Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

এক গাছে পাঁচবার ধান

করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি যখন থমকে গেল।  তখন কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিশ্ববাসীকে খাবারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। আমরা যে যাই করি না কেন দিন শেষে কৃষকের উৎপাদিত ফসলই আমাদের  ভরসা। এই গরীব কৃষকদের জন্য যখন নতুন কিছু  উদ্ভাবিত হয় আবার সেই  বিজ্ঞানী…

 





করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি যখন থমকে গেল। 

 তখন কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিশ্ববাসীকে 

খাবারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। আমরা যে যাই করি না কেন দিন শেষে কৃষকের উৎপাদিত ফসলই আমাদের  ভরসা। এই গরীব কৃষকদের জন্য যখন নতুন কিছু  উদ্ভাবিত হয় আবার সেই  বিজ্ঞানী যদি দেশের হন তাহলে আমাদের গর্ব অনেক।

 

 বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরীর  লেখা নিচে....... 


'মৌলভীবাজারের যে গ্রামে ১৪ বছর ধরে এই ধান চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, সেই গ্রামেই আমি বড় হয়েছি। শৈশবে আমি গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। ওই কমিউনিটিতে আমি থেকেছি। একটা সংগ্রামময় জীবন ছিল আমার। ষাটের দশকে কৃষিকে ঘিরে আমাদের একটা জীবন ছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাবাকে হারিয়েছি। পরে মাকে কেন্দ্র করে আমার একটা জীবন ছিল। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় কৃষকের জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন থেকেই ধান নিয়ে কিছু একটা করব- এরকম একটা ভাবনা আমার ছিল।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ে আমেরিকায় গেলাম। তখন চেষ্টা করেছি বায়োলজির দিকে ফিরে আসতে। ধানের বিজ্ঞানের দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, ধান ফলিয়ে মানুষের আয় বাড়ানোর। কারণ, আমি দেখেছি কৃষিকাজ যারা করছেন, তারা একেবারেই দরিদ্র অবস্থায় রয়ে গেছেন। ধান ফলিয়ে টাকা রোজগার করা যায় না- এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এই সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে আমি যখন বিদেশে গেলাম, তখন জেনেটিক্স আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি। দেশে দেশে গেছি বিজ্ঞান শেখার জন্য।

১৪ বছর ধরে আমি আমার গ্রাম কানিহাটির মাঠে এই ধানগুলো লাগিয়েছি। একটি ধানের সঙ্গে আরেকটি ধান ক্রস করেছি। আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে থাকা আমার শিক্ষকদের সাহায্য নিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি ধান কত বেশি উৎপাদনশীল করা যায়। এভাবে আমি আমার কাজটি এগিয়ে নিয়েছি।

আমার শৈশবের স্মৃতি, দারিদ্র্য দেখা এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে মানুষের বেঁচে ওঠার সংগ্রাম আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, এই ধানগুলো আমার জীবনেরই একটা প্রতিচ্ছবি। ধানের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমি জাগ্রত হয়ে উঠেছি। একটা কবিতা আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণ দেয়, 'হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন জন্ম নিয়েছ সচেতনতার ধান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।'

আমার জীবনের অভিজ্ঞতা, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, দারিদ্র্য এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে সংগ্রামের মাধ্যমেও যারা দরিদ্র রয়ে গেছেন, তাদের এই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে।

আমার উদ্ভাবিত ধান পাঁচবার ফলন দিচ্ছে, যা বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত জরুরি। এটি জলবায়ুবান্ধব ধান। এই ধানটি হাইব্রিড নয়, কিন্তু এই ধানের উৎপাদন হাইব্রিডের সমান। সাধারণত আমাদের দেশে আউশ, আমন ও বোরো ধান রোপণ করা হয়। দীর্ঘসময় মাঠ খালিও থাকে। অনেক সময় তিনটি ধান একসঙ্গে করাও যায় না। কিন্তু আমার উদ্ভাবিত ধান সারাবছরই উৎপাদনের কারণে লাগানো যায়।

একটি বিশাল দিক হচ্ছে, কৃষক নিজের কাছে এ ধানের বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন। এটি এমন একটি আবিস্কার, যার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট একটা পরিবর্তন আসতে পারে। গত বছর যখন দেখেছি এ ধানটি পাঁচবার মাঠে থাকতে পারে এবং ফসল দিতে পারে- এটা আমাকে বিরাট উজ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। যেন সংগ্রামমুখর জীবন পেরিয়ে দীর্ঘ রজনীর পর উষার দ্বারপ্রাপ্তে এসে উপনীত হয়েছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনেক কাজ করেছি। কিন্তু আমার সব কাজ ছাপিয়ে এখন মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত কিছু একটা অর্জন করতে পেরেছি।

এই যে দীর্ঘ সংগ্রামের একটা জীবনের মধ্যে কৃষি ও ধানের বিজ্ঞানকে নিয়ে জাগ্রত হয়ে ওঠা, ২০-৩০ বছর ধরে একই সঙ্গে কাজ করা এবং ফাইনালি একটা কিছু করতে পারা- এটা মনে হচ্ছে একটা পরিণতির দিকে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি আজ অত্যন্ত তৃপ্ত, অত্যন্ত খুশি।

বাংলাদেশের অনেক সুধীজন, বন্ধু, পরিচিতজন আমাকে সব সময় সহাযোগিতা করেছেন। আমি বিশেষ করে স্মরণ করছি আমার মাকে, যিনি আমাকে বড় করেছেন। এ অর্জন তারই জীবনের সার্থকতার প্রতিচ্ছবি। আজ তিনি বেঁচে নেই। তার কথা আমি বিশেষ করে মনে করি এবং এসব কাজকে আমি তার স্মৃতির প্রতি নিবেদন করলাম। এ ছাড়া কানিহাটি গ্রামে আমার এ ধান চাষের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন রাসেল মিয়া। তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা। আমার এই উদ্ভাবন কোনো ব্যবসায়িক কাজে নয়, গরিব মানুষের জন্য বিলিয়ে দেব।'


সমকাল : ২০ নভেম্বর ২০২১

No comments