রাঢ়অধিষ্ঠাত্রী দেবী বাশুলী: মা বিশাললোচনা বিশালাক্ষী- তমাল দাশগুপ্ত
মা বাশুলী বহুযুগ ধরে বাঙালি মহাজাতির সভ্যতাকেন্দ্র রাঢ়ভূমির অধিষ্ঠাত্রী হয়ে আছেন। মধ্যযুগের সূচনায় বড়ু চণ্ডীদাস মায়ের উপাসনা করেন, বস্তুত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য …
রাঢ়অধিষ্ঠাত্রী দেবী বাশুলী: মা বিশাললোচনা বিশালাক্ষী- তমাল দাশগুপ্ত
মা বাশুলী বহুযুগ ধরে বাঙালি মহাজাতির সভ্যতাকেন্দ্র রাঢ়ভূমির অধিষ্ঠাত্রী হয়ে আছেন। মধ্যযুগের সূচনায় বড়ু চণ্ডীদাস মায়ের উপাসনা করেন, বস্তুত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য শুরুই হয় বাশুলী বন্দনায়। চৈতন্যযুগ শুরু হওয়ার পূর্বে নবদ্বীপের অধিবাসীগণ বাশুলী মায়ের নামে জয়ধ্বনি দিত, বৈষ্ণব গ্রন্থ সাক্ষ্য দেয়। চৈতন্যযুগেও মা সমান জনপ্রিয়, সেজন্যই দেখি কবি মুকুন্দ মিশ্র "বাশুলীমঙ্গল" কাব্য লিখেছেন ১৫০৭ (অথবা ১৫৭৭) খ্রিষ্টাব্দে। বাশুলী বা বিশাললোচনা মা এভাবে বর্ণিত হয়েছেন এই মঙ্গলকাব্যে:
চামুণ্ডা নৃমুণ্ডমালা ধৃত রুধিরাম্বরা
সরক্ত কর্পর কাতি হাথে
শোণিত সিন্ধুর জলে কল্পবৃক্ষের মূলে
নরপ্রেতাসনে ভগবতী।
মায়ের স্তুতি অন্যত্র এভাবে করেছেন বাশুলীমঙ্গলের কবি।
রণমুখী রুচি দুর্গা রুধিরাকাঙ্ক্ষিণী।
শরদিন্দুমুখী জয়া চকোরনয়নী।।
হরের ডমরু মাঝা মৃগত্রিলোকিনী।
আতঙ্করহিতমনা কঙ্কালমালিনী।।
তন্ত্রসার গ্রন্থে মা বাশুলী তাঁর ধ্যানমন্ত্রে এভাবে বর্ণিত:
মা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, দ্বিভুজা, উগ্ররূপা, খড়্গ ও খেটকহস্তা, রক্তবসনা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। জটামুকুটশোভিত মা শবের ওপরে অবস্থান করেন।
এছাড়া ধর্মপূজাবিধানে মা বাশুলীর বন্দনার নির্দেশ আছে, সেখানে মা এই প্রণাম মন্ত্রে বন্দিত:
বিশালবদনা দেবী বিশালনয়নোজ্জ্বলে।
দৈত্যমাংসস্পৃহে দেবী বিশালাক্ষী নমোহস্তুতে।।
মায়ের ধ্যানমন্ত্র অবশ্য ধর্মপূজা বিধানে যা পাই, তা তন্ত্রসার থেকে ভিন্ন। ধর্মপূজাবিধানে মা সিঁদুরবর্ণা, বিকটদন্তা, মুণ্ডমালিনী, হাস্যমুখরা, খড়্গহস্তা, রক্তপানরতা, মায়ের পায়ে নূপুরমঞ্জরী। মা বাশুলীর সঙ্গে মঙ্গলচণ্ডিকার অভিন্নতাও ঘোষিত হয়েছে এই ধ্যানমন্ত্রে।
আমার ধারণা রাঢ়ভূমির সর্বত্র যদিও বাশুলী পূজিত হয়েছেন, বস্তুত তিনিই রাঢ়অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কিন্তু তাঁর উপাসনার উৎস ও ব্যাপকতা সম্ভবত প্রাচীন সুহ্ম, বর্তমানের হুগলি জেলায় সূচিত।
মা বাশুলীর মূর্তির বিভিন্নতা লক্ষণীয়। তা মায়ের পূজার প্রাচীনত্ব এবং মায়ের আদি পূজা নানা রূপে প্রচারিত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে। তা ইঙ্গিত করে যে বাশুলী আদিতে সর্বময়ী জগজ্জননী প্রকৃতিমাতৃকা হিসেবে উপাস্য ছিলেন বলেই তাঁর নানা রূপভেদ আছে। তিনি অবৈদিক ব্রাত্য তন্ত্রধর্মীয় সভ্যতার আদি দ্যোতনা বহন করেন বলেই তাঁর মূর্তির নির্দিষ্ট একটি ধ্যানমন্ত্র নেই।
উত্তর রাঢ় থেকে দক্ষিণ রাঢ়, মায়ের এরকম মূর্তিকল্প পাই।
বীরভূমে নানুর অঞ্চলে চণ্ডীদাস পূজিত বাশুলী মূর্তি প্রকৃতপক্ষে পালযুগের বাগদেবী সরস্বতী। তাঁর এক হাতে জপমালা, অন্য হাতে গ্রন্থ, অপর দুই হাতে বীণা। বস্তুত এরকম একটি তত্ত্ব আছে যে বাগীশ্বরী থেকেই বাশুলী শব্দ এসেছে। গয়ায় একটি মন্দিরে সরস্বতীর চতুর্ভুজ মূর্তি বাসিরী নামে অভিহিত।
বলা দরকার যে হুগলির সিনেট অঞ্চলে বিশালাক্ষী ও বিষলক্ষ্মী/বিষহরি মনসা দুই ভগ্নীরূপে পূজিত হন, অতএব মা সত্যই সর্বময়ী। তিনি সরস্বতী, তিনি চণ্ডী, তিনি কালী, তিনিই মনসা।
■ আবার বাঁকুড়ার ছাতনা অঞ্চলে চণ্ডীদাস পূজিত বাশুলী আছেন, তাঁর মূর্তি তুলনায় তন্ত্রসার গ্রন্থের ধ্যানমন্ত্রের নিকটবর্তী (পুরোটা নয়), যদিও মায়ের পূজা এখানে ধর্মপূজা বিধান অনুসারে ঘটে। বস্তুত ছাতনা অঞ্চলে মায়ের যে মূর্তি পাই, এই রূপেই মা বাশুলী রাঢ়ভূমিতে অধিকতর জনপ্রিয়ভাবে অধিষ্ঠিত।
ছাতনাবাসিনী বাশুলী: মা এখানে দ্বিভুজা। ডান হাতে খড়্গ এবং বাঁ হাতে খর্পর ধারণ করেন। মায়ের মুখে প্রশান্ত হাসি, মা মুণ্ডমালিনী। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, মা এখানে দুই পায়ে দুটি পুরুষমূর্তিকে দলন করেন, মায়ের একটি পা একদিকের শায়িত পুরুষমূর্তির জঙ্ঘায় অপর পা অপর পুরুষমূর্তির মস্তকে স্থাপিত, যে দুটি পুরুষমূর্তি এখানে অসুর বলে বর্ণিত।
★ বলা দরকার যে বাঁকুড়া থেকে হুগলি অবধি রাঢ়ভূমির সর্বত্র মায়ের মূর্তির সবথেকে জনপ্রিয় যে রূপটি দেখি, যেখানে মা একটি শায়িত এবং একটি উপবিষ্ট পুরুষমূর্তিকে দলন করেন, যে দুটি কখনও শিব-ভৈরব কখনও অসুর বলে চিহ্নিত, সে রূপের উল্লেখ না তন্ত্রসার, না ধর্মপূজাবিধান, কোনও ধ্যানমন্ত্রেই নেই। মায়ের এই রূপ বাঙালি জনমানসে জনপ্রিয়, সেযুগের বিদ্যাবোঝাই (বাবুমশাই )শাস্ত্রবিৎদের কলমে নথিবদ্ধ হয়নি।
■ মেদিনীপুর জেলায় বরদাপল্লী অঞ্চলে চতুর্ভুজা মা বাশুলী পূজিত হন পঞ্চমুণ্ডি আসনে। মা এখানে পীতবর্ণা। মায়ের দক্ষিণে গণেশ, বামে কার্তিক, সম্মুখে জয়া বিজয়া, এবং মায়ের পেছনে যোগিনী। মা ঈষৎ দন্তবিস্ফার করে আছেন।
★সমগ্র হুগলি জেলা জুড়েই মায়ের নানা পীঠস্থান দেখি। মা বিশালাক্ষীর জয়জয়কার যদি কোনও জেলায় অবিরত প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে তবে সে হল হুগলি। শুধু হুগলি জেলার বিভিন্ন বিশালাক্ষী মন্দির নিয়ে একটি সুবিশাল লেখা তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু স্থানাভাবে দুয়েকটি উল্লেখ করেই থামতে হবে। প্রসঙ্গত হুগলি জেলায় অনেক স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিশালাক্ষী মা পূজিত হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ হুগলির রাজবলহাটে মা রাজবল্লভী অবশ্যই বিশালাক্ষীর একটি রূপ, সন্দেহ নেই।
■ হুগলি জেলায় কলাছড়া গ্রামের চতুর্ভুজা বিশালাক্ষী মা তাঁর পদতলে শবশিব দলন করেন এবং একপাশে নীলবর্ণের মহাকাল বা কালভৈরব উপবিষ্ট আছেন।
■ হুগলি জেলার চণ্ডীতলার শিয়াখালায় মা উত্তরবাহিনী বা উত্তরাস্যা নামে পূজিত হন দ্বিভুজা ত্রিনয়নী মা বিশালাক্ষী। তিনি এখানে পদতলে শায়িত মহাকালের বক্ষে দক্ষিণ পদ স্থাপন করেছেন, মায়ের বাম পা রয়েছে পার্শ্বে জোড়হস্তে উপবিষ্ট নীলবর্ণের বটুক ভৈরবের মস্তকে। মায়ের দুই পদতলের মধ্যে একটি ছিন্ন অসুরমুণ্ড দেখি এখানে যা মহাকাল শিবের নাভিদেশে স্থিত। মা মুণ্ডমালিনী, মা হরিদ্রাবর্ণা।
এ লেখার শেষে বলি, মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যে লিখেছিলেন, "বাশুলী চলিল সহজ জানাবার তরে"। বাশুলী মা আমাদের বাঙালিদের সহজভক্তি প্রদান করেন। আমরা প্রকৃতিমাতৃকাশক্তির সহজ ধর্মে স্থিত হয়ে যেন গুহ্য বিকার পরিহার করে মায়ের নির্দেশিত সেই পথে চলি। যে পথে আজ আমি চলেছি, পাঠক, আপনিও চলেছেন, এ পথ আমাদের মা স্বয়ং আমাদের জানিয়ে গেছেন।
জয় মা, জয় মা, জয় মা।
© Tamal Dasgupta (fb.me/tdasgupto)
ছবিতে দেখছেন শিয়াখালাবাসিনী মা উত্তরবাহিনী বিশালাক্ষী। ছবি ইন্টারনেট থেকে।
No comments