স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের অন্যান্য অংশের মতো মেদিনীপুরেও পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদেরও অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার 64 বছর পরে মেদিনীপুরের সংগ্রামী ও জাতীয়তাবাদী মানুষ যখন মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্র…
স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের অন্যান্য অংশের মতো মেদিনীপুরেও পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদেরও অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার 64 বছর পরে মেদিনীপুরের সংগ্রামী ও জাতীয়তাবাদী মানুষ যখন মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন পুরুষদের সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মহিলাও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সংস্থার নবতিপর সদস্যা মাননীয়া শ্রীমতী ছবিরাণী দাসঅধিকারী তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলার ময়না থানার অন্তর্গত পূর্ব-দক্ষিণ ময়না গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিহারীলাল দাসঅধিকারী ও মাতা সুশীলা দেবী। তৎকালীন সমাজের বিধান অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করার আগেই মাত্র ১২ বছর বয়সে ভূপতিচরণ দাস অধিকারীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর মহিষাদলের মধ্যহিংলী গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে চলে আসেন। শ্বশুর বাড়ি ছিল আট ভাইয়ের যৌথ পরিবার। আট আট শ্বশুর-শাশুড়ি,তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনী নিয়ে বালিকা বধূ শুরু করলেন ঘরকন্নার কাজ।
এরকম একজন গৃহবধূর আর কি পরিচয় থাকতে পারে? কথায় বলে মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। আক্ষরিক অর্থে হয়তো ছবিরাণীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না, তবে সুযোগ পেলেই তিনি লক্ষণগণ্ডী অতিক্রম করেছেন। স্বামীর সমর্থনে অন্দরমহল হতে বেরিয়ে বাহিরের আঙিনায় পা রেখেছেন।
ছবি দেবী সেই ছোটো থেকেই ডায়েরীতে তাঁর নিজের কথা লিখে রাখেন। ডায়েরীর পাতায় চোখ রেখে আমরা তাঁর ভীত সন্ত্রস্ত শৈশবের কথা জানতে পারি। তিনি লিখেছেন------- ৪৯ এর আষাঢ় মাসে বিয়ের পর বাবার বাড়িতে থাকাকালীন ঝঞ্ঝাসহ বন্যার কবলে পড়েন। ঘরের চালা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে বাবা কাকা জোর করে সবাইকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। আরও জানতে পারি ---- মেদিনীপুরের সফল ভারতছাড় আন্দোলন দমনের নিষ্ঠুরতার কথা, পুলিশের লুটপাটের কথা, পুলিশের তাড়ায় মায়ের গয়নার কৌটা ভেসে যাওয়া, পুলিশি নির্মমতার হাত হতে রেহাই পেতে মেয়ে বউয়েরা ঘুমতো কোনো নিরাপদ বাড়িতে।
রান্নাবান্না ছাড়াও গরুর জাবনা দেওয়া,ঘুঁটে দেওয়া,ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গা, সবজি চাষে জল দেওয়া ইত্যাদি কাজ করতেন। আবার অবসর সময়ে চলত সূচিশিল্পের কাজ,আসন বোনা, সুতো আর উল দিয়ে নানা ধরনের ছবি ফুটিয়ে তোলা আর গল্পের বই পড়া।
শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর পর বাইরে বেরিয়ে সমাজের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মেয়েদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গ্রামে গ্রামে সভাসমিতির আয়োজন করেছেন। সংগঠনও গড়েছেন। পরবর্তীকালে স্থানীয় ক্লাব তরুণ সংঘের মহিলা সমিতিতে যোগ দেন।
মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার প্রতি ছবি দেবীর অবদান অপরিসীম। তাঁর সদিচ্ছায় এই পরিবারের ২৫ জনেরও বেশিজন মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার সদস্য হয়েছেন। প্রসঙ্গত জানানো যায় যে ছবি দেবী হলেন মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার পত্রিকা 'সমন্বয় বার্তা' র সম্পাদক স্বপন দাসঅধিকারী মহাশয়ের মাতা। 'মেদিনীপুর ভবন' ক্রয় করার সময় অর্থের অভাবে যখন কর্মকর্তাগণ দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন ঠিক সেই সংকটময় মুহূর্তে এক অতি সাধারণ গৃহবধূ ছবি দেবী তাঁর পেনশনের টাকার সামান্য সঞ্চয় থেকে এক লাখ টাকা দান করে এক অসাধারণ কাজের নজির গড়লেন। তথ্য ঘেঁটে জানা গেল যে তিনিই প্রথম মহিলা হিসাবে 'মেদিনীপুর ভবন নির্মাণ' তহবিলে দান করেছেন।
এই ৯১ বছর বয়সেও তিনি নিয়ম করে বই পড়েন, ডায়েরী লেখেন এবং হাঁটাহাঁটি করেন। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যে মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থা যেন দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয় আর তিনি চান------সংস্থার প্রত্যেক সদস্য/সদস্যা তথা পরিচালকমণ্ডলী যেন মেদিনীপুরবাসী বিশেষ করে নারীর কল্যাণে ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যান।
অনুলিখনে সুব্রত কুমার মাঝি/সম্পাদক/ কলকাতা দক্ষিণ আঞ্চলিক ইউনিট। ৬২৯০৯৯৫৯৪৭।
No comments