Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সপ্তসূত্রে সিংহবাহিনী তমাল দাশগুপ্ত

সপ্তসূত্রে সিংহবাহিনী তমাল দাশগুপ্তআমাদের চূড়ান্ত উপাস্য প্রকৃতিমাতৃকাশক্তি, এবং তাঁর সিংহবাহিনী রূপ সম্পর্কে বাঙালি মাত্রেই অবহিত আছেন। আজ সিংহবাহিনী সপ্তসূত্র। মা সিংহবাহিনী সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে এই সাত সূত্র অনুসরণ করবেন। …

 



সপ্তসূত্রে সিংহবাহিনী তমাল দাশগুপ্ত

আমাদের চূড়ান্ত উপাস্য প্রকৃতিমাতৃকাশক্তি, এবং তাঁর সিংহবাহিনী রূপ সম্পর্কে বাঙালি মাত্রেই অবহিত আছেন। আজ সিংহবাহিনী সপ্তসূত্র। মা সিংহবাহিনী সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে এই সাত সূত্র অনুসরণ করবেন। আমি মাতৃধর্মের অনুসারী বাঙালি মহাজাতিকে তার শেকড়ে পুনসংস্থাপিত করতে এসেছি, আমার এই পেজে আমার দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল আমি সর্বাগ্রে বাঙালি জাতির সামনে উপহার স্বরূপ তুলে ধরছি, কারণ আধুনিক বিশ্বে বাঙালিই মাতৃধর্মের প্রধান পুরোহিত, এবং বিশ্বে মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্মের পুনরুত্থানে বাঙালির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী। 

১. তন্ত্র বহু প্রাচীন ধর্মীয় দর্শন। বেদ পুরাণ নিতান্ত অর্বাচীন, তারা তন্ত্রের কোরাপ্টেড চেহারা তুলে ধরে। তন্ত্র প্রথম বিশ্বজনীন ধর্ম ছিল, এবং আদি সিংহবাহিনী মাতৃকার যে রূপ, মাতৃকা মধ্যিখানে, দুইদিকে দুটি সিংহ, সেটা তন্ত্রের দর্শনে সুষুম্নার দুইদিকে ইড়া পিঙ্গলার দ্যোতনা বহন করে।


এই ধর্মটি বিশ্বজনীন কেন? কারণ ইজিপ্ট থেকে সুমের থেকে এশিয়া-ইউরোপের সংযোগস্থল সর্বত্র এ ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল, তার পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। একই রকম মূর্তি। মাঝে কেন্দ্রীয় চরিত্র, সেটা হরপ্পা সভ্যতায় মাতৃকা, তাঁর দুই দিকে দুটি ব্যাঘ্রকে তিনি দুই হাতে ধারণ করছেন, শমিত করছেন, শাসন করছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন। একই রকম মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে অন্যত্র, অন্য সভ্যতায়, সেখানে বাঘের বদলে হয়ত সিংহ।


অতএব তন্ত্র সম্পর্কে বুঝতে গেলে সবার আগে এই কুসংস্কার ত্যাগ করবেন, যে সবই বেদে আছে। কারণ দুটি। প্রধান কারণ, তন্ত্র অবশ্যই অবৈদিক। দ্বিতীয়ত তন্ত্রের উৎস সম্পর্কে বুঝতে গেলে কেবলমাত্র বেদ পুরাণে সীমাবদ্ধ থাকা আর পাড়ার চাউমিনের দোকানে সীমাবদ্ধ থেকে চাইনিজ কুইজিন বুঝতে যাওয়া সমান নির্বুদ্ধিতা। পাড়ার দোকান বা বেদ পুরাণকে খাটো করা হচ্ছে না, তারাও যথাক্রমে সুস্বাদু এবং সুলিখিত হতেই পারে। বক্তব্য হচ্ছে, ওতে সীমাবদ্ধ থাকলে কিছুই বোঝা যাবে না। আপনার পাড়ার দোকানে চাইনিজ রান্নার ইতিহাস সৃষ্টি হয়নি, আপনার বেদ পুরাণে তন্ত্রধর্মের উৎস নেই।


২. সিংহবাহিনী মাতৃকা অতএব প্রাচীন যুগের, মূলত ব্রোঞ্জ যুগের মাতৃকা উপাসক সভ্যতায় সৃষ্ট পৃথিবীর প্রথম সার্বজনীন ধর্ম, তন্ত্রধর্মের অন্যতম মূল সারবস্তুর একটি সরল প্রকাশ। 


এই প্রেক্ষিতেই প্রথম সিংহবাহিনী মাতৃকা, যাঁর মূর্তি বর্তমান তুরস্কের Çatalhöyük অঞ্চলে পাওয়া গেছিল। ছবি কমেন্টে। তিনি পৃথুলা কারণ তিনিই পৃথিবী। তাঁর দুইদিকে দুটি সিংহ আমাদের তন্ত্রের অনুশীলন তত্ত্বের পরিচয় দেয়, যা আমাদের সাহায্য করে আমাদের শক্তিকে পরিশীলিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে। এই সিংহবাহিনী মাতৃকা পরবর্তী যুগে গ্রীক সভ্যতায়  Cybele/Kybeli নামে পরিচিত।


তিনি প্রায়শ পর্বতবাসিনী বলে পরিচিত হচ্ছেন এই সময়। দুদিকে দুটি সিংহ তাঁর বাহন।


ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতার পতন ঘটলেও মাতৃধর্ম টিঁকে থাকে, যদিও আগের চেহারায় নয়। সিংহবাহিনী এরপর মূলত একটি সিংহ নিয়েই আবির্ভূত হবেন। তবে চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় এমন সিংহবাহিনী মাতৃকার মূর্তি পাওয়া গেছে যেখানে দুটি সিংহর মোটিফ বিদ্যমান। আগে পেজে দিয়েছি। লিংক রইল কমেন্টে।


৩. কুষাণ যুগে তাদের সাম্রাজ্যে সিংহবাহিনী "নানা" প্রধান উপাস্য মাতৃকা, তিনি ommo নামেও অভিহিত, যা উমার সঙ্গে অভিন্ন ভাবা হয়। এই সময় থেকে উপমহাদেশে সিংহবাহিনীর ব্যাপক প্রচলন হয়। মথুরা পর্যন্ত যেহেতু কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তৃত, তাই মথুরায় প্রচুর সিংহবাহিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। গুপ্তযুগে এই সিংহবাহিনীর পূজা অব্যাহত থাকে।


কুষাণ মুদ্রায় সিংহবাহিনী মায়ের উপস্থিতি নিয়ে বি এন মুখার্জির একটি চমৎকার বই আছে। গুপ্ত মুদ্রাতেও সিংহবাহিনী মা রয়েছেন।


এরপর শশাঙ্কযুগে নালন্দায় সিংহবাহিনী মাতৃকার সীল পাওয়া গেছে।


৪. হরপ্পা সভ্যতায় সিংহবাহিনী ছিলেন না। তবে ব্যাঘ্রধারিণী ছিলেন, যাঁর কথা ওপরে বলেছি। এছাড়া একজন মহিষমর্দিনী মাতৃকার উপাসনা ভারতে বহু প্রাচীন। মহিষমেধ হত হরপ্পা সভ্যতায় মায়ের উপাসনায়, এবং যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণে আজকে দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজোয় মহিষবলি সেই মহিষমেধ ও আদি মহিষমর্দিনীর পরিচয়। হরপ্পা সভ্যতার তথাকথিত প্রোটো শিব আসলে মাতৃধর্মের পুরোহিত। অনুরূপ মূর্তি কেল্ট জাতির মধ্যেও প্ৰচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। 


দক্ষিণ ভারতে প্রথম এই মহিষমর্দিনী ও সিংহবাহিনী মূর্তির সাযুজ্য স্থাপন করে দুই মূর্তির একীকরণ ঘটেছিল, এবং মহিষটিও অসুরের রূপ পায় (মামল্লাপুরম দ্রষ্টব্য) যা পালযুগে নবম দশম শতক থেকেই বাংলায় নিয়মিতভাবে বিদ্যমান।


৫. সিংহবাহিনী নানা সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি চন্দ্রী, অর্থাৎ তিনি মুন গডেস। সুকুমার সেন নানা সম্পর্কে জানতেন না সম্ভবত, কিন্তু তিনিও বলেছেন, চণ্ডী হল আদিতে চন্দ্রী শব্দের একটি কোরাপ্ট ভার্শন, সংস্কৃত ভাষায় কোনও একটি অসংস্কৃত শব্দের পরিবর্তিত রূপ।


বাংলায় সিংহবাহিনী চণ্ডী বহু প্রাচীন। দুর্গা নামে উপাসনা তুলনায় পরে এসেছে, এবং বাঙালি আজও তাঁর সিংহবাহিনী মাতৃকাকে চণ্ডী নামে স্বচ্ছন্দ সম্বোধন করে। এমনকি পঞ্চদশ শতকের শুরুতে গৌড়ের সম্রাট দনুজমর্দন দেব এবং মহেন্দ্র দেব দুজনেই নিজেদের চণ্ডীচরণপরায়ণ আখ্যা দিয়েছেন।


৬. সিংহ পশুরাজ। একদা সিংহ রাঢ় অঞ্চলে পাওয়া যেত, প্রত্ন জীববিদ্যা অনুযায়ী। বিজয়সিংহের কাহিনীটি দেখলে বোঝা যায় সিংহের সঙ্গে বাঙালির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল এবং পূর্ব ভারতে গঙ্গারিডাই সভ্যতা থেকেই যে বিজয়সিংহের উত্থান তা একরকম সিদ্ধ। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ যেহেতু গঙ্গারিডাই সভ্যতার ব্যাপকভাবে ছিল, কাজেই তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সিংহবাহিনী মাতৃকার উপাসনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন যদিও সিংহবাহিনী সেভাবে পাওয়া যায় নি। এ কথাও ঠিক যে চন্দ্রকেতুগড় বা সুন্দরবনের গঙ্গাল সভ্যতা অঞ্চলে প্রকৃত অর্থে প্রত্নখনন প্রায় কিছুই হয় নি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে যা হয়েছে সেটার সিংহভাগ ওই অঞ্চলের কিছু ফড়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে, স্থানীয় মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ করা সেভাবে সম্ভব হয় নি। আমরা জানি দুদিকে দুইজন অথবা চারজন সন্তান সহ দশায়ুধা (মাথার খোঁপায় দশটি কাঁটা দশটি ক্ষুদ্রাকৃতি আয়ুধ) মাতৃকার জনপ্রিয়তা ছিল সেখানে, আর্যাবর্ত কর্তৃক আগ্রাসনে সেই মাতৃকা মুছে গেছিলেন এবং তাঁর ধ্যান, মূর্তিকল্প, উপাসনাপদ্ধতি, তাঁর নাম - আস্ত গঙ্গাল জাতির নামই বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু শেকড় গভীর, এ মহাদ্রুমকে উৎপাটিত করে সাধ্য কার? ইনিই পরে দশভুজা দশপ্রহরণধারিণী হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন পালযুগে।


৭. চণ্ডী সম্ভবত আমাদের বাংলায় সিংহবাহিনী মাতৃকার আদি নাম। তিনি সর্বব্যাপী ছিলেন, পালসম্রাট গোপাল যে চুন্দা মাতৃকার উপাসনা করতেন তিনি এই চণ্ডীর ভিন্ন রূপ মনে করা হয়, যদিও চুন্দা মূলত চন্দ্রদেবী, তিনি সিংহবাহিনী নন সর্বদা। এশিয়ার বিশেষ করে বৌদ্ধ সার্কিটে বাঙালি বণিকের হাত ধরে সর্বত্র চুন্দা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন যা থেকে প্রাচীন বাংলায় তাঁর জনপ্রিয়তা বোধগম্য হয়। 


পরে পালযুগে মহিমর্দিনী ও সিংহবাহিনীর সাযুজ্য স্থাপনের মাধ্যমে দুর্গা নামে পরিচিত হলেন চণ্ডী।


পালযুগে মহিষমর্দিনী বা মহিষাসুরমর্দিনী ব্যতিরেকে আলাদাভাবে সিংহবাহিনী মাতৃকার মূর্তি বিরল হয়ে গেছিল। একাদশ শতকে বৃহৎ বঙ্গের বিহারে প্রাপ্ত পাল সাম্রাজ্যে উৎকীর্ণ এই অষ্টভুজা সিংহবাহিনী মূর্তি বর্তমানে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে আছে। পাদদেশে দুটি সিংহের মোটিফ লক্ষ্য করুন।


আপনি জানলে অবাক হবেন মাতৃকার পাদদেশে দুদিকে দুটি পশুরাজের এই মোটিফ তন্ত্রধর্মের সরল অথচ প্রগাঢ় বার্তা যা আদিযুগে পৃথিবী জুড়ে ব্যাপ্ত হয়েছিল। মাতৃকা আমাদের কুল, এবং দুদিকে দুটি সিংহ আমাদের শীল। মাতৃকা সুষুম্না, দুদিকে দুটি সিংহ ইড়া ও পিঙ্গলা। 


অনেক সহস্র বছর ধরে এই ধর্ম যে আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতাকে মায়ের পরম মমতায় ধারণ করেছে, আসুন, আজ সেই ধর্মের পুনরুত্থানে,আমাদের শেকড়ের পুনরুদ্ধার ব্রতে আমরা অগ্রসর হই জয় মা ধ্বনি দিয়ে।




©

No comments