Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বাঙালী জাতির প্রাচীনত্ব’- রানা চক্রবর্তী


‘বাঙালী জাতির প্রাচীনত্ব’(প্রথম পর্ব)একটা জাতি হিসাবে বাঙালী ঠিক কতটা প্রাচীন? এর উত্তর পেতে হলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে নজর দিতে হবে। পৃথিবীতে মনুষ্য আকৃতির জীবের বিবর্তন ঘটেছিল ‘প্লাওসীন যুগে’। তার পরের যুগকে ‘প্লাইস্টোসীন’ য…

 






‘বাঙালী জাতির প্রাচীনত্ব’

(প্রথম পর্ব)

                                        

একটা জাতি হিসাবে বাঙালী ঠিক কতটা প্রাচীন? এর উত্তর পেতে হলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে নজর দিতে হবে। পৃথিবীতে মনুষ্য আকৃতির জীবের বিবর্তন ঘটেছিল ‘প্লাওসীন যুগে’। তার পরের যুগকে ‘প্লাইস্টোসীন’ যুগ বলা হয়। মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল সেই যুগে । যদিও ঐতিহাসিকরা ‘প্লাইস্টোসীন’ যুগের মানুষের কোনও ‘নরকঙ্কাল’ এখনো পর্যন্ত ভারতে পাননি, তবুও তার আগের যুগের ‘অনু-নর জীবের কঙ্কাল’ ঐতিহাসিকরা এখনো পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের তিন জায়গা থেকে পেয়েছিলেন৷ সেই জায়গাগুলি হচ্ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ ‘শিবালিক গিরিমালা’, ‘জাভা’ ও ‘চীনদেশের চুংকিঙ’। এই তিনটি স্থানবিন্দু সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বঙ্গদেশ সেটার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং ওই ধরণের জীবসমূহ যে সেযুগে বঙ্গদেশের ওপর দিয়েই যাতায়াত করত, সেরূপ অনুমান ঐতিহাসিকরা করে থাকেন। যদিও সঠিকভাবে নির্ণীত ‘প্লাইস্টোসীন’ যুগের মানুষের কোনও নরকঙ্কাল ঐতিহাসিকরা এদেশে পাননি, তবুও মানুষ যে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বঙ্গদেশে বাস করে এসেছে তার প্রমাণ ঐতিহাসিকরা পেয়েছেন বঙ্গদেশে পাওয়া তাঁদের ব্যবহৃত ‘আয়ুধসমূহ’ থেকে। সেই আয়ুধসমূহের অন্যতম হচ্ছে পাথরের তৈরী বিভিন্ন হাতিয়ার, যার সাহায্যে সেযুগের মানুষেরা পশু শিকার করত তার মাংস আহারের জন্য। এটা খুবই বিচিত্র ব্যাপার যে, সেই হাতিয়ারগুলির আকার ও নির্মাণরীতি পশ্চিম ইউরোপে যে ধরণের ছিল ভারতেও ঠিক সেই ধরণের ছিল। ওই ধরণের হাতিয়ার বঙ্গদেশের বহু জায়গায় পাওয়া গিয়েছে, যথা - ‘বাকুড়া’, ‘বর্ধমান’, ‘মেদিনীপুর’ প্রভৃতি জেলার নানা জায়গা থেকে। সেই সকল আয়ুধকে ‘প্রত্নপ্রস্তর যুগের আয়ুধ’ বলা হয়। ‘প্রত্ন প্রস্তর যুগের’ পরিসমাপ্তি ঘটেছিল আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে। তখন ‘নবপ্রস্তর’ বা ‘নবোপলীয় যুগের’ সূচনা হয়েছিল। নবপ্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালীর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল। ভ্রাম্যমাণ জীবনের পরিবর্তে মানুষ স্থায়িভাবে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বসবাস করতে শুরু করেছিল। সেই যুগেই কৃষি ও বয়নের উদ্ভব হয়েছিল এবং মানুষ পশুপালন করতে শুরু করেছিল। সেই যুগের ধর্মীয় আচার সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা খুব বেশী কিছু জানতে পারেননি। তবে ‘প্রত্নপ্রস্তর যুগের’ মানুষের মতো তাঁরা যে ‘ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া’র আশ্রয় নিত ও মৃত ব্যক্তির সমাধির উপরে একখানা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিত - তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকরা ওই ধরণের ঋজুভাবে প্রোথিত পাথর - ‘মেদিনীপুর’, ‘বাঁকুড়া’, ‘হুগলি’ প্রভৃতি জেলায় লক্ষ্য করেছিলেন। সেগুলিকে ‘বীরকাঁড়’ বলা হয়। ওই ধরণের ঋজুভাবে প্রোর্থিত প্রস্তর ফলক ঐতিহাসিকেরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পেয়েছিলেন। ‘বাঁকুড়া’ শহর থেকে দশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ‘ছাতনা’য়, একটি পুকুরের কাছে, ওই ধরণের ঋজুভাবে প্রোথিত স্মৃতিফলক দেখতে পাওয়া যায়৷ সেগুলি চার-পাঁচ ফুট উঁচু এবং সেগুলির গায়ে অপরিণত শৈলীর ক্ষোদিত মূর্তি আছে। সেগুলি সম্বন্ধে নানারূপ জনশ্রুতি বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে - যে সকল সাহসী বীর সৈনিক যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, সেগুলি তাঁদেরই সমাধির ওপরে প্রোথিত। ‘মেদিনীপুরের’ ‘কিয়ারচাঁদ’ গ্রামেও এই ধরণের ঋজুভাবে প্রোথিত বহু প্রস্তর ফলক দেখতে পাওয়া যায়। ‘এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে’ সেগুলির বর্ণনায় বলা হয়েছিল - “Rounded at the top, they seemed to have been deliberately chiselled and stand on the open field as rigid and uncommunicative sentinels which they certainly are, continuing to baffle historians as to how they originated.” এই ধরণের ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তর-ফলক ‘বাঁকুড়া’ জেলার ‘ছাতনা’র দু’মাইল দূরে ‘মৌলবনা’য় ও ‘হুগলি’ জেলাতেও পাওয়া গিয়েছে। ‘হুগলি’ জেলাতে এগুলিকে ‘বীরকাঁড়’ বলা হয়। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, সেগুলি ‘অনু-অস্ট্রেলীয়’ বা ‘প্রোটো-অস্ট্রালয়েড’ জাতির অবদান। কেননা, দক্ষিণভারতের আদিবাসীদের মধ্যেও ঐতিহাসিকরা ওই ধরণের ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তৱ-ফলক খুঁজে পেয়েছেন। ‘নীলগিরি’ পাহাড়ের অধিবাসী ‘কুড়ুম্বা’ উপজাতির লোকরাও ওই ধরণের প্রস্তর-ফলককে 'বীরকল্লু' নামে অভিহিত করেন ও সেগুলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ‘কুড়ুম্বা’ এবং ‘ইরুল’ উপজাতিদের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে - ‘বীরপুরুষদের স্মৃতিফলক’। এক কথায় সেগুলি হচ্ছে সমাধির ওপরে স্মারক-ফলক। সমাধির ওপরে এই ধরণের স্মারক-ফলক, গবেষক ‘ডালটন’, ছোটনাগপুরের ‘হো’ ও ‘মুণ্ডা’ উপজাতিদের গ্রামেও দেখেছিলেন। ‘নীলগিরি’ পাহাড়ের ‘কুড়ুম্বা’দের মত ছোটনাগপুরের ‘হো’ ও ‘মুণ্ডা’ জাতিরাও সেগুলির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ‘করেন। ছোটনাগপুরের ‘খেরিয়া’ উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত এই ধরণের স্মৃতিফলক সম্বন্ধে ‘এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে’ বলা হয়েছিল যে - “Beside the grave-stones monumental stones are set up outside the village to the memory of men of note. The Kherias have collections of these monuments in the little enclosure round their houses and libations are constantly made to them.” ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, বঙ্গদেশে মানুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরে গ্রামের বাইরে যে ‘বৄষকাষ্ঠ’ স্থাপন করা হয়, সেগুলি ওই ধরণের প্রস্তর ফলকেরই কাষ্ঠ-নির্মিত উত্তর সংস্করণ। বস্তুতঃ ‘নবোপলীয়’ যুগের অনেক কিছুই, বাঙালি তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এখনো ধরে রেখেছে। যথা - ধামা, চুবড়ি, কুলো, ঝাঁপি, বাটনা বাটবার জন্য শিল-নোড়া ও শস্য পেষাইয়ের জন্য জাতা ইত্যাদি। এগুলি সবই ‘নবোপলীয় যুগের প্রযুক্তি’ অনুযায়ী তৈরী। ‘নবপ্রস্তর যুগ’ পর্যন্ত মানুষ আয়ুধ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি প্রস্তর দ্বারাই নির্মাণ করত। এর পরে মানুষ তামা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। সেই দুই যুগের সন্ধিক্ষণে যে সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল, সেটাকে ‘তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতা’ বলা হয়। সেই যুগের মানুষ নগর নির্মাণ করতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ, সেই যুগেই প্রথম নাগরিক সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল। সিন্ধু উপত্যকায় ‘মহেঞ্জোদারো’, ‘হরপ্পা’ প্রভৃতি সে যুগেরই নগরের প্রতীক। বঙ্গদেশে সেই ধরণের সভ্যতার নিদর্শন হচ্ছে ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’৷ ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’ ‘বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা’ অঞ্চলে অবস্থিত। সেখানে ১৯৬২-৬৫ সালে উৎখনন কার্য চলেছিল৷ এছাড়া - ‘অজয়’, ‘কুন্নুর’ ও ‘কোপাই’ নদীর উপত্যকার অন্যত্রও ঐতিহাসিকরা সেই সভ্যতার পরিচয় পেয়েছেন। ১৯৯০ সালে, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ’, ‘অজয়’ ও ‘কুন্নুর’ নদীর সঙ্গমস্থলের কাছে ‘মঙ্গলকোটে’, ‘তাম্রপ্রস্তর’ যুগ থেকে ‘মধ্যযুগ’ পর্যন্ত, একটানা উন্নত সভাতার নানাবিধ প্রত্নসম্ভার আবিষ্কার করেছিল। ‘ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের’ মতে, সেই সভ্যতা যে ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্র’ রচনার বহু পূর্ববর্তী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এখানে ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রের’ নাম এজন্য উল্লেখ করা হচ্ছে যে, ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ই (২।২।৩) ঐতিহাসিকরা সর্বপ্রথম ‘আর্যাবর্ত’ নামের উল্লেখ পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিকরা ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’তে চারটি বিভিন্ন যুগের সভ্যতার অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। সেখানে মানুষ বাস করতে শুরু করেছিল খ্রীস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে থেকে। সেই যুগের লোকরা ‘কাঁকরপেটা’ (‘মুরাম’) গৃহতল নির্মাণ করত, চক্রে লাল-কালো ও ধূসর রঙের মৃৎপাত্র তৈরী করত ও ধানের চাষ করত। প্রথম যুগের পরে ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’তে একটি প্লাবন ঘটেছিল এবং স্থানটি সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল। সেখানকার দ্বিতীয় যুগের লোকরাই ‘তাম্রাশ্ম যুগের’ সভ্যতার বাহক ছিল। তাঁরা সুপরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তৈরী করত। তাঁরা গৃহ ও দুর্গ - উভয়ই নির্মাণ করতে জানত। তাঁরা তামার ব্যবহার জানত। কৃষি ও বাণিজ্য - তাঁদের অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল। তাঁরা ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করত এবং পশুপালন ও কুম্ভকারের কাজও জানত। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শয়ন করিয়ে তাঁরা মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করত এবং ‘মাতৃকাদেবী’র পূজা করত। পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় যুগের মানুষেরা ব্যবহার করত লাল-কালে| রঙের ‘কোশীপাত্র’ এবং অপরাপর সুদৃশ্য ‘কলস’, ‘ভাণ্ড’ ও ‘তৈজসপত্রাদি’। সেই যুগের মৃৎপাত্রসমূহের ওপরে অঙ্কিত চিত্রাদি তাঁদের নান্দনিক মানসের সাক্ষ্য দেয় এবং প্রতিফলিত করে নগরভিত্তিক এক অনুপম সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক রুচি। সেই লাল কালো মৃৎপাত্রগুলির গঠন ও চিত্রিত নিদর্শনগুলি ‘নর্মদা উপত্যকা’ (নাভদা টোলি), ‘রাজস্থান’ (আহাড়), ‘মধ্যপ্রদেশ’ (এরণ) ও ‘মহারাষ্ট্রের’ (বাহাল) অনুরূপ বিভিন্ন মৃৎপাত্রের সঙ্গে তুলনীয়। সেখান থেকে দ্বিতীয় যুগের আরও যেসব জিনিস দ্বিতীয় যুগে পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলি ছিল - ‘ক্ষুদ্রাশ্মর ছুরিকা’, ‘হাড়ের আয়ুধ’, ‘তামার অলংকার’, ‘পোড়ামাটির তকলি’ ও ‘শিমুল তুলা থেকে বোনা চিকন ও শুভ্র বস্ত্ৰ’৷ ‘কার্বন ১৪’ পরীক্ষায় দ্বিতীয় যুগের বয়স নির্ণীত হয়েছিল, খ্রীস্টপূর্ব ১০১২+১২০ বছর। একই জায়গা থেকে পাওয়া গিয়েছিল তৃতীয় যুগে নির্মিত ‘নবাশ্মর কুঠার’, ‘অঙ্গারমিশ্রিত লোহার অস্ত্র’ এবং ‘কালো রঙের মণ মৃৎপাত্র’। তবে তখনো লাল-কালো রঙের মৃৎপাত্রের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। এছাড়া পাওয়া গিয়েছিল লৌহ ঢালাইকরণের জন্য ব্যবহৃত চুল্লিসমূহ। ওই জায়গায় ধারাবাহিক খননকার্যের ফলে জানা গিয়েছিল যে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ফলে তৃতীয় যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ও সেই বসবাসস্থল পরিত্যক্ত হয়েছিল। ওই ধরণের একাধিক অগ্নিকাণ্ড অবশ্য সেখানে দ্বিতীয় যুগেও ঘটেছিল। এরপরে ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’তে আবার বসবাস শুরু হয়েছিল বহু পরে, চতুর্থ বা ঐতিহাসিক যুগে ‘মৌর্য’দের সময় থেকে। তবে ঐতিহাসিকদের মতে ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’র দ্বিতীয় যুগটাই ছিল সবচেয়ে গৌরবময় ও সমৃদ্ধিশালী যুগ৷ সেটাই ছিল ‘তাম্রাশ্ম যুগ’ এবং বাণিজ্যই তাঁদের জীবনের প্রধান অবলম্বন ছিল। তাঁরা অভ্যস্তরস্থ দেশসমূহ ছাড়াও ‘সাত সমুদ্র, তেরো নদী’ অতিক্রম করে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করত। ‘ক্রীটদ্বীপ’ ও ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাঁদের সবচেয়ে বেশী বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ‘ক্রীটদেশের’ প্রচলিত লিপি-পদ্ধতিতে লিখিত একটি চক্রাকার সীলমোহর ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’তে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁদের বাণিজ্যের পণ্যসম্ভারের অন্তর্ভুক্ত ছিল - ‘মসলা’, ‘তুলা’, ‘বস্ত্র’, ‘হস্তিদন্ত’, ‘স্বর্ণ’, ‘রৌপ্য’, ‘তাম্র’ এবং খুব সম্ভবতঃ ‘হীরক’। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, ‘গুড়’ বা ‘শর্করা’ও তাঁদের বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেননা, পরবর্তীকালে বাঙলার ‘গুড়’ ও ‘শর্করা’ ‘রোমসাম্রাজ্যে’ বিশেষভাবে আদৃত হত। সীলমোহর ছাড়া ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’তে আরও একটি মাটির ‘লেবেল’ পাওয়া গিয়েছিল। ওই ধরণের মাটির ‘লেবেল' সেই ধরনের ঝুড়ির সঙ্গে বাধা থাকত, যার মধ্যে থাকত মৃৎফলকের ওপর লিখিত পণ্য ও বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পর্কিত হিসাবপত্র। তবে এই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই যে, বাণিজ্য উপলক্ষে বাঙালীরা ‘ক্রীট’দেশে গিয়ে ও ‘ক্রীট’দেশের লোকেরা বঙ্গদেশে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ওই অঞ্চলে বাঙালী বণিকদের উপনিবেশের কথা, ঐতিহাসিকরা পরবর্তীকালে ‘ইজিপ্টবাসী’ এক নাবিক-প্রণীত ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থেও উল্লেখ পেয়েছিলেন। ‘ভেলেরিয়াস ফ্লাকাস’-ও তাঁর ‘আরগনটিকা’ পুস্তকে লিখে গিয়েছিলেন যে, ‘গঙ্গারিডি’ দেশের বাঙালী বীরেরা, ‘কৃষ্ণসাগরের উপকূলে’ ১৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে (‘ঋগ্বেদ’ রচয়িতা ‘নর্ডিক আর্য’দের ‘পঞ্চনদে’ এসে উপস্থিত হবার সমসাময়িককালে) ‘কলচিয়ান’ ও ‘জেসনের’ অনুগামীদের সঙ্গে বিশেষ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এরই প্রতিধ্বনি করে ‘ভার্জিল’ও তাঁর ‘জর্জিকাস’ নামক কাব্যে লিখে গিয়েছিলেন যে, ‘গঙ্গারিডি’র বাঙালী বীরদের শৌর্যবীর্যের কথা “আমি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখব।” বলা বাহুল্য ‘বিদেহ’ বা ‘মিথিলা’র আগে অবস্থিত বাঙালী বীরদের সেই শৌর্যবীর্ষই প্রতিহত করেছিল অগ্রগামী ‘বৈদিক আর্য’দের। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে বাঙালীরা ‘ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলে’ বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত ছিল। অনুরূপভাবে একথাও ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বণিকদেরও বঙ্গদেশে উপনিবেশ ছিল। ফলে, দুই দেশের বণিকদের মধ্যে যে ‘বিবাহঘটিত সম্পর্ক’ স্থাপিত হত - সেটাও অনুমান করা যেতে পারে। নৃতাত্ত্বিকরা চেহারা দেখে, বাঙলার ‘সুবর্ণবণিক’ সম্প্রদায়কে তাঁদেরই বংশধর বলে করেন। পরবর্তীকালে ‘সুবর্ণবণিক’দের ‘সপ্তগ্রামী সমাজের’ অবস্থানও সেই ধরণের নির্দেশ করে। ঐতিহাসিকরা সেই বণিকদেরই  ‘ঋগ্বেদে’ ‘পণি’ নামে অভিহিত হতে দেখেছেন। বস্তুতঃ ‘বণিক’, ‘পণ্য’ প্রভৃতি শব্দ, ‘পণি’ শব্দটি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। আর সমবাচক ‘শ্রেষ্ঠী’ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে ‘আল্পীয় অসুর’দের ‘হট্টি’ বা ‘হিট্টি’ শব্দটি থেকে। পরস্পর সেই মেলামেশার ফলে রাঢ়দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ‘ক্রীট’দেশের সংস্কৃতির অনেক সাদৃশ্য প্রকাশ পেয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে - উভয়দেশেই মাতৃদেবীর সঙ্গে সিংহের সম্পর্ক। এছাড়া ঐতিহাসিকরা উভয় দেশের রূপকথার মধ্যেও অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করে থাকেন। তা ছাড়া ‘ক্রীটদ্বীপের’ নারীরা দেহের উপরের অংশ অনাবৃত রাখতেন। ‘বাৎসায়ন’ তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, পূর্ব ভারতের রাণীরা তাঁদের দেহের উপরাংশ অনাবৃত রাখেন।

                                           

ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, ‘ভূমধ্যসাগরীয় গোষ্ঠীর জাতিরা’ তাম্র আহরণের জন্যই বঙ্গদেশে এসে হাজির হয়েছিল। তাঁদের আরও মনে হয় যে, তাঁদেরই অনুসরণ করে এসেছিল আর্যভাষা-ভাষী ‘অসুর’ জাতীয় ‘আল্পীয় গোষ্ঠী’র বণিকেরা। তাঁরাও এদেশে বসতি স্থাপন করেছিল। সম্ভবতঃ ‘ভূমধ্যীয় গোষ্ঠী’র তুলনায় তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। বর্তমান বাঙলায় ‘আল্পীয় নরগোষ্ঠী’র গরিষ্ঠতা সেটাই অন্ততঃ প্রমাণ করে। তা ছাড়া পরবর্তীকালের সাহিত্যে বঙ্গদেশকে ‘অসুরদের দেশ’ হিসাবেই বর্ণিত হতে দেখা যায়। তাঁরা পশ্চিমদিকে অন্ততঃ ‘অঙ্গদেশ’ পর্যন্ত নিজেদের বিস্তৃত করেছিল। ‘মহাভারত’ ও ‘পুরাণ’ অনুযায়ী - ‘অঙ্গ’, ‘বঙ্গ, ‘কলিঙ্গ’, ‘পুণ্ড্র’ ও ‘সুহ্ম’ - ‘অসুররাজ বলি’র ক্ষেত্রজ সন্তান ছিলেন। অর্থাৎ - ‘অঙ্গ’, ‘বঙ্গ’, ‘কলিঙ্গ’, ‘পুণ্ড্র’ ও ‘সুহ্ম’ অসুরজাতি-সম্ভৃত ছিলেন। অসুরেরা ছিল বিস্তৃত ‘শিরস্ক জাতি’, এবং ‘অঙ্গ’, ‘বঙ্গ’, ‘কলিঙ্গ’, ‘পুণ্ড্র’ ও ‘সুহ্ম’ - বিস্তৃত শিরস্ক জাতিরই বাসভূমি ছিল। মোট কথা হল, দ্রাবিড়ই বলা হোক বা আর্যভাষা-ভাষী অসুরজাতিই বলা হোক, তাঁরা ভারতের আদিবাসী প্রাক্-দ্রাবিড়দের সঙ্গে কিভাবে মিশে গিয়েছিল তা ঐতিহাসিকদের পক্ষে আজও জানা সম্ভব হয়নি। সম্ভবতঃ সেই মিশ্রণ হয়েছিল বাণিজ্য সম্পর্কিত বন্ধুত্বের সুযোগে ও বিবাহের মাধ্যমে। অসুরেরা বৈদিক আর্যদের মত দুর্ধর্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে এদেশের আদিবাসীদের বিজিত করেনি বলেই ঐতিহাসিকদের মনে হয়। কেননা, আগন্তুক ‘নর্ডিক’ বা ‘বৈদিক আর্যরা’ এদেশে বাণিজ্য উপলক্ষে আসেনি। তাঁরা এসেছিল ‘ধর্মধ্বজী যোদ্ধা’ হিসাবে। আর্যসংস্কৃতির ধ্বজা সামনে রেখে দুর্ধর্ষ সংগ্রাম করতে করতেই তাঁরা এগিয়ে গিয়েছিল উত্তরভারতের পূর্বদিকে, তাঁদের মনের মধ্যে ছিল আর্যসংস্কৃতির গরিমা ও এদেশের লোকদের ও তাঁদের সংস্কৃতির প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এজন্য তাঁরা নিজেদের অধীনস্থ এলাকাকে স্বতন্ত্র করে সেগুলোর নাম দিয়েছিল - ‘ব্রহ্মর্ষিদেশ’, ‘আর্যাবর্ত’ ইত্যাদি। নিজেদের আর্যসংস্কৃতির সীমানার বাইরের অংশকে তাঁরা ‘দস্যুদের দেশ’ বলে অভিহিত করত। ‘বিদেহ’ পর্যন্ত এগিয়ে আসার পরে তাঁরা প্রাচ্যদেশের অসুরদের দ্বারা প্রতিহত হয়েছিল। অসুরদের দেশকে তাঁরা ‘ব্রাত্যদেশ’ বা ‘বেদ-বহির্ভূত দেশ’ বলে অভিহিত করত। ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’ মহাভারতের কথা করিয়ে দেয়। জনশ্রুতি অনুসারে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বহুদিন ধরে বাঙলার ‘বীরভূম’ জেলার ‘একচক্রানগরে’ বাস করেছিলেন। আজও ‘অজয়’ নদের তীরে যেখানে ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’ অবস্থিত, তার কাছে ও অদূরে পাণ্ডবদের স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত একাধিক জায়গা রয়েছে। ‘ভীমেশ্বরে’ আছে মধ্যমপাণ্ডব ‘ভীম’ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ। ‘পাণ্ডবেশ্বরে’ও অনুরূপ লিঙ্গ আছে। জনশ্রুতি যেটাই হোক না কেন, অতিহাসিকদের একাংশের মতে ‘ভরতবংশীয়’ রাজাদের অভ্যুত্থান কিন্তু পূর্বভারতেই হয়েছিল। ‘ভরতবংশীয়’ রাজারা ‘ঋগ্বেদে’ বর্ণিত সম্মিলিত দশ রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ‘পাণিনি’ ও ‘পতঞ্জলি’, তাঁদের গ্রন্থে ‘ভরত’দের ‘প্রাচ্যদেশীয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মহাভারতের ‘আদি পর্বে’ উল্লিখিত এক কাহিনী থেকে জানতে পারা যায় যে, ‘ভরতবংশীয়’ রাজা ‘দুষ্যন্তের’ এক পূর্বপুরুষ ‘অরিহ’, ‘অঙ্গদেশের’ এক কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। ‘কাশিকা’র টীকা অনুযায়ী ‘পাণিনি’ উল্লেখিত প্রাচ্যদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল - ‘পঞ্চাল’, ‘বিদেহ’, ‘অঙ্গ’ ও ‘বঙ্গ’৷ ইতিহাসের জন্য ‘কাশিকা’র সেই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, মহাভারতের কাহিনী থেকে জানা যায় যে, ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ‘একচক্রানগরে’ অবস্থানকালে ‘পঞ্চাল রাজার কন্যা’ ‘দ্রৌপদী’কে বিবাহ করেছিলেন। সুতরাং ‘পঞ্চালদেশ’ ‘বীরভূমের একচক্রানগরের’ই নিকটবর্তী কোন রাষ্ট্র ছিল বলে গবেষকদের একাংশ মনে করেন। সেই সকল গবেষকদের মতে, মহাভারতের ‘আদিপর্বে’ বর্ণিত ‘জতুগৃহদাহের’ পরে পাণ্ডবদের পলায়নের কাহিনী উপরি-উক্ত তথ্যসমূহকে সমর্থন করে। তাঁদের  মতে, ‘জতুগৃহ’ নির্মিত হয়েছিল গঙ্গা নদীর উত্তর তীরে ‘বারণাবত’ নগরে। তাঁরা মনে করেন যে, মহাভারতের ‘বারণাবত’ ও বর্তমানের ‘বরৌনী’ অভিন্ন। ‘বিদূর’ কর্তৃক প্রেরিত ‘বাষ্পীয় জলযানে’ আরোহণ করে পাণ্ডবরা পূর্বদিকে রওনা হয়ে প্রভাতকালে গঙ্গানদীর দক্ষিণতীরে অবতরণ করেছিলেন। তাঁরা মনে করেন যে, সেই জায়গাটা ‘রাজমহলের’ কাছাকাছি কোনও জায়গা ছিল। তারপরে তাঁরা ঘোর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ অতিক্রম করে অবশেষে ‘একচক্রানগরে’ এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই ঘোর জঙ্গল ‘সাঁওতাল পরগনা’র জঙ্গলই হওয়া সম্ভব এবং তা অতিক্রম করেই তাঁরা ‘বীরভূম’ প্রদেশে প্রবেশ করে ‘একচক্রানগরে’ গিয়ে সেখানে বাস করতে শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁরা একদিন ‘পঞ্চালরাজ্যে’ গিয়ে স্বয়ংবর সভা থেকে ‘দ্রৌপদী’কে জয় করেছিলেন। সুতরাং ‘পঞ্চালরাজ্য’ যে ‘একচক্রানগরের’ কাছাকাছি অবস্থিত কোন দেশ ছিল, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। সেই সকল গবেষকদের মতে, পণ্ডিতগণ যে মনে করেন ‘পঞ্চালরাজ্য’ ‘উত্তরপ্রদেশে’ অবস্থিত ছিল, তা ভুল বলেই মনে হয়। কারণ, সেই মতবাদ ‘পাণিনি’র ‘কাশিকা’ টীকার বিরোধী, ‘কাশিকা’ টীকায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ‘পঞ্চালরাজ্য’ - ‘বিদেহ’, ‘অঙ্গ’ ও ‘বঙ্গের’ সঙ্গে ‘প্রাচ্যদেশে’ অবস্থিত। বিতর্ক যাই থাকুক, সেই সব ঘটনা যে বৈদিক যুগের আগেই ঘটেছিল, মহাভারতে বর্ণিত ঘটনাবলী সেটার সাক্ষ্য বহন করে। এর স্বপক্ষে আরও কিছু কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রথমতঃ, নারীর ‘বহুপতিগ্রহণ’ ‘বৈদিক ও বেদোত্তর যুগে’ প্রচলিত ছিল না। ‘জটিলা’র বহুপতিগ্রহণ আর্যদের ‘পঞ্চনদে’ আসবার আগেকার ইতিহাসের ঘটনার প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়। দ্বিতীয়তঃ, মহাভারত অনুযায়ী, পাণ্ডবেরা প্রথমে ‘দ্রৌপদী’কে স্বয়ংবরসভা থেকে জয় করে এনে বহুদিন স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করেছিলেন। তারপর তাঁরা ‘দ্রুপদরাজা’র গৃহে আবার গিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দ্রৌপদী’কে বিবাহ করবার জন্য। বর্তমানে এটা সকলেরই জানা আছে যে, মহাভারতের মধ্যে বহু ‘প্রক্ষিপ্ত’ অংশ আছে। পাণ্ডবদের পরে ‘দ্রুপদ’রাজার গৃহ গিয়ে ‘দ্রৌপদী’কে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করার কাহিনীটি সেই ধরণের ‘প্রক্ষিপ্ত’ অংশ বলেই মনে হয়। ‘ডঃ অতুল সুর’ তাঁর ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন যে, ‘বেদোত্তর যুগে’ যখন ‘সপ্তপদীগমন’ ও বিবাহের অন্যান্য অনুষ্ঠানের প্রবর্তন ঘটেছিল, তখনই সেটাকে কালোপযোগী করবার জন্য, সেই অংশ মহাভারতের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়েছিল। এই সব ঘটনা থেকে গবেষকদের একাংশ মনে করেন যে, ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’র সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবদের সম্বন্ধ কোন অলীক কিছু নয়, এবং মহাভারতের মূলকাহিনী ‘তাম্রাশ্ম যুগের’ সমকালীন ও ‘প্রাক্-আর্য যুগের’। ‘মহাভারতীয় যুগের কাল’ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে নানা মত প্রচলিত আছে। কিন্তু কোন ধরণের বাদবিতণ্ডার মধ্যে প্রবেশ না করেও এক সহজ উপায়ে মহাভারতের কাল নিরূপণ করা যেতে পারে। ‘বৃহৎসংহিতা’র গণনানুসারে ‘৬৫৩ কল্যব্দে’ পাণ্ডু পুত্র ‘যুধিষ্ঠিরের’ রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। বর্তমানে (১৪২৮ বঙ্গাব্দ) ‘৫১২২ কল্যব্দ’ চলছে। সুতরাং সেই হিসাব অনুযায়ী যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেকের সময় ছিল ৪৪৬৯ বছর আগে বা ‘খ্রীস্টপূর্ব ২৪৮৪ অব্দে’। সেটা ‘তাম্রাশ্ম-যুগের’ সমকালীন হয়। এই বিষয়ে, বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘C-14’ পরীক্ষায় ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’র বয়স নির্ণীত হয়েছে ‘খ্রীস্টপূর্ব ১০১২ + ১২০’। এটা যে অভ্রান্ত নয়, তা ‘Carlton S. Coon’-রচিত ‘The History of Man’ গ্রন্থের ১৬৭ নং পৃষ্ঠায় লিখিত মন্তব্য পড়লেই বুঝতে পারা যায়। তিনি লিখেছিলেন যে, ‘C-14’ পরীক্ষার জন্য আহৃত দ্রব্য সঙ্গে সঙ্গে ‘polyethylene tube’-এর মধ্যে সীল করে না রাখলে পরীক্ষার ফল ভুল বের হবে। যেহেতু পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে আহৃত যে সব বস্তুর ‘C-14’ পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেগুলো এইভাবে সংরক্ষিত হয়নি, সেই কারণে সেই পরীক্ষায় নির্ণীত বয়সও অভ্রান্ত নয়।

পণ্ডিতমহল ধরেই নিয়েছেন যে, ‘সিন্ধুসভ্যতা’র অপমৃত্যু ঘটেছিল৷ এর জন্য তাঁরা নানারকম কারণও দর্শান। যথা - বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প, বহিরাক্রমণ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের’ সর্বময়কর্তা ‘স্যার জন মার্শালের’ নির্দেশে ১৯২৮-৩১ সালে, একদল গবেষক যখন সেই সম্বন্ধে সন্ধান করেছিলেন, তখন তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন, যে সিন্ধুসভ্যতার আদৌ বিলুপ্তি ঘটেনি। বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প ও ‘বৈদিক বিরোধিতা’ সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে হিন্দুসভ্যতার মধ্যে জীবিত ছিল (‘ক্যালকাটা রিভিউ’, এপ্রিল-মে ১৯৩১ সাল)। তখনই কয়েকজন গবেষক বলেছিলেন যে, রীতিমত খনন কার্য চালালে দেখা যাবে যে সিন্ধুসভ্যতা গঙ্গা উপত্যকার সুদূর প্রত্যন্তদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও আবিষ্কার, তাঁদের সেই উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করেছিল। বাঙালীরা আজও সিন্ধুসভ্যতাকে আঁকড়ে ধরে আছে। প্রমানগুলো বাঙালীর ঠাকুরঘরের দিকে তাকালেই পাওয়া যায়। বাঙালীর ঠাকুরঘরে ব্যবহৃত বাসন-কোশনগুলির মধ্যে - পাথরের থালা, তামার কোশাকুশি প্রভৃতি - সবই ‘তাম্রাশ্ম যুগের’ নিদর্শন। সাম্প্রতিক অতীতে ‘তাম্রাশ্ম যুগের কোশাকুশি’ ‘মহিষদলে’ পাওয়া গিয়েছিল। নিরবচ্ছিন্নভাবে বাঙালী এগুলোকে ‘তাম্রাশ্ম যুগ’ থেকেই ব্যবহার করে আসছে। ‘তাম্রাশ্মযুগের’ সভ্যতার অভ্যুদয়ে তামাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ‘মিশর’ বলা হোক, ‘সুমের’ বলা হোক, বা ‘সিন্ধু উপত্যকা’ বলা হোক - সর্বত্রই সভ্যতার প্রথম প্রভাতে তামার ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ঐতিহাসিকরা সহজেই অনুমান করতে পারেন যে, ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতা’র উন্মেষ এমন কোন জায়গায় হয়েছিল, যেখানে তামা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখানে সেখানে অবশ্য তামা সামান্য কিছু কিছু পাওয়া যেত, কিন্তু তা নগণ্য। বাঙলাই ছিল সে যুগের তামার প্রধান আড়ত। তামার সবচেয়ে বৃহত্তর খনি ছিল বঙ্গদেশে। বাঙলার বণিকেরাই ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ পার হয়ে, সেই তামা নিয়ে সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রসমূহে বিপণনের জন্য যেতেন। সেজন্যই সেই সময়ের বাঙলার সবচেয়ে বড় বন্দর নগরের নাম ছিল ‘তাম্রলিপ্ত’। সেই তামা সংগৃহীত করা হত, ‘ধলভূমে’ অবস্থিত তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম তাম্রখনি থেকে। সিন্ধুসভ্যতার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ‘মাতৃদেবী’র ও ‘আদি-শিবের’ পূজা। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায়, মাতৃদেবীর পূজার প্রাবল্য বঙ্গদেশেই সব চেয়ে বেশী পরিমানে দেখতে পাওয়া যায়৷ এটা ‘মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার যুগ’ থেকে চলে এসেছে। ‘মহেঞ্জোদারো’, ‘হরপ্পা’ প্রভৃতি নগরে, ঐতিহাসিকেরা মাতৃদেবীর পূজার নিদর্শনরূপে পেয়েছিলেন মাতৃকাদেবীর বহু মৃন্ময়ী ক্ষুদ্রকায়া মূর্তি। সেই একই ধরণের মূর্তি বঙ্গদেশেও বর্তমান কাল পর্যন্ত তৈরি হয়ে আসছে। তবে সেগুলি সাধারণতঃ বাচ্চাদের খেলার পুতুল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেই ধরণের পুতুলগুলিকে ‘কুমারী পূতুল’ বলা হয়। এই নামটা খুব অর্থপূর্ণ। কেননা ‘মহেঞ্জোদারো’, ‘হরপ্পা’ ও সমসাময়িক সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে মাতৃদেবী ‘কুমারী’ (virgin goddess) হিসাবে পূজিতা হতেন। দুর্গাপূজার ‘মহাষ্টমী’র দিন বাঙালী কন্যাদের ‘কুমারী পূজা’ সেটারই স্মৃতি নিদর্শন। যদিও ‘তাম্রাশ্মযুগে মাতৃদেবী’ ‘কুমারী’ হিসাবে পরিকল্পিত হতেন, তবুও তাঁর ‘ভর্তা’ ছিল। সেই ‘ভর্তা’র প্রতিকৃতি ঐতিহাসিকরা ‘মহেঞ্জোদারো’তে পেয়েছিলেন। তাঁকে ‘পশুপতি’ শিবের আদিরূপ বলা হয়েছে। শিব যে একজন প্রাগার্য দেবতা, সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। তবে সে সম্পর্কে যেটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা হল, বঙ্গদেশে শৈবধর্মের প্রাধান্য। বস্তুতঃ বাঙলায় যত শিব মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, তত আর  অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। সুতরাং ‘শিব ও শক্তিপূজা’ যে ‘মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার কাল’ থেকেই চলে এসেছে, সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। সিন্ধুসভ্যতার অনুরূপ সভ্যতা ‘সুমেরে’ও পাওয়া গিয়েছে। সুমেরের প্রাচীন কিংবদন্তী অনুযায়ী সুমেরের লোকরা পূর্বদিকের কোন পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসেছিল। সে জায়গাটা কোথায়? বিখ্যাত ইতিহাসকার ‘হল’ (Hall) সাহেব বলেছিলেন যে, সুমেরের লোকরা ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছিল। এই সম্বন্ধে ‘যোগিনীতন্ত্রে’ উল্লিখিত ‘সৌমার’ দেশের সঙ্গে ‘সুমের’-এর বেশ শব্দগত সাদৃতা ও সঙ্গতি পাওয়া যায়। ‘সৌমার’ দেশ সম্বন্ধে ‘যোগিনীতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে - “পূর্বে স্বর্ণনদী যাবৎ করতোয়া চ পশ্চিমোদদক্ষিণে মন্দশৈলশ্চ উত্তরে বিহগাচল/ অষ্টকোণম্ চ সৌমারম্ যত্র দিক্করবাসিনী।” অর্থাৎ ‘দিক্করবাসিনী’র আবাসস্থল ‘সৌমার’ ‘অষ্ট কোণাকৃতি দেশ’, যার সীমারেখা হচ্ছে পূর্বে ‘স্বর্ণ নদী’ (সুবর্ণসিরি), পশ্চিমে ‘করতোয়া’ নদী, দক্ষিণে ‘মন্দ পর্বতসমূহ’ (মুণ্ডাজাতি অধ্যুষিত পর্বতমালা) ও উত্তরে ‘বিহগাচল’ (হিমালয়)। সুমেরের লোকেরা যে প্রাচ্যভারত থেকে গিয়েছিল এবং তাঁদের নতুন উপনিবেশের নাম আগত দেশের নাম অনুযায়ী করেছিল (এই ধরণের নামকরণ পদ্ধতি অতি প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত আছে), মাতৃ-পূজাই সেটার প্রমাণ। বাঙলার ও সুমেরের মাতৃদেবীর কল্পনার মধ্যে অদ্ভুত কিছু সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে - (১) উভয় দেশেই মাতৃদেবী ‘কুমারী’ হিসাবে কল্পিত হতেন, অথচ তাঁর ‘ভর্তা’ ছিল, (২) উভয় দেশেই মাতৃদেবীর বাহন ‘সিংহ’ ও তাঁর ভর্তার বাহন ‘বৃষ’, (৩) উভয় দেশেই মাতৃদেবী তাঁর নারীসুলভ কর্ম ছাড়া, পুরুষোচিত কর্ম (যেমন যুদ্ধাদি) করতে সক্ষম ছিলেন। সুমেরের লিপিসমূহে পুনঃপুনঃ তাঁকে ‘যুদ্ধবাহিনীর নেত্রী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে৷ ভারতেও - ‘মার্কণ্ডেয়পুরাণ’-এর ‘দেবীমাহাত্ম্য’ অংশে বর্ণিত হয়েছে যে, দেবতারা অসুরগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে মাতৃদেবীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন, এবং তাঁর সাহায্যেই অসুরাধিপতি ‘মহিষাসুর’ নিহত হয়েছিলেন। (৪) সুমেরে মাতৃদেবীর সঙ্গে পর্বতের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। তাঁকে পুনঃপুনঃ ‘পর্বতের দেবী’ বলা হয়েছে। ভারতেও মাতৃদেবীর - ‘পার্বতী’, ‘হৈমবতী’, ‘বিন্ধ্যবাসিনী’ প্রভৃতি নাম সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (৫) উভয় দেশেই ধর্মীয় আচরণ হিসাবে নারীরা সাময়িকভাবে তাঁদের ‘সতীত্ব’ বিসর্জন দিতেন। এই সম্পর্কে ভারতে ‘কুলপূজা’য় অনুরূপ আচরণ লক্ষ্যণীয়। ‘গুপ্তসংহিতা’য় স্পষ্টই বলা হয়েছে - “কুলশক্তিম বিনা দেবী যো জপেৎ স তু পামর।” আবার ‘নিরুত্তরতন্ত্রে’ বলা হয়েছে - “বিবাহিতা পতিত্যাগে দূষণম ন কুলার্চনে।” (‘ক্যালকাটা রিভিউ’, এপ্রিল-মে ১৯৩১ সাল)। তবে বাঙালীরা যে কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচীত্যেই শক্তিপূজার বীজবপন করেছিল, তা নয়। তাঁরা ‘শক্তিপূজা’কে ভূমধ্যসাগরের ক্ষুদ্র ‘ক্রীটদ্বীপ’ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কেননা, ‘ক্রীটদেশে’ও মাতৃদেবীর বাহন ছিল ‘সিংহ’। এছাড়া ‘ক্রীটদেশে’ প্রচলিত লিপি ও বাংলার পাঞ্চমার্ক যুক্ত মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপির মধ্যে সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। উভয় দেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের নারীরা যে তাঁদের দেহের উর্ধাংশ অনাবৃত রাখতেন, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। বিভিন্ন সীলমোহর ও বিভিন্ন বিদেশী লেখকের লেখা প্রাচীন গ্রন্থ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ‘গঙ্গারিডি’র বাঙালী বীরদের সেখানে একটা উপনিবেশ ছিল ও সেখানে তাঁরা শিবের আরাধনা ও কালীর পূজা করতেন। ঐতিহাসিকরা ‘মহেঞ্জোদারো’য় হস্তীর প্রতিকৃতি পেয়েছিলেন। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে নিবন্ধিত কিংবদন্তী অনুযায়ী হস্তী প্রাচ্যভারতের ‘পালকাপ্য’ মুনি কর্তৃক বশীভূত জন্তু। তিনিই হস্তীকে প্রথম বশ করেছিলেন ও ‘হস্তীবিদ্যা’ সম্বন্ধে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই বিষয়ে, ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ও তাঁর একটি প্রবন্ধে বিশদে আলোচনা করেছিলেন। ‘পালকাপ্য’ মুনি নিজের যে পরিচয় দিয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে - “হিমালয়ের নিকটে যেখানে লৌহিত্য নদ সাগরাভিমুখে যাইতেছে সেখানে সামগায়ন নামে এক মুনি ছিলেন; ঔরসে ও এক করেণুর গর্ভে আমার জন্ম। আমি হস্তীদেড় সহিত ঘুরিয়া বেড়াই, তাহারাই আমার আত্মীয়, তাহারাই আমার স্বজন। আমার নাম পলিকাপ্য।” সুতরাং পালিত পশু হিসাবে হাতীর আদি নিবাস বঙ্গদেশ ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কিছু নেই। ‘মহেঞ্জোদারো’য় হাতীর প্রতিকৃতির উপস্থিতি বঙ্গদেশের সঙ্গে ওই সভ্যতার সম্পর্ককে সুচিত করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ‘মহেঞ্জোদারো’র ওই হাতীর প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার পাঞ্চমার্কযুক্ত মুদ্রায় উৎকীর্ণ হাতীর বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায়। আরও অনেক জিনিস সিন্ধুউপত্যকায় বাঙালীরা নিয়ে গিয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল - ‘চাল ও মাছ ধরবার বঁড়শি’। ‘চাল ও মাছ’ - এই দুটোই বাঙালীর প্রিয় খাদ্য, আজকের থেকে নয়, সেই প্রাচীন যুগ থেকে। ধানের চাষ যে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের কোন জায়গায় শুরু হয়েছিল - সেই সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। ‘কারলো চিপোলো’ তার ‘দ্যা ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ওয়ার্ল্ড পপুলেশন’ পুস্তকে এই মত প্রকাশ করেছিলেন। ‘পরেশ দাশগুপ্ত’ তাঁর ‘একস্স্ক্যাভেশনস অ্যাট পাণ্ডুরাজাস ঢিবি' গ্রন্থে বলেছিলেন যে ধানের চাষ প্রথমে বাঙলাতেই শুরু হয়েছিল, এবং বাঙলা থেকে তা ‘চীন’ দেশে গিয়েছিল।


(ক্রমশঃ)

                                      

(তথ্যসূত্র:

১- History & Culture of Bengal, A. K. Sur.

২- ভারতের বিবাহের ইতিহাস, ডঃ অতুল সুর।

৩- The History of Man, Carlton S. Coon.

৪- ক্যালকাটা রিভিউ, এপ্রিল-মে ১৯৩১।

৫- বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন, ডঃ অতুল সুর।

৬- বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়।

৭- বাঙ্গলার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

৮- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।)

                                    




(শেষ পর্ব)

                                                                                

পশুপালন ও চাষবাস মানুষকে বাধ্য করেছিল স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে। এর ফলে গ্রাম্য-সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল। সেটা ‘নবোপলীয় যুগে’ই প্রথম আরম্ভ হয়েছিল৷ কেননা, ‘প্রত্নপলীয় যুগের’ লোকেরা যাযাবরের জীবন যাপন করত৷ সুতরাং সভ্যতার সূচনা কোথায় হয়েছিল, সেই সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে হলে, প্রথমে নির্ণয় করতে হবে যে, ‘নবোপলীয়’ সভ্যতার উৎপত্তিকেন্দ্র ঠিক কোথায় ছিল। কিছুকাল আগে পর্যন্ত পণ্ডিতমহলে (অবশ্য এখনও অনেক পণ্ডিত একই ভ্রান্ত মত পোষণ করেন) যে মত প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল, তা হচ্ছে, আজ থেকে প্রায় আট-নয় হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের ‘জারমো’, ‘জেরিকো’ ও ‘কাটাল হুয়ুক’ নামক জায়গাগুলিতেই ‘নবোপলীয়’ সভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল, এবং সেটা বিকশিত হয়ে ক্রমশঃ ‘ইরানীয় অধিত্যকা’ ও ‘মধ্য এশিয়া’র দিকে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু আরও পরেকার আবিষ্কারের ফলে জানা গিয়েছিল যে, তার চেয়ে আরও আগে ‘নবোপলীয়’ সভ্যতার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল ‘থাইল্যাণ্ডে’। গবেষক ‘রোন্যাল্ড শিলার’ সেই সভ্যতার বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন। ‘সি. ও সয়ার’ তাঁর ‘এগ্রিকালচারাল অরিজিনস্ অ্যান্ড ডিসপারসাল’ নামক গ্রন্থেও বলেছিলেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই ‘নবোপলীয়’ বিপ্লবের সবচেয়ে প্রাচীন লীলাভূমি ছিল বলে তাঁর মনে হয়। ‘নবোপলীয় সভ্যতা’র পরের যুগেই ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতা’র অভ্যুদয় ঘটেছিল। ‘হরপ্পা’ নগরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে, ঐতিহাসিকেরা ‘নবোপলীয় যুগ’ থেকে শুরু করে পরিণত ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতা’র বিকাশের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যতে এবং ‘থাইল্যাণ্ডে’ যেমন স্বতন্ত্রভাবে ‘নবোপলীয় সভ্যতা’র অভ্যুদয় ঘটেছিল, ঠিক সেই ভাবেই ভারতেও ‘নবোপলীয় সভ্যতা’ স্বতন্ত্রভাবেই উদ্ভূত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ‘প্রত্নপলীয় যুগ’ থেকে ‘নবোপলীয় যুগ’ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতা, ঐতিহাসিকেরা ভারতেও লক্ষ্য করেছেন। ঐতিহাসিকেরা সেই ধারাবাহিকতা বঙ্গদেশেও লক্ষ্য করেছিলেন। ঐতিহাসিকেরা ‘প্রত্নপলীয় যুগের’ আয়ুধসমূহ বাঙলার নানা জায়গা থেকে পেয়েছিলেন। সেই সব জায়গার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে - মেদিনীপুর জেলার ‘অরগণ্ডা’, ‘শিলদা’, ‘অষ্টজুড়ি’, ‘শহারি’, ‘ভগবন্ধ’, ‘কুকড়াধুপি’, ‘গিডনি’ ও ‘চিলকিগড়’; বাঁকুড়া জেলার ‘কাল্লা লালবাজার’, ‘মনোহর’, ‘বন অসুরিয়া’, ‘শহরজোড়া’, ‘কাঁকড়াদাড়া’, ‘বাউড়িডাঙা’, ‘ঝাড়গ্রাম’, ‘শুশুনিয়া’ ও ‘শিলাবতী’ নদীর প্রশাখা ‘জয়পাণ্ডা’ নদীর অববাহিকা; বর্ধমান জেলার ‘গোপালপুর’, ‘সাতখনিয়া’, ‘বিলগভা’, ‘সাগরডাঙা’, ‘আরা’ ও ‘খুরুপি’র জঙ্গল। পুরুলিয়ার ‘ঝালদা’ অঞ্চলে ‘হেলামু’ গুহার আশপাশ থেকে পাওয়া গিয়েছিল ‘প্রত্নপলীয় যুগের’ মানুষের আয়ুধ। অধুনা বাংলাদেশের ‘কুমিল্লা’ জেলায় ‘ময়নামতী’ থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণে ‘লালমাই’ পাহাড়ের মধ্যে প্রস্তরযুগের মানুষের ব্যবহার করা ৫০টির ওপরে প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছিল। বাঁকুড়া জেলার ‘শুশুনিয়া’ থেকে ঐতিহাসিকেরা যে সব জীবের অশ্মীভূত কঙ্কালাস্থি পেয়েছিলেন, সেগুলোর গুরুত্ব এই সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি। সেগুলি ‘প্লাইস্টোসীন’ যুগের, অর্থাৎ যে যুগে পৃথিবীতে প্রথম মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল - সেই যুগের। আগেই বলা হয়েছে যে (প্রথম পর্বে) মানুষের বিবর্তন ঘটেছিল পূর্বগামী নরাকার জীব থেকে। ঐতিহাসিকেরা সেই ধরণের নরাকার জীবের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পেয়েছিলেন এশিয়ার তিন জায়গা থেকে। সেই জায়গাগুলি হচ্ছে - ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ‘শিবালিক গিরিমালা’, ইন্দোনেশিয়ার ‘জাভা’ ও চীনদেশের ‘চুংকিঙ’। সেই তিনটি স্থানবিন্দুকে একটি সরলরেখার দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বঙ্গদেশ সেটার কেন্দ্রস্থলে পড়ে৷ সুতরাং ওই ধরণের জীবসমূহ যে বঙ্গদেশেও ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। সেই সব জীব থেকেই প্রকৃত মানবের (homo sapiens) বিবর্তন ঘটেছিল। সুতরাং বঙ্গদেশেও যে প্রকৃত মানবের যে বিবর্তন ঘটেছিল, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এর প্রমাণ স্বরূপ বলা যায় যে, ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে, ‘রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ’, মেদিনীপুর জেলার ‘রামগড়ের’ অদূরে ‘কংসাবতী’ নদীর বাঁ তীরে অবস্থিত ‘সিজুয়া’ নামক জায়গা থেকে একটি মানব চোয়ালের অশ্মীভূত ভগ্নাংশ পেয়েছিল (কার্বন পরীক্ষায় নির্ণীত বয়স ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। ভারতে আজ পর্যন্ত প্রাচীন প্রকৃত মানবের অশ্মীভূত যত নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সেটাই ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। সুতরাং ‘হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো’র অনেক আগে থেকেই বঙ্গদেশে যে প্রকৃত মানবেরা বাস করত এবং তাঁরা যে ‘প্রত্নপলীয় যুগের’ কৃষ্টির ধারক ছিল, সেটাই প্রমাণিত হয়। ‘প্রত্নপলীয় যুগ’ ও ‘নবোপলীয় যুগের’ মধ্যকালীন যুগের কৃষ্টিকে ‘মেসোলিথিক (mesolithic) কালচার’ বলা হয়। ‘মেসোলিথিক’ কৃষ্টির প্রচুর নিদর্শন, ‘ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ’, ১৯৫৪-৫৭ সালে বর্ধমান জেলার ‘বীরভানপুর’ থেকে আবিস্কার করেছিল। ‘মেসোলিথিক’ যুগের পরেই ‘নবোপলীয়’ যুগের উদ্ভব হয়েছিল। সেই যুগেই মানুষ প্রথম কৃষি, পশুপালন, বয়ন, মৃৎপাত্র নির্মাণ ও স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিল। সেই ‘নবোপলীয়’ যুগের বৈশিষ্ট্যমূলক একটি আয়ুধ ছিল মসৃণ ‘পরশু’। ঐতিহাসিকেরা সেই ধরণের ‘পরশু’ পেয়েছিলেন - বাঁকুড়া জেলার ‘বন অসুরিয়া’, ‘কাচিণ্ডা’ ও ‘জয়পাণ্ডা’য়; মেদিনীপুর জেলার ‘অরগণ্ডা’, ‘কুকড়াধুপি’, ‘তারাফেনি’ ও ‘দুলুঙ’ নদীর মোহনায় ও ‘কংসাবতী’ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ‘কাঁকড়াদাড়া’ থেকে। এছাড়া ঐতিহাসিকেরা ‘নবোপলীয়’ যুগের ‘পরশু’, উত্তরে ‘কালিমপঙ’ থেকেও প্রচুর পরিমাণে পেয়েছিলেন। সুতরাং ‘প্রত্নপলীয়’ যুগ থেকে ‘নবোপলীয়’ যুগের বিবর্তন যে বঙ্গদেশে স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছিল, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

                                     

‘নবোপলীয়’ যুগের গ্রামীণ সভ্যতাই পরবর্তীকালে ‘তাম্রাশ্ম’ যুগের নগরসভ্যতায় বিকশিত হয়েছিল। যেহেতু তামার সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার বঙ্গদেশেই ছিল, তা থেকে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, সেই বিবর্তন বঙ্গদেশেই ঘটেছিল, এবং বাঙলার বণিকেরাই অন্যত্র তামা সরবরাহ করে সেই সব জায়গায় ‘তাম্রাশ্মযুগের নগরসভ্যতা’ গঠনে সাহায্য করেছিল। এটা সম্ভবতঃ মেদিনীপুরের লোকেদের দ্বারাই সাধিত হয়েছিল। কারণ, অতীতে মেদিনীপুরের লোকেরা যে সামুদ্রিক বাণিজ্যে বিশেষ পারদর্শী ছিল, সেটার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ওই জেলার ‘পান্না’ গ্রাম থেকে। সেই গ্রামের (‘ঘাটালের’ থেকে ছয় মাইল দক্ষিণে) একটি পুকুর খনন করার সময়, ৪৫ ফুট গভীর তল থেকে পাওয়া গিয়েছিল, সমুদ্রগামী একটি নৌকার কঙ্কালাবশেষ। বঙ্গদেশে যে এক বিশাল ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতার’ অভ্যুদয় ঘটেছিল, সেটা ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে জানতে পেরেছিলেন। ১৯৭৬ সালে, মেদিনীপুর জেলার ‘গড়বেতা’ থানার ‘আগাইবনি’তে, ৪০ ফুট গভীর মাটির তলা থেকে ঐতিহাসিকেরা পেয়েছিলেন - তামার একখানা সম্পূর্ণ ‘পরশু ও অপর একখানা প্রমাণ আকৃতির ‘পরশু’র ভাঙা মাথা, ছোট আকৃতির আধভাঙা আর একটি ‘পরশু’, এগারোটি তামার বালা এবং কয়েকটি ক্ষুদ্রকায় তামার চাঙারী। পুরাতাত্ত্বিক ‘দেবকুমার চক্রবর্তী’র মতে, সেগুলি ‘হরপ্পা’র পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক কোন মানব-গোষ্ঠীর ছিল। ১৮৮৩ সালে, মেদিনীপুরের ‘বিনপুর’ থানার অন্তর্গত ‘তামাজুড়ি’ গ্রামেও তাম্র-প্রস্তর যুগের অনুরূপ নিদর্শনসমূহ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৬ সালে, সেই জেলারই ‘এগরা’ থানার ‘চাতলা’ গ্রামে আরও ওই ধরনের কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে পুরুলিয়া জেলার ‘কুলগড়া’ থানার ‘হাড়া’ গ্রামেও কিছু কিছু ওই ধরনের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। ওই একই ধরণের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, ১৯৬০ সাল নাগাদ, ‘মধ্যপ্রদেশের’ ‘রেওয়া’ জেলার ‘পাণ্ডিগাঁয়ে’ পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল, ঠিক ‘আগাইবনি’র ধরনের ৪৭টি তামার বালা ও পাঁচটি ‘পরশু’। সেই সব থেকে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেছিলেন যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার পরিযান (migration) পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ঘটেছিল। আগেই বলা হয়েছে যে (প্রথম পর্বে), বাঙলার ‘তাম্রাশ্ম’ সভাতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল - বর্ধমান জেলার ‘অজয়’নদের তীরে অবস্থিত ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’ থেকে। ‘অজয়’, ‘কুন্নুর’ ও ‘কোপাই’ নদীর উপত্যকার অন্যত্রও, ঐতিহাসিকেরা সেই সভ্যতার পরিচয় পেয়েছিলেন। ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’র দ্বিতীয় যুগের লোকেরাই ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতা’র বাহক ছিল। তাঁরা স্বপরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তৈরি করত। তাঁরা গৃহ ও দুর্গ - এই উভয়ই নির্মাণ করতে জানত। তাঁরা তামার ব্যবহার জানত। কৃষি ও বৈদেশিক বাণিজ্য তাঁদের অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল। তাঁরা ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করত এবং পশুপালন ও কৃম্ভকারের কাজও জানত। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শয়ন করিয়ে তাঁরা মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করত এবং ‘মাতৃকাদেবী’র পূজা করত। সেই সব নিদর্শন থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সুদূর অতীতে ‘পুরুলিয়া’-’মেদিনীপুর’-’বাঁকুড়া’-’বর্ধমান’ অঞ্চল জুড়ে এক সমৃদ্ধিশালী ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতা’ গড়ে উঠেছিল। খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে ঐতিহাসিকেরা সেই লুপ্ত সভ্যতার মাত্র সামান্য কিছু আভাস পেয়েছিলেন। ‘তাম্রাশ্মযুগ’ থেকেই বাঙালী ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমুহের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। সেই বাণিজ্য খ্রীস্টজন্মের পর পর্যন্ত বলবৎ ছিল এবং ঐতিহাসিকেরা সেটার বহুল প্রমাণ ‘পূর্ব মেদিনীপুর’ ও ‘উভয় চব্বিশ পরগনা’য় পেয়েছিলেন। বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিকেরা যদি - ‘হরপ্পা’, ‘মহেঞ্জোদারো’, ‘লোথাল’, ‘কালিবঙ্গান’ প্রভৃতি জায়গার মত প্রণালীবদ্ধভাবে রীতিমতো খননকার্য চালাতেন (অবশ্যই সদিচ্ছা নিয়ে), তা হলে নিশ্চয়ই জানতে পারা যেত যে, ‘তাম্রাশ্ম সভ্যতা’র উন্মেষ আদতে বঙ্গদেশেই ঘটেছিল ও বাঙলাই সেই সভ্যতার জন্মভূমি ছিল।

                               

(তথ্যসূত্র:

১- History & Culture of Bengal, A. K. Sur.

২- ভারতের বিবাহের ইতিহাস, ডঃ অতুল সুর।

৩- The History of Man, Carlton S. Coon.

৪- ক্যালকাটা রিভিউ, এপ্রিল-মে ১৯৩১।

৫- বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন, ডঃ অতুল সুর।

৬- বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়।

৭- বাঙ্গলার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

৮- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।)

                                      

No comments