Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

মুর্শিদাবাদ জেলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও বিনাশ কথা -আশুতোষ মিস্ত্রী

মুর্শিদাবাদ জেলায়  বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও বিনাশ কথা -আশুতোষ মিস্ত্রীমুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র অঞ্চলেই প্রত্নবস্তুুর ছড়াছড়ি আজও দেখা যায়। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ব…

 




মুর্শিদাবাদ জেলায়  বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও বিনাশ কথা -আশুতোষ মিস্ত্রী

মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র অঞ্চলেই প্রত্নবস্তুুর ছড়াছড়ি আজও দেখা যায়। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চল ও তৎসংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু ভগ্ন শিলামূর্তি ও অলংকৃত পাথরের অজস্র টুকরো। সেই ভগ্ন মূর্তি গুলি পরীক্ষা করে দেখলেই বোঝা যায় হয় সেগুলি বৌদ্ধ দেব দেবীর মূর্তি নয়তো হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি। বৌদ্ধ ধর্মের বিলুপ্তির পর বৌদ্ধ দেব দেবীরা হিন্দু দেব দেবী রূপে বর্তমানে বহু স্থানে পূজিত হচ্ছেন। যেমন মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চলে কান্দির রুদ্রদেব আসলে এক বুদ্ধ মূর্তি শিব ঠাকুর রূপে পূজিত হচ্ছে। মদনেশ্বর মন্দিরের রক্ষিত বুদ্ধ মূর্তি শিব রূপে পূজা পাচ্ছেন। অনুরূপ জজানের সর্ব মঙ্গলা দেবী , বেলডাঙার নওপুকুরের ডুমনি মা তারা দেবী বা জিয়াগঞ্জের সাধকবাগের শিব প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মেরই দেবতা। অপরদিকে কিরীটেশ্বরীর দেবী বিমলা ও ভৈরব সম্বর্ত আসলে বুদ্ধ মূর্তি। বর্তমানে মূর্তিটি জিয়াগঞ্জ সংগ্রহ শালায় রক্ষিত আছে। 

কর্নসুবর্ণ অঞ্চলে খনন করে রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। সামশেরগঞ্জ থানার জিয়ৎকুঁড়িতে বৌদ্ধ দেব দেবীর প্রস্তর ফলক পাওয়া যায়। এছাড়া সাগরদিঘী থানার মহিপালে প্রচুর বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। অপরদিকে নবগ্রাম থানার অমৃতকুন্ড ও পাঁচগ্রাম বিল বসিয়া সংলগ্ন অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ দেবী মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এসব থেকে স্পষ্ট যে একসময় সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলায় বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিল,  যা আজ কোথাও চোখে পড়েনা। তাহলে কথা হচ্ছে এত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব হটাৎ করে হারিয়ে গেল কিভাবে?

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দাপটে সেন আমলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব কমতে থাকে।  সেই সময় সমাজে ন্যাড়া মুন্ড বৌদ্ধ শ্রমণদের উপর ব্রাহ্মণেরা নানারকম অত্যাচার করতো।  ১২০২ সালে বাংলায় তুর্কি আক্রমণে সেন বংশের পতন হয়।  সেই বৌদ্ধ ধর্মের  মানুষেরা অর্ধেকেরও বেশি ব্রাহ্মন ও মুসলিম শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত হন। এই জন্য এই অঞ্চলের ধর্মান্তরিত মুসলমান সম্প্রদায়কে " ন্যাড়া" বলে অভিহিত করা হত। এর মধ্যে কিছু বৌদ্ধ শ্রমণ ব্রাহ্মণদের বশ্যতা স্বীকার করে "নবশাখ" বা নতুন এক শাখা হিসেবে স্থান পেল। আর বাকি যারা বশীভূত হল না , তারা ব্রাহ্মণদের কোপে পড়ে কেউ দেশান্তরিত হতে বাধ্য হল , কেউ বা দেশেই থেকে গেল। এই দেশে থাকা শ্রমণেরা ব্রাহ্মণ ও রাজাদের নিপীড়নের ভয়ে " বুদ্ধ" নামের পরিবর্তে " ধর্ম" নামে তার পুজো করতে লাগলো। অবিভক্ত বাংলার বহু গ্রামে সেই সময় থেকে ধর্ম পূজা শুরু হয়। মুর্শিদাবাদে বিশেষ করে রাঢ় ও বাগড়ি অঞ্চলে খুব আড়ম্বরের সাথে ধর্ম পূজা হতে দেখা যায়। তবে এই পূজা ও আচার অনুষ্ঠানে নিম্নবর্ণের মানুষেরাই বেশি অংশগ্রহন করে। এই শ্রেণীর মানুষ সহজে  স্বধর্ম ত্যাগ করতে পারেননি। তাই বৌদ্ধ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান অক্ষুণ্ণ রেখে এই পূজা রীতির অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে  সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মালম্বিরা " যোগী, ' নাথ' প্রভৃতি সম্প্রদায় হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। যোগীদের জাতবিচার , অন্নবিচার ছিল না । সেই জন্য সেন রাজা ও ব্রাহ্মণেরা এই ধর্মের মানুষের উপর অমানবিক নির্যাতন করে চলতো। যোগী বা যুগিরা ব্রাহ্মণ্যগুরুবাদ ও পুরোহিত তত্ত্বকে মানতো না , তারা নিজেরাই দিক্ষাদান ও গৃহপুজা সম্পন্ন করতো। এরা নিরীহ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। হিন্দু ধর্মীয় সৎকার প্রথাকে এরা মানতো না , তাই যুগিরা মৃতদেহ দাহ না করে মাটিতে বসা অবস্থায় সমাধি দিত। এই প্রথাকে নিয়ে সেই সময় বাংলায় একটা ভয়ের প্রবাদ বাক্য ব্যবহার হত যে, তোকে ' যুগিন পোতা করে পুঁতবো'।

যুগিদের এই নাথ সম্প্রদায় নানা জাতি থেকে শিষ্য নিয়োগ   করে দীক্ষা দিত। দীক্ষা দান যিনি দিতেন  তিনি শুদ্ধাচারের উপর খুব জোর দিতেন, এমনকি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিতেন। এরা সংস্কৃত চর্চা করতেন , যেমন ভাতকে অন্ন বলতো। যা থেকে আরো একটি প্রবাদ বাক্যের জন্ম হয় - ' কালকের যুগি ভাতকে বলে অন্ন'। সেইসময় ব্রাহ্মণদের প্রচেষ্টায় ' বুদ্ধ ' নাম মুছে ফেলার নানান চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত নাথ যুগিরা শৈব মত গ্রহন করে। এবং ব্রাহ্মণ ছাড়াই পূজা প্রচলন করেন। এই পূজা প্রচলনের বা প্রচারের জন্য হুঙ্কার বা গর্জন রীতির প্রচলন হয়। গর্জন শব্দের অপভ্রংশে গাজন নামের উৎপত্তি। গাজন হল ধর্ম প্রচারের অঙ্গ। গাজন উৎসবে যে চড়ক পূজার প্রচলন হয় , তার মধ্যে ও বৌদ্ধ রীতিনীতির ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। ঘূর্ণায়মান চড়ক বৌদ্ধ ধর্ম চক্রের প্রতীক স্বরূপ।

এই বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের মধ্যে যারা পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিল তারাও প্রাচীন রীতিনীতি সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেননি।  গৌড়ের  রাজা গণেশের আমল থেকে 'সত্যপীর ' হিন্দু ও মুসলমানদের আরাধ্য রূপে পূজিত হয়ে আসছেন।

অপরদিকে হিন্দু ধর্মে ও কিছু নিম্ন বর্ণের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ রূপান্তরিত হয়েছিলেন।  নিহার রঞ্জন রায়ের মত অনুযায়ী বাঙালির পালিত , ধর , রক্ষিত , কর , ভূতি, গুঁই বা গুইন , দাম বা দাঁ , পান বা পাইন প্রভৃতি অন্তজ শ্রেণীর মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্মে মিশে গিয়েছেন। অপরদিকে আবার বৈষ্ণবদের 'ভেক ' আদতে ভিক্ষু কথা থেকেই এসেছে। আগে আলোচনা করেছিলাম কিছু বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষ আবার বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য প্রদেশে শেষ আশ্রয় খুঁজে নেই।

তথ্য সূত্র: ঝড় বিশেষ সংখ্যা আলোকপাত ১,

                মুর্শিদাবাদ ইতিবৃত্ত ২ : অরূপ চন্দ্র,

                

No comments