জ্যোতি বাবু ক্যাবিনেটে নিতে চেয়েছিলেন, যাননি নিরুপম সেন, পার্টির কথায় চাকরি ছেড়েছিলেন হাসতে হাসতে
ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল বাংলা। প্রথম সারির সমস্ত নেতাই প্রায় জেলে। রোজ ভাঙছে সংগঠন। রোজ চলছে সেই সংগঠন গড়ে তোলার কাজ। রাজনৈ…
জ্যোতি বাবু ক্যাবিনেটে নিতে চেয়েছিলেন, যাননি নিরুপম সেন, পার্টির কথায় চাকরি ছেড়েছিলেন হাসতে হাসতে
ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল বাংলা। প্রথম সারির সমস্ত নেতাই প্রায় জেলে। রোজ ভাঙছে সংগঠন। রোজ চলছে সেই সংগঠন গড়ে তোলার কাজ। রাজনৈতিক উথালপাতালের সেই সময়েই রোগা রোগা চেহারার একটা ছেলে বর্ধমান রাজ কলেজের প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। আর ছাত্রদের মধ্যে সংগঠক খুঁজে বের করতে হন্যে হয়ে ঘুরছেন সিপিএম নেতারা। ‘হীরের টুকরো’ চিনতে ভুল হয়নি তাঁদের।
১৯৪৬ সালের ৮ অক্টোবর বর্ধমানের গোবিন্দপুরে জন্ম নিরুপম সেনের। ১৫ বছর বয়স অর্থাৎ ’৬১ সালে বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
স্নাতক হওয়ার পর শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন নিরুপম সেন। প্রথমে বর্ধমানের সিএমএস হাই স্কুল এবং পরে তিকরহাট হাইমাদ্রাসায় বছর দুয়েক চাকরি করার পর দলের তরফে তাঁকে চাকরি ছেড়ে দলের হোলটাইমার হওয়ার কথা বলা হয়। বর্ধমানের এক প্রবীন কৃষক নেতার কথায়, দু’দিনের মধ্যে সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছিলেন নিরুপম। চাকরি ছেড়েছিলেন হাসতে হাসতে।
কৃষক নেতা মদন ঘোষ এবং সুশীল ভট্টাচার্যের হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান নিরুপমবাবু। ‘৬৫ সালে বিপিএসএফ (বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন)-এর বর্ধমান জেলার সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ২২ বছর বয়সে, ১৯৬৮ সালে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য হয়েছিলেন নিরুপম সেন। ১৯৬৮সালে তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। ওই বছরই এপ্রিলে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত হয় মতাদর্শগত প্রশ্নে সিপিএমের কেন্দ্রীয় প্লেনাম। ওই প্লেনামে যেখানে পলিট ব্যুরো সদস্যরা রাত্রিবাস করতেন সেই বর্ধমান ভবনে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিরুপম সেন। ডাইনিং রুমে টেবিলের ওপর চাদর পেতেই শুতেন পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া ও অন্যান্য পলিট ব্যুরো সদস্যরা। বাইরে বারান্দায় অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে শুতেন নিরুপম সেন।
১৯৬৮ সালেই নাদনঘাটে বর্ধমান জেলার দশম সম্মেলনে নিরুপম সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮৯ সালে রবীন সেন বর্ধমান জেলা কমিটি সম্পাদক পদ থেকে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে এলে বর্ধমান জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পান নিরুপম সেন। সেই থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছয় এবং সাতের দশকের অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় এক অংশে তীব্র কৃষক আন্দোলন এবং অন্য অংশে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। নিরুপম সেন এই আন্দোলনের স্রোতে মিশে গিয়েছিলেন। এর জন্য অন্যান্য সি পি আই (এম) নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা হয়। ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ রাতে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ফেলে দেওয়ার পর দিন যুক্তফ্রন্টের ডাকে সাধারণ ধর্মঘট হয়েছিল। ধর্মঘটের দিন বর্ধমানে তেলমোড়িয়া রোড দিয়ে ধর্মঘটের সমর্থনে একটি মিছিলে সাঁইবাড়ির ছেলেরা বোমা নিয়ে আক্রমণ করেছিল, যাতে আদিবাসীসহ কয়েকজন আহত হন। এরপরে আদিবাসীরা চড়াও হয়েছিলেন সাঁইবাড়িতে। সেদিন ঐ মিছিলে নিরুপম সেন ছিলেন না, তিনি ছিলেন কার্জন গেটের সামনে আরেকটি মিছিলে। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা নিরুপম সেনসহ বহু সি পি আই (এম) নেতাকে সাঁইবাড়িতে আক্রমণের মিথ্যা অভিযোগে জড়িয়েছিলো। যদিও মামলায় নিরুপম সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদৌ টেঁকেনি।
সেই সময় বর্ধমানের অনেক সিপিএম নেতার মতোই আত্মগোপন করতে বাধ্য হন নিরুপম। বর্ধমান শহরেই আত্মগোপন করে মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের সাহায্য নিয়ে পার্টি সংগঠনের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর ছদ্মনাম ছিলো ‘বিজন’। এর আগে ছাত্র আন্দোলনের সময়েও তিনি ‘হরিদাস’ ছদ্মনাম নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে রেল ধর্মঘটের সময় অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আত্মগোপনকারী সেই সব কর্মী ও নেতার বর্ধমানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও খাবার সরবরাহের কাজেও নিরুপম সেন সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হওয়ার পরে বর্ধমানে পার্টির পুনর্গঠনে শ্রমিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদির আন্দোলনে মধ্যবিত্ত অংশের মানুষকে সংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর কখনই প্রশাসনে যাওয়ার মোহ দেখা যায়নি তাঁর মধ্যে। তার চেয়ে সংগঠনে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করেছেন। কারণ ৭৭ সালে বামফ্রন্টের সরকার হলেও, সে বার বর্ধমান শহরের আসন জিততে পারেনি সিপিএম। নিরুপম সেনকে দায়িত্ব দেয় দল। পুনরুদ্ধার হয় ওই কেন্দ্র।
১৯৮৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী পেয়েছিলেন নিরুপম সেন। সেই তাঁর প্রথমবার বিধানসভায় প্রবেশ। জ্যোতিবাবু নিরুপম সেনকে ভূমি-রাজস্ব দফতরের প্রতিমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজি হননি নিরুপম সেন। বলেছিলেন, আমায় ছেড়ে দিন জ্যোতিবাবু। আমি পার্টিটাই করতে চাই।’
১৯৮৫ সালেই নিরুপম সেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হন। ১৯৯৫ সালে নিরুপম সেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন, জেলা থেকে রাজ্যে বর্ধিত দায়িত্ব নিয়ে আসেন। ১৯৯৮ সালে কলকাতায় দলের ষোড়শ কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের পার্টি কংগ্রেসে তিনি পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে নিরুপম সেন ফের বর্ধমান (দক্ষিণ) বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। এ বার বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ২০০৬ সালেও তিনি ঐ কেন্দ্র থেকেই পুনর্নির্বাচিত হন। এবারও তিনি শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরের মন্ত্রী হন। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে বিদ্যুৎমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। বিধায়ক ও মন্ত্রী হিসাবে বিধানসভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় সমৃদ্ধ বক্তৃতা করার জন্য তিনি যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হিসাবে তিনি রাজ্যের শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। শিল্পায়নের এই দশ বছরের পর্বে কৃষির সাফল্যের ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে কৃষক খেতমজুরদের স্বার্থরক্ষা করে রাজ্যে শিল্প এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টেনে আনায় তিনি দক্ষতার নিদর্শন রেখেছিলেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে টানা আলোচনার মাধ্যমে তেল প্রাকৃতিক গ্যাস, ইস্পাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ আনাতেও তিনি সাফল্য পান। আবার টাটাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে উত্তরাখণ্ড থেকে তাদের অটোমোবাইল প্রকল্প এ রাজ্যের সিঙ্গুরে টেনে আনাতেও তিনি সফল হয়েছিলেন। যদিও শেষপর্যন্ত সিঙ্গুরে আর তা রূপায়িত হয়নি। রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিকাঠামো উন্নয়নে এবং বিদ্যুৎ পর্ষদকে অর্থনৈতিক ভাবে সুদৃঢ় করাতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। বামফ্রন্ট সরকারের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে তিনি বহু লেখা লিখেছিলেন। তাঁর লেখা ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘বিকল্পের সন্ধানে’, ‘বর্তমান সময় ও আমাদের পার্টি’, ‘অর্থচিন্তা’, ‘ডাঙ্কেল প্রস্তাব ও ভারতের সার্বভৌমত্ব’, ‘চীনের ডায়েরি’, ‘সময়ের দর্পণে কমিউনিস্ট ইশতেহার’, ‘সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায়’, ‘প্রসঙ্গ মতাদর্শ’, ‘কেন এই বিতর্ক’, ‘শ্বেত পারাবতের সন্ধানে’, ‘অশান্ত কাশ্মীর’ ইত্যাদি বই জনপ্রিয়।
অনেকে বলেন, মাথায় ‘আইস প্যাক’ নিয়ে ঘুরতেন নিরুপম সেন। তাঁর সঙ্গে পঞ্চাশ বছর রাজনীতি করা নেতারাও মনে করে বলতে পারছেন না, কবে নিরুপম সেন চেঁচিয়ে কথা বলেছেন। তবে বর্ধমানের এক নেতার কথায়, “নিরুপমদাকে একবারই দেখেছিলাম উত্তেজিত হতে। ২০০৯ সালের ১৫ জুন, মঙ্গলকোটে খুন হন সিপিএম নেতা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্মরণ সভায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন নিরুপম সেন, তা আগে কখনও শোনা যায়নি।”
২০১৩ সালে নিরুপম সেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে সুস্থ হলেও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। ফলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে যান। ২০১৫ সালের পার্টি কংগ্রেসে তিনি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হন। অসুস্থ অবস্থাতেও কমরেড নিরুপম সেন হুইল চেয়ারে বসে পার্টির অনেক সভা সম্মেলনে যোগ দিতেন।
গতবছর আজকের দিনেই তার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু বাম আন্দোলনের একটি যুগের অবসান।
এ রাজ্যে বাম আন্দোলন এবং বাম শাসনের ইতিহাস তাঁকে অনেকদিন মনে রাখবে।
No comments