Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বুদ্ধদেব গুহ স্মৃতিচারণে - নরেশ জানা

আমরা যারা ১৩ বছরে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের চিতা বহ্নিমান কিংবা ১৫ বছরে নিমাই ভট্টাচার্যর মেমসাহেব পড়ে প্রেম মানে শুধুই শূন্যতা বলে শাশ্বত বিরহমার্গে বিচরণ করেছি তখন ১৮ বছরে আমাদের হাত ধরে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন যে মানুষটি তাঁর নাম বু…

 







আমরা যারা ১৩ বছরে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের চিতা বহ্নিমান কিংবা ১৫ বছরে নিমাই ভট্টাচার্যর মেমসাহেব পড়ে প্রেম মানে শুধুই শূন্যতা বলে শাশ্বত বিরহমার্গে বিচরণ করেছি তখন ১৮ বছরে আমাদের হাত ধরে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন যে মানুষটি তাঁর নাম বুদ্ধদেব গুহ। ওনাকে মুখের ওপর সেই কথাটা বলেও ফেললাম একদিন। বললাম, 'আপনি আমাদের যৌনতাকে নির্মাণ করেছেন।' উনি যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, 'সে কী? সে কী রকম?' আলাপটা জমে উঠল এক সময়। তারপর কবে যেন পিতৃসম মানুষটাকে বুদ্ধদা বলে ফেললাম সাহস করেই। আর আমাদের যৌবনের সেই দুরগামী অধরা নক্ষত্রটি চলে এসেছিল হাতের কাছে। এতটাই কাছে যে কতদিন তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়িতে গিয়ে রাতভর আড্ডা মারার আমন্ত্রণ পেয়েছি আমরা ক'জন মিলে। আমি, কমল বিষয়ী, শ্যামল সেন আর আশিস মিশ্র। যে বাঙালির আবেগ সর্বদাই বাস্তবকে উপেক্ষা করে প্রিয়জন মাত্রই চিরজীবী বলে মনে করে থাকে হয়ত সেরকমটাই মনে করে আজ যাব কাল যাব বলে আর যাওয়া হলনা সেই আড্ডায়। তারপর কোভিড কাল, আর তারপর নিঃশব্দ পতন। অথচ কিছুদিন আগেও যখন তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন তখনও কমলের ফোন থেকে কত কথা হল, কথা হল, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়, করোনা কাল শেষ হলেই শান্তিনিকেতন।

         

১৯৮৪-৮৫, মার্কস, এঙ্গেলস, গোর্কি কিনা এডগার স্নোয়ের সাথেই পড়ছি একটু উষ্ণতার জন্য, কোয়েলের কাছে, মহুলসুখার চিঠি। বুকের ভেতরে তির তির করে নিষিদ্ধ অথচ পবিত্র কামনার স্রোত বইয়ে দিচ্ছে ছুটি অথবা সুখী বৌদি। বাংরিপোসি থেকে পালাম হয়ে নেতারহাট ছুটছে আমাদের যৌবন, আমাদের কামনা। নিষিদ্ধ অথচ সম্মতি সাপেক্ষে সে যৌনতায় কোনও আপত্তি শোনার নয়। আমাদের সেই সংহত যৌনতাকে নির্মাণ করছেন বুদ্ধদেব গুহ। আমরা ভেতরে ভেতরে গলছি মোমের মত, গলিয়ে দিচ্ছে নরম দুটি কবুতর ছানা। প্রায় ৩০বছর পর যখন তাঁর কাছে বসে তাঁর প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে এই প্ৰণত উত্তর রাখছি, মুখে জর্দা ঠাসা পান গলিয়ে তিনি হাসছেন মিটমিট করে। বলছেন, অত ভেবে তো লিখিনি ভাই।

         

তারও বছর পনের আগে, ঠিক হল 'আপনজন' কয়েক মাসের জন্য দৈনিক হবে। আমি একটি ইংরাজি দৈনিকে। তমালিকা দি বললেন, হলদিয়ায় এসে থাকো, দৈনিকটা তোমাকেই দেখতে হবে। খড়গপুর থেকে মাস দেড়েকের জন্য উৎসব ভবনে চলে এলাম।সকালে উঠেই আমার প্রথম কাজটিই হল বিখ্যাত বাঙালিদের একেক জনকে ফোন করে হলদিয়া সম্পর্কে কিছু বলানো। তো একদিন তাঁকেই ফোনটা করে ফেললাম। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনেই বুকটা কেঁপে উঠল যেন। সেই জলদ গম্ভীর গলা! ঠিক যেমনটা মনে মনে কল্পনা করেছিলাম। ততদিনে তমালিকা পন্ডা শেঠের উদ্যোগে বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসব বাংলা ছাড়িয়ে বৃহত্তর বাংলায় পৌঁছে গেছে। বন্দর আর শিল্পের বাইরে বাইরে হলদিয়ার আরও একটি পরিচিতি সাংস্কৃতিক শহর হিসাবে। এক ফোনেই গড়গড়িয়ে বলে গেলেন অনেক কিছু। বললেন কলকাতা আর শান্তিনিকেতনের বাইরে আমার আরেকটা বাড়ি হলদিয়া। সম্ভবতঃ সেই শিরোনামেই লেখাটা বের হয়েছিল।

            

২০১৫ থেকে তাঁর আরও একটু কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হল। তারপর কবে কবে বুদ্ধদা! একটা স্পর্ধিত সম্পর্কও যেন হয়ে গেছিল তারই মাঝে। ২০১৬ সালে কবি তমালিকা পন্ডা শেঠ চলে গেলেন। তারপর থেকে হলদিয়ায় বিশ্ব বাংলা সাহিত্য উৎসবের পাশাপাশি কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির ভাষাভবনে দিদির জন্মদিনে আরও একটা অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি সামনের সারিতে বসে। বুদ্ধদা মিনিট পাঁচেক বলার পর নেমে যাচ্ছেন। আমি সাহস করে বলেই ফেললাম, এবার একটা টপ্পা হয়ে যাক। থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটু বাঁকা হেঁসে বললেন, টপ্পা! টপ্পার তুমি কী বোঝ হে? না, কি বুঝি তার ব্যাখ্যা দিতে হয়নি। তিনি একটু থেমে শুরু করলেন। একটা ঠুংরি আর একটা টপ্পা হল। আমি আর শ্যামল রেকর্ড করলাম। সেই থেকে শুরু।

             

হলদিয়ায় মেরিন কলেজ আর আইওসি প্রেক্ষাগৃহেও আমার সেই একই অনুরোধ। মনে আছে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী কী মন দিয়ে শুনছিলেন। গান শুরুর আগে কমলের আগে থেকে আনা পান মুখে দিয়ে শুরু করতেন। বলতেন, পান না হলে গান ঠিক জমেনা হে। কথা জড়িয়ে যায়। আর সেই প্রথম বললেন, এবার থেকে আমি কিন্তু গানই গাইব শুধু। কিন্তু তাও আর হল কই। ২০১৯ জানুয়ারিতে আইওসির প্রেক্ষাগৃহে বিশ্ববাংলা সাহিত্য উৎসবের পরই করোনা ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর আর উৎসব করা যায়নি। তমালিকাদির জন্মদিনও আর হলদিয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলনা। এতবড় মাপের মানুষ অথচ কী শিশুর মত খলবলিয়ে হাসতে পারতেন!  


কমলকে ফোন করতেন নিজে থেকেই। বলতেন, লক্ষন (শেঠ)কেমন আছেন? জিজ্ঞাসা করতেন, কমল তোমার মা কেমন আছেন? খুঁটিনাটি আপনজনীয় খোঁজ। একবার কথা হল, হলদিয়া ঢোকার আগে কমলের চকদ্বীপার বাড়িতে ঢুকবেন, সেখানে আড্ডা হবে। সে আড্ডাও হল কই? হলদিয়ায় আসলে তাঁর থাকার বন্দোবস্ত হত গোল্ডেন রিট্রিটে। অনুষ্ঠান শেষে সেখানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার সময় ইশারায় বললেন, চল রাতে ওখানেই বসা যাবে। আড্ডা হবে। আমাদের কাজ শেষ হয়নি তখনও, আমরা বললাম, না আজ নয়। বললেন, কেন? তমালিকা খেতে বারণ করেছে বুঝি? আচ্ছা চল আমি তমালিকাকে বলে দিচ্ছি। আমরা পালিয়ে বাঁচি। তখন সবে মাত্র আলাপ, ওঁর সঙ্গে বসে পান করব? সেই সঙ্কোচ কাটিয়ে ওঠার পরই এসেছিল সেই মহার্ঘ্য আমন্ত্রণ, শান্তিনিকেতনে ওঁর বাড়িতে আড্ডার। কিন্তু তার আগেই চলে গেলেন যে বড়!

No comments