পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের অদূরে এক মনোরম দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এটি নদিয়া বাসীর কাছে ভীষণ জনপ্রিয় । এখানে রয়েছে "রাজরাজেশ্বরের মন্দির" , স্থানীয় লোকদের কাছে এটি" বুড়ো শিবের মন্দির" বলে…
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের অদূরে এক মনোরম দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এটি নদিয়া বাসীর কাছে ভীষণ জনপ্রিয় । এখানে রয়েছে "রাজরাজেশ্বরের মন্দির" , স্থানীয় লোকদের কাছে এটি" বুড়ো শিবের মন্দির" বলে পরিচিত।
কথিত আছে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বর্গী আক্রমণের সময় কৃষ্ণনগর থেকে তার রাজধানী সরিয়ে আনেন এখানে এবং শিবের নামে স্থানটির নামকরণ করেন "শিবনিবাস"। এখানে তিনি একটি রাজপ্রাসাদ ও কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । তার মধ্যে মাত্র তিনটি মন্দির অবশিষ্ট আছে।
এই শিবনিবাসে তার রাজধানী প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটি কাহিনী আছে। কাহিনীটি এরকম, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামক এক দুর্ধর্ষ ডাকাত কে দমন করতে মাজদিয়ার কাছে এক গভীর অরণ্যে উপস্থিত হন। ডাকাত দমন করে সেখানেই তিনি রাত্রি বাস করেন। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি যখন নদীতীরে মুখ ধুচ্ছিলেন ,তখন একটি রুই মাছ জল থেকে লাফিয়ে মহারাজার কাছে এসে পড়ে। আনুলিয়া নিবাসী কৃষ্ণরাম নামক মহারাজার এক আত্মীয় মহারাজকে বলেন , "এ স্থান অতি রমণীয়। উপরন্তু রাজভোগ্য সামগ্রী নিজে থেকে মহারাজার সামনে উপস্থিত হচ্ছে । তাই এই স্থানে মহারাজা বাস করলে মহারাজের নিশ্চয়ই ভালো হবে।" মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন বর্গী আক্রমণ থেকে বাঁচতে এরকম নিরাপদ ও নির্জন স্থানে খুঁজছিলেন। তারপর এখানেই তিনি বসবাস শুরু করেন ।এখানে কঙ্কন আকারে নদীবেষ্টিত করে তিনি এই স্থানটিকে সুরক্ষিত করেন । সেই নদী বা খাল জুড়ে দেয় দুই নদীকে - ইচ্ছামতী নদী আর চূর্ণী নদী। এই কঙ্কণাকার নদীটির নাম কঙ্কনা নদী ।
এই শিবনিবাসে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মহাসমারোহে অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন ।এই যজ্ঞ উপলক্ষ্যে কাশী, কাঞ্চি, কানৌজ ইত্যাদি স্থান থেকে সমাগত বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা তাকে "অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী" আখ্যা দেন। সেই সময় শিবনিবাস কাশীতুল্য পরিগণিত হোত সকলের কাছে।
এই শিবনিবাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১০৮ টি মন্দির ও একটি রাজপ্রাসাদ । তবে যে তিনটি মন্দির অবশিষ্ট আছে তার কিছুটা বর্ণনা দি। সবচেয়ে বড় মন্দিরের নাম " রাজরাজেশ্বর মন্দির" । এই মন্দিরটি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর প্রথমা মহিষীর অনুরোধে নির্মাণ করেন। এই মন্দিরটি উঁচু বেদির ওপর নির্মিত । মন্দিরটি প্রায় একশো কুড়ি ফুট উঁচু। এই মন্দিরটি অষ্ট প্রস্থচ্ছেদের মন্দির । প্রতিটি কোনায় মিনার ধরনের সরু থাম, শীর্ষদেশ ছত্রাকার। প্রবেশদ্বারের খিলান ও অবশিষ্ট দেয়ালে একই আকৃতির ভরাট করা নকল খিলান গুলি " গথিক" রীতি অনুযায়ী নির্মিত। মন্দিরের অন্দরে কৃষ্ণপাষাণে নির্মিত এক শিবলিঙ্গ অবস্থিত। শিবলিঙ্গের উচ্চতা ১১ফুট ৯ ইঞ্চি, বেড় ৩৬ ফুট । শিবের মাথায় জল ঢালতে শিবলিঙ্গের পাশে থাকা সিঁড়ির সাহায্য নিতে হয়। এখানে বহুদিন পর্যন্ত এটাই ছিল পূর্ব ভারতের সর্বোচ্চ শিবলিঙ্গ ,।
বামদিকে রয়েছে রামসীতা মন্দির । মন্দিরের উচ্চতা ৫০ ফুট। এই মন্দিরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠান করছেন কোষ্ঠী পাথরের রামচন্দ্র, অষ্টধাতুর দেবী সীতা , অনুজ লক্ষণ। এছাড়াও শিব,কালী গণেশ ও কৃষ্ণের প্রাচীন মূর্তি এখানে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দির প্রাঙ্গণে ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
এর পাশেই আরেকটি শিব মন্দির আছে। যার নাম " রাজ্ঞেশ্বর মন্দির" । এই মন্দিরটি মহারাজা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেন । এটি উঁচু ভিত্তির ওপর নির্মিত । উচ্চতা ৬০ ফুট । এটি আবার বর্গাকার প্রস্থচ্ছেদের চারচালা যুক্ত মন্দির । এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৬২ সাল। এই মন্দিরের অবস্থিত শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ৭ ফুট।
এছাড়াও মন্দিরগুলোতে রয়েছে এক অসাধারণ বিশেষত্ব । প্রতিটি মন্দিরের মাথায় কয়েকশো ফোকর বা ফাঁক রয়েছে। এখানে কয়েক'শ টিয়া পাখি বাসা বাঁধে এবং তাদের কলকাকলিতে মন্দির প্রাঙ্গন ভরিয়ে তোলে। এ এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য !
১৮২৪ সালে বিশপ হেয়ার সাহেব নদীপথে ঢাকা যাওয়ার সময় এই মন্দির ও রাজপ্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান । তিনি এই মন্দির গুলি সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যেটি ১৮২৮ সালে লন্ডনের এক বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়। তিনি রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারটি কে ক্রেমলিনের প্রধানের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন, সেই বিস্তীর্ণ প্রাসাদের মনোরম নির্মাণশৈলী তাকে ক্যাসেল ও বোলটন অ্যবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই মন্দিরগুলোতে কোন টেরাকোটার কাজ না থাকলেও এর গঠনশৈলী বাংলার মন্দির রীতিতে এক অনন্য উল্লেখযোগ্য সংযোজন। মন্দির ছাড়াও শিবনিবাসে একটি রেশম খামার আছে।
প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার লক্ষাধিক মানুষ নবদ্বীপের গঙ্গা নদী থেকে জল নিয়ে ৪২ কিলোমিটার পথ পদব্রজে অতিক্রম করে শিবনিবাস এর এই বুড়ো শিবের মাথায় জল ঢালতে আসেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এখানে ১০৮ টি মন্দির ও একটি রাজ প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন ,কিন্তু কালের অতল গহবরে সব ধ্বংসপ্রাপ্ত । শুধুমাত্র তিনটি মন্দির কালের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে এখনও বিরাজমান। বাংলার বুকে শিবনিবাস এর ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম।
সম্পাদক মহাশয়,ধন্যবাদ আমার লেখাটি এখানে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাকে জানিয়ে দিলে আরো খুশি হতাম। কারণ আমার নিজের ব্লগও রয়েছে।
ReplyDeleteপরবর্তীতে আমার লেখা দিলে আমাকে জানিয়ে দেবেন।
ReplyDelete