Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

‘রাণী শিরোমণি ও চোয়াড় বিদ্রোহ’ রানা চক্রবর্তী

‘পলাশীর যুদ্ধে’ নবাব ‘সিরাজোদ্দৌলা’ চক্রান্তের স্বীকার হয়ে সিংহাসন হারালে, কিছু কালের জন্য বাংলার নবাব হয়েছিলেন ‘মীরজাফর’ ও ‘মীরকাশিম’। নবাব ‘মীরকাশিম’, ইংরেজ অনুগ্রহে বাংলার মসনদে বসার বিনিময়ে, রাজকোষ শূন্য দেখে, নগদ টাকার পরি…

 






                                        

‘পলাশীর যুদ্ধে’ নবাব ‘সিরাজোদ্দৌলা’ চক্রান্তের স্বীকার হয়ে সিংহাসন হারালে, কিছু কালের জন্য বাংলার নবাব হয়েছিলেন ‘মীরজাফর’ ও ‘মীরকাশিম’। নবাব ‘মীরকাশিম’, ইংরেজ অনুগ্রহে বাংলার মসনদে বসার বিনিময়ে, রাজকোষ শূন্য দেখে, নগদ টাকার পরিবর্তে ব্রিটিশ ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী’কে যে তিনটি জেলার রাজস্ব সংগ্রহ করার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে একটি জেলা ছিল ‘মেদিনীপুর’। এরপরে মুনাফাখোর ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’র প্রতিনিধিরা যেন-তেন প্রকারে যতটা বেশি সম্ভব রাজস্ব সংগ্রহ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। ইতিমধ্যে ১৭৬৫ সালে ‘রবার্ট ক্লাইভ’ দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতে আসার পরে দিল্লীর তৎকালীন মুঘল সম্রাট ‘শাহ আলমের’ কাছ থেকে ‘বাংলা’, ‘বিহার’ ও ‘উড়িষ্যা’র দেওয়ানি লাভ করে তাঁদের শাসন ও শোষণকে আরও বলবৎ করতে চেয়েছিলেন। ১৭৬৬ সালেই ইংরেজরা ঘোষণা করেছিল যে, সারা মেদিনীপুর জেলায় যে সমস্ত ছোট বড় জমিদার আছেনা, তাঁদের সবাইকে বৰ্দ্ধিত হারে খাজনা দিতে হবে এবং সেই সব জমিদারদের কোন প্রজাই আর ‘নিষ্কর জমি’ ভোগ করতে পারবেন না। তাঁদের সবাইকে রাজস্ব দিতে হবে। অথচ সেই সমস্ত প্রজারা তাঁদের জমিদার কর্তৃক নির্দ্ধারিত বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বহুদিন ধরে ‘নিষ্কর জমি’ ভোগ করে আসছিলেন। ১৭৯৩ সালে ‘লর্ড কর্ণওয়ালিস’ কর্তৃক ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জমির উপরে জমিদারদের ও পাইকদের সামান্য অধিকারের অবলুপ্তি ঘটেছিল। তার উপরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল, যে সমস্ত জমিদার নির্দ্ধারিত রাজস্ব নির্দ্ধারিত দিনে দিতে পারবে না - তাঁদের জমিদারী এমন কি বাসগৃহও সূর্যাস্তের পরে নিলামে তোলা হবে। এর ফলে বহু পুরানো জমিদার তাঁদের জমিদারী হারিয়েছিলেন। তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি ইংরেজদের হস্তগত হয়েছিল। সেই সমস্ত জমিদারদের প্রজারাও ‘নিষ্কর জমি’ ভোগ দখলের অধিকার হারিয়েছিলেন। কারণ বাংলার অভ্যন্তরীন শাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী অধিগ্রহণ করায় জমিদারদের পাইক রাখা নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং তাঁদের সমস্ত জমিজমা কোম্পানীর অধিকারের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। এর ফলে ‘জঙ্গলমহালের’ স্থানীয় জমিদারেরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। প্রাক্-ব্রিটিশ যুগের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গঠিত হতে শুরু করেছিল। বলপূর্বক সংগৃহীত রাজস্বে কাঁচামাল খরিদ করে ব্রিটেনের কলকারখানায় প্রেরণ করে কোম্পানীর কর্মচারীরা দু’দিক দিয়ে লাভবান হয়েছিল। প্রথমতঃ, তাঁদের স্বদেশের শিল্প বিপ্লব সংগঠনে ভারত থেকে প্রেরিত কাঁচামাল অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল; দ্বিতীয়তঃ, তাঁদের ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের পরিমাণ অকল্পনীয় হয়েছিল। অন্যদিকে মেদিনীপুর জেলার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের আদিম অধিবাসী; যাঁদের ব্রিটিশরা বলত ‘অসভ্য’, ‘চোয়াড়’ প্রভৃতি - প্রত্যক্ষ করেছিল ইংরেজদের চরম শোষণ ও নির্যাতন। তাঁদের আজন্ম অধিকারের জমি কেড়ে নিয়ে ইংরেজরা চড়া রাজস্বে অন্য জমিদারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এর ফলে অন্ততঃ পঁচিশ হাজার সাধারণ কৃষক তাঁদের ‘পাইকান জমি’ ও অন্যান্য জমি, ঘরবাড়ী হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। সরল সাদামাটা কৃষকদের মনে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে শুরু হয়েছিল। তবে শুধু কৃষকরা (চোয়াড়) নন, ঐ সময় বিক্ষোভ গাঢ়তর হতে শুরু করেছিল - ‘নাড়াজোল’, ‘রামগড়’, ‘ঘাটশিলা’, ‘ঝাড়গ্রাম’, ‘লালগড়’, ‘শিলদা’, ‘জামবনী’, ‘গড়বেতা’র জমিদার তথা রাজা ও ‘কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি’র মনে।

                                       

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকবিদ্রোহের নেত্রী ‘শিরোমণি’ ছিলেন মেদিনীপুর জমিদারীর শেষ রাজা ‘অজিত সিংহের’ স্ত্রী এবং ‘শিবায়ন’ কাব্য রচয়িতা ‘রামেশ্বর ভট্টাচার্য্যের’ পৃষ্ঠপোষক, বাংলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ জমিদার ‘যশোবন্ত সিংহের’ পুত্রবধূ। অজিত সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর নিঃসন্তান বিধবা দুই রাণী যথাক্রমে - ‘রাণী ভবানী’ ও ‘রাণী শিরোমণি’ - মেদিনীপুর জমিদারীর অধিকারিণী হয়েছিলেন। তাঁরা যৌথভাবে তাঁদের জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন - ‘নাড়াজোলের জমিদার’ ‘ত্রিলোচন খান’কে। উল্লেখ্য যে, বহুদিন ‘নাড়াজোল’ মেদিনীপুর জমিদারীর অন্তর্গত ছিল। মেদিনীপুরের জমিদার বংশের অন্যতম আবাসস্থল ছিল ‘নাড়াজোল’। এছাড়া অন্য দুটি আবাসস্থল ছিল - মেদিনীপুর শহরের কাছে অবস্থিত ‘আবাসগড়’ ও মেদিনীপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ‘কর্ণগড়’। তবে মেদিনীপুরের জমিদাররা অধিকাংশ সময়ই কর্ণগড়ে থাকতে পছন্দ করতেন দুটি কারণে। প্রথমতঃ, কর্ণগড় ছিল তাঁদের জমিদারীর প্রায় মধ্যস্থলে। দ্বিতীয়তঃ, অঞ্চলটি ঘন জঙ্গলে আবৃত হওয়ায় আত্মরক্ষার সুবিধা ছিল। তাই মেদিনীপুরের জমিদাররাই ‘কর্ণগড়ের জমিদার’ রূপে সুবিদিত হয়েছিলেন। ১৭৬০ সালে সেই কর্ণগড়েই ‘রাণী ভবানী’র মৃত্যু হয়েছিল। ফলে মেদিনীপুর জমিদারীর সমস্ত প্রজার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়েছিল শিরোমণির উপরে। রাণী ভবানীর মৃত্যুর পরে, তাঁর অংশের জমিদারী ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হলেও শিরোমণির জমিদারী অটুট ছিল। তিনি আগের মত নাড়াজোলের জমিদার ‘ত্রিলোচন খানের’ সাহায্য নিয়ে জমিদারী চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনকার দিনে বড় বড় জমিদারদের প্রজারা ‘রাজা’ বলে সম্বোধন করতেন। মেদিনীপুরের প্রায় প্রত্যেক জমিদারকে ‘রাজা’ বলা হতো। এই কারণে জমিদার পত্নী শিরোমণিও ‘রাণী’ রূপে সম্মানিতা হয়েছিলেন। ‘জঙ্গলমহালের’ নিম্নবর্ণের বিদ্রোহ, যা ইংরেজদের ভাষায় ‘চোয়াড় বিদ্রোেহ’ বলে ইতিহাসে পরিচিত, সেটি ‘জে. সি. প্রাইসের’ একটি রিপোর্টে প্রথম উল্লিখিত হয়েছিল। ‘জে. সি. প্রাইস’ ছিলেন ‘ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের’ একজন পদস্থ কর্তা। তিনি মেদিনীপুরের ‘সেটেলমেন্ট অফিসার’ থাকা কালীন ‘চোয়াড় বিদ্রোহ’ সম্বন্ধে সরকারি কাগজপত্র ঘেঁটে একটি রিপোর্ট তৈরী করেছিলেন। ঐ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে - চোয়াড় বিদ্রোহের জন্য মেদিনীপুরের কালেক্টর সাহেব রাণী শিরোমণির গতিবিধি সন্দেহজনক বলে মনে করেছিলেন। তিনি নাড়াজোলের জমিদারের আত্মীয় ‘চুনিলালের’ সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে চোয়াড় বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে পারেন বলে রিপোর্টে সন্দেহ করা হয়েছিল। ফলে কালেক্টর সাহেব রাণীকে ‘সংরক্ষিত’ করার জন্য একদল সিপাই পাঠানো দরকার বলে রিপোর্টে সুপারিশ করেছিলেন। কালেক্টর সাহেবের মতে, রাণীকে বাগে আনার সেটিই ছিল অন্যতম পথ। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছিল যে, রাণীকে ‘চুনীলালের’ সংস্পর্শ থেকে সরিয়ে না রাখলে শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। গোটা দেশে অশান্তি যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে বিশেষ নজর রাখা হয়েছিল। গুপ্তচর মারফৎ কালেক্টর সাহেব জানতে পেরেছিলেন যে - চোয়াড়দের একটি বিরাট দল রাণী শিরোমণির আশ্রিত ছিল এবং তাঁরা পারস্পরিক পরামর্শের জন্য রাণীর কেল্লায় গোপনে যাতায়াত করত। শুধু তাই নয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্যও, ‘নাড়াজোল’ থেকে রাণীর কেল্লায় চারটি গরুর গাড়িতে করে অস্ত্রশস্ত্রও নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে, রাণীর কাজকর্ম সম্বন্ধে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী শীর্ষ আধিকারিকদের মনে গভীর সন্দেহ দেখা যায়দিয়েছিল। রাণী শিরোমণি সহ জঙ্গলমহালের সমস্ত জমিদারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তাঁরা যেন কোন ভাবেই চোয়াড়দের আশ্রয় বা সাহায্য না করেন। অন্যদিকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল চোয়াড়দের ঘর লুঠপাট করার জন্য। প্রয়োজন বোধ করলে তাঁদের গুলি চালানোরও স্বাধীনতা হয়েছিল। জঙ্গলমহালের চাষীদের সেই সংকটময় মুহূর্তে কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি স্বয়ং এগিয়ে এসেছিলেন সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে।

                                       

রাণী শিরোমণির জন্ম ঠিক কোথায়, কবে, কোন গ্রামে বা বংশে তা জানা যায় না। তবে সম্ভবতঃ তিনি কোন জমিদার কন্যা ছিলেন না। কারণ তিনি জমিদার কন্যা হলে বিদ্রোহের সময় তিনি অবশ্যই তাঁর পিত্রালয়ের সাহায্য পেতেন। সেদিক থেকে গবেষকরা মনে করেন যে, ‘ত্রিলোচন’ তাঁর পিত্রালয়ের কেউ ছিলেন। তিনি জমিদারীর মালিক হওয়ার পরেই তাই মেদিনীপুরের জমিদারদের ‘নাড়াজোলের আবাসগৃহ’ সহ জমিদারীর কিছু অংশ ‘ত্রিলোচন খান’কে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি যখন বিদ্রোহের পরিচালনা করেছিলেন, বন্দী হয়েছিলেন - তখন সব সময়েই ‘নাড়াজোলের জমিদার’ ও তাঁদের আত্মীয়বর্গ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নাড়াজোলের জমিদার ‘আনন্দলাল খানের’ একজন আত্মীয়, ‘চুনীলাল খান’ - রাণীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সেই প্রতিবাদী আন্দোলনের সহকারী ছিলেন। গবেষকদের মোতে, ‘চুনীলাল খান’ যদি তাঁর নিকট আত্মীয় না হতেন তাহলে, রাণীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য তৎকালীন সমাজ তাঁকে সন্দেহ করতো। কিন্তু তা হয়নি। পক্ষান্তরে শিরোমণিকে তাঁরা তাঁদের মাথার মণির মতো রক্ষা করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় নাড়াজোলের জমিদাররা জাতিতে ‘সদগোপ’ ছিলেন। গোষ্ঠী হিসেবে তাঁরা মোটামুটি সঙ্গতিসম্পন্ন কৃষক ছিলেন। সেই কারণে গবেষকরা অনুমান করেন যে, রাণী শিরোমণিও জাতিতে ‘সদ্‌গোপ’ এবং কৃষক কন্যা ছিলেন। তবে অধ্যাপক ‘জে. সি. ঝা’ তাঁকে, কোন সূত্র নির্দেশ না করেই ‘আধা উপজাতি’ বলে যে আখ্যা দিয়েছেন তা অযৌক্তিক। গ্রাম্য পরিবেশে লালিতপালিত শিরোমণি কর্মঠ, বুদ্ধিমতী ও অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। তখনকার দিনের জমিদারদের ‘আভিজাত্যের’ অন্যতম অঙ্গ ছিল গ্রামে, বিশেষতঃ নিজের জমিদারী এলাকায় কোন সুন্দরী অবিবাহিতা যুবতী দেখলে তাঁকে বিয়ে করে ঘরে আনা। ‘অজিত সিংহ’ও শিরোমণিকে গ্রাম থেকে তুলে এনে বিয়ে করে রাণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। রাণী হলেও কৃষক পরিবারের কন্যা শিরোমণি কৃষকদের দুঃখকষ্টের কথা কোনদিনও ভোলেননি। তাঁদের সুখে দুঃখে সর্বদা তিনি তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের প্রজাদের তিনি সন্তানবৎ লালনপালনের চেষ্টা করেছিলেন। রাণীর ব্যক্তিত্ব, মধুর বাক্য ও ব্যবহারের জন্য প্রজাদের কাছে তিনি মাতৃরূপিনী ছিলেন। ইংরেজরা রাণীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে খারাপ ব্যবহার করেছিল। রাণীর জমিদারী হস্তগত করার জন্য নানা অছিলার আশ্রয় নিয়েছিল। ১৭৯৪ সালে ‘রামগড়ের কালেক্টর’ অভিযোগ করেছিলেন যে, রাণী শিরোমণি ও তাঁর আত্মীয়বর্গ, প্রজাসাধারণ কেউই ইংরেজদের সাথে যথাযথ ও আশানুরূপ ব্যবহার করছেনা না, এবং তাঁরা তাঁদের ব্যবসার ভীষণ ক্ষতি করছেনা। সেই অজুহাতে কালেক্টর প্রথমেই আঘাত হানার জন্য, ১৭৯৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি তারিখে রাণীর জমিদারী পরিচালন ব্যবস্থার কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য রাণী যে ইংরেজ বিদ্বেষী - সেই সন্দেহ ইংরেজদের মনে বহুদিন আগে থেকেই ছিল এবং সেটার সঙ্গত কারণও ছিল৷ যেমন ১৭৮৪ সালের ৮ই জুলাই ‘কৰ্ণগড়ে’ কৃষকবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল - কর্ণগড়ের ‘সীতারাম খান’ ও ‘বনসুরাম (বাঞ্ছারাম) বক্সী’র নেতৃত্বে। রাণী শিরোমণি সেই বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাতে ইংরেজ কোম্পানী শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সৈন্য পাঠিয়ে ‘সীতারাম’ ও ‘বাঞ্ছারাম’কে বন্দী করে বিচারের জন্য মেদিনীপুরের ফৌজদারী কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং একটি সরকারি নির্দেশনামায় রাণীকে এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে যদি তিনি আবার চোয়াড় জাতীয় অসভ্য মানুষদের বিদ্রোহে সাহায্য করেন, তাহলে তাঁকে প্রাণদন্ড দেওয়া হতে পারে। ১৭৯০ সালে মেদিনীপুরের রাণী শিরোমণির ১১৯৫ টাকা খাজনা বাকী পড়ায়, তাঁর খাজনামুক্ত ‘নানকর’ জমি ইংরেজ প্রশাসন বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। এইভাবে বহু অবিচার শিরোমণির উপরে নেমে এসেছিল। রাণীর ইংরেজ বিদ্বেষ সেই সময় চরমরূপ নিয়েছিল যখন ইংরেজরা তাঁর সন্তানবৎ প্রজাদের ‘পাইকান’ জমি কেড়ে নিয়েছিল। তিনি উপায়ান্তর না দেখে বিদ্রোহী কৃষকদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের আশির দশক থেকে জঙ্গলমহালের আর্থিক সংকট চরমরূপ ধারণ করতে শুরু করেছিল। ১৭৮৮ সালে লবনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ১৭৮৯ সালে মারাঠা আক্রমণের ধাক্কা এবং ১৭৯১ সালে ‘রাজা সুন্দরনারায়ণের’ অতিরিক্ত কর সংগ্রহ কৃষকদের চরম আর্থিক দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। তাছাড়া, তখন মেদিনীপুর জমিদারীর অধিকাংশ অঞ্চল ছিল জঙ্গলাবৃত ও অনুর্বর, তাই সেগুলো জনবিরল ছিল। যেটুকু চাষযোগ্য জমি কৃষকদের ছিল তাতে ভালো ফসল ফলতো না, তাই আয়ও বেশি হতো না। তাই চাষবাসে তাঁরা তেমন মনোযোগীও ছিলেন না। তাঁরা সামরিক জীবন বেশি পছন্দ করতেন। তাঁদের অনেকেই ভাড়াটে সৈন্য হয়ে গিয়েছিলেন। টাকা পেলে ইংরেজদের হয়েও তাঁদের যুদ্ধ করতে আপত্তি ছিল না। তাঁরা ইংরেজ কোম্পানীর হয়ে দাক্ষিণাত্য, মহীশূর, উত্তর ভারত ইত্যাদি অঞ্চলেও যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের স্বার্থে যখন ইংরেজরা যখন ঘা দিয়েছিল, তাঁদের নিষ্কর ‘পাইকান’ জমিও কেড়ে নিয়েছিল, তখন তাঁরাও প্রত্যাঘাত হেনেছিলেন। তাঁদের অতিপ্রিয় রাণীর জমিদারী কেড়ে নিলে তাঁরা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। মেদিনীপুরের জমিদারীর অন্তর্গত পাইক-বরকন্দাজেরা ইংরেজাদের চোখে ছিলেন - অসভ্য, জংলী, চোয়াড়। আসলে সেই পাইক বরকন্দাজেরা ছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া গরীব কৃষক। বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা ছাড়া তাঁদের মূল পেশা ছিল কৃষিকাজ। পাইকের কাজ মূলতঃ করতেন ‘ভূনজ্’ (ভূমিজ), ‘কুরমালি’, ‘কোড়া’, ‘মুন্ডারী’, ‘কুর্মী’, ‘বাগদী’, ‘মাঝি’, ‘লোধা’ ইত্যাদি উপজাতিসমূহ। তাঁরা বংশানুক্রমে দীর্ঘদিন ধরে এলাকার ‘শান্তিরক্ষক’ হিসেবে কিছু নিষ্কর জমি ভোগদখল করছিলেন। ১৭৯৩-৯৪ সালে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মেদিনীপুরের জমিদারী অঞ্চলে নতুন পাইক নিয়োগ করেছিল - সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য। পাইক বরকন্দাজদের সমস্ত ‘পাইকান’ জমিতে ইংরেজরা খাজনা বন্দোবস্ত করেছিল। সেই সব নিষ্কর জমিতে যে সব ভূমিহীন কৃষকরা চাষবাস করতেন, তাঁরা সেই জমির কিছু অংশ পাইকদের দিয়ে বাকিটাতে চাষ করে নিজেদের সংসার চালাতেন, তখন তাঁরাও ভূমিহীন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের অনেকেই বেশি টাকা দিয়ে জমি বন্দোবস্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ও শহরস্থ মহাজনদের দালালের শরণাপন্ন হয়ে ‘কৃষি-ক্রীতদাসে’ পরিণত হয়েছিলেন। মন্বন্তর, বর্গীর আক্রমণ, রাজনৈতিক অত্যাচার, ইংরেজদের সমর্থনপুষ্ট বাবু মহাজনদের শোষণে নিষ্পেষিত হচ্ছিল তৎকালীন কৃষকসমাজ। তাই তাঁদের সমব্যথী রাণী ইংরেজদের অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছিলেন। তাঁর জমিদারীতে ‘রতন সিং’, ‘রাম সিং’, ‘রঞ্জিত মহাপাত্র’ প্রভৃতি কয়েকজন ‘সর্দার-তহশীলদার’কে ইংরেজ সরকার যখন বরখাস্ত করেছিল, এমনকি তাঁদের কোন জমি বন্দোবস্ত দিতেও অস্বীকার করেছিল, তখন রাণী ইংরেজ প্রেরিত নিষ্ঠুর খাজনা আদায়কারী ‘রামমোহন রায়’কে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সময় মেদিনীপুরের জমিদারীর অন্তর্গত কৃষক বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল তিনটি। এক - খাজনা বাকি পড়লে কৃষকদের জমি নিলাম হতো। দুই - নিষ্কর জমির খাজনা বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছিল। তিন - পাইক বরকন্দাজদের সামাজিক দায়িত্ব অস্বীকার করে, তাঁদের পরিবর্তে বহিরাগত দারোগা ও পুলিশদের হাতে স্থানীয় শান্তি রক্ষার ভার অর্পণ করা হয়েছিল। তাঁদের শোষণের জন্য আবার ১৭৯৩ সালের ‘২২ নং রেগুলেশন’ বলে, একটি নতুন কর-ও ধার্য করা হয়েছিল। তার উপরে জমিদারী এলাকায় ব্যাপক বে-আইনী বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। চাষীদের নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখার জন্য ইংরেজরা গোপনে বিনামূল্যে আফিম সরবরাহ করতে শুরু করেছি। এতকিছু করেও ইংরেজদের কোন লাভ হয়নি। এর মধ্যে চাষীদের সুখ দুঃখের অংশীদার রাণী শিরোমণির জমিদারী বাজেয়াপ্ত হলে তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। মেদিনীপুরের জমিদারীর মধ্যে যারা বাস করতেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন পাইক। তাঁরা জমিদারের হয়ে লড়াই করতেন, বিনিময়ে কিছু নিষ্কর জমি তাঁরা ভোগ করতেন। তাঁদের জীবন ধারণের উৎসসমূহ ইংরেজ কোম্পানি রুদ্ধ করে দিলে, তাঁরা সঙ্গতি সম্পন্ন, সুদখোর, ইংরেজ পদলেহনকারী ব্যক্তিদের বাড়িতে ডাকাতি ও লুঠপাট শুরু করেছিলেন। ইংরেজ ও তাঁদের আশ্রিত ও সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিদের তাঁরা প্রধান শত্রু রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। রাণী সেই সব ডাকাতি বা লুঠপাট বন্ধ করার চেষ্ট না করে তাঁদের উৎসাহিত করেছিলেন। রাণী শিরোমণি বিদ্রোহী হয়েছিলেন মূলতঃ কয়েকটি কারণে। প্রথমতঃ, তাঁর জমিদারীর পরিচালন ক্ষমতা ইংরেজরা ১৭৯৪ সালে কেড়ে নেওয়ায় তিনি অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ, রাণীর সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সাথে ইংরেজদের মাখামাখি গলাগলি রাণীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিপ্রায়ে সেইসব চক্রান্তমূলক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি তাঁর পিতৃপরিবার ও আত্মীয়রা সবাই কৃষক ছিলেন। ইংরেজদের নতুন ভূমিব্যবস্থার ফলে সেখানকার কৃষক সম্প্রদায় দারুণ আর্থিক দুর্গতির মধ্যে পড়েছিল। সরকারকে খাজনা দিয়ে যা তাঁদের উদ্বৃত্ত থাকতো তাতে তাঁদের কয়েক মাসের ভরণপোষণ চলতো। তাছাড়া তাঁদের ওপরে প্রতিনিয়ত চলতো ইংরেজ সেপাই, তহশীলদার, গোমস্তা ইত্যাদির নিত্য নিপীড়ন ও শোষণ। সেসময় শুধু গরীব চাষীরা সর্বস্বান্ত হননি, মাঝারি কৃষকেরাও হয়েছিলেন। আত্মীয়, পরিবার-পরিজনদের উপরে ইংরেজদের শোষণ ও শাসন রাণীকে বিচলিত করে তুলেছিল। তিনি স্বেচ্ছায় ও স্বপরিকল্পনায় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। আন্দোলনের সমস্ত কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

                                       

আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে রাণী শিরোমণি ‘জঙ্গলমহাল’ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তা রীতিমতো তারিফ করার মতো। তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল নিজের জমিদারীর সমস্ত প্রজার সমর্থন অর্জন করা। প্রজাদের দুঃখকষ্টে তিনি তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন বলে গণ সমর্থন অর্জন করতে তাঁকে বিশেষ অপেক্ষা করতে হয়নি। জঙ্গলমহালের বিশেষতঃ তাঁর জমিদারীর প্রায় সমস্ত উপজাতি সর্দারদের সাহায্যের আশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পার্শ্ববর্তী জমিদারদের সাহায্য ও সমর্থন না পেলে তাঁর আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে ইংরেজ ও পার্শ্ববর্তী জমিদারদের মোকাবিলা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সেই কারণে বিদ্রোহ শুরু করার আগে তিনি পার্শ্ববর্তী এলাকার জমিদারদের নিয়ে একটি গোপন বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন যে ইংরেজরা কেন সবার শত্রু। শুধু তাই নয় - সেই ইংরেজ বিরোধী গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি জমিদারদের আহ্বান করেছিলেন। তাঁর নিজের কর্তব্য ও দায়িত্বের কথাও তিনি ওই বৈঠকে পেশ করেছিলেন। রাণী প্রথমাবধি ইংরেজ বিরোধী ছিলেন। সব সময়ই তিনি ইংরেজ বিরোধীদের সাহায্য করেছিলেন। যেমন ১৭৬৭ সালের নভেম্বর মাসে ‘নাড়াজোলের জমিদার’ ‘অযোধ্যারাম’ ইংরেজদের খাজনা দিতে অস্বীকার করলে কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই সমস্ত কারণে তিনি প্রজাপ্রিয় ও জমিদারদের আস্থাভাজন ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন দেখা গিয়েছিল যে, কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণির নিষ্কর জমির নিলাম ডাক শুরু হলে কোন পার্শ্ববর্তী জমিদার এমন কি কোন মহাজনও সেই জমি নিলামে ডেকে নিতে এগিয়ে আসেননি। অবশ্য মহাজনেরা ভয়ে ওই নিলামে অংশ নেননি। ইংরেজদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তিনি ‘গেরিলা’ পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ মেদিনীপুরের জমিদারীর অধিকাংশ অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলাবৃত। তাই জঙ্গলের ভিতর থেকে তীর ধনুক নিয়ে অতর্কিতে ইংরেজদেড় সৈন্য আক্রমণ করে গা ঢাকা দেওয়া সহজ ছিল। আবার কোন কোন সময় কৌশল প্রয়োগ করে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে তিনি দুর্বল করে দিতেন। যাঁরা ইংরেজকে সমর্থন করতেন, তাঁদের সাহায্য করতেন - তাঁদের ঘর বাড়ি লুটপাটের আদেশ দিতেন এবং অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে কখনও তাঁদের হত্যা করে রাস্তার ধারের গাছে তাঁদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতেন। রাণীর আদেশে বিদ্রোহী কৃষকরা লুণ্ঠনজাত সামগ্ৰী নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন। রাণী শিরোমণির নেতৃত্বে বিদ্রোহ এমন চরমরূপ ধারণ করেছিল যে ইংরেজরা নিরাপত্তার কারণে তাঁদের পরিবার পরিজনদের কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। একবার, মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, চোয়াড়রা মেদিনীপুর শহর আক্রমণ করে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে, জেলা কালেক্টরেরও একই রকমেরে অভিমত ছিল। খবরটি জানাজানি হওয়ার পরেই বহুলোক মেদিনীপুর শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে ভয় পেয়েছিলেন ধনীলোকেরা। মেদিনীপুর শহরকে সেই আতঙ্ক থেকে রক্ষা করার জন্য ‘লেফটেন্যান্ট কর্ণেল’ ‘ডার্ন’কে বিশেষ অনুরোধ করা হয়েছিল। কালেক্টর সাহেব শহরের বিভিন্ন জায়গায় সেপাই মোতায়েন করেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি। তিনি ‘ডার্ন’কে জানিয়েছিলেন যে, নিরাপত্তার জন্য তাঁর হেফাজতে থাকা কোষাগারটি যেন অস্ত্রাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। গ্রামের যে সব কৃষক ইংরেজদের আদেশ শিরোধার্য করেছিলেন তাঁদের গ্রাম ছেডে, সব ফেলে রেখে শহরে চলে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইংরেজদের পদলেহনকারী মহাজন ও সম্পন্ন কৃষকদের সম্পত্তি লুঠপাট হয়েছিল, তাঁদের জমির ধান কেটে নিয়ে গরীব কৃষকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিদ্রোহী সর্দাররা এলাকার সমস্ত কৃষককে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কোনভাবেই ইংরেজদের বা তাঁদের প্রতিনিধিদের খাজনা দেওয়া চলবে না। সেই নিয়ম লঙ্ঘন করলে তাঁদের হত্যা করা হবে। সম্পন্ন কৃষক, যাঁরা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি, নিজেদের গ্রামের ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। চাষবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ফলে ইংরেজদের পক্ষে খাজনা আদায় করা আর সম্ভব হয়নি। ইংরেজরা দারুণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছিল। এমনকি মেদিনীপুর শহরের নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। অথচ ইংরেজরা তখনও সঠিক বুঝে উঠতে পারেনি যে সেই সমস্ত বিদ্রোহ ও ক্ষয়ক্ষতির মূলে ছিলেন রাণী শিরোমণি। মেদিনীপুরের কালেক্টর তখনও আশা করেছিলেন যে, রাণী শিরোমণি ও তাঁর সহযোগী নাড়াজোলের জমিদার আত্মীয় ‘চুনীলাল খান’ সেইসব জংলী চোয়াড় পাইকদের আয়ত্বে রাখতে না পেরে তাঁদের হাতেই শেষ হবেন। কালেক্টর তাই আদেশ দিয়েছিলেন যে, কর্ণগড়ের দুর্গ রক্ষার জন্য রাণী যে আবেদন করেছিলেন, তাতে সাড়া দিয়ে তখনই যেন কোন সেপাই সেখানে না পাঠানো হয়। কারণ তাঁর মতে রাণী তখন বিপজ্জনক অবস্থায় ছিলেন। আসলে রাণী ইংরেজদের সাথে মোকাবিলা করার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তা কালেক্টর প্রথমে বুঝে উঠতে পারেন নি। কর্ণগড়, নাড়াজোল প্রভৃতি অঞ্চল দখলের জন্য যখন ইংরেজরা নতুন করে কলকাতা থেকে সৈন্য আমদানী করছিল তখন ঐ সেন্যবাহিনীকে বিভাজিত করে, দুর্বল করে, অতর্কিতে জেলা প্রশাসনের মূলকেন্দ্র মেদিনীপুর শহর আক্রমণের পরিকল্পনা তিনি নিয়েছিলেন। তাই তিনি জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন যে তিনিও পাইকদের বিদ্রোহে অতিষ্ঠ এবং তাঁরও সম্পত্তি পাইকরা ডাকাতি করে নিয়েছে। সেই অবস্থায় জেলা কালেক্টরযেন সেপাই পাঠিয়ে দুর্বৃত্ত পাইকদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করেন। কিন্তু রাণীর দুর্ভাগ্য যে, তাঁরই নায়েব ‘যুগলচরণ’ - কর্ণগড়ের রাজা হওয়ার আশায় সমস্ত বিষয় গোপনে ইংরেজদের জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং আরও জানিয়েছিলেন যে, ইংরেজরা যদি রাণীকে সরিয়ে তাঁকে কর্ণগড়ের জমিদার করেন তাহলে ইংরেজদের তিনি অনেক বেশি খাজনা দেবেন। রাণীর দেওয়ান ‘যুগলচরণ’ ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর ও চক্রান্তকারী। বুদ্ধিমতী রাণী শিরোমণি তাঁর দেওয়ান যুগলের সন্দেহজনক গতিবিধি, মতলব ও কার্য্যকলাপ উপলব্ধি করে তাঁকে তাঁর জমিদারী থেকে বহিস্কৃত করেছিলেন। তাঁর জায়গায় তিনি তাঁর আত্মীয় নাড়াজোলের ভূস্বামী ‘চুনীলাল খান’কে দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। সেই চুনীলালই বিদ্রোহ পরিচালনার ব্যাপারে ভবিষ্যতে রাণীর দক্ষিণ হস্ত রূপে ওই অঞ্চলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এরপরে সমস্ত বিষয় ইংরেজদের কাছে পরিষ্কার হয়েছিল। ইংরেজরা রাণীকেই সমস্ত গন্ডগোলের জন্য দায়ী করেছিলেন এবং কৌশলে রাণীকে দমন করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। প্রথমে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কমান্ডিং অফিসারকে ‘আবাসগড়’ দখল করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কৃষক বিদ্রোহের কার্যস্থল আবাসগড়ে থাকতেন রাণীর সহযোগী ‘চুনীলাল খান’। আবাসগড় আক্রমণ করে ইংরেজ আগে রাণীর ডানহাত ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। কয়েকদিন পরে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট রাণী, ‘চুনীলাল খান’ ও ‘নরনারায়ণ বক্সী’র নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে একদিকে কর্ণগড়ে অন্যদিকে আবাসগড়ে দ্বিমুখী আক্রমণ চালিয়েছিলেন। সেই অতর্কিত আক্রমণে শিরোমণি আত্মগোপন করার সুযোগ পাননি। ইংরেজরা ‘আবাসগড়’ ও ‘কর্ণগড়’ দখল করে রাণীকে ও রাণীর সহযোগী সমর্থকদের বন্দী করেছিল। তবে ৩০০ জন কৃষক বিদ্রোহী তথা পাইক, যাঁরা তখন কর্ণগড়ের জঙ্গলে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা সেই অকস্মাৎ আক্রমণে কোনক্রমে আত্মগোপন করেছিলেন। কর্ণগড় ও তার আশপাশ জনমানবহীন হয়ে পড়েছিল। সমস্ত গোলমালের জন্য ইংরেজরা রাণীকে দায়ী করে ১৭৯৯ সালের ৬ই এপ্রিল তারিখে বন্দী করেছিল। ‘শিরোমণি’, ‘চুনীলাল খান’, ‘নুরু বক্সী’ প্রভৃতিকে দুর্গের অর্ডিনেন্স ডিভিসনে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কারুর সাথে বন্দী অবস্থায় রাণী সাক্ষাৎ করতে পারবেন না বলে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে, বিশেষ প্রয়োজনে, ভারতীয় কোন বিশ্বস্ত পদস্থ কর্মচারীর উপস্থিতিতে, রাণী কয়েক মিনিটের জন্য কারো কারো সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। কারণ কথাবার্তার বিষয়বস্তু ঐ পদস্থ সরকারি কর্মচারী কর্তৃক ইংরেজরা জানতে পারতেন।

                                        

এরপরে রাণীকে আদালতে অভিযুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসন মামলা সাজাতে শুরু করেছিল। কর্ণগড়ে অনেক যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া গেছে বলে প্রশাসনের তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, যেমন - ২৭টি গাদা বন্দুক, ৪টি বিলাতি গাদা বন্দুক, ২৫টি তলোয়ার, ৪টি যুদ্ধ কুঠার, ৪টি বল্লম, ১০টি ক্ষুদ্র গোলাকার ঢাল, ৫টি বাঁশের ধনুক, ১৪টি ধনুকের তীর রাখার ক্ষুদ্র থলি, ৯টি ছোরা, ৪টি গুঁড়া বারুদের অস্ত্র এবং একটি রৌপ্য আবৃত ছোট তলোয়ার। সেই যুদ্ধাস্ত্রগুলি রাণীর বিচারের দিন প্রমাণ হিসেবে পেশ করার জন্য ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী কর্ণগড় থেকে মেদিনীপুরে নিয়ে এসেছিল। উল্লেখ্য যে, সেই সময় একটি বড় জমিদারের বাড়িতে কিন্তু উপরোক্ত যুদ্ধাস্ত্র মজুত রাখা অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল। তখনকার দিনে এর চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধাস্ত্র অনেক ছোট ছোট জমিদারদের কাছে থাকতো। বস্তুতপক্ষে রাণী নিজের গড়ে বেশি যুদ্ধাস্ত্র মজুত রাখেননি। অধিকাংশ অস্ত্র তিনি বিদ্রোহী কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজদের বিরূদ্ধে লড়াই করবার জন্য। প্রথমে ইংরেজরা রাণীকে কর্ণগড় দুর্গে ও নাড়াজোলের জমিদার ‘চুনীলাল খান’ ও ‘নরনারায়ন বক্সী’ দেওয়ানকে মেদিনীপুর জেলে বন্দী করে রেখেছিল। কিছুদিন পরে তাঁদের সবাইকে বিচারের জন্য কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইংল্যাণ্ডের ‘প্রিভি কাউন্সিলের’ বিচারে রাণীকে যাবজ্জীবন বন্দী করে রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। রাণী সেই আদেশের বিরূদ্ধে আপীল করেও কোন সুবিচার পাননি। বিশাল সংখ্যক সেপাই কর্ণগড়, আবাসগড় ও নাড়াজোলে মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই বছরের ২০শে মে, মেদিনীপুর জেলায় ৫ কোম্পানি অতিরিক্ত সেপাই কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং কিছু সেপাইকে মূল উপদ্রুত অঞ্চলসমূহে, যেমন - ‘আনন্দপুর’, ‘সৎপতি’, ‘কর্ণগড়’, ‘শালবনি’, ‘গোপীবল্লভপুর’ ও ‘বলরামপুরে’ মোতায়েন করা হয়েছিল। সহযোগী হিসাবে ছিল - সুবাদার, জমাদার, হাবিলদার, নায়েক প্রভৃতি, যাঁদের মোট সংখ্যা ছিল (সেপাই সহ) ৩০৯ জন। মেদিনীপুরেই রাণী শিরোমনির চূড়ান্ত বিচার হয়েছিল। নাড়াজোলের জমিদার ‘সীতারাম খানের পুত্র’ ‘আনন্দলাল খানের’ মধ্যস্থতায় কোম্পানির সঙ্গে রাণীর মিটমাট হয়েছিল। বিচারে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে ‘চুনীলাল খান’ ও ‘নরনারায়ন বক্সী’কে আবাসগড় দুর্গে কার্যত নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই সময় কর্ণগড় অঞ্চলে একটি জনশ্রুতি গড়ে উঠেছিল এই যে, সাধারণ কৃষকের অতিপ্রিয় রাণী শিরোমণিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে মেদিনীপুরে বিদ্রোহের আগুন কখনও নিভবে না। তাই সমস্ত দিক বিবেচনা করে ইংরেজরা রাণীকে আবাসগড় দূর্গে নজর বন্দিনী করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেখানেই রাণী জীবনের শেষ তেরো বছর কাটিয়ে এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিচালনার জন্য তাঁর জমিদারি হারিয়ে ১৮১২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।

                                     

রাণী শিরোমণি যথার্থই রাণী ছিলেন। তিনি ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, সাহসী ও প্রজাহিতৈষী। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন ৷ মেদিনীপুর জমিদারীর অর্ধেক ভাগ তিনি পেয়েছিলেন। তিনি সাধারণ কৃষক প্রজাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে, বিদ্রোহে নেতৃত্ব না দিয়ে, আর পাঁচটা জমিদার গৃহিণীর মত তিনি আরামে বিলাসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। গ্রামের সাধারণ পরিবেশে তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত করে তিনি কৃষকদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখেছিলেন, এমনকি নিজেও সেটা অনুভব করেছিলেন। তাই ধনী জমিদারের গৃহিণী হয়েও তিনি কৃষক প্রজাদের স্বার্থের কথা ভোলেন নি। প্রায় অশিক্ষিত এই রমণীর আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। তিনি দয়াদাক্ষিণ্য, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তার বলে প্রজাদের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর মেলে একটি ঘটনা থেকে। তিনি যখন নিজামত আদালতের নির্দেশে কলকাতা থেকে মেদিনীপুরে বিচারের জন্য আনীত হচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে ‘বানগ্রাজ’ গ্রামে তাঁর শত শত প্রজা, শুভানুধ্যায়ী, এমনকি প্রাক্তন দেওয়ান এসে তাঁকে শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জানিয়েছিলেন। বাহ্যতঃ রাণী মুক্তি পেলেও কার্যতঃ তিনি ছিলেন বন্দিনী। রাণী শিরোমণিকে তাঁর সাহস, দৃঢ়তা ও অন্যায়ের বিরূদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়ার জন্য বহু ক্লেশ ভোগ করতে হয়েছিল। তিনি যে পাইক বা কৃষক বিদ্রোহের প্রকৃত কর্ণধার ছিলেন তার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় যে, তাঁকে বন্দী করার পরেই বিদ্রোহ একেবারে দমিত না হলেও বিদ্রোহের তীব্রতা অনেক কমে গিয়েছিল। বিদ্রোহী কৃষক বাহিনী কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। সেই সাময়িক ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা কৃষকবিদ্রোহের নেতাদের বিরূদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেছিল এবং তাঁদের অনেককে বন্দী করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা কিছুটা দমিত হলেও তাঁরা নিরুৎসাহিত হননি। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় পূর্বের মত ইংরেজ ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮০০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ‘আরনেস্ট’, ‘রেভেনিউ বোর্ডের সভাপতি’ ‘কাউপার’কে এক পত্র মারফৎ জনিয়েছিলেন যে, চোয়াড় কৃষকেরা নতুন নিলামদার জমিদারদের জমি আক্রমণ করা শুরু করেছে। বিভিন্ন জায়গায় ঘরবাড়ি লুঠপাট করছে কিংবা পুড়িয়ে দিচ্ছে। সুযোগ পেলেই ইংরেজদের লোককে হত্যা করছে। ভিখারীর ছদ্মবেশে অতর্কিতে মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের হত্যা করছে। শেষে অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে কৃষক পাইকদের খাজনা অনেকক্ষেত্রে মকুব করা হয়েছিল। বিক্ষুব্ধ কৃষকদের নিষ্কর জমি নামমাত্র জমায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সর্বোপোরি ‘শান্তিরক্ষার কর’ মকুব করে সুপ্রাচীন জমিদারদের উপর স্থানীয় শান্তিরক্ষার ভার অর্পণ করা হয়েছিল। তাঁরা হিন্দুযুগ থেকে যেসব ‘ঘাটোয়ালী অধিকার’ ভোগ করে  আসছিলেন, সেগুলো সবই বলবৎ রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দীদের অনেককেই ক্ষমা করা হয়েছিল। তবু বিদ্রোহের আগুন নির্বাপিত হয়নি। প্রথমে ১৮০৬ সালে, পরে ১৮৩২ সালে আবার জঙ্গলমহালের কৃষকেরা ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরূদ্ধে তীব্র সশস্ত্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর জঙ্গলমহালের কৃষক বিদ্রোহ ও রাণী শিরোমণি দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয় - একে অপরের পরিপূরক। মেদিনীপুর জমিদারীর কৃষক বিদ্রোহ মানেই রাণী শিরোমণি, রাণী শিরোমণি মানেই কৃষক বিদ্রোহ। প্রায় নিরক্ষর সেই কৃষক কন্যার কৃষক ও গরীব দুঃখীদের জন্য আত্মত্যাগ, বুদ্ধি ও কৌশল আজও বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। তিনি শুধু নিজের রাজ্য রক্ষার জন্য ইংরেজদের বিরূদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন নি, নিম্নবর্গ অথবা অনগ্রসর ও দলিত সমাজের মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে তিনি আন্তরিকভাবে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ ইংরেজদের হাতে ‘ভারতের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী’ ছিলেন। ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

                                      

(তথ্যসূত্র:

১- পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ।

২- দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস কথা, কিরণ চৌধুরী।

৩- দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার ইতিহাস, ডঃ গৌরীপদ চট্টোপাধ্যায়।

৪- মেদিনীপুর সম্পদ, হরিসাধন দাস।

৫- মেদিনীপুরের ইতিহাস, ত্রৈলোক্যনাথ পাল।

৬- বৈচিত্র্যময় মেদিনীপুরের ইতিহাস, শ্যামাপদ ভৌমিক।)

                                  

No comments