Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রাজার শেষ দিনগুলি’- রানা চক্রবর্তী

‘১৮৩০ সালের নভেম্বর মাসে, ‘অ্যালবিয়ন’ নামের জাহাজে চড়ে রামমোহন রায়, ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন - ‘রামরত্ন মুখোপাধ্যায়’, তাঁর পালিত পুত্র ‘রাজারাম’ এবং তাঁর দু’জন চাকর - ‘রামহরি দাস’ ও ‘শেখ বক্স’। ভ…

 





                                             

১৮৩০ সালের নভেম্বর মাসে, ‘অ্যালবিয়ন’ নামের জাহাজে চড়ে রামমোহন রায়, ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন - ‘রামরত্ন মুখোপাধ্যায়’, তাঁর পালিত পুত্র ‘রাজারাম’ এবং তাঁর দু’জন চাকর - ‘রামহরি দাস’ ও ‘শেখ বক্স’। ভারতবর্ষের মাটি থেকে শেষবারের মতো পা তুলে নিলেও, ভারতের অবর্ণনীয় দুঃখদুর্দশার কথাই জাহাজে বসে রামমোহন ভাবতেন। আর তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি; তাই তিনি যে সব কিছুই যুক্তির দ্বারা লিখবেন ও বলবেন - সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। জাহাজে সময় পেলেই সেইজন্য তিনি পড়তেন ও লিখতেন। ইউরোপকে তিনি যা শোনাবেন, সে সবই জাহাজে বসেই ঠিকঠাক করে নিয়েছিলেন। রামমোহনের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল, কেবল পড়া আর পড়া। এসব প্রায় সকলেই জানেন। একবার রামমোহনের সঙ্গে তন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে এক পণ্ডিত তর্কে নেমেছিলেন। রামমোহন তাঁর কাছে একদিন সময় চেয়েছিলেন। তন্ত্রের একটা বই তাঁর পড়া ছিল না। তাই সেইদিনই, ‘শোভাবাজার রাজবাটী’ থেকে তিনি বইটি আনিয়েছিলেন। তারপরে সারারাত্রি পরিশ্রম করে পড়ে সেই কঠিন বইটিকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন। এমনই ছিল তাঁর মেধা। বিলেতের পথেও রামমোহনের পড়ার গতি সেইরকমই ছিল। তবে জাহাজে আলোচনা করবার জন্য তিনি তাঁর মনের মতো কোন বন্ধুকে পেয়েছিলেন কিনা - সেটা জানা যায় না। সেকালে জাহাজে করে ইংল্যাণ্ডে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগত। এক সময় জাহাজ ‘কেপ টাউনে’ পৌঁছেছিল। সেখানে রামমোহনের সাথে ছোটো একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পড়ে গিয়ে রামমোহনের একটি পা ভেঙে গিয়েছিল। তাঁর সেই ভাঙা পা আর কোনো দিনই সারেনি। রামমোহন অবশ্য তাঁর শরীরের সেই কষ্টকে ভ্রূক্ষেপই করেননি। তাঁর জাহাজ কেপ টাউনে থাকার সময় আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, দুটি ফরাসি জাহাজে তেরঙা পতাকা উড়ছে। রামমোহন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের জাহাজ। স্বাধীন ফ্রান্সের পতাকা তাঁর কাছে ছিল - স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর পতাকা! রামমোহন ভাঙা পা নিয়েই একখানি জাহাজে উঠেছিলেন। তখন নিজের শরীরের কষ্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন রামমোহন। ওই বিপ্লবের পতাকাকে তিনি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। আনন্দে বলে উঠেছিলেন - অভিনন্দন, অভিনন্দন, অভিনন্দন ফ্রান্সকে। তাঁর কাছে ফ্রান্সকে অভিনন্দন জানানো মানে ছিল বিপ্লবকে অভিনন্দন জানানো। কখনো কখনো বিপ্লবও যে প্রয়োজন, সেই সত্যটি তিনি মেনেছিলেন। এই প্রসঙ্গে রামমোহনের জীবনের আর একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা বলে রাখা যাক। ‘সিল্ক বাকিংহাম’ ছিলেন রামমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৮২১ সালের আগস্ট মাসে তিনি একটি ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। রামমোহন সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু সেই ভোজসভায় তিনি যেতে পারেননি। সেদিন রামমোহন একটি দুঃসংবাদ পেয়েছিলেন। সেদিন ‘অস্ট্রিয়া’ আক্রমণ করেছিল ‘ইটালি’কে। ইটালির স্বাধীনতা হরণ করেছিল অস্ট্রিয়া। সেই সংবাদে রামমোহন একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। ‘সিল্ক বাকিংহাম’কে একটি চিঠি লিখে তিনি জানিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতার শত্রু এবং নির্দয়তার সাক্ষী রাজতন্ত্র এই পৃথিবীতে কখনও সফল হতে পারবে না। মানুষের মুক্তির জন্য রামমোহনের কী বিশাল আকাঙ্ক্ষা ছিল। আর তাঁর শত্রুদের প্রতি কী প্ৰচণ্ড ঘৃণা ছিল তাঁর! যেখানেই তিনি স্বাধীনতার প্রকাশ দেখেছিলেন, সেখানেই তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮২৩ সালে যেদিন, ‘স্পেনের’ দাসত্ব থেকে ‘দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশগুলি’ মুক্তি পেয়েছিল, সেদিন রামমোহন তাঁর কলকাতার বাড়িতে এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। সেদিন তাঁর বক্তৃতায় অভিনন্দিত হয়েছিল উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি। রামমোহনের ইউরোপীয় বন্ধু-বান্ধবরা পর্যন্ত সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অমন ব্যাপার তাঁদের দেশেও কেউ করতেন না। তাঁরা রামমোহনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির জন্য রামমোহনের এত আনন্দ কেন? রামমোহনের সঙ্গে তো সেই দেশগুলির কোন সম্পর্ক নেই! রামমোহন গর্জে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “What! Ought I to be insensible to my fellow creatures wherever they are, or however unconnected by interest, religion or language?” সংগ্রামীদের সঙ্গে রামমোহনের আত্মীয়তাবোধ ওই ভাবেই সেদিন প্রকাশ পেয়েছিল। ভারতভূমির সঙ্গে বিশ্বের যোগ ঘনিয়ে উঠেছিল সেদিন। সেটাকেই বলা যায় ‘বিশ্বপ্রেম’। অনেককাল পরে, শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ওরকম ভাবেই বিশ্বের নির্যাতিত মানুষদের ঐক্যের কথা ভেবেছিলেন। রামমোহনের কথায় ও কাজে সেটারই সূচনা হয়েছিল। ১৮৩১ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে রামমোহন ‘লিভারপুলে’ পৌঁছেছিলেন। রামমোহনকে অভ্যর্থনা জানাতে জাহাজঘাটাতেও সেদিন অনেক মানুষ এসেছিলেন। রামমোহনের খ্যাতি যে সেই সময়ের সমগ্র ইংল্যাণ্ডেই ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা লিভারপুলের জনসমাগম থেকেই বুঝতে পারা যায়। তৎকালীন সময়ের ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘উইলিয়ম রস্কো’ তখন লিভারপুলে থাকতেন। রামমোহনের পাণ্ডিত্যে তিনি মুগ্ধ ছিলেন। রামমোহনের মেধা আর মনন তাঁকে স্পর্শ করেছিল। লিভারপুলের ‘টমাস হাডসন’ যখন ভারতে এসেছিলেন, রামমোহনকে লেখা তাঁর একটি চিঠি পৌঁছে দিতে বলেছিলেন ‘রস্কো’। সে চিঠি অবশ্য রামমোহন পাননি। কেননা তখন রামমোহন ছিলেন ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজে। ‘রস্কো’ সে চিঠিতে রামমোহনকে তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। রামমোহন যেমন নিন্দা পেয়েছিলেন, তেমনি তিনি শ্রদ্ধাও কম পাননি। রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছালে রস্কো তাঁকে নিজের গৃহে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রামমোহনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে রামমোহনকে শ্রদ্ধা জানাবার দিনটি পর্যন্ত তিনি বেঁচে আছেন। কী অসীম আকৃতি আর শ্রদ্ধা ঝরে পড়েছিল তাঁর সেই অনুভবে ও প্রীতিতে। রামমোহন প্রথমেই ভারতীয় প্রথায় রস্কোকে সম্মান জানিয়ে বলেছিলেন, “যাঁর খ্যাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, তাঁকে দেখতে পেয়ে তিনি সুখী এবং গর্বিত”। রস্কো তখন রোগশায়। প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিলনের সেই দৃশ্য যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁরা কোনদিনই ভুলতে পারেননি। রামমোহন ‘ম্যাঞ্চেস্টারের’ কল-কারখানাগুলো ঘুরে দেখেছিলেন। কারখানার কুলি মজুরেরাও রামমোহনকে দেখে খুশি হয়েছিলেন। রামমোহনকে তাঁরা শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষ সেদিন ভারতবর্ষের ওই দৃপ্ত মানুষটিকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন। লিভারপুল থেকে রামমোহন ‘লণ্ডনে’ চলে গিয়েছিলেন। পথে যেখানেই সুযোগ মিলেছিল, দর্শনার্থীরা রামমোহনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছিলেন। লণ্ডনের ‘রিজেন্ট স্ট্রিটে’ একটি বাড়ি নিয়েছিলেন তিনি। সারা শহরময় রামমোহনকে দেখবার জন্য উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। বেলা এগোরাটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত - রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলেরই ভিড় জমেছিল রামমোহনের ওই বাড়িতে। এখানে একটি চমৎকার ঘটনার কথা বলে রাখা যাক। রামমোহন কিছুদিনের জন্য, ‘বণ্ড স্ট্রিটের’ একটা হোটেলে ছিলেন। সেখানে হঠাৎ একদিন মাঝরাতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত দার্শনিক - ‘জেরেমি বেন্থাম’। বেন্থামের তখন জগৎ-জোড়া নাম ছিল। ভারতেও কেউ কেউ তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। রামমোহনও তাঁর চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ও বেন্থামের প্রভাবে উদ্দীপ্ত ছিলেন। জগতের সুখের তাৎপর্য কী - বেন্থাম তাঁর লেখার মাধ্যমে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। রামমোহন যখন লণ্ডনে পৌঁছেছিলেন, বেন্থাম তখন বৃদ্ধ। সেই সময় তিনি কারও সঙ্গে বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ করতেন না। কিন্তু তিনিই ছুটে গিয়েছিলেন রামমোহনকে দেখতে! তৎকালীন ইউরোপের বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা রামমোহনকে সম্মান জানাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ইংল্যাণ্ডের রাজার ভাই ‘ডিউক অব কাম্বারল্যাণ্ড’, ‘হাউস অব লর্ডসে’ রামমোহনকে বিধিমতে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন। রামমোহন চেয়েছিলেন বলে ‘টোরি’ সদস্যরা ‘জুরি বিলের’ বিরুদ্ধে ভোট দেননি। ‘ব্রাহাম’, যিনি বিশ্ব থেকে ক্রীতদাস প্রথার উচ্ছেদের পক্ষে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে রামমোহনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। ব্রাহামের সঙ্গে তাঁর মনের মিল হয়েছিল এ কারণেও, যে তিনি জনশিক্ষার প্রসারের পক্ষপাতী ছিলেন। তাই শিক্ষার প্রচারে ব্রতী ব্রাহামকে রামমোহন যে নিজের কাছে টেনে নেবেন, সেতো স্বাবাবিক। ১৮৩১ সালের ৬ই জুলাই তারিখে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টররা, রামমোহনকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। ভারতে কিন্তু সেই কোম্পানিই রামমোহনের ‘রাজা’ উপাধিকে মেনে নেয়নি। কী বিচিত্র গতি সময়ের! শেষ পর্যন্ত নিজেদের দেশে তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ভারতীয়দের জন্য সেবাব্রতে রামমোহনের অবদান স্মরণযোগ্য। মৌমাছি যেমন বাগানের ফুলগুলি থেকে সবচাইতে মিষ্টি মধু আহরণ করে, তেমনি রামমোহন ভ্রমণ ও পঠনের দ্বারা অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে মধু সংগ্রহ করছিলেন। তাঁর মানসিক প্রকর্ষের তুলনা ছিল না - সেই সত্য উচ্চারিত হয়েছিল, কোম্পানির চেয়ারম্যানের কন্ঠে। এখানেই রামমোহনকে সন্মান প্রদর্শনের শেষ ঘটেনি। ‘চতুর্থ উইলিয়মের’ অভিষেক-উৎসবে, ইউরোপের রাজশক্তিগুলির রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে আসন লাভ করেছিলেন রামমোহন। রামমোহন সেখানে ‘ভারততত্ত্ববিদ’ ‘হেনরি টমাস কোলব্রুকের’ সম্মানার্থে ধন্যবাদজ্ঞাপক একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। জ্ঞানতাপসের প্রতি রামমোহনের শ্রদ্ধা প্রকাশের সেটাই ছিল উপযুক্ত জায়গা। তিনি মানবতাবাদী সমাজহিতৈষী ‘রবার্ট আওয়েনের’ সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রামমোহন কেবল ভারতের ছিলেন না, তিনি ছিলেন সকলের। ইংল্যাণ্ডে প্রজামঙ্গলের জন্য ‘রিফর্ম বিলের’ সমর্থক ছিলেন তিনি। ওই বিলটি ‘কমন্স সভা’য় পাশ হলেও ‘লর্ডসের সভায়’ নাকচ হয়ে যাচ্ছিল। তৃতীয় দফায় যখন বিলটি লর্ডসের সভায় প্রেরণ করা হয়েছিল, তখন ইংল্যাণ্ডের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সেই বিলের পরিণাম সম্বন্ধে। রামমোহন তখন সেখানে ছিলেন। তিনিও উত্তেজিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিলটি পাশ হয়ে গিয়েছিল। রামমোহনের আনন্দ দেখে কে? ‘উইলিয়ম রাথবোন’কে তিনি একটি চিঠি লিখে তাঁর সেই আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। রামমোহনকে ইংল্যাণ্ডে পেয়ে, ব্রিটিশ সরকার নিজেদের আর একটি ভুল শুধরে নিয়েছিলেন। রামমোহনের ‘রাজা’ উপাধিটি তাঁরা সরকারিভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অদৃষ্টের কী পরিহাস! আসলে, একজন রাজাকে যথাযোগ্য সম্মান না জানালে, তৎকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক আর শিক্ষিত মহলে তাঁদের সম্মান যে ধুলোয় মিশে যেত। রাজা ‘উইলিয়ম’ রামমোহনের সঙ্গে দেখা করতেও সম্মত হয়েছিলেন। সেই সময় লণ্ডনে একটি সেতুর উদ্বোধন হচ্ছিল।না সেই উপলক্ষে আয়োজিত একটি ভোজসভায় রামমোহন নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এছাড়া রাজার সম্মানে একটার পর একটা সংবর্ধনা সভার আয়োজন তো হচ্ছিলই। ‘জেরেমি বেন্থাম’ সেরকম একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন। লণ্ডনের ‘ইউনেটেরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ সাড়ম্বরে রাজাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন ‘ড. বাওরিং’। তিনি রামমোহনকে প্লেটো, সক্রেটিস, মিল্টন ও নিউটনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। “হাজার হাজার বছর আগেকার সেসব মনীষীকে পেলে আমরা যেমন আনন্দিত হতাম, তেমনি হাজার হাজার মাইল দূর দেশ থেকে আগত ওই মানুষটিকে পেয়ে আমার সেই অনুভূতি হচ্ছে” - ‘ড. বাওরিং’-এর এই অভিমত যেন ভারতবর্ষকে এক লাফে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলির সমান সারিতে এনে দিয়েছিল। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ‘ড. কাকল্যাণ্ড’ ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি রামমোহনকে আমেরিকায় স্বাগত জানিয়েছিলেন। রামমোহন অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা যে বিদেশে সম্মানিত হয়েছিল, সেজন্য তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। তাঁর কথায় বললে - “বিচারবুদ্ধির সঙ্গে শাস্ত্রের, সহজবুদ্ধির সঙ্গে সম্পদের, শক্তির সঙ্গে সংস্কারের সংগ্রাম চলছে। এই তিনটির সঙ্গে ঐ তিনটি যুদ্ধ করে আসছে। আমার এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আজ হোক বা কাল হোক আপনাদের জয় অনিবার্য।” আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী রামমোহনের চরিত্রের পরিচয় এখানে পাওয়া যায়। এরপরে ইংল্যাণ্ডে যে উদ্দেশ্যে রামমোহন গিয়েছিলেন, সেই কাজও যথাসাধ্য তিনি করে ফেলেছিলেন। তাঁর আবেদনে মোঘল সম্রাট ‘দ্বিতীয় আকবরের’ বাৎসরিক অনুদান তিন লক্ষ টাকার মতো বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু বেথির সতীদাহ সওয়াল? যার আড়ালে ছিল ব্রাহ্মণ্য শক্তির আস্ফালন? যাঁদের উসকানিতে পাড়ায় পাড়ায় রামমোহনের বিরুদ্ধে ছড়া তৈরি হয়েছিল - “ব্যাটার সুরাই মেলের কুল,/ ব্যাটার বাড়ি খানাকুল,/ ব্যাটার জাত বোস্টম কুল,/ ওঁ তৎসৎ বলে ব্যাটা বানিয়েছে স্কুল -”। রামমোহন একের পর এক যুক্তি দিয়েছিলেন। যুক্তি তো নয়, যেন তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্র। তাঁর যুক্তির বিপক্ষে বেথি দাঁড়াতে পারেননি। রামমোহন তো ছিলেন প্রতিবাদীর (Oppressed) পক্ষে। আর উকিল (Advocate)-এর সম্বল ছিল কেবল পাঁজিপুথি। সেদিন কে শুনেছিল সেই সব কথা। মানুষ তখন অন্যকালে পৌঁছে গিয়েছিল, মানুষ তখন উদয় দিগন্তের শঙ্খধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। রামমোহনের কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল সেই বজ্রনির্ঘোষ। তাই সতীদাহ প্রথা রোধের বিপক্ষে নাকচ হয়ে গিয়েছিল ইংল্যাণ্ডের রক্ষণশীলদের আপিল। রামমোহন জানতেন যে, ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালের মেয়াদ বাড়ানো হবে। তখন আইনের রদবদল হবে, সংস্কারের কাজ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তিনি ইংরেজকে ভারতের সমগ্র চেহারাটা বোঝাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। ‘হাউস অব কমন্সে’, ‘সিলেক্ট কমিটি’র সামনে রামমোহনকে আহ্বান করা হয়েছিল তাঁর বক্তব্য পেশ করার জন্য। সেটাই তো রামমোহন চেয়েছিলেন। সেখানে রামমোহন যা বলেছিলেন তাঁর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল দেশপ্রেম। প্রচুর পরিশ্রম করে তিনি সিলেক্ট কমিটির জন্য তাঁর জবাব তৈরি করেছিলেন। সেখানেও রামমোহনের মেধা আর মননের আশ্চর্য প্রকাশ ঘটেছিল। সেখানে রামমোহনকে কোন কোন বিষয়ের জবাব দিতে হয়েছিল সেটাও জানিয়ে রাখা যাক। প্রথমে, ভারতবর্ষের রাজস্ব-প্রথার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে রামমোহনের অভিমত কী সেটা জানতে চাওয়া হয়েছিল। রামমোহন প্রজাস্বত্ব, খাজনার হার, কৃষক এবং জনসাধারণের উন্নতি সম্পর্কে নিজের মতামত দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ, বিচারপদ্ধতি সম্পর্কে রামমোহনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। রামমোহন বিচারপদ্ধতির প্রায় চুলচেরা বিচার করে সমস্যার প্রকৃত রূপ ইংরেজদের দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সমস্যাগুলির সমাধান কী হতে পারে সেকথাও তিনি জানিয়েছিলেন। তৃতীয়তঃ, ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের বসবাস সম্পর্কে রামমোহনের অনুকূল অথবা প্রতিকূল কোনো মত আছে কিনা - সেটা জানতে চাওয়া হয়েছিল। রামমোহন তাঁর বিবেচনামতো উত্তর দিয়েছিলেন। চতুর্থতঃ, ভারতের প্রজাদের অবস্থা বিষয়টি রামমোহনের কাছে ছিল জরুরি। রামমোহন সবিস্তারে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডে সিলেক্ট কমিটির সামনে রামমোহনকে যা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এবং রামমোহন সেগুলোর যে জবাব দিয়েছিলেন তা এত বিস্তারিত যে এখানে তা আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে খুঁটিয়ে দেখলে সেসব উত্তরের মধ্যে, রামমোহনের দেশের জন্য শ্রদ্ধাবোধ, দেশের মানুষের প্রতি আন্তরিক টান, নিপীড়িতের প্রতি দরদ দেখতে পাওয়া যায়। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার প্রতি রামমোহনের তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর জবাবে। শিক্ষার প্রসার, জ্ঞানের উন্নতিকে বাধা দিয়ে স্বৈরাচারী শাসন বর্বরতার দিকে ঠেলে দেয় দেশকে। রামমোহন দেখিয়েছিলেন যে, জ্ঞানের চর্চা যে দেশে যত বেশি সে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা তত সুরক্ষিত। আর কৃষকদের কথা? রামমোহনের পরে, ‘অক্ষয়কুমার দত্ত’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ এবং আরও অনেকে বঙ্গদেশের কৃষকের কথা বলেছিলেন। কিন্তু রামমোহনই প্রথম জমিদারি ব্যবস্থার ত্রুটি কোথায় সেটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ইংরেজদের তিনি ভারতের কৃষকদের দুর্দশার কথা শুনিয়েছিলেন, সুবিধাভোগী শোষক জমিদারদের চেহারাটা তুলে ধরেছিলেন তাঁর জবাবে। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, কৃষকের দুর্দশা বেড়ে গিয়েছিল জমিদারি প্রথার জন্যেই। জমিদারের স্বার্থপরতা আর লোভ কৃষকের সর্বনাশ করেছিল। আর সরকারি আমিনের অসাধুতার চাপে কৃষক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। জমিদাররা যখন খুশি খাজনার হার বাড়িয়ে দেন। সরকার জমিদারকেই সমর্থন করে ফলে কৃষকের সর্বনাশ ঘটে। কোনো বছর বাড়তি ফসল হলে ফসলের দাম কমে যায়। ফলে কৃষককে সব ফসল বেচে দিয়ে জমিদারের খাজনা মেটাতে হয়। কৃষকরা উপোসী থাকে, নূতন করে ফসল বোনবার জন্য বীজধানও থাকে না ঘরে। রামমোহন নিজেও জমিদার ছিলেন। কিন্তু জমিদারি ব্যবস্থার কুফল কোথায়, সেটা তিনি তখনই ধরতে পেরেছিলেন। তিনি অবশ্য জমিদারি ব্যবস্থা উঠে যাক এমন কথা বলেননি। তাঁর অনেক পরে রবীন্দ্রনাথও তাঁর বৌমাকে জমিদারি ব্যবস্থার বোঝা যে কী কঠিন হয়ে বঙ্গদেশের বুকে চেপে বসে আছে, সেকথা জানিয়েছিলেন। জমিদাররা যে বৃহৎ মাছ! ছোটো মাছ দেখলেই খেয়ে ফেলে। সেকথা জানিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ - ধীরে ধীরে সংস্কারের পথটা প্রশস্ত হয়েছিল। আর ভারতে ইংরেজের আইন? সে কেমন? বহুকাল পর্যন্ত ভারতবাসীরা ইংরেজের আইনকে অল্পবিস্তর সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। রামমোহনকে সিলেক্ট কমিটি যখন প্রশ্ন করেছিল, ভারতে ইংরেজ আইনের শাসন কী রকম? ইংরেজের বিচারব্যবস্থা কেমন? ত্রুটি থাকলে শোধরাবার পথ বলে দিন। তখন রামমোহন তাঁদের বলেছিলেন, ইংরেজ বিচারপতিরা ভারতীয় নন। ভারতের চালচলন সমাজব্যবস্থা কাজকর্ম সম্পর্কে তাঁদের কোনো জ্ঞান নেই। তাঁরা কী বিচার করবেন? অন্যদিকে ভারতবাসী বহুকাল ধরে পরাধীন, পেয়েছে উপেক্ষা। তাঁদের উপর দেশবাসীর কোনো বিশ্বাসই নেই। সুতরাং তিনি চেয়েছিলেন এমন বিচারপতি, যাঁর মধ্যে থাকবে ভারতীয় অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপীয় ন্যায়পরায়ণতা। সেই দু’য়ের যোগাযোগেই ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সুষ্ঠু কাঠামো গড়ে উঠবে। এটা কি মনে হতে পারে যে, রামমোহন ইংরেজদের স্তাবকতা করেছিলেন? এমন ধারণাই কেউ কেউ করেছেন। আসলে ইউরোপের কাছ থেকে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ-সংস্কারের আন্দোলন, বিপ্লবের আদর্শ শিক্ষিত ভারতবাসী চেয়েছিল, তাই চেয়েছিলেন রামমোহন। কিন্তু ইংরেজরা ভারতবাসীর সেই প্রত্যাশা পূরণ করেনি। ফলে একদিন সভ্যতারই সংকট দেখা দিয়েছিল। ইংল্যাণ্ডে রামমোহনের মানবধর্মের জয় ঘোষণা সে দেশের মানুষকে স্পর্শ করেছিল। তবে রামমোহনের স্বপ্নের দেশ ছিল ফ্রান্স। যে ফ্রান্সের জনগণ ‘বাস্তিল কারাগার’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল - সেই ফ্রান্স। যে ফ্রান্স থেকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর চিন্তার রসদ। তিনি ফরাসি দরবারের কাছে তিনি ফ্রান্স যাবার অনুমতি চেয়েছিলেন। প্রথমে ফরাসি সরকার বেঁকে বসলেও পরে তাঁকে অনুমতি দিয়েছিল। রামমোহন ফ্রান্স পৌঁছেছিলেন। ফ্রান্সের জনতা রামমোহনকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। অবশ্য ১৮২৮ সালেই ‘সোসিয়েতে আসিয়াতিক’ রামমোহনকে ‘অ্যাসোসিয়েট করেসপণ্ডেন্ট’ খেতাব প্রদান করেছিল। ‘সিসমঁদি’ নামের এক ফরাসি পণ্ডিত রামমোহনের যে পরিচয় ঐ উপলক্ষ্যে দিয়েছিলেন, তাতে তিনি লিখেছিলেন যে - “রামমোহন সংস্কারমুক্ত মানুষ; তিনি সত্যস্বরূপ এক ঈশ্বরের উপাসনা, নীতি ও ধর্মগত একতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।” সুতরাং ফরাসি দেশের মানুষের যে রামমোহনের খ্যাতি এবং পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল সেটা বোঝাই যায়। ‘উজ্যান বুর্মুফ’ এক সময় রামমোহনের রচনার যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলে। বেদান্তের অনুবাদে রামমোহনই যে সর্বশ্রেষ্ঠ সে কথাও তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন। ‘রাজা ফিলিপ’ রামমোহনকে এক ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ফ্রান্স ‘রাজা’ প্রচুর সম্মান পেয়েছিলেন। তাঁর মন প্রসন্নতায় ভরে গিয়েছিল।

এরপরে রামমোহন লণ্ডনে ফায়ার এসেছিলেন। কিন্তু ফ্রান্স থেকে ফিরে আসার পরেই তাঁর অর্থের টানাটানি আরম্ভ হয়েছিল। রামমোহনের ভারতবর্ষের টাকা পয়সা যে দুটি ব্যাঙ্ক থেকে বিলেতে যেত, সেই ব্যাঙ্কগুলি ‘ফেল’ করেছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাছে রামমোহন টাকা ধার চেয়েছিলেন, সেটাও তিনি পাননি। ইংল্যাণ্ডের ‘হেয়ার পরিবার’ তাঁকে অর্থিক সাহায্য করতে চাইলেও, সেই অর্থ নিতে তাঁর আত্মমর্যাদায় বেঁধেছিল। তাই তিনি তাঁদের প্রদত্ত অর্থ নেননি। রামমোহনের আর্থিক দুশ্চিন্তা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে তাঁর শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। ভাঙা পা-এর রোগযন্ত্রণাও তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল। রামমোহনের ইউরোপীয় বন্ধুরা তাঁকে হাওয়াবদলের জন্য লণ্ডন থেকে ‘ব্রিস্টলে’ চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রামমোহনের পরম বন্ধু, ‘রেভারেণ্ড ডক্টর কার্পেন্টারের’ আমন্ত্রণে তিনি ব্রিস্টলে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছে রামমোহনের অর্থকষ্ট কিছুটা দূর হয়েছিল। ‘মিস কিডিল’ নামের এক মহিলা, ‘স্টেপ্‌ল্‌ল্টন গ্রোভে’ তাঁর বড়ো বাড়ির অনেকটাই রামমোহনের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘মিস কিডিল’কে রামমোহন শ্রদ্ধা করতেন। পুত্রকে তাঁর কাছে রেখেই তিনি শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত করে তুলতে চেয়েছিলেন। ‘মিস ক্যাসেল’ নামের এক মহিলাও রামমোহনের অন্তরঙ্গ ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে রামমোহন - রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। ‘ড. কার্পেন্টার’, ‘মিস কিডিলের’ বদান্যতায় রামমোহন বেশ প্রফুল্ল ছিলেন। তিনি তাঁর মানসিক শান্তিও ফিরে পাচ্ছিলেন। কিন্তু একটানা পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। সেই সময়, ‘ড. ল্যান্ট কার্পেন্টার’, ‘যাজক লিউইনে’ প্রমুখ বন্ধুদের সাহচর্যে রামমোহন তবুও কিছুটা সুস্থ বোধ করতেন। কিন্তু ১৮৩৩ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে তিনি হঠাৎই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জ্বর আর মাথার যন্ত্রণা - এই দুয়ের আক্রমণে রামমোহন দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ‘ভারত প্রেমিক’ ‘ডেভিড হেয়ারের বোন’ তাঁর ক্রমাগত সেবা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রামমোহন আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ডাক্তাররা আর তাঁর জীবনের কোনো ভরসা দিতে পারছিলেন না। তাঁর শেষ সময়ে, ‘ড. ইস্টলিন’ তাঁর চিকিৎসা করছিলেন। পরে, রামমোহনের শেষের সেই কয়েক ঘন্টা সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “শুক্লপক্ষের রাত ছিল সেটা। মিঃ হেয়ার, মিস কিডিল, আমি জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম সেখানে গ্রামের শান্ত মধ্যরাত্রির দৃশ্যপট বিস্তৃত ছিল। অন্যদিকে ঘরের মধ্যে সেই অনন্যসাধারণ মানুষটি মৃত্যুর পথে চলেছিলেন। সেই মুহূর্তটি আমি কখনও ভুলব না।” ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তারিখে, রাত্রি আড়াইটার সময় ‘মিঃ হেয়ার’ ঘরে এসে বলেছিলেন, “সব শেষ হয়ে গেছে। দুটো বেজে পঁচিশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।” ১৮৩৩ সালের ১৮ই অক্টোবর তারিখে, ব্রিস্টলের ‘স্টেপ্‌ল্টন গ্রোভে’ রামমোহনের মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছিল। রাজার সঙ্গে যাঁদের বন্ধুত্ব ছিল, সেই শোক-অনুষ্ঠানে তাঁদের সকলেই এসেছিলেন। ‘হেয়ার’ সপরিবারে লণ্ডন থেকে গিয়েছিলেন। ‘মিস ক্যাসেলের’ অভিভাবক ও আত্মীয়েরা, রামমোহনের শেষ সেবায় যিনি ছিলেন সেই ‘মিস হেয়ার’, রাজার পালিত পুত্র ‘রাজারাম’, তাঁর চাকরেরা, ডাক্তাররা, ‘ড. জেরার্ড’, ‘জন ফস্টার’, ‘কার্পেন্টারের পিতা’ ও ‘কার্পেন্টার’ - সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন শোকস্তব্ধ। ‘জন ফস্টার’ লিখেছিলেন, “এমন একটি সমাধির উপর দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতা কার ছিল!” রামমোহনের মৃত্যুর দশ বছর পরে, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর’ লণ্ডনে গেলে, তিনি ‘স্টেপ্‌ল্টন’ থেকে রামমোহনের দেহ ‘আরনোস ভেল’ নামে আর এক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করেছিলেন। তারপর তাঁর সমাধির উপরে নিজের খরচে তিনি একটি অপূর্ব সমাধিমন্দির তৈরী করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সমাধি মন্দিরেই ‘ভারতপথিকের’ যাত্রার শেষ হয়েছিল, আবার সেখান থেকেই নবীনকালের নবীন ভারতের যাত্রার শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, রামমোহনের সময়ে ভারতবর্ষে কালরাত্রির অন্ধকার নেমে এসেছিল। শাস্ত্ৰ না বুঝে ‘ওঁ তট তট তোতয় তোতয়’ মন্ত্র পাঠ করছিলেন অর্ধশিক্ষিত পণ্ডিতেরা। ভয়ে, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ বাস করছিল একটা ঘেরাটোপের মধ্যে। তাঁরা দরজা জানালা খুলত না, তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছিল যে, খুললেই একজটা দেবী দেখা দেবেন। তাহলেই সর্বনাশ! একটা অচলায়তনের প্রাচীর গেঁথে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের সামনে। মানুষে মানুষে ভেদ-বিভেদ বজায় রাখবার জন্য একের পর এক পাঁচিল তৈরী করা হচ্ছিল। রামমোহন অভয়মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি সেই পাঁচিল ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। মানুষের মৃঢ়তার শেকল ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি। মানুষের অধিকার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ভারতবর্ষকে বিশ্বের মিলনের সেতু হিসেবে রচনা করেছিলেন তিনি। সেটাই আমাদের উত্তরাধিকার। কিন্তু সেটা কতটা পালন করছি আমরা? এই প্রশ্ন কতটা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে? জ্ঞানবিজ্ঞানকে মানুষের কাজে আমরা কতটা ব্যবহার করতে পেরেছি? “আমাদের অজ্ঞান” - আমাদের ‘দুর্বলতাই’ বিরোধীদের ‘বল’। রামমোহন অক্লান্তভাবে সমাজ সংস্কারের বিরোধীদের সঙ্গে যে সংগ্রাম করেছিলেন, রামমোহনের সেই সংগ্রামকে আমরা দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় আরও শক্তিশালী করে তুলব - এই প্রতিজ্ঞা কি আমরা নিতে পারি না?

                                             

(তথ্যসূত্র:

১- রাজর্ষি রামমোহন: জীবনী ও রচনা, অনিলচন্দ্র ঘোষ।

২- মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার উপদেশ ও মতামত - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত।

৩- সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।)

                            

No comments