ী আদ্যা নিত্যা জগন্মাতার ধর্মের পুনঃপ্রকাশ - এ সবই একসঙ্গে ঘটেছে। এই কারণেই সেনযুগে দেখি কালী ও কৃষ্ণ যথাক্রমে বল্লালযুগে ও লক্ষ্মণযুগে পরপর জনপ্রিয়। দশমহাবিদ্যা ও দশাবতার তত্ত্ব এই সেনযুগেই চূড়ান্ত রূপ পেল। সেনদের সমসাময়িক কর্ণাট দেশের হয়সালা হালেবিডু মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ মূর্তির পাশেই কালীর মূর্তি খোদিত হয়েছিল। এই সেনযুগেই রাঢ়বাংলার উত্তরে শ্যামরূপা মন্দিরের কাহিনী প্ৰচলিত হয়েছিল।
৫. মধ্যযুগের শুরুতেই বাশুলী উপাসক চণ্ডীদাস লিখলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। স্পষ্টত মাতৃধর্মের অনুসারী কর্তৃক বাংলায় রাধাকৃষ্ণ উপাসনার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক রচিত হল।
৬. গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন বাঙালির তন্ত্রধর্মীয় শেকড়ের নতুন অভ্যুদয়। কথিত আছে, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু স্বহস্তে একটি শ্রী শ্রী চণ্ডী পুঁথি লিখেছিলেন। আমরা জানি নিত্যানন্দ প্রভু সর্বদা ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র ধারণ করতেন। নিতাইচাঁদ খড়দহে স্বগৃহে যে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন, সে পুজো আজও হয়। বস্তুত এই যুগে শাক্তধর্ম ছিল গুহ্য, গোপনতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, জগাই মাধাই গুহ্য অসামাজিক বিকারে আক্রান্ত অন্ধকার মধ্যযুগে শাক্তধর্মের বিকৃত চেহারার অনুগামী ছিলেন,সেখান থেকে তাদের আলোর পথে চালিত করেন গৌর নিতাই। শ্রীরাধা স্বয়ং শক্তি, রাইরাজা সেই শক্তির প্রকাশ।
৭. আমরা দেখি, এই শাক্ত বৈষ্ণব সংশ্লেষ বাঙালির ইতিহাসে যুগে যুগে ঘটেছে। শাক্তশ্রেষ্ঠ যশোরসম্রাট প্রতাপাদিত্য বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসকে তাঁর রাজসভায় মহা সমাদরে স্থান দিয়েছিলেন, এবং গোবিন্দদাস তাঁর পদে সম্রাটের উল্লেখ করেছেন। বস্তুত প্রতাপ উড়িষ্যায় অভিযান চালিয়ে রাধা গোবিন্দ মূর্তি নিয়ে আসেন এবং খেতুরি মহোৎসব এর পরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মোগলের শত্রু প্রতাপের সঙ্গে তাঁদের সংযোগের কথা পরবর্তী যুগের বৈষ্ণবরা সেভাবে আর স্বীকার করেন নি, কিন্তু সমকালের নথি দেখলে বোঝা যায়, প্রতাপ একা নন, বাঙালির মধ্যে নবজীবনের নবজাগরণের সূচনা করে বারো ভুঁইয়ার উত্থানের জমি প্রশস্ত করেছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন।
সেই প্রভাবেই এরপর শাক্তদের মধ্যে গণধর্মী ভক্তি আন্দোলন হবে, বৃহৎ তন্ত্রসার সহ একাধিক শাক্ত শাস্ত্র রচিত হবে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজ্য জুড়ে মহা সমারোহে প্রকাশ্যে দশ সহস্র কালীপুজো অনুষ্ঠিত করে গুহ্য বিকারের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন, এর পেছনে বৈষ্ণব আন্দোলনের ভাবাদর্শ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সাধক কবি রামপ্রসাদ গাইবেন, কালী হলি মা রাসবিহারী, নটবর বেশে বৃন্দাবনে। সাধক কবি কমলাকান্ত অনেকগুলি বৈষ্ণব গীতি রচনা করবেন। এই প্রভাবেই রামকৃষ্ণ পরমহংস পানিহাটি চিঁড়াদধি মহোৎসবকে স্মরণ করে আঁখিজলে ভাবাবিষ্ট হবেন।
বাঙালির শাক্ত ও বৈষ্ণব অভিন্ন। যে কালা, সেই তো কালী।
কালী কেবল মেয়ে নয়, কখনও কখনও পুরুষ হয়, সাধক কবি কমলাকান্ত এজন্যই গেয়েছিলেন। আদ্যা নিত্যা জগদকারণ প্রকৃতি হলেন অব্যক্ত, তিনি সমস্ত লিঙ্গভেদের অতীত, আমরা ক্ষুদ্র মানববুদ্ধিতে আমাদের বাঙালি জন্ম সার্থক করে তাঁকে মা বলে ডাকি। জয় মা, জয় মা, এই ধ্বনি দিলে আমাদের এই বাঙালি জন্ম সার্থক হয়।
জয় জয় মা রটন্তী কালী। জয় জয় মা শ্যামরূপা। জয় জয় মা কৃষ্ণকালী।
No comments