Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

‘বিদ্যার সাগরে বিদ্যাসাগর’-

একজন ছাত্র হিসেবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন? কারাই বা তাঁর শিক্ষক ছিলেন? তিনি কোন কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন? ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মজীবন ও সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্ম নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, তাঁর ছাত্রজীবন নিয়ে তেমন বিস্ত…

 




                                               

একজন ছাত্র হিসেবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন? কারাই বা তাঁর শিক্ষক ছিলেন? তিনি কোন কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন? ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মজীবন ও সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্ম নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, তাঁর ছাত্রজীবন নিয়ে তেমন বিস্তারিতভাবে কোথাও আলোচনা করা হয় না। বরং খুবই সংক্ষেপে তাঁর ছাত্র জীবন নিয়ে কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে তাতে ইতি টেনে দেওয়া হয়। বৃক্ষের পরিচয় তার চারা অবস্থাতেই পাওয়া যায়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছাত্রাবস্থার ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রযোজ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে তিনি যে কি সুবিশাল মহীরুহে পরিবর্তিত হতে চলেছেন, সেটার পরিচয় তাঁর ছাত্রাবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া, তৎকালীন বঙ্গদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও তাঁর পরবর্তী জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। সুতরাং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে গেলে, বিস্তারিতভাবে তাঁর ছাত্রজীবনের কথা অবশ্যই জানা প্রয়োজন। ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মের সময় তাঁর কোষ্ঠি গণনা করে দেখা গিয়েছিল যে, নবজাতক ষাঁড়ের মত একগুঁয়ে হলেও সত্যবাদী, সৎ ও যশস্বী হবেন। এই কারণে তাঁর শৈশব ও কৈশোরে তাঁর পিতামহ ও পিতা তাঁকে ঠাট্টা করে ‘এঁড়ে বাছুর’ বলতেন। পরিহাসছলে তাঁরা যেটা বলতেন, পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছিল যে সেটা একেবারে মিথ্যা হয় নি। কারণ, ঈশ্বরচন্দ্রকে দিয়ে কোনও কাজ করাতে হলে তাঁকে ঠিক তার উল্টোটা করতে বলতে হত, না হলে তিনি করতেন না। তাঁর একগুয়েমীর জন্য তাঁর পিতা তাঁকে অনেক সময় মারধোর পর্যন্ত করতেন। শৈশবে ঈশ্বরচন্দ্র কোনদিনই শান্ত শিষ্ট ছিলেন না। গ্রামবাসীদের উপর অনেক সময় অনেক রকম উৎপাত করতেও তিনি ছাড়তেন না। তিনি তাঁদের বাগান থেকে ফল বা ফুল চুরি করতেন অথবা তাঁদের অন্ধবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে তাঁদের বিরক্ত করতেন। বিদ্যাসাগর পরিণত বয়সে পৌঁছাবার পরে, একবার এক ভদ্রলোক তাঁর কাছে নিজের ছেলের বিষয় নালিশ করতে এসেছিলেন। তখন ঈশ্বরচন্দ্র হাসতে হাসতে তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি হতাশ হবেন না। আমার দিকে চেয়ে দেখুন। আমাকে নিয়েও ছেলেবেলায় বেশ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। বাবা মাকে এবং পাড়াপড়শীদের জ্বালাতন করার জন্য আমিও নানা রকম দুষ্টুমী করতে ছাড়তাম না। কিন্তু তা সত্বেও আমি এখন কোনও রকমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি এবং আমার ছেলেবেলায় তথাকথিত বিজ্ঞ ব্যক্তিরা আমার ভবিষ্যৎ যতটা অন্ধকার হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অন্ততঃ ততটা অন্ধকার হয়নি। কে বলতে পারে যে আপনার ছেলেও ভবিষ্যতে আমার মত অথবা আমার চেয়ে বেশী উন্নতি করবে না?” বিদ্যাসাগর তাঁর বিখ্যাত শিশুপাঠ্য, ‘বর্ণ পরিচয়’ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ) পুস্তকে, ‘গোপাল’ নামে একটি বাধ্য ও আদর্শ চরিত্র বালকের কাহিনী লিখেছিলেন। সেই গল্পের মধ্যে একটি অবাধ্য ও দুষ্টু বালকের চরিত্রও পাওয়া যায়, তাঁর নাম - ‘রাখাল’। নবীন শিক্ষার্থীদের তিনি রাখালের চরিত্র অনুসরণ না করে গোপালের চরিত্র অনুসরণ করবার উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই গল্প সম্বন্ধে রবান্দ্রনাথ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো সুবোধ ছেলের অভাব নেই। এ ক্ষীণতেজ দেশে রাখাল এবং তাঁহার জীবনীলেখক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো দুর্দান্ত ছেলের প্রাদুর্ভাব হইলে বাঙ্গালী জাতির শীর্ণ চরিত্রের অপবাদ ঘুচিয়া যাইতে পারে। সুবোধ ছেলেগুলি পাস করিয়া ভালো চাকরি বাকরি বা বিবাহকালে প্রচুর পণ লাভ করে সন্দেহ নাই, কিন্তু দুষ্ট অবাধ্য অশান্ত ছেলেগুলির কাছে স্বদেশের জন্য অনেক আশা করা যায়।” কিন্তু একটি বিষয়ে অর্থাৎ লেখাপড়ার ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্র রাখালের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। তাঁর গল্পের রাখাল পড়াশুনা করত না, কিন্তু বিদ্যাসাগর অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে লেখাপড়া করতেন, সেটাও অনেক বাধা বিপত্তি সত্বেও। সে যুগে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হত গ্রামের পাঠশালায়। তারপর অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীরা ‘টোলে’ যেতেন উচ্চতর সংস্কৃত শিক্ষার জন্য। বীরসিংহ গ্রামে একটি পাঠশালা ছিল। সেই পাঠশালার ভারপ্রাপ্ত গুরুমশাই মনে করতেন যে, মারধোর না করলে ছেলেরা মানুষ হয় না! সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে অতি উৎসাহের সঙ্গে তিনি ছাত্রদের তাড়না করতেন। ওই পাঠশালার ছেলেমেয়েরা সেই কারণে তাঁকে যমের মত ভয় করত। সুতরাং ঈশ্বরচন্দ্রকে পড়াবার জন্য, তাঁর পিতা ‘ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায়’, ‘কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়’ নামের এক কুলীন ব্রাহ্মণকে ঠিক করেছিলেন। ‘কালীকান্ত’ ছিলেন অমায়িক প্রকৃতির মানুষ এবং শিক্ষক হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। কিন্তু গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষকতার চেয়ে ‘কৌলিন্য’ প্রথার আর্থিক সুবিধার প্রতি তাঁর বেশী আকর্ষণ ছিল। কালীকান্তর শিক্ষকতার কাজে অনিচ্ছা সত্বেও ঠাকুরদাস অনেক বুঝিয়ে রাজী করিয়ে তাঁকে দিয়ে গ্রামে একটি পাঠশালা খুলিয়েছিলেন। কালীকান্তকে পাঁচ বছরের বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে লেখাপড়া শেখাবার ভার দেওয়া হয়েছিল। আগে সাধারণতঃ ঐ বয়সেই হিন্দু প্রথা অনুসারে শিশুদের ‘হাতেখড়ি’ হত। কালীকান্ত তাঁর ছাত্রের বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পক্ষে মাত্র তিন বছরের মধ্যে পাঠশালার পাঠ্যক্রম শেষ করে ফেলাটা যে একটা অসাধারণ ব্যাপার - সেই কথা তিনি ঠাকুরদাসকে একাধিকবার জানিয়েছিলেন। ঠাকুরদাসকে তিনি আরও বলেছিলেন যে, “ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতার কোনও ভালো ইংরাজী স্কুলে ইংরাজী শিক্ষার জন্য পাঠাবার এই হল উপযুক্ত সময়।” ঠাকুরদাসও তাঁর সঙ্গে সেই বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। যে গ্রামীণ আবহাওয়ার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল, সেটা ছিল নিষ্প্রাণ ও হতাশাব্যঞ্জক। ‘বীরসিংহ’ গ্রামটি তৎকালীন বঙ্গের অন্যান্য বহু গ্রামের মতই শিক্ষাসংস্কৃতির আলোকবর্জিত একটি অনুন্নত গ্রাম ছিল। সেখানকার সমাজ জীবনের একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য ছিল যা ঈশ্বরচন্দ্রের প্রস্ফুটমান মনের উপরে কিছুটা হলেও ছাপ ফেলেছিল। বীরসিংহ ও তার আশেপাশের বেশীরভাগ গ্রামের অধিবাসীরাই ছিলেন ‘ধীবর’ বা ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রকাশ পেত গ্রামের উৎসব, মেলা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। সেই জীবনে কিছু কিছু সজীবতার লক্ষণ ছিল যা প্রাণহীন আচার অনুষ্ঠানের চাপে নষ্ট হয়ে যায় নি। সেই সময়, সাধারণতঃ উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজে, কঠোর নিষ্প্রাণ আচার নিষ্ঠা প্রচলিত ছিল। ভাগ্যক্রমে বীরসিংহ গ্রামের আবহাওয়ায় সেই জিনিসটা ছিল না। ফলে ঈশ্বরচন্দ্রের সেই তরুণ মনের সক্রিয় বিকাশ কখনো রুদ্ধ হতে পারেনি। বিদ্যাসাগর যখন কলকাতায় রওনা হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল আট বছর। তিনি দেখতে ছিলেন বেঁটে, রোগা এবং বয়সের তুলনায় ভীতু ও লাজুক প্রকৃতির। যাত্রার আগে ঠিক হয়েছিল যে, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর পিতা ও শিক্ষক ছাড়া একজন ভৃত্যও যাবেন। ১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসের এক শুভদিনে সেই চারজন বীরসিংহ থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত কলকাতা শহর অভিমুখে পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিলেন। তিন দিন ধরে তাঁরা উদয়াস্ত পথ চলেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বেশ ভাল ভাবেই পথের কষ্ট সহ্য করেছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তাঁকে তাঁর পিতা বা শিক্ষক বা বৃদ্ধ ভৃত্যের পিঠে চড়ে যেতে হয়েছিল। বীরসিংহ থেকে যাত্রা শুরুর তৃতীয় দিনে তাঁরা ‘সালকিয়া’ যাওয়ার নতুন পাকা সড়কে পৌঁছেছিলেন। সেই গ্রামটি, হুগলী নদীর পশ্চিমে কলকাতার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত ছিল। হাঁটা পথে চলতে চলতে, পথের ধারে দূরত্ব নির্দেশক পাথরের ফলকগুলি দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের কৌতূহল হয়েছিল। তখন ঠাকুরদাসকে সেই ফলকগুলির তাৎপর্য বালককে বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র সহজেই সেই প্রস্তর ফলকগুলি থেকে ইংরাজী সংখ্যামালা শিখে ফেলেছিলেন। তিনি অত সহজে সেটি শিখে ফেলেছিলেন দেখে, কালীকান্ত ও ঠাকুরদাস উভয়েই অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন। যাত্রা শুরুর তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁরা নৌকো করে হুগলী নদী পার হয়ে কলকাতা শহরের ‘বড়বাজার’ এলাকায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন। ভাগীরথীর পশ্চিম থেকে পূবের সেই যাত্রা ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনে এক স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ অভিযান। সেটা যেন ছিল, পুরাতন থেকে নতুন যুগের উদ্দেশ্যে তাঁর এক তীর্থযাত্রা।

কলকাতায় পৌঁছে ঠাকুরদাস ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁর প্রাক্তন আশ্রয়দাতা ‘ভাগবত চরণ সিংহের’ বড়বাজারস্থ বাড়ীতে নিয়ে যান। সেই বাড়িতে তখন ভাগবত চরণের পঁচিশ বছর বয়সী পুত্র ‘জগৎ দুর্লভ’, তাঁর মা ও বিধবা বোন ‘রাইমণি’ থাকতেন। ঠাকুরদাস ও ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁরা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ‘রাইমণি’ ঈশ্বরচন্দ্রকে মাতৃস্নেহে সমাদর করেছিলেন। সেকথা ঈশ্বরচন্দ্র জীবনে কখনও ভোলেন নি। তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন, “স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে, রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্যন্ত আমার নয়ন গোচর হয় নাই। এই দয়াময়ীর সৌম্যমূর্ত্তি, আমার হৃদয়মন্দিরে, দেবীমূর্তির ন্যায়, প্রতিষ্ঠিত হইয়া, বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে, তাঁহার কথা উত্থাপিত হইলে তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে, অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না।” অনেকে মনে করেন যে রাইমণির প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের সেই সশ্রদ্ধ ভালবাসা ও তাঁর বালবৈধব্য সম্বন্ধে সহানুভূতি, ওই দুই কারণে তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ নিবারণের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। কলকাতায় পৌঁছাবার কয়েকদিনের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রকে এক পাঠশালায় পাঠানো হয়েছিল, তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা কতদূর এগিয়েছিল, সেটার পরীক্ষা নেবার জন্য। সেই পাঠশালার গুরুমশাই ‘স্বরূপচন্দ্র’ - কালীকান্তের চেয়ে ভাল শিক্ষক ছিলেন। তিন মাস ধরে সেই পাঠশালায় পড়াশুনা করে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছিলেন। এরপরে তিনি কলকাতার কোনো ভালো স্কুলে উচ্চশিক্ষা লাভের উপযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোন ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন - ইংরেজি, না কি সংস্কৃত - ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা, শিক্ষকেরা এবং তাঁর অন্যান্য শুভাকাঙ্খীরা সেটা নিয়ে এক সমস্যায় পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষার পারস্পরিক সুবিধা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলেছিল। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, ঈশ্বরচন্দ্র সেই সমস্যাটি সংক্ষেপে বর্ণনা করে লিখেছিলেন, “গুরু মহাশয়ের পাঠশালায যতদূর শিক্ষা দিবার প্রণালী ছিল, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও স্বরূপচন্দ্র দাসের নিকট আমার সে পর্যন্ত শিক্ষা হইয়াছিল। অতঃপর কিরূপ শিক্ষা দেওয়া উচিত, এ বিষয়ে পিতৃদেবের আত্মীযবর্গ, স্ব স্ব ইচ্ছার অনুযায়ী পরামর্শ দিতে লাগিলেন। … আমরা পুরুষানুক্রমে সংস্কৃত ব্যবসায়ী; পিতৃদেব অবস্থার বৈগুণ্যবশতঃ ইচ্ছানুরূপ সংস্কৃত পড়িতে পারেন নাই; ইহাতে তাঁহার অন্তঃকরণে অতিশয় ক্ষোভ জন্মিয়াছিল। তিনি সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিযাছিলেন, আমি রীতিমত সংস্কৃত শিখিযা চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করিব। এ জন্য পূর্ব্বোক্ত পরামর্শ তাঁহার মনোনীত হইল না। তিনি বলিলেন, উপার্জ্জনক্ষম হইয়া আমার দুঃখ ঘুচাইবেক, আমি সে উদ্দেশ্যে ঈশ্বরকে কলিকাতায় আনি নাই। আমার একান্ত অভিলাষ, সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতবিদ্যা হইয়া দেশে চতুষ্পাঠী করিবেক, তাহা হইলেই আমার সকল ক্ষোভ দূর হইবেক। … মাতৃদেবীর মাতুল রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্য পুত্র মধুসূদন বাচষ্পতি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। তিনি পিতৃদেবকে বলিলেন, আপনি ঈশ্বরকে সংস্কৃত কলেজে পড়িতে দেন, তাহা হইলে, আপনকার অভিপ্রেত সংস্কৃত শিক্ষা সম্পন্ন হইবেক; আর যদি চাকরী করা অভিপ্রেত হয়, তাহারও বিলক্ষণ সুবিধা আছে; সংস্কৃত কলেজে পড়িয়া যাঁহারা ল’ কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাঁহারা আদালতে জজ পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হইয়া থাকে। ... অনেক বিবেচনার পর বাচষ্পতি মহাশয়ের ব্যবস্থাই অবলম্বনীয় স্থির হইল।” ঠাকুরদাস ও তাঁর আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষার পারস্পরিক সুবিধা সম্বন্ধে যে সময় আলোচনা চলছিল, তখন সেটা ছিল ১৮২৯ সাল। ইংরেজি শিক্ষার সমর্থক বা ‘অ্যাংলিসিষ্ট’ ও প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষার সমর্থক বা ‘ওরিয়েন্টালিষ্ট’দের মধ্যে তখন তুমুল বাক্‌বিতণ্ডা চলছিল। বারো বছর ধরে সেই তর্ক বিতর্ক চলেছিল। ১৮২২-২৩ সালে শুরু হয়ে, তাঁদের মধ্যেকার সেই বিরোধ চরমে পৌঁছেছিল - ১৮২৯ ও ১৮৩৫ সালের মধ্যে এবং শেষ হয়েছিল - ১৮৩৫ সালের ৭ই মার্চ তারিখে, বড়লাট ‘লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের’ বিখ্যাত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ‘মেকলে’, ইংরাজী শিক্ষার সরকারী সমর্থনের জন্য যে সুপারিশ করেছিলেন তারই ভিত্তিতে সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকালে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের কয়েকটি স্পষ্ট পর্যায দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রথম পর্যায়ে, কোম্পানীর কোনও স্বীকৃত ভূস্বত্ত্ব বা রাজনৈতিক অধিকার না থাকাতে, ভারতীয়দের শিক্ষা ব্যবস্থা, কোম্পানীর শাসন নীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এর দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ ১৭৮১ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত, তাদের নীতি ছিল - প্রাচ্যবিদ্যার পৃষ্ঠপোষকতা করা; সেই সময় - ‘কলকাতা’, ‘মাদ্রাজ’ ও ‘বেনারসে’ সংস্কৃত কলেজগুলি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেই নীতির উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু ও মুসলমানদের শিক্ষা দিয়ে, কোম্পানীর শাসন ও বিচার বিভাগীয় কাজের জন্য দেশীয় বেতনভুক কর্মচারী তৈরী করা। তৃতীয় স্তরে, ১৮১৩ সালে, শিক্ষা বিস্তার করা রাষ্ট্রের দায়ীত্ব বলে আইনতঃ মেনে নেওয়া হয়েছিল। ওই সময়, ভারতীয়দের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ইংরাজী শিক্ষা প্রসারের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ১৮১১ সালের ৬ই মার্চ তারিখে, ‘লর্ড মিন্টো’, তাঁর বিখ্যাত ‘কার্যবিবরণী’তে (Minute) ভারতীয়দের শিক্ষার প্রতি শাসকশ্রেণীর ঔদাসীন্যের নিন্দা করে বলেছিলেন, “... অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, যে জাতির নিকট সাংস্কৃতিক চর্চ্চা এত প্রিয় এবং সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে তার প্রসারের জন্য বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে, সেই জাতি হিন্দুদের সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতে এবং ইউরোপীয় পণ্ডিত সমাজের সামনে এই সাহিত্য ভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত করতে অসমর্থ হয়েছে।” তাঁর সেই মন্তব্যের ফলে, ১৮১৩ সালের ‘চার্টার এ্যাক্টে’ সর্বপ্রথম ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে - “ভারতীয় সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন, ভারতীয় পণ্ডিত সমাজকে উৎসাহ দান এবং বৃটিশ ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচারের জন্য” বছরে অন্ততঃ এক লাখ টাকা খরচ করা হবে। শেষে দেখা গিয়েছিল যে, ১৮১৩ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত - বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সীতে শিক্ষার জন্য বছরে প্রায় দু’লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছিল। শিক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনার জন্য ১৮২৩ সালে কলকাতায় এবং ১৮২৬ সালে মাদ্রাজে ‘জনশিক্ষা সমিতি’ স্থাপিত হয়েছিল এবং বোম্বাইতে ১৮২৩ সালে ‘শিক্ষা সমিতি’ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় শিক্ষার জন্য সরকারিভাবে যা খরচ করা হচ্ছিল, সেটা সু-পরিকল্পিত ছিল না। ইতিমধ্যে ১৮২৩ সালের ২১শে আগষ্ট, সপরিষদ বড়লাট সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, বেনারসের মত কলকাতাতেও একটি সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করা হবে এবং সেটার জন্য বার্ষিক ২৫,০০০ টাকা মঞ্জুর করা হবে। সরকারী মন্তব্যে বলা হয়েছিল যে, যদিও “কলকাতা সংস্কৃত কলেজের বর্তমান বা সরাসরি উদ্দেশ্য হবে হিন্দু সংস্কৃতির অনুশীলন” তবুও সপরিষদ বড়লাট বাহাদুরের মতে - “এর গভীরতর উদ্দেশ্য হবে ইউরোপের জ্ঞান প্রসার করবার উপযুক্ত উপায় নির্ধারণ করা।” সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৮২৪ সালের ১লা জানুয়ারী, কলকাতার ‘৬৬নং বহুবাজারের’ ভাড়া বাড়ীতে ‘সংস্কৃত কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। পরে ১৮২৬ সালের ১লা মে, নিজস্ব নতুন ভবনে কলেজটি স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। তাহলে দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের আগে কোম্পানীর শিক্ষানীতি কোনও চূড়ান্তরূপ নেয়নি। ইতিমধ্যে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ঘড়ি ব্যবসায়ী ‘ডেভিড হেয়ার’ এবং বিচারপতি ‘এডওয়ার্ড হাইড ইষ্টের’ সহায়তায়, কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালী, ইংরাজী শিক্ষা বিস্তারের জন্য, ১৮১৭ সালে কলকাতায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি নাম ছিল, যেমন - ‘হিন্দু কলেজ’, ‘মহাবিদ্যালয়’ ও ‘এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কলেজ’। সেই প্রতিষ্ঠানটিই বর্তমানে ‘কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে’ পরিণত হয়েছে। হিন্দু কলেজ স্থাপন করেছিলেন কয়েকজন উচ্চ শ্রেণীর নিষ্ঠাবান বাঙালী হিন্দু। তবে লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, সেই সময়ে, পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনকারী ‘রাজা রামমোহন রায়’, সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। এর কারণ অনুসন্ধান করা কঠিন নয়। ১৮১৫-১৬ সাল থেকে রামমোহন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা, যেমন - বহু দেবদেবীর পূজা, মূর্তিপূজা, সতীদাহ বা সহমরণ ইত্যাদি, দূর করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক আচারের বিরুদ্ধে তাঁর সেই অভিযানে, গোঁড়া হিন্দুরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং সম্ভবতঃ সেই কারণেই, একমাত্র হিন্দু ছাত্রদের জন্য স্থাপিত সেই নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে রামমোহনের কোনো সাহায্য তাঁরা নিতে চান নি। অতএব রামমোহন, ১৮২২ সালে, কলকাতায় আর একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ‘লর্ড আমহার্স্ট’কে লিখিত তাঁর বিখ্যাত পত্রে তিনি ভারতে শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের প্রাচ্যবিদ্যামুখী নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং ভারতে এক উদার ও প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে সেই শিক্ষার মধ্যে থাকা উচিত ছিল - “গণিত শাস্ত্র, প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরবিদ্যা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান শাস্ত্র  - যেগুলি যথাযথ অনুশীলনের ফলে ইউরোপীয় জাতিরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক উন্নতি করতে পেরেছে।” তখনকার দিনে ইংরেজদের মধ্যে অনেকে ছিলেন, যাঁরা সংস্কৃত ভাষা ও প্রাচ্যজ্ঞানকে শ্রদ্ধা করতেন ও সেগুলোর চর্চা করতেন। কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি ভাষা ও কৃষ্টির সমর্থক খুব বেশী ছিলেন না। রামমোহন রায়ই সর্বপ্রথম স্পষ্ট ভাষায় ভারতে ইংরেজি শিক্ষার সমর্থন করেছিলেন এবং ১৮১৬ থেকে ১৮৩০ সালে তাঁর বিলাত যাত্রা পর্যন্ত ভারতে ইংরেজি শিক্ষার স্বপক্ষে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে হিন্দু কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত এক নতুন তরুণ গোষ্ঠির সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা ইংরেজি শিক্ষার প্রবল সমর্থন করতে শুরু করেছিলেন। সেই ব্যাপারটি ঘটেছিল ১৮২৯-৩০ সাল নাগাদ। ঠিক সেই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে কি ধরনের উচ্চশিক্ষা দেওয়া হবে - সেটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। এরপরে যতদিনে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন, ততদিনে প্রাচ্যবিদ্যার সমর্থকরা হার মানতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সেটা ১৮৩৫ সালের কথা, ঈশ্বরচন্দ্র ততদিনে তাঁর ছাত্রজীবনের মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদাস যখন ঠিক করেছিলেন যে, ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হবে, তখন পর্যন্ত প্রাচ্যবিদ্যার পৃষ্ঠপোষকেরা প্রবল ছিলেন এবং ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষার মধ্যে কোনটি ভারতে প্রবর্তন করা উচিৎ, সেই বিষয়ে ইংরেজ শাসকেরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। বিদেশী শাসকদের ধীরেসুস্থে কাজ করার অবকাশ ছিল কিন্তু ন’বছরের একটি বালকের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রাখা তাঁর অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতএব ঈশ্বরচন্দ্রের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেটা শীঘ্রই কার্যে পরিণত করা হয়েছিল। ১৮২৯ সালের ১লা জুন তারিখে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই চাঞ্চল্যময় তৃতীয় দশকে তিনি শিক্ষা শুরু করেছিলেন। বিদ্যার সাগরে বিদ্যার জাহাজ চলতে শুরু করেছিল।

                                         

ঈশ্বরচন্দ্র বারো বছর পাঁচ মাস ধরে সংস্কৃত কলেজের বিভিন্ন শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেছিলেন। ১লা জুন ১৮২৯ সালে, সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হবার পরে ঈশ্বরচন্দ্র, ‘ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণী’ থেকে তাঁর ছাত্র জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। সেই সময়ে কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যাপনা করতেন ‘কুমারহট্ট’নিবাসী ‘গঙ্গাধর তর্কবাগীশ’। ‘শ্লোকমঞ্জরী’ গ্রন্থের বিজ্ঞাপন অংশে, নিজের সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হবার কথা উল্লেখ করে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছিলেন, “১৮২৯ খৃষ্টীয় শাকে, জুন মাসের প্রথম দিবসে, আমি কলিকাতার রাজকীয় সংস্কৃত বিদ্যালয়ে বিদ্যাধিরূপে পরিগৃহীত হই। তৎকালে আমার বয়স নয় বৎসর। ইহার পূর্ব্বে আমার সংস্কৃতশিক্ষার আরম্ভ হয় নাই। ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়া ঐ শ্রেণীতে তিন বৎসর ছয় মাস অধ্যয়ন করি। ... কুমারহট্টনিবাসী পূজ্যপাদ গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশ্য তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক ছিলেন। শিক্ষাদান বিষয়ে তর্কবাগীশ মহাশয়ের অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল। তৎকালে সকলে স্পষ্ট বাক্যে স্বীকার করিতেন, ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রেরা শিক্ষা বিষয়ে যেরূপ কৃতকাৰ্য্য হয়, অপর দুই শ্রেণীর ছাত্রেরা কোনও ক্রমে সেরূপ হয় না। বস্তুতঃ পূজ্যপাদ তর্কবাগীশ মহাশয় শিক্ষাদানকার্যে বিলক্ষণ দক্ষ, সাতিশয় যত্নবান্, ও সবিশেষ পরিশমশালী বলিয়া অসাধারণ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিলেন।” ব্যাকরণ-শ্রেণীতে প্রবেশ করবার দেড় বছর পরে (অর্থাৎ, ১৮৩০-৩১ সালের বার্ষিক পরীক্ষার পরে), ১৮৩১ সালের মার্চ মাস থেকে ঈশ্বরচন্দ্র মাসিক ৫ টাকা করে ‘বৃত্তি’ পেয়েছিলেন। তবে তাঁর সহোদর, ‘শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন’, ‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত’ গ্রন্থে ভুলবশতঃ লিখেছিলেন যে, ঈশ্বরচন্দ্র “কলেজে প্রবিষ্ট হইবার ছয় মাস পরে পরীক্ষোত্তীর্ণ হইয়া, মাসিক ৫ টাকা বৃত্তি পাইলেন।” সেই সময়, সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্রদের কলকাতায় থাকা-খরচের জন্য সেই বৃত্তি দেওয়া হত। যাঁরা সেই বৃত্তি পেতেন, তাঁদের ‘Pay Student’; ও যাঁরা সেই বৃত্তি পেতেন না, তাঁদের ‘Out Student’ বলা হত। সেই সময় ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে ঈশ্বরচন্দ্রের সহপাঠী ছিলেন - ‘মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ’, ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কার’ প্রভৃতি। ঈশ্বরচন্দ্র ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে সাড়ে তিন বছর - ১৮৩৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে ‘শ্লোকমঞ্জরী’ গ্রন্থের বিজ্ঞাপন অংশে তিনি নিজেই লিখেছিলেন, “তিন বৎসবে মুগ্ধবোধপাঠ সমাপ্ত করিয়া, শেষ ছয় মাসে অমরকোষের মনুধ্যবর্গ ও ভটিকাব্যের পঞ্চম সর্গ পর্য্যন্ত পাঠ করিয়াছিলাম।” ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ঈশ্বরচন্দ্র উপর্যুপরি তিনটি বার্ষিক পরীক্ষায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে, তিন বারই পারিতোষিক পেয়েছিলেন। সেই পারিতোষিকগুলির পরিমাণ ছিল - (১) ১৮৩০-৩১ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে ব্যাকরণ ও নগদ ৮ টাকা; (২) ১৮৩১-৩২ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় - ‘অমরকোষ’, ‘উত্তররামচরিত’ ও ‘মুদ্রারাক্ষস’ গ্রন্থ; (৩) ১৮৩২-৩৩ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবে নগদ ২ টাকা (মদনমোহন তর্কালঙ্কার পাঁচ টাকা দামের বই পেয়েছিলেন)। উপরের ঘটনাবলীর মাঝে, সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের ইংরেজি শিক্ষার সুবিধা দেবার জন্য, ১৮২৭ সালের ১লা মে তারিখে, ‘ওলাস্টন’ (M. W. Wollaston) নামের এক জন ইংরেজকে মাসিক ২০০ টাকা বেতনে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি তখন ‘অবশ্যশিক্ষণীয় বিষয়’ ছিল না। ব্যাকরণ-শ্রেণী থেকেই প্রথমে ইংরেজি-শ্রেণীতে প্রবেশ করতে হত। ব্যাকরণ-শ্রেণীতে ‘মুগ্ধবোধ’ পড়তে পড়তে ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৩০ সালে কলেজের ইংরেজি-শ্রেণীতেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৮৩৩-৩৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায়, ইংরেজির ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্ররূপে, ঈশ্বরচন্দ্র ৫ টাকা দামের বই - ‘History of Greece’ (Rs. 4), ‘Reader etc.’ (Re 1.80), এবং ১৮৩৪-৩৫ সালের বার্ষিক পরীক্ষায়, ইংরেজির পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্ররূপে ‘Poetical Reader No. 3’ এবং ‘English Reader No. 2’ - পারিতোষিক হিসেবে পেয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে, সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজি-শ্রেণী তুলে দেওয়া হয়েছিল। ১৮৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজের সাহিত্য-শ্রেণীতে প্রবেশ করেছিলেন। ‘জয়গোপাল তর্কালঙ্কার’ তখন সেই শ্রেণীর অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৩৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত, দুই বছর ধরে ঈশ্বরচন্দ্র সাহিত্য-শ্রেণীতে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই দুই বছরও তিনি আগের মত মাসিক ৫ টাকা করে বৃত্তি পেয়েছিলেন। কলেজের সাহিত্য-শ্রেণীতে ঈশ্বরচন্দ্রকে - ‘রঘুবংশ’, ‘কুমারসম্ভব’, ‘মেঘদূত’, ‘কিরাতার্জুনীয়’, ‘শিশুপালবধ’, ‘নৈষধচরিত’, ‘শকুন্তলা’, ‘বিক্রমোৰ্ব্বশী’, ‘বেণীসংহার’, ‘রত্নাবলী’, ‘মুদ্রারাক্ষস’, ‘উত্তররামচরিত’, ‘দশকুমারচরিত’, ‘কাদম্বরী’ পড়তে হয়েছিল। ১৮৩৪-৩৫ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় (অর্থাৎ সাহিত্য-শ্রেণীর দ্বিতীয় বছরের পরীক্ষায়) প্রথম স্থান অধিকার করে ঈশ্বরচন্দ্র - ‘সাহিত্যদর্পণ’, ‘কাব্যপ্রকাশ’ ও দুই খণ্ড ‘History of British India’ - পারিতোষিক হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কার’ও একই পারিতোষিক পেয়েছিলেন। এছাড়া ‘দেবনাগর’ হস্তাক্ষরের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র একটি স্বতন্ত্র পারিতোষিক - ‘হিতোপদেশ’ ও রবিনসনের ‘Grammar of History’ পেয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের ‘অলঙ্কার শ্রেণী’তে যোগ দিয়েছিলেন। সেই শ্রেণীতে তখন ‘প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ’ অধ্যাপনা করতেন। ওই অলঙ্কার-শ্রেণীতেও মদনমোহন ঈশ্বরচন্দ্রের সহপাঠী ছিলেন এবং তাঁদের দু’জনেই তখন মাসিক ৫ টাকা করে বৃত্তি পেতেন। ওই শ্রেণীতে ঈশ্বরচন্দ্র এক বছর পড়েছিলেন; তাঁকে ‘সাহিত্যদর্পণ’, ‘কাব্যপ্রকাশ’ ও ‘রসগঙ্গাধর’ পড়তে হয়েছিল। ১৮৩৫-৩৬ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র সর্ব্বোচ্চ স্থান অধিকার করে - ‘রঘুবংশ’, ‘সাহিত্যদর্পণ’, ‘কাব্য প্রকাশ’, ‘রত্নাবলী’, ‘মালতীমাধব’, ‘উত্তররামচরিত’, ‘মুদ্রারাক্ষস’, ‘বিক্রমোৰ্ব্বশী’ ও ‘মৃচ্ছকটিক’ - পারিতোষিক হিসেবে পেয়েছিলেন। অলঙ্কার-শ্রেণীর পাঠ শেষ করে, ১৮৩৬ সালের মে মাসে, সহপাঠী মদনমোহনের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজের ‘বেদান্ত-শ্রেণী’তে যোগদান করেছিলেন। সেই সময় ‘শম্ভুচন্দ্ৰ বাচস্পতি’ ওই শ্রেণীর অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৩৬ সালের মে মাস থেকে, ১৮৩৮ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত, দুই বছর ধরে ঈশ্বরচন্দ্র, বেদান্ত-শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেছিলেন। এর আগে তিনি ক্রমাগতঃ মাসিক ৫ টাকা করে বৃত্তি পেয়ে আসছিলেন, কিন্তু ১৮৩৭ সালের মে মাস থেকে তাঁর ও মদনমোহনের মাসিক বৃত্তি বাড়িয়ে ৮ টাকা করে নিৰ্দ্ধারিত করা হয়েছিল। ১৮৩৬-৩৭ সালের বার্ষিক পরীক্ষার পারিতোষিকের তালিকা সংস্কৃত কলেজের নথিপত্রের মধ্যে কোন অজ্ঞাত কারণে পাওয়া যায় না। সেই কারণে ওই বছর ঈশ্বরচন্দ্র কোন পারিতোষিক পেয়েছিলেন কি না, সেটা জানা সম্ভব নয়। বেদান্ত-শ্রেণীতে দ্বিতীয় বছর অধ্যয়ন করবার পরে, ১৮৩৭-৩৮ সালের বার্ষিক পরীক্ষায়, ঈশ্বরচন্দ্র প্রথম স্থান অধিকার করে দশ টাকা দামের বই - ‘মনু’ (২ টাকা), ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ (২ টাকা), ‘অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব’ (৫ টাকা) এবং ‘দত্তকচন্দ্রিকা’ ও ‘দত্তকমীমাংসা’ (১ টাকা) পারিতোষিক হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁর বন্ধু মদনমোহনও একই পারিতোষিক পেয়েছিলেন। ১৮৩৮ সালের ১৫ই মে তারিখে, কলকাতা টাউন হলে সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়েছিল। ১৮৩৮ সালের প্রথম ভাগে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজের ‘স্মৃতি-শ্রেণী’তে প্রবেশ করেছিলেন। ‘মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ’ ও ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কার’ সেই শ্রেণীতে তাঁর সহাধ্যায়ী ছিলেন। ‘হরনাথ তর্কভূষণ’ তখন সংস্কৃত কলেজে ‘স্মৃতিশাস্ত্রের’ অধ্যাপনা করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি-শ্রেণীতে এক বছর ধরে পড়েছিলেন এবং আগের মত মাসিক ৮ টাকা করে বৃত্তি পেয়েছিলেন। সেই শ্রেণীতে তাঁকে - ‘মনুসংহিতা’, ‘মিতাক্ষরা’, ‘দায়ভাগ’, ‘দত্তকর্মীমাংসা’ ও ‘দত্তকচন্দ্রিকা’, ‘দায়তত্ত্ব’, ‘দায়ক্রমসংগ্রহ’ ও ‘ব্যবহারতত্ত্ব’ - পড়তে হয়েছিল। ‘শম্ভুচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন’ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “হরচন্দ্র তর্কভূষণ মহাশয়, দর্শনশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন বটে; কিন্তু প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রে তাঁহার তৎপূর্ব্বে বিশেষ দৃষ্টি ছিল না, সুতরাং স্মৃতির ব্যবহারাব্যায়ে ভালরূপ ব্যবস্থা স্থির করিতে অক্ষম ছিলেন। যদিও অগ্রজ স্মৃতির শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, তথাপি ঐ পণ্ডিতের নিকট অধ্যয়ন করিয়া মনের তৃপ্তি জন্মাইত না; একারণ, অদ্বিতীয় ধীশক্তি সম্পন্ন হরচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের নিকট যাইয়া স্মৃতি অধ্যয়ন করিতেন।” ১৮৩৮-৩৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ঈশ্বরচন্দ্র নগদ ৮০ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন; তাঁর সহাধ্যায়ী ‘মুক্তারাম’ প্রথম স্থান অধিকার করে ১০০ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কৃত গদ্য-রচনার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি-শ্রেণীর আর একটি ১০০ টাকার পারিতোষিক পেয়েছিলেন। সেই পুরস্কারপ্রাপ্ত গদ্য রচনাটি ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সংস্কৃত রচনা’ পুস্তকে পাওয়া গেলেও, সেটির সঙ্গে তাঁর লেখা আসল রচনাটির বিশেষ কোন মিল পাওয়া যায় না। ‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়’ সংস্কৃত কলেজের পুরানো দপ্তর থেকে ঈশ্বরচন্দ্রের লেখা যে আসল রচনাটি উদ্ধার করেছিলেন, সেটি হল - “লৌকিককাৰ্য্যে সত্যকথনস্যোপকারাঃ॥ সত্যং হি নাম মানব্য সাধারণজন বিশ্বসনীয়তা প্রতিপাদকং বিশ্ব সনীয়তায়াশ্চ ফলমিহ বহুতরমুপলভ্যতে তথাহি যদি কন্ঠচিত্ কথঞ্চন, সত্যকথনদর্শনেন সাধারণসমীপে বিশ্বসনীয়তা ভবতি ভবতি হি তস্য ক্রমশো নরপতিবিশ্বাসভাজনতা সমুস্তৃতায়াঞ্চ ত্যাং কিং নাম নব্য দুরবাপমবতিষ্ঠতে অধিপ্ৰত্যর্থিনোশ্চ বিবদমানয়ঃ সন্দিগ্ধবিষয়ে সন্দেহা পারপারাবারবারিণি নিমগ্ন্য নরপতেন তন্নিস্তরণবিষয়ে সাক্ষিণাং সত্য বচনতরণিক পাবলম্বনমন্তরেণ কশ্চন সদুপায়: সাক্ষিণামপি সত্যকথনেন বহুতর প্রতিষ্ঠ। দৃশ্যতে যা পুনর্বচসি ন সত্যতা প্রতিভাসঃ কো নাম তমিহ বিশ্বসিতি তথাপি যদি কথন সাক্ষিণাং ৰচনস্যাসত্যতাবিজ্ঞানং ভবতি তে খলু ভবত্তি চিবমের সাক্ষিধৰ্ম্মবতিষ্কতাঃ সততাবিশ্বসনীয়া অনেকশে! দণ্ডনীয়াশ্চ অপিচ কিমত্র বহুতবং বক্তব্যং শিশবোঽপি বালপীলাবিষয়ে যদি কশ্চিন্মিথ্যাবাদিতয়া নিশ্চিতো ভবতি শৃণুত ভো: সথায়ো নানেনাধমেনান্মাভিঃ পুনব্যবৰ্ত্তব্যময়ং খলু মুষাভাষীবেমাদি গিরমুগিরম্ভীতি লৌকিককায্যে বহুধা সত্যকথনস্যোপকার ইত্যস্ত কিং বিস্তরেণেতি। ধৰ্ম্মশাস্ত্রাধ্যায়ি ঈশ্বরচন্দ্ৰ শৰ্ম্মণঃ॥” সংস্কৃত কলেজে রীতিমত স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করে ঈশ্বরচন্দ্র ‘হিন্দু ল’ কমিটি’র পরীক্ষা দেবার সঙ্কল্প করেছিলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, সেকালে যাঁরা আদালতের ‘জজ-পণ্ডিত’ নিযুক্ত হতেন, তাঁদের সেই পরীক্ষা দিতেই হত। ১৮৩৯ সালের ২২শে এপ্রিল তারিখে সেই পরীক্ষা হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র কৃতিত্বের সঙ্গে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তী মে মাসে যে প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন, সেটা ছিল এইরকম -


“HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION.

We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd twenty-second April 1889 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chunder Vidyasagur was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Indoo Law Officer in any of the Established Courts of Judicature.


H. T. PRINSEP, President

J. W. J. OUSELY Members of the Committee of Examination.


This Certificate has been granted to the said Issur Chunder Vidyasagur under the Seal of the Committee this 16th Sixteenth day of May in the year 1889 corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.

J. C. C. Sutherland

Secy. to the Committee.”


১৮৩৯ সালের মে মাসে প্রদত্ত এই প্রশংসাপত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের নামের শেষে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি লক্ষ্যণীয়। অনেকে লেখেন যে, ১৮৪১ সালে কলেজের পড়াশোনা শেষ পরে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকেরা মিলিতভাবে তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তথ্য যে ভিত্তিহীন, সেটা এই প্রশংসাপত্র থেকেই প্রমাণিত। ১৮৩৯ সালের প্রথমদিকে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজের ‘ন্যায়-শ্রেণী’তে প্রবেশ করেছিলেন। ‘নিমাইচন্দ্র শিরোমণি’ তখন সেই শ্রেণীর অধ্যাপক ছিলেন। ওই বছরেরই ২১শে মে তারিখে, সংস্কৃত কলেজের সব বিভাগের বহু ছাত্র, সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি-বিভাগটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য, কলেজের তৎকালীন সেক্রেটরী ‘জি. টি. মার্শেলের’ কাছে আবেদন করেছিলেন। ওই আবেদনপত্রে, সংস্কৃত কলেজের ‘ন্যায়-শ্রেণী’র ছাত্রদের নামের মধ্যে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রেরও নাম ছিল। আবেদনকারীরা লিখেছিলেন - “ন্যায়শাস্ত্রাধ্যায়িনাং ছাত্রাণাং ... আমারদিগের দুর্ভাগ্যবশতঃ কেবল সংস্কৃত পাঠশালাতেই ইংরাজিভাষাধ্যয়নের রীতি উঠিয়া গিয়াছে কিন্তু মাদর্শাতে উক্তভাষাধ্যয়ন ক্রমে বৃদ্ধি হইতেছে ইহাতে কেবল আমারদিগেরই দুর্ভাগ্য বলিতে হইবেক নতুবা যে রাজা এতদ্দেশে ইংরাজি বিদ্যাবৃদ্ধার্থে ষত্নপূর্ব্বক বহুতর ধন ব্যয় করিয়া বিদ্যালয় সংস্থাপন করিতেছেন তাঁহার যে কেবল এতন্মহানগবস্থ প্রধান বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের উক্তভাষাভ্যাসবিষয়ে অমনোযোগ হইয়াছে ইহা কোনরূপেই সম্ভব নহে অতএব এইক্ষণে প্রার্থনা যে অনুগ্রহপূর্বক রীত্যহসাবে আমারদিগের ইংরাজিভাসাভ্যাসের অনুমতি প্রকাশ হয় তাহা হইলে ক্রমে রাজকীয় কাৰ্য্য ও শিল্পাদি বিদ্যা জানিয়া লৌকিক কার্য নির্বাহে সমর্থ হইতে পারি ইতি - লিপিরিয়ং জ্যৈষ্ঠ্যাষ্টদিবসীয়া -”। ১৮৩৯ সালে কলেজের ন্যায়-শ্রেণীতে পড়ার সময় ঈশ্বরচন্দ্র একটি রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘সংস্কৃত রচনা’ পুস্তকে লিখেছিলেন, “পশ্চিম অঞ্চলে, (সাহারাণপুরের) জন মিরর নামে এক অতি মহানুভাব সিবিলিয়ান্ ছিলেন। ঐ মাননীয় বিদ্যোৎসাহী মহোদয়ের প্রস্তাব অনুসারে, পুরাণ, সূর্য্যসিদ্ধান্ত, ও য়ুরোপীয় মতের অনুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ে, কতকগুলি শ্লোক লিখিয়া, একশত টাকা পারিতোষিক পাইয়াছিলাম।” তাঁর লেখা সেই শ্লোকগুলো তাঁর রচিত ‘ভূগোলখগোলবর্ণনম্’ পুস্তকে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পুরস্কারের পরিমাণ ছিল ৫০ টাকা, ১০০ টাকা নয়। সংস্কৃত কলেজের পুরানো নথিপত্রের মধ্যে, ১৮৩৯-৪০ সালের বার্ষিক পরীক্ষার জন্য প্রদত্ত পারিতোষিকের কোন তালিকা পাওয়া যায় না, সেই কারণে, কলেজের ন্যায়-শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র কোন কোন বিষয়ে পারিতোষিক পেয়েছিলেন, সেটা জানা যায় না। ‘শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন’ লিখেছিলেন যে, তিনি “দর্শনের প্রাইজ টাকা পান, এবং সংস্কৃত কবিতা-বচনায় সর্ব্বাপেক্ষা ভাল কবিতা লিখিয়া ১০০ টাকা পুরস্কার প্রাপ্ত হন।” ‘বিদ্যার প্রশংসা’ নামে সংস্কৃতে একটি পদ্য রচনা করে ঈশ্বরচন্দ্র যে ওই প্রতিযোগিতায় ১০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন - সে কথা তিনি নিজেই তাঁর ‘সংস্কৃত রচনা’ পুস্তকে লিখে গিয়েছিলেন। ১৮৪০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘নিমাইচন্দ্র শিরোমণি’র মৃত্যু ঘটলে, তাঁর জায়গায় ‘সৰ্ব্বানন্দ ন্যায়বাগীশ’ কিছু দিনের জন্য অস্থায়ীভাবে সংস্কৃত কলেজে ন্যায়শাস্ত্রাধ্যাপনা করেছিলেন। ১৮৪০ সালের ১১ই আগস্ট তারিখে, ‘জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন’, মাসিক ৮০ টাকা বেতনে স্থায়ী ভাবে সংস্কৃত কলেজের ন্যায়-অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র ন্যায়-শ্রেণীতে দ্বিতীয় বছরে (১৮৪০-৪১) প্রধানতঃ জয়নারায়ণেরই কাছেই পড়েছিলেন। ন্যায়-শ্রেণীতে তাঁকে - ‘ভাষাপরিচ্ছেদ’, ‘সিদ্ধান্তমুক্তাবলী’, ‘ন্যায়সূত্র’ ও ‘কুসুমাঞ্জলি’ পড়তে হয়েছিল। ১৮৪০-৪১ সালে, ন্যায়-শ্রেণীর দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র একাধিক বিষয়ে পরিতোষিক পেয়েছিলেন; ন্যায়ের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করবার জন্য ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগর হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা এবং বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ে পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য ২৫ টাকা - সর্বসাকুল্যে নগদ ২৩৩ টাকা পারিতোষিক তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর পদ্য রচনার বিষয় ছিল - “অগ্নীধ্র রাজার তপস্যা”; ওই কবিতাটি তাঁর ‘সংস্কৃত রচনা’ পুস্তকে পাওয়া যায়। ১৮৪১ সালেও বিদ্যাসাগর কয়েক মাসের জন্য, ‘জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের’ অধীনে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর মাসিক ৮ টাকা বৃত্তি, ঐ বছরের জুন মাসে বন্ধ হয়ে যাবার উল্লেখ, ১৮৪০ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখের সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের বৃত্তির একটি তালিকায় পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর কমপক্ষে তিন বছর ধরে সংস্কৃত কলেজে ন্যায়শাস্ত্র পড়েছিলেন। ১৮২৬ সালের এপ্রিল মাসে সংস্কৃত কলেজ কতৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন যে, সংস্কৃত কলেজের ‘সাহিত্য ও অলঙ্কার-শ্রেণী’র ছাত্রদের অন্ততঃ এক বছরের জন্য, ‘ভাস্করাচার্য্যের লীলাবতী ও বীজগণিত’ পড়তে হবে। সেই বিষয়ে অধ্যাপনার জন্য, পরবর্তী মে মাসে, ‘উইলসন’ সাহেবের সুপারিশে, ‘যোগধ্যান মিশ্র’ নামের এক জন পণ্ডিতকে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সম্ভবতঃ ঈশ্বরচন্দ্র, কলেজের ন্যায়-শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘জ্যোতিষ-শ্রেণী’তেও পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি যে একই সময়ে কলেজের ওই শ্রেণীতে পড়েছিলেন, সেটার প্রমাণ হিসেবে বলা যায় যে, ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা তাঁকে যে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন, তাতে কলেজের জ্যোতিষের অধ্যাপক ‘যোগধ্যান মিশ্রের’ও স্বাক্ষর ছিল। এই ভাবে একটানা বারো বছর পাঁচ মাস ধরে সংস্কৃত কলেজে পড়ার পরে, ১৮৪১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে, বিদ্যাসাগর ‘কলিকাতা গবর্মেন্ট সংস্কৃত কলেজের’ প্রশংসাপত্র লাভ করেছিলেন। সেদিন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা মিলিতভাবে বিদ্যাসাগরকে যে প্রশংসাপত্রটি দিয়েছিলেন, তাতে ‘দেবনাগর অক্ষরে’ লেখা ছিল -


“অম্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলিকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানিসংস্থাপিতবিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চ মাসাংশ্চোপস্কায়াধোলিখিতশাস্ত্রাণ্যধীতবান।


ব্যাকরণম ... শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ

কাব্যশাস্ত্রম ... শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ

অলঙ্কারশাস্ত্রম ... শ্রীপ্রেমচন্দ্ৰ শর্ম্মভিঃ

বেদান্তশাস্ত্রম ... শ্রীশম্ভুচন্দ্ৰ শর্ম্মভিঃ

ন্যায়শাস্ত্রম ... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ

জ্যোতিষশাস্ত্রম ... শ্রীযোগধ্যানশর্ম্মভিঃ

ধর্মজ্ঞানশাস্ত্রঞ্চ ... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ


সুশীলতয়োপস্থিতসৈতসৈতেষু শাস্ত্ৰেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট। ১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতিদিবসীয়ম্।


Rassomoy Dutt, Secretary.

10 Decr. 1841.”


এই হল বিদ্যাসাগরের ছাত্র জীবনের নিরস ইতিহাস। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত কলেজের এই প্রায় তেরো বছরের ইতিহাস দেখে এটা সহজেই বোঝা যায় যে তাঁর নামের পিছনে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটির সার্থকতা কোথায়। কলেজে প্রবেশের সময় থেকে শুরু করে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত, যে মানুষটি ক্রমাগত ‘মাসিক বৃত্তি’, ‘পারিতোষিক’ ও পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সামনে যে, শ্লোকের ভুল ব্যাখ্যা করা পণ্ডিতেরা বিতর্কে হেরে কুপোকাৎ হবেন, সেই বিষয়ে সন্দেহ কোথায়? বর্তমানে প্রায়শঃই বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটি প্রচলিত গল্পে দেখা যায় যে, তিনি নাকি ‘পরাশরসংহিতা’ থেকে বিধবা পুনর্বিবাহের শ্লোকটি আবিষ্কার করে, “পেয়েছি পেয়েছি” বলে চিৎকার জুড়েছিলেন! বাস্তবে, বিদ্যাসাগরের ছাত্র জীবনের মেধা ও ইতিহাস বলে যে তাঁর ঐরূপ নাটকীয় ধরণের কিছু করার দরকার ছিল না, কারণ তিনি তখনকার দিনে হিন্দু শাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। এটা ঠিক যে, ওই শ্লোকটি খুঁজতে তাঁকে বেশ কয়েক রাত জগতে হয়েছিল, বইপত্রও ঘাঁটতে হয়েছিল, কিন্তু বিশেষ বেগ পেতে হয়নি - বুঝতে ও বোঝাতে। সুতরাং, যাঁরাই তাঁকে নিয়ে ওই গল্পটি বাজারে চালু করে থাকুন, সেটা করে তাঁরা তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রতি সুবিচার অন্ততঃ করেননি। বিদ্যাসাগরের ছাত্রজীবনের ইতিহাস নিরস হলেও, যিনি বাংলা ভাষাকে সবার প্রথমে সরস করে সাহিত্যের মর্য্যাদা দিয়েছিলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের উদ্যোগপর্বের ইতিহাস, অনিসন্ধিৎসু মানুষের কাছে কম মূল্যবান হওয়ার কথা নয়।

                                               

(তথ্যসূত্র:

১- বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন।

২- বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়।

৩- সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়।

৪- বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ।

৫- নব ভারত স্রষ্টা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ।

৬- বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার।

৭- বিদ্যাসাগর রচনাবলী।)

                                       

No comments