রাঢ়ভূমির রাত্রি: একটি বন্ধ মন্দির - তমাল দাশগুপ্ত
বাঙালির রূপকথার তেপান্তরের মাঠ যদি কোথাও থেকে থাকে তাহলে সে রাঢ়। রাঢ় প্রাচীন ভূমি। নব্য প্রস্তর যুগেও এখানে বসতি ছিল, প্রমাণ আছে। পুরাকালে এ জায়গাটার নাম সুহ্ম। সে খ্রিষ্টপূর্ব যুগ…
রাঢ়ভূমির রাত্রি: একটি বন্ধ মন্দির - তমাল দাশগুপ্ত
বাঙালির রূপকথার তেপান্তরের মাঠ যদি কোথাও থেকে থাকে তাহলে সে রাঢ়।
রাঢ় প্রাচীন ভূমি। নব্য প্রস্তর যুগেও এখানে বসতি ছিল, প্রমাণ আছে।
পুরাকালে এ জায়গাটার নাম সুহ্ম। সে খ্রিষ্টপূর্ব যুগের তো বটেই, মহাভারত যুদ্ধের সময়কালের কথা। সেই সময় থেকেই এখানে মাতৃকা উপাসনা জনপ্ৰিয়।
ওই খ্রিষ্টপূর্ব কালেই গঙ্গারিডাই যুগে বিজয়সিংহ: এর খুব কাছেই সিঙ্গুর।
এরপর পালযুগে এখানে দক্ষিণরাঢ়, দক্ষিণী সৈন্যরা কখনও কখনও তাদের কন্নড় উচ্চারণে বলত তক্কনলাড়। কাছেই হরিপাল আর তাঁর কন্যা কানাড়ার স্মৃতিবিজড়িত স্থান আছে।
খুব কাছেই লোকনাথপীঠ ছিল পালযুগে। আগে পালযুগের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র, পালযুগে বাংলা জুড়ে অবস্থিত অনেক লোকনাথপীঠ ও তারাপীঠ নিয়ে লিখেছি। আজ অবশ্য একটিই তারাপীঠ আর লোকনাথ প্রায় সর্বত্র শিবে মিশেছেন। প্রসঙ্গে ফিরি।
এরপর বখতিয়ার আগমন। বাঙালির ভেঙেচুরে যাওয়ার সময়। কিছু পাঠান এসে বসতি করেছিল। শের শাহ নিজেই এখানে কয়েকবার এসেছিল শোনা যায়। এখানে একটা দুর্গ গড় ছিল।দামোদর নদীর গতিপথ পাল্টে গেলে কানা দামোদর তৈরি হয়, আর সেই সঙ্গে বিস্তীর্ন বালিখাদ।
মুসলমান যুগের শেষে ইংরেজ আমলের শুরুতে বর্ধমান রাজ্যের সীমান্তে চুঙ্গি কর নেওয়ার জন্য চোঙদার আগমন করেন।চোঙদার এরপর বসতি করিয়েছিলেন একঘর সোনার বেনেকে। দত্ত। দত্ত নির্মাণ করিয়েছিলেন এই শীতলা মন্দির, যার ছবি দেখছেন।কয়েকদিন আগে কার্তিকী অমাবস্যার রাতে কালীপুজোয় মগ্ন ছিল গৌড়বঙ্গ। এই শীতলামন্দিরটি তখন তালাবন্ধ ছিল, এমন সময় ছবিটি তোলা। একটা আলাদা রহস্যময় পরিবেশ ছিল। খুব কাছেই কালীপুজোর মহা ধুমধাম, কিন্তু এই স্থানটি কোনও অজ্ঞাত কারণে নির্জন ও নিস্তব্ধ ছিল। যদিও দুয়ার বন্ধ, মন্দিরটি তবুও আলোকময়, উজ্জ্বল। এ স্থানটির নাম বালিগোড়ি, এ স্থানটিও বাঙালির বেশিরভাগ স্বভূমির ন্যায় কালীক্ষেত্র। খুব কাছেই বড় মার মন্দির, তিনি এই অঞ্চলের বাগদিদের উপাস্য ছিলেন, পরে বড় মা যখন বর্তমান মন্দিরে স্থানান্তরিত হন, তখন থেকে বাগদিপাড়ায় ছোট মা পূজিত হচ্ছেন। এই পেজে বড় মা ও ছোট মার বিসর্জন শোভাযাত্রার ভিডিও পোস্ট করেছিলাম, দেখে থাকবেন।
বাঙালির এই পুণ্যভূমিতে মায়ের নাম ব্যতিরেকে, মায়ের থান বর্জিত এক কিলোমিটার অবিচ্ছিন্ন ভূমি পাওয়া অসম্ভব। বাঙালির সংজ্ঞায়ন হয় মাতৃধর্মে, আজও কারো সন্দেহ আছে? মাটিতে নামুন, সন্দেহ কেটে যাবে।
যেখানে মায়ের নাম হবে, সেখানে বাঙালি প্রাণ পাবে। যেখানে মায়ের সাজ হবে, সেখানে বাঙালি রাজ হবে।
বন্ধ মন্দিরটির দিকে তাকিয়ে বিস্মৃত অতীতের রহস্য অনুধাবন করুন। অক্ষয় বট যেন একটা ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে আপনার আমার ধরাছোঁয়ার নাগালে, শুধু একটু ব্যবধান আছে, সেটুকুই রহস্য। 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো।'
No comments