Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সিমুলিয়ার দত্তবংশ’ রানা চক্রবর্তী

কলকাতা শহরের ‘শিমলা’ বা ‘সিমুলিয়া’ পল্লীর প্রসিদ্ধ দত্ত পরিবারে নরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম হয়েছিল। সেই পরিবারটি পুরুষানুক্রমে সুশিক্ষিত, সঙ্গতিসম্পন্ন ও বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ছিল। সেই পরিবারটির আদি নিবাস ছিল ‘বর্ধমান’ জেলার অন্তর্গত…

 






                                            

কলকাতা শহরের ‘শিমলা’ বা ‘সিমুলিয়া’ পল্লীর প্রসিদ্ধ দত্ত পরিবারে নরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম হয়েছিল। সেই পরিবারটি পুরুষানুক্রমে সুশিক্ষিত, সঙ্গতিসম্পন্ন ও বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ছিল। সেই পরিবারটির আদি নিবাস ছিল ‘বর্ধমান’ জেলার অন্তর্গত ‘কালনা’ মহকুমার ‘দেরেটোন’ (বা ‘দেরিয়াটোনা’) গ্রামে, এবং সেই পরিবারের ‘রামনিধি দত্ত’ গ্রাম ছেড়ে কলকাতার ‘গড় গোবিন্দপুরে’ বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। পরে ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’ ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ নির্মাণের জন্য ‘গোবিন্দপুর’ অধিগ্রহণ করলে, ‘রামনিধি ও তাঁর পুত্র ‘রামজীবন’ ‘শিমুলিয়ার মধু রায় লেনে’ একটি নতুন পাকা বাড়ী তৈরি করে সেখানে উঠে যান। স্বামিজীর পিতা বিশ্বনাথ দত্তের বিবাহের পরে সেই বাড়ীটি শরিকরা একযোগে বিক্রি করে দিয়েছিলেন (Swami Vivekananda by Dr. Bhupendra Nath Dutta)। নরেন্দ্রনাথের প্রপিতামহ ‘রামমোহন দত্তের’ (রামনিধি দত্তের প্রপৌত্র) আমলে সেই বংশের গৌরব সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল৷ ‘রামমোহন’ একজন আইনজ্ঞ ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন ইংরেজ এটর্নির ম্যানেজিং ক্লার্ক ও সহকর্মী হিসাবে কাজ করতেন। ঐ কাজ করে তিনি অতি অল্প বয়সে প্রভূত ধন-সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর (শিমলা পল্লীর মধু রায় লেনের) পৈতৃক বাড়ীর কাছে ‘গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীটে’ একটি সাবেক ধরনের প্রাসাদোপম বাড়ী তৈরি করে সেখানেই বাস করতে শুরু করেছিলেন। আগে সেই বাড়ীর প্রশস্ত প্রবেশ দ্বার, সুবৃহৎ উঠোন, পূজা-দালান, গোশালা, অন্দর মহলের দোতলা বাসগৃহ ও মহিলাদের স্নানের পুকুর ইত্যাদি অনেক কিছুই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিবারটির দুরবস্থার সময়ে বাড়িটির অনেকটা অংশ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ‘রামমোহন’ গৌরবর্ণ সুশ্রী পুরুষ ছিলেন। এবং তিনি বহু আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ‘ওলাউঠা’ রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর সময় তিনি ‘দুর্গাপ্রসাদ’ ও ‘কালীপ্রসাদ’ নামে তাঁর দুটি নাবালক পুত্র, কয়েকটি কন্যা ও প্রচুর অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ এবং ‘মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম’ থেকে প্রকাশিত ‘Life of Swami Vivekananda’ গ্রন্থে রামমোহন দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ‘দুর্গাচরণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু স্বামীজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ‘ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত’ তাঁর 'Swami Vivekananda' গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে, তাঁদের ১৮৮৩-৮৪ সালের বণ্টন মোকদ্দমার আর্জিতে তাঁর নাম ‘দুর্গাপ্রসাদ’ বলে লেখা হয়েছিল। দুর্গাপ্রসাদ পিতার মতো গৌরবর্ণ সুপুরুষ ছিলেন। এবং তাঁর মতো তিনিও কোন এটর্নি অফিসে আইনজীবীর কাজ করতেন। তিনি উত্তর কলকাতা নিবাসী দেওয়ান রাজীবলোচন ঘোষের সুশিক্ষিতা ও পরমাসুন্দরী কন্যা ‘শ্যামাসুন্দরী’কে বিবাহ করেছিলেন। শ্যামাসুন্দরীর গর্ভে তাঁর দুটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল। তাঁদের প্রথম সন্তানটি ছিল কন্যা ও মাত্র সাত বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তানটি ছিল পুত্র, ১৮৩৫ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল। সেই পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘বিশ্বনাথ’। সেই বিশ্বনাথই ছিলেন জগদ্বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দের পিতা।


বিশ্বনাথের জন্মের অল্প পরেই এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে দুর্গাপ্রসাদ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস-ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন। তারপরে তাঁর বা তাঁর স্ত্রী শ্যামাসুন্দরীর যে খবরাখবর পাওয়া যায়, সেটা খুবই সামান্য। বিশ্বনাথের যখন তিন বছর বয়স, তখন শ্যামাসুন্দরী তাঁকে নিয়ে তীর্থ করতে নৌকায় কাশী যাত্রা করেছিলেন। পথে শিশু বিশ্বনাথ একদিন সকালবেলা নৌকা থেকে জলে পড়ে গিয়েছিলেন এবং শ্যামাসুন্দরী তাঁর ছেলেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে তাঁকে সবলে ধরে ফেলেছিলেন। কিন্তু সাঁতার না জানায়, তিনি ঐ অবস্থায় বিশ্বনাথ সমেত গঙ্গায় ডুবে যাচ্ছিলেন৷ সেই অবস্থায় কবিরাজ ‘উমাপদ গুপ্ত’ নামে তাঁর এক সহযাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের উভয়কে উদ্ধার করেছিলেন। সেই ঘটনার পরে কাশীধামে পৌঁছে, শ্যামাসুন্দরী সেখানকার দেবমন্দিরগুলো দর্শন করতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। একদিন গঙ্গাস্নান করে তিনি যখন বিশ্বনাথের মন্দিরে যাচ্ছিলেন তখন একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছিল। মন্দিরের কাছে জল ভেজা পথের উপরে পা পিছলে পড়ে গিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তখন একটি পথচারী সাধু তাঁকে ধরে তুলে মন্দিরের চাতালের উপরে রেখেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে শ্যামাসুন্দরী যখন চোখ খুলে তাকিয়েছিলেন তখন বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছিলেন, যে সাধু তাঁর দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছেন, তিনি আর অন্য কেউ নন, তাঁর স্বামী দুর্গাপ্রসাদ। ততক্ষণে দুর্গাপ্রসাদও তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন এবং “মায়া, মায়া” বলতে বলতে নিমেষের মধ্যেই তাঁর দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিলেন। দুর্গাপ্রসাদ সম্বন্ধে আরও জানা যায় যে, সন্ন্যাসীদের নিয়মানুসারে সন্ন্যাস গ্রহণের বারো বছর পরে (সম্ভবতঃ ৩৬/৩৭ বৎসর বয়সে) তিনি তাঁর জন্মস্থান দর্শনের জন্য একবার কলকাতায় এসে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন। তখন তাঁর সেই বন্ধু (তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও) সেই বিষয়ে গোপনে তাঁর আত্মীয়দের খবর দিয়েছিলেন এবং তাঁরা গিয়ে তাঁকে জোর করে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন ও একটি ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। দুর্গাপ্রসাদ কোন কথা না বয়ে তিন দিন নীরবে ঐ ঘরে ছিলেন বটে, কিন্তু ঐ তিন দিন তিনি কোন খাদ্য স্পর্শ করেননি। শেষে তাঁর মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে শুরু হয়েছিল। তাতে তাঁর আত্মীয়রা শঙ্কিত হয়ে ঘরের তালা খুলে দিয়েছিলেন। তখন সুযোগমত তিনি ঐ বাড়ি ত্যাগ করে চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়েছিলেন। এবং এরপরে তাঁর আর কোন সংবাদই পাওয়া যায়নি। তবে এটা জানা যায় যে, দুর্গাপ্রসাদ গৃহত্যাগ করার পরে শ্যামাসুন্দরীর পারিবারিক জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। সেই সময়, ‘কালীপ্রসাদ’ সংসারের কর্তা হয়ে উঠে পরিবারের বহু সহস্র টাকা নষ্ট করেছিলেন এবং কোন একটা মামলা চালাবার জন্য শ্যামাসুন্দরীর মূল্যবান অলঙ্কারগুলি ধার করে নিয়ে বন্ধক রেখেছিলেন। পরে শ্যামাসুন্দরী সেই অলঙ্কারগুলি ফেরৎ চেয়েও আর ফেরৎ পাননি। এছাড়া, কালীপ্রসাদের কোন উপার্জন না থাকলেও তিনি সংসারের ব্যয় কিছুমাত্র কমান নি। ফলে, যৌথ পরিবারের সঞ্চিত অর্থ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং পরিবারটি তখন শুধু তাঁর কয়েকটি স্থাবর সম্পত্তির সঙ্কীর্ণ আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে কোন মতে চলেছিল। এই সব কারণে কালীপ্রসাদের কর্তৃত্বকালে শ্যামাসুন্দরী, তাঁর পুত্র বিশ্বনাথকে নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা ও কষ্ট-অসুবিধার মধ্যে জীবন যাপন করেছিলেন। তাঁর স্বামী সন্ন্যাসী হবার ১০/১১ বছর পরে তিনি ‘ওলাউঠা’ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিলেন।

                                          

মায়ের মৃত্যুর পরে স্নেহহীন খুড়া-খুড়ীর আশ্রয়ে বিশ্বনাথ এক দারুণ অযত্ন ও অবহেলার মধ্যে পড়েছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও প্রতিভাশালী। তিনি পড়ার জন্য প্রতিদিন খালি পায়ে হেঁটে শিমুলিয়া থেকে ‘আহেরিটোলা’য় গিয়ে স্কুল করতেন। এবং তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত হলে, তিনি এক ইংরেজ এটর্নির অফিসে শিক্ষানবীশ (articled clerk) হয়ে সেখান থেকে এটর্নিশিপ পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টের এটর্নি হয়েছিলেন (১৮৬৬)। এটর্নির ব্যবসায় বিশ্বনাথ খুবই কৃতকার্য হয়েছিলেন। এবং সেখান থেকে তিনি প্রচুর অর্থ রোজগার করতেন। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন সহ সুবৃহৎ যৌথ পরিবার প্রতিপালনের ভার তাঁর উপরে থাকায়, তিনি প্রথম জীবনে টাকা জমাবার কোন সুযোগ পাননি। এবং পরেও তাঁর হাতে টাকা কখনও জমতে পারেনি। তাঁর প্রধান কারণ ছিল, তিনি ছিলেন অমিতব্যয়ী এবং ছোট-বড় সকল কাজেই তিনি অত্যধিক ব্যয় করতেন। এছাড়া, আত্মীয়-বন্ধুদের সম্পর্কে তাঁর ঔদার্যের যেন কোন সীমা ছিল না। বন্ধুদের তিনি প্রায়ই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন এবং তাঁদের বিপদে-আপদে সাহায্য করতেন। জানা যায় যে, তাঁর কোন কোন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়রা তাঁরই অন্নে প্রতিপালিত হয়ে আলস্যে দিন কাটাত ও তাঁরই টাকায় নেশা-ভাঙ্গ করে জীবনের অবসাদ দূর করত। নরেন্দ্রনাথ বড় হয়ে সেই সব অযোগ্য লোককে দান করবার জন্য তাঁর পিতাকে অনুযোগ করলে তিনি তাঁকে বলেছিলেন, “মানুষের জীবনে যে কত দুঃখ তা তুই এখন কি বুঝবি? যখন বুঝতে পারবি তখন ঐ দুঃখ হতে ক্ষণিক মুক্তির জন্যে যারা নেশা-ভাঙ্গ করে তাঁদেরও তুই দয়ার চক্ষে দেখতে পারবি।” সেই অপূর্ব ঔদার্য ছাড়াও, বিশ্বনাথের আরও নানা গুণ ছিল। শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে তিনি খুবই উন্নত ছিলেন। তিনি ইংরেজী, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি, ফারসী, উর্দু ও আরবী - এই সাতটি ভাষা জানতেন৷ ধর্ম ও সামাজিক বিষয়ে তিনি উদার মত পোষণ করতেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-প্রবর্তিত বিধবা-বিবাহের সমর্থক ছিলেন, ‘বাইবেল’ ও ‘দেওয়ান-ই-হাফেজ’ গ্রন্থ শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়তেন ও নরেন্দ্রনাথকেও সেগুলো পড়তে উপদেশ দিতেন এবং মোঘল পদ্ধতিতে পোলাও-মাংস রান্না করে নিজের বন্ধু-বান্ধবদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন। আবার নানা বিষয়ে তিনি (তখনকার আরও অনেকের মতন) ইউরোপীয় রীতি অনুসরণ করে চলতেন৷ বস্তুতঃ তিনি হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টান - এই তিনটি সংস্কৃতির উপরেই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এবং স্বভাবতই তাঁর মধ্যে ঐ সবকিছুর একটা অস্পষ্ট সমন্বয়ের ভাব দেখা যেত। এসব ছাড়াও, সঙ্গীত ও বিভিন্ন কলাবিদ্যার উপরে বিশ্বনাথের খুবই অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে সুকণ্ঠ গায়ক ছিলেন ও ভাল গান গাইতে পারিতেন। এবং জানা যায়, প্রতি শনি-রবিবারে তিনি তাঁর বাড়ীতে গানের আসর বসাতেন এবং সেখানে সমাগত ব্যক্তিদেরকে প্রত্যেক দিনই পোলাও-মাংস রান্না করে খাওয়াতেন। বাহ্যিক আচরণে বিশ্বনাথ ধীর, গম্ভীর ও কিছু রহস্য-প্রিয় ছিলেন। তাঁর পুত্রকন্যাদের কেউ কোন অন্যায় করলে তিনি তাঁকে তিরস্কার না করে তাঁর অপরাধের বিষয়ে তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এমন ভাবে প্রচার করে দিতেন যে, তাতে সে লজ্জা পেয়ে নিজেই নিজেকে সংশোধন করে নিত। একবার নরেন্দ্রনাথ কোন কারণে তাঁহার মাকে কটু কথা বললে, বিশ্বনাথ তাঁর ঘরের দরজার উপরে একখণ্ড কয়লা দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন - “নরেনবাবু তাঁহার মাকে আজ এই এই কথা বলিয়াছেন।” নরেন্দ্রনাথের বন্ধুরা সেই ঘরে ঢুকতে গেলেই সেটা দেখতে পেতেন৷ এর ফলে নরেন্দ্রনাথ তাঁর অপরাধের জন্য বহু দিন পর্যন্ত বিশেষ লজ্জিত ও দুঃখ বোধ করেছিলেন। নরেন্দ্রনাথের মাতা ‘ভুবনেশ্বরী দেবী’ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও অত্যন্ত কর্মঠ ছিলেন। তিনি স্বভাবতঃ কথা কম বলতেন এবং তাঁর সব কাজ ও চলাফেরার মধ্যে ফুটে উঠত ধৈর্য, তেজ ও আভিজাত্যের একটা রাজকীয় গরিমা। জানা যায় যে, সংসারের খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি নানা কাজের গুরুভার তাঁর উপরে ন্যস্ত ছিল এবং তিনি সেগুলো সবই অতি সুচারুভাবে সম্পাদন করতেন। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদাচারী, নিষ্ঠাবতী ও ধর্ম পরায়ণা। তিনি প্রতিদিন নিজের হাতে শিবপূজা ও নিয়মিত জপ-ধ্যান করতেন এবং একই সাথে প্রায়ই উপবাসাদি নানা কৃচ্ছ-সাধনেও রত হতেন। ওই ধরনের কঠোর ধর্মাচরণ ও সংসারের বিপুল কাজকর্ম করেও, তিনি প্রতিদিন সেলাই, বয়ন ও রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করবার সময় করে নিতেন। বিশ্বনাথের মতো ভুবনেশ্বরী দেবীও সঙ্গীত-প্রিয় ও সুকণ্ঠী ছিলেন। এবং মাত্র একবার শুনেই তিনি একটি গান সুর-তাল-লয়ের সঙ্গে আয়ত্ত করতে পারতেন। সেই প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্য তাঁর নিত্যপাঠ্য বাংলা রামায়ণ-মহাভারত তাঁর একধরনের কণ্ঠস্থ ছিল। এবং তিনি ঐ সব বইয়ের গল্প তাঁর পুত্রকন্যাগণের কাছে বর্ণনা করে বাল্যকালেই তাঁদের সেগুলোর শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পরিপুষ্ট করে তুলেছিলেন। এইভাবে বহুগুণান্বিত অসাধারণ পিতা-মাতা থেকে জন্ম-লাভ করে নরেন্দ্রনাথ তাঁর বিধিনির্দিষ্ট বিপুল কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

                                           

(তথ্যসূত্র:

১- Swami Vivekananda, Dr. Bhupendra Nath Dutta.

২- স্বামী বিবেকানন্দ, মানদাশঙ্কর দাশগুপ্ত।

৩- অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ, শংকর।)

                                       

No comments