Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রাজভবনের চাবি ও ঘড়িবাবু’ রানা চক্রবর্তী

‘পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের সরকারি বাসভবন হল কলকাতার রাজভবন। সেই রাজভবনে কয়টি কামরা ও কতগুলো ঘড়ি আছেন জানেন কি? সেই সব কামরার চাবিগুলো কার কাছে থাকে ও ঘড়িগুলোর দেখাশোনা কে করেন? দুটো কাজই করেন একজন ব্যক্তি। রাজভবনের প্রায় ঊননব্বইটি…

 





                                    

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের সরকারি বাসভবন হল কলকাতার রাজভবন। সেই রাজভবনে কয়টি কামরা ও কতগুলো ঘড়ি আছেন জানেন কি? সেই সব কামরার চাবিগুলো কার কাছে থাকে ও ঘড়িগুলোর দেখাশোনা কে করেন? দুটো কাজই করেন একজন ব্যক্তি। রাজভবনের প্রায় ঊননব্বইটি বিভিন্ন কামরার চাবি গচ্ছিত রাখা ও বিভিন্ন ঘরের ঘড়িতে ঠিক ঠিক সময়ে দম দেওয়া - এক বিচিত্র কাজ বটে। যিনি কাজটি করেন, তাঁকে এককথায় ‘রাজভবনের ঘড়িবাবু ও চাবিবাবু’ বলা চলে। নামটা পড়ে নিশ্চই ‘বিমল মিত্র’র বিখ্যাত উপন্যাস ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর সেই জমিদার বাড়ির ‘ঘড়িবাবু’র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য লাগলেও, সেই পদাধিকারী ব্যক্তি সত্যিই কলকাতার রাজভবনে রয়েছেন। তাঁর অফিসে বসবার ঘরে কাঠের এক বিরাট আলমারি জুড়ে বাঁধা থাকে রাজভবনের চাবির থোকা। এটা সেই বৃটিশ আমলের নিয়ম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও চলছে। কাঠের মস্ত কাঁচ-লাগানো আলমারিতে প্রতি গোছা চাবির নীচে রং দিয়ে রাজভবনের বিভিন্ন কামরার নাম ও নম্বর বসানো থাকে। বলাতো যায় না কখন কোন চাবি হারিয়ে যায়। ডুপ্লিকেট চাবির তখনই প্রয়োজন পড়ে। সম্ভবতঃ চাবি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই চতুর সংশঙ্খল বৃটিশ জাতি সেই কি বোর্ড-এর সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করেছিল।

কলকাতা রাজভবনে যতগলি ঘর রয়েছে, ঠিক ততগুলি না হলেও, তার প্রায় অর্ধেক পরিমাণ হল সেখানকার ঘড়ির সংখ্যা। সেগুলোর কোনটা টেবিল ক্লক, কোনটা দেওয়াল ঘড়ি, কোনটা গ্র্যান্ড মাষ্টার ক্লক, কোনটা ইলেকট্রনিক্যাল ঘড়ি ইত্যাদি। সেগুলোর ঘণ্টার আওয়াজও বিচিত্র। বিচিত্র সেগুলোর এক এক রকমের অঙ্গসৌষ্ঠব। পুরাকালের সঙ্গে সদ্য আধুনিকতার অপরূপ সংমিশ্রণ সেগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। সেই ঘড়িগুলোর কোনোটা বার্নিশ করা, কোনোটা স্প্রে পেণ্টিং করা, কোনোটা আবার রং চটা - দেখে মনে হয় সেটা ধাঁ চকচকে রাজভবনের একেবারে অযোগ্য। সে এক এলাহি ব্যাপার। এ ছাড়া রাজভবনের প্রধান ভবনের বাইরে ওয়েলসলী প্লেসের গ্যারাজে, ষ্টোরে, ইলেকট্রিক অফিসে, রাজভবন এষ্টেটের অফিসে বিভিন্ন আকারের নানা রকমের ঘড়ি আছে। সেগুলোর কোনটাতে প্রত্যহ দম দিতে হয়। কোনোটিতে আবার সপ্তাহে একবার। কোনোটা খালি ব্যাটারীতেই চলে। তবে সেই সব ঘড়িগুলোর বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা জায়গায় মিল আছে। সেটা হল যে, রাজভবনের সব কয়টি ঘড়িই এখন দুষ্প্রাপ্য। ইংরেজিতে সেগুলোকে ‘Atique’ বলা হয়। নিলামের দোকানে গিয়ে মাথা ঠুকলেও বা চড়া দাম দিলেও সেসব ঘড়ি এখন আর পাওয়া যাবে না।                            

পুরাকালের কলকতার জমিদার বাড়ীর মতো রাজভবনেও একজন ঘড়িবাবু আছেন। তিনি রাজভবনের বিভিন্ন ঘড়িতে দম দেন। এর জন্য তিনি তাঁর মাইনা ছাড়াও আলাদা মাসিক ‘এ্যালাউন্স’ পান। আর রাজভবনের ঘড়িবাবুর সবচেয়ে কষ্টের কাজ হল, স্বয়ং রাজ্যপালের শোয়ার ঘর বা ‘বেডরুমের’ ঘড়িতে দম দেওয়া। কারণ, রাজ্যপাল কখন কী মেজাজে থাকবেন সেটার সঠিক ইতিহাস পূর্বাহ্নে রাজ্যপালের খাস বেয়ারার কাছ থেকে জেনে না নিলে, ঘড়িতে দম দিতে গিয়ে ঘড়িবাবর কপালে রাজ্যপালের ধমক জুটতে পারে। আসলে রাজভবনে, রাজ্যপালের ঘরে, বিনা অনুমতিতে কেউই ঢুকতে পারেন না। আর রাজ্যপালের শয়নকক্ষে প্রবেশ করা তো প্রায় অমার্জনীয় অপরাধ। এই নিয়ম সেই বৃটিশ আমল থেকে চলে আসছে। তখন অবশ্য এতো কড়াকড়ি ছিল বড়লাটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য। এখনও নিরাপত্তার জন্যই সেই কড়াকড়ি চালু আছে কি না সেটা অবশ্য বলা যায় না। তাহলে ঘড়িবাবু কখন রাজ্যপালের শয়নকক্ষের ঘড়িতে দম দেন? যখন রাজ্যপাল নিজের স্নান পর্ব সারতে যান, তখনই সুযোগ বুঝে ঘড়িবাবু তাঁর খাস বেয়ারার হুকুম নিয়ে তাঁর শয়নকক্ষের ঘড়িতে চাবি দিয়ে আসেন। এই কাজটা কিন্তু ঘড়িবাবুকে প্রায় রেসের ঘোড়ার মতন ছোটাছুটি করে সারতে হয়। কারণ হিসেব মাঝে মাঝে একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই তাঁকে প্রায়ই অপ্রস্তুততে পড়তে হয় ও তখন তাঁর কপালে রাজ্যপালের ধমক জোটাও বিচিত্র নয়।


এই প্রসঙ্গে ১৯৬০ সালের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন ‘শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু’। সেই সময় কলকাতা রাজভবনের ঘড়িবাবু ছিলেন ‘মিঃ খামারু’। তিনি ছিলেন রাজভবনের পুরানো কর্মচারী। অতি পাকা পোক্ত লোক। কর্মঠ ও কায়দাকেতায় তাঁকে এক কথায় পাক্কা ‘নেটিভ সাহেব’ বলা যেত। তিনি অনর্গল ইংরেজী বলতে পারতেন, তবে তাঁর বিদ্যা যে নন ম্যাট্রিক - প্যারীচরণ সরকারের ফার্স্ট বুকের ঘোড়ার পাতা পর্যন্ত ছিল - সেটা তিনি সৎভাবে স্বীকার করতেন। তিনি বৃদ্ধ ছিলেন, কিন্তু কোন ইংরেজ লাট সাহেব কবে কেমন করে হেসেছিলেন, কেমন করে কোঁদেছিলেন, কী কী কথা বলেছিলেন -সে সবই ছিল তাঁর নখাগ্রে। কোন লাট কী ফল ভালবাসতেন বা কোন ব্রিটিশ লাট প্রজাপতি নিয়ে কালচার করতেন - সেগুলিও ছিল তাঁর মুখস্থ। কথায় অকথায় তিনি গর্ব করে বলতেন, ‘‘আমি হচ্ছি মিঃ জি. খামারু। এই পশ্চিমবাংলার বাঙালীর মধ্যে বিচিত্র আমার পদবী। আর সেন্টারে আছেন মিঃ নেহেরু। এঁরাই তো দেশকে চালাচ্ছেন।’’ এই কথা বলার ভেতর তাঁর বেশ দাম্ভিকতা থাকতো। তবে তিনি যে তাঁর রাজভবনের জীবনে অত্যন্ত কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান মানষ ছিলেন তা রাজভবনের পুরানো কর্মচারীরা আজও স্বীকার করেন। এবারে আসল ঘটনায় আসা যাক। ঘটনার দিন সকালে, শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু স্নান করতে তাঁর স্যুইটের লাগোয়া স্নানঘরে ঢুকেছিলেন। সেই সময়ে, ঘড়িবাবু মিঃ খামরু, যথারীতি টুক করে তাঁর শোয়ার ঘরে ঢুকে সেখানকার ঘড়িতে দম দিচ্ছিলেন। হঠাৎ শ্রীমতী পদ্মজা কেন জানি কী কারণে ভিজে চুলে ঘরে ফিরে এসেছিলেন। উভয়েই অপ্রস্তুত হওয়ার আগেই ঘড়িবাবু তড়িঘড়ি হুট করে স্যুইটের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পদ্মজা ততক্ষণে সেই ঘরে থাকা বিরাট আয়নাতে কার যেন ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। এরপরেই শুরু হয়েছিল হৈ হৈ ব্যাপার। রাজভবনে তোলপাড় পড়েছিল। রাজ্যপালের তৎকালীন খাস বেয়ারা ‘হাকিম মহম্মদ’ কিছুতেই মানতে চাইছিলেন না যে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে কেউ রাজ্যপালের ঘরে ঢুকেছিলেন। কিন্তু তিনিও মনে প্রাণে জানতেন যে তিনি মিথ্যে কথা বলছেন। কারণ, তখন তিনি অন্য করিডরে দাঁড়িয়ে অন্য বেয়ারার সঙ্গে দেশওয়ালী কথাবার্তা বলছিলেন। ওদিকে শ্রীমতী পদ্মজাও তাঁর কথা কিছুতেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। কারণ, তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন যে আয়নাতে ছায়া পড়েছে কোন এক অজানা লোকের। তাই শুরু হয়েছিল খোঁজ। কে রাজ্যপালের শয়নকক্ষে ঢুকেছিল তার খোঁজ। পদ্মজার ছিল ভীষণ গোঁসা। সেদিন তাঁর ভয়ে গোটা রাজভবন নিঃশ্চুপ ছিল। শেষ পর্যন্ত দিনের শেষে মিঃ খামরু ভয়ে ভয়ে রাজ্যপালের তৎকালীন সেক্রেটারী ‘পিনাক রঞ্জন সিনহা’র কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁকে তিনি প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বলেছিলেন - ‘‘I am guilty, sir’’. রাজ্যপালের সেক্রেটারী শ্রীমতী পদ্মজাকে সব ব্যাপার খুলে বলেছিলেন। শ্রীমতী পদ্মজা রাজভবনের সেই বৃদ্ধ কর্মচারীটিকে খুব ভালবাসতেন। তিনি সব কথা শুনে একটু হেসেছিলেন। সেখানেই সেই পর্ব শেষ হয়েছিল। এরপরেও একই কাণ্ড অন্য কোন রাজ্যপালের সাথে ঘটেছিল কিনা সেটা জানা যায় না। তবে রাজভবনের চাবি ও ঘড়িবাবুকে কেউ আবার হেলাফেলা ভাববেন না। সেই কবে ব্রিটিশ আমল থেকে তাঁদের জন্য রাজভবনে পদ রয়েছে। সেই ট্রাডিশন এখনও চলেছে। তাঁদের জন্যই রাজভবনের একশোটি দুষ্প্রাপ্য ঘড়ির কাঁটা আজও ঘুরে চলছে।

                                

(সহায়ক গ্রন্থ: কলকাতা রাজভবনের অন্দরমহল, অমিয় রায়।)

                             

No comments