আমার বাবা একদিন বলেছিলেন, তুই অনেক কষ্ট করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিস। আমি তোকে একটুও সহযোগিতা করি নি। প্রয়োজন হয়নি বলেই করিনি।"আমি বলেছিলাম, বাবা এমন কথা বলো না।এমন কথা শোনা অন্যায় । তুমি কেন দিতে যাবে তোমার যা আছে আমি তো ন…
আমার বাবা একদিন বলেছিলেন, তুই অনেক কষ্ট করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিস। আমি তোকে একটুও সহযোগিতা করি নি। প্রয়োজন হয়নি বলেই করিনি।"আমি বলেছিলাম, বাবা এমন কথা বলো না।
এমন কথা শোনা অন্যায় । তুমি কেন দিতে যাবে তোমার যা আছে আমি তো নিয়ে ফেলেছি।
জানি, তোর মনে এসব আসে না। শোন, সব বাবা চায় ছেলে বাবাকে টপকে যাক। বাবা মারা গিয়েছেন ২০১০ সালে ৯৬ বছর বয়সে। এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন ২০০৩ সালে যখন বাংলাদেশ যাই। এই যে তুই কবি জীবনানন্দ দাশের নামে এত বড় মেলা করলি। একি কম কথা। বিদেশীরাও এখানে এসেছে। বিদেশ থেকে এইভাবে কতজন ডাক পায়। আমি বাবাকে বললাম, বাবা আর না। তারপর আমি যেন পালিয়ে বাঁচলাম। আমি আমার জীবনে বাবার কাছে একটানা আধাঘন্টা বসেছি মনে পড়ে না। বাবা তো অনেক বড় মাপের মানুষ। আমি কোনদিন সাহস করিনি। খুব প্রয়োজন থাকলে ৫ থেকে ১০ মিনিট কথা বলতাম। বাবা বসতে বলতেন ।আমি কিন্তু কখনো বসিনি ।তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বাবার কাছে চেয়ারে বসবো, সে যোগ্যতা অর্জন করেছি ,আমি মনে করি নি। আমার স্কুলের হেডমাস্টার খুব মেরেছিলেন আমাকে। কারণ আমি ক্লাসরুমের একটা চেয়ার ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। তারপর আর কোন দিন একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত গুরুজনদের সামনের চেয়ারে বসতাম না। একদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো সেই হেডমাস্টার মশাই মণিভূষণ সাঁতরা আমার কাছে এসেছিলেন বিশেষ কাজে। আমার অফিসে আমি তখন চেয়ারে বসে আছি। আমি তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে আমার চেয়ারটা তাঁকে ছেড়ে দিলাম। তিনি কিছুতেই রাজি নন । বললাম স্যার এই চেয়ারটা আপনার জন্যই পেয়েছি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর পরে স্কুলের সামনে তার যে স্ট্যাচু বসানো হয়েছিল তার আবরণ উন্মোচন আমি করেছিলাম। আমরা শিক্ষিত হয়ে গেছি এবং অন্যকে শিক্ষিত করার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছি এই অহংকার খুবই ক্ষতিকারক। পতনের লক্ষণ। চোখ-কান সজাগ রাখতে হয় সচেতন রাখতে হয় মনকে এবং সক্রিয় রাখতে হয় ।তাহলে কত শিখতে পারি। আসলে আহরণ করার ইচ্ছা আগ্রহ মানসিকতা থাকা চাই। জীবনটাকে ভাসিয়ে দিতে নেই।
আমি তখন সিক্স সেভেনে পড়ি। বাবা প্রবাসী পত্রিকা পড়তেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত সচিত্র মাসিক পত্রিকা "প্রবাসী" । সাদা সবুজের প্রচ্ছদ। প্রথম সংখ্যা ১৩০৮ বঙ্গাব্দ ( এপ্রিল ১৯০১)। এই সূচনা সংখ্যাটি এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়েছিল। বার্ষিক মূল্য ছিল আড়াই টাকা। পত্রকাটি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪০। প্রথম সংখ্যার লেখক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কমলাকান্ত শর্মা দেবেন্দ্রনাথ সেন নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং যোগেশচন্দ্র রায়। পত্রিকাটির অস্তিত্ব ছিল ৫০ বছর।আমি বইটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে, আমার হাতে পত্রিকাটি দিয়ে বলেন পড়। তখন পত্রিকাটি পুরনো হয়ে গেছে। প্রবাসী পত্রিকায় বাউল কবি গগন হরকরার বিখ্যাত গান ছাপা হয়েছিল। কুষ্টিয়াতে জন্মেছিলেন শ্রী গগনচন্দ্র দাম। ডাক হরকরার কাজ করতেন তিনি। সময় পেলে ছুটে যেতেন লালনের আখড়ায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরার খুব সখ্যতা ছিল। গগন হরকরার গান "আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে"। গগন হরকরার গগন হরকরার গানের সুর থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে রবীনাথ ঠাকুর লিখলেন "ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।" এখন এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় নারী পুরুষের সমান অধিকার বিশ্বাস করতেন। নারী প্রগতি নিয়ে তিনি লিখেছেন এবং তিনি নারীদের লেখায় উৎসাহিত করতেন। পত্রিকাটি নির্ভীক প্রগতিবাদী। পত্রিকাটি পড়েছি কি পড়িনি জানতে চাননি কোনদিন। এত সুন্দর লেখা গল্প কবিতা। আমার নেশা ধরে গেল। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে (একসঙ্গে জড়ো করা কয়েকটি সংখ্যা) আমি পড়তাম। যতই কাজ থাক পত্রিকাটি একবার হাতে না নিলে আমার মন খারাপ করতো। একদিন একটি গল্প পড়তে পড়তে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে মাদুর বিছিয়ে যতক্ষন না অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে কষ্ট করে পড়েছি সেই গল্প। গল্প সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হলো আমার মধ্যে। গল্পের ছলে কথা বলা অভ্যেস হয়ে গেল। রাজনৈতিক কারণেই অনেক দেরিতে সাহিত্য চর্চা করেছি। কিন্তু সেই শৈশবেই ভিত তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে।
বাবা আমাকে কোনদিনই বলেননি রাজনীতি করার জন্য। একদিনও উৎসাহিত করেন নি। একজন নিষ্ঠাবান রাজনীতির মানুষকে দেখেছি আমি। আমি নিজেই জানি না বাবা তো দূরের কথা, কখন রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েছি। একদিন আমাদের পাশের হানুভূঁইয়া গ্রামে গীতা মুখার্জী এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং করতে। বাড়িতে লোকজন আসতো। চর্চা হতো তাই আমি জানতে পেরেছিলাম। আমি একটি মাঠ একটি খাল পেরিয়ে মিটিং এর পাশে পৌছে গেলাম ।দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছের আড়াল থেকে শুনলাম। জোতদারদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিচ্ছেন গীতা মুখার্জী। সেই সভাতে বাবা সভাপতি। ঐ ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়া বালক রাতারাতি একজন প্রতিবাদী হয়ে উঠলাম। পড়াশোনায় মন বসতো না ।মাথায় এইসব ঘুরঘুর করতো। সেই অভ্যেস আজও ছাড়তে পারিনি। শৈশবে শিশু যা দেখে ব্যাখ্যা করতে পারে না কিন্তু মনে গেঁথে যায়। আর সেই শৈশব হাওয়া শরীরে মনে লেপ্টে থাকে আমৃত্যু।১৬ অক্টোবর ২০২১
No comments