Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বিধবা বিবাহ আইন: বাস্তব ইতিহাসের সন্ধানে’ রানা চক্রবর্তী

‘                   বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তখন বঙ্গদেশে এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছিল। সকলে ভেবেছিলেন যে, এই বিদগ্ধ পণ্ডিত কেন এই কাজে হাত দিলেন। সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা যে কতদূর গড…

 





‘                   

বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তখন বঙ্গদেশে এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছিল। সকলে ভেবেছিলেন যে, এই বিদগ্ধ পণ্ডিত কেন এই কাজে হাত দিলেন। সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা যে কতদূর গড়িয়েছিল তার প্রমাণ স্বরূপ এ সম্বন্ধে প্রচলিত দু’একটি কাল্পনিক গল্প এখানে সংক্ষেপে দেওয়া যেতে পারে। প্রথম গল্প এইরকম। বীরসিংহ গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যাসাগরের খেলার সাথী ছিল৷ বালিকাটি ছিল বালবিধবা। বিদ্যাসাগর তাঁকে খুব পছন্দ করতেন এবং মনে হয় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের মধ্যে অনুরাগের সঞ্চার হয়েছিল। বিদ্যাসাগর যখন জানতে পেরেছিলেন যে সে বিধবা এবং শাস্ত্রের নির্দেশে সেই বিধবা বালিকাকে আজীবন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে, তখন তিনি হিন্দু বিধবাদের পুনবিবাহ প্রবর্তন করার সঙ্কল্প করলেন। আর একটি কাহিনী হল এই যে, একটি বিধবা রমণী কঠোর বৈধব্য দশা পালন করতে না পারায় সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। সেই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর যখন সেই অসহায় বিধবার শোচনীয় পরিণামের কথা জানতে পেরেছিলেন তখন তিনি শপথ করেছিলেন যে তিনি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকার সমাজে প্রচলিত করে সরকারকে দিয়ে তা বিধিবদ্ধ করাবেন। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মহান প্রচেষ্টার পিছনে কোনও না কোন আকস্মিক কারণ ছিল বলে বিদ্যাসাগরের জীবনীকারেরা সকলেই ভুল করেছিলেন। ‘সমাজ সম্বন্ধে মানুষের মনোভাব’ সহসা সক্রিয় হয়ে ওঠে না, সেই মনোভাব বাস্তব ক্ষেত্রে রূপায়িত হতে সময় লাগে। বিদ্যাসাগরের যুগে যে বিধবা বিবাহের সমর্থনে এবং বহুবিবাহের বিপক্ষে সামাজিক মনোভাব সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার পিছনে একটা দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ‘রাজা রামমোহন রায়ের’ যুগে সেই মনোভাব সর্বপ্রথম রূপ গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। ১৮১৫ সালে রামমোহন ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সভায় প্রথম থেকেই এই সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হত। ১৮১৯ সালে সেই সভার এক অধিবেশনের বিবরণীতে বলা হয়েছিল - “এই সভায় ... বালবিধবাদের সারাজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের বাধ্যবাধকতা, বহুবিবাহ ও সহমরণ রূপ কুপ্রথাগুলির তীব্র নিন্দা করা হয়েছিল” (দ্য ক্যালকাটা জার্নাল, তৃতীয় খণ্ড, ১৮ই মে ১৮১৯)। ‘সতীদাহের’ মত নৃশংস প্রথা দূর করার জন্য ভারতবাসী রামমোহন রায়ের কাছে অনেক পরিমাণে ঋণী। তিনি যখন বিলেত গিয়েছিলেন তখন বঙ্গদেশের সব পরিবারেই এই কথা বলাবলি হত যে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রবর্তন করার শপথ নিয়েই তিনি ইংল্যাণ্ডে গেছেন। গল্প পাওয়া যায় যে, সেই সময়, এমনকি বৃদ্ধা বিধবারা পর্যন্ত ঠাট্টা করে বলাবলি করতেন যে রামমোহন বিদেশ থেকে ফিরে এলেই তাঁদের বিবাহ হবে। বলা বাহুল্য বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে রামমোহন সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন, কিন্তু ‘সতীদাহ প্রথা’ উচ্ছেদ করার পরে সেই সমস্যার সমাধান করার মত যথেষ্ট সময় তিনি পান নি। তবে শুধু রামমোহন নয়, গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তরুণ ‘ডিরোজিও’র ছাত্র শিষ্যেরা বিধবা বিবাহ ও অন্যান্য সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা করতেন এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার চেষ্টা করতেন। তাঁদের দু’খানি সাময়িক পত্র - ইংরেজিতে ‘দি এনকোয়ারার’ ও বাংলাতে ‘জ্ঞানান্বেষণ’-এর পৃষ্ঠাতেও সেই সমস্যা নিয়ে চর্চা হয়েছিল। তাঁদের সেই সব আলোচনায় এইটুকু ফল হয়েছিল যে ‘ভারতীয় আইন কমিশন’ বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন। কমিশনের সম্পাদক ‘জে. পি. গ্র্যান্ট’ একটি বিজ্ঞপ্তি মারফৎ সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন এবং চারটি ‘প্রেসিডেন্সী’র (শাসনের সুবিধার জন্য বিভাগ) ‘সদর আদালত’গুলির মতামত চেয়েছিলেন৷ সেই ব্যাপারে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল এই যে, বিভিন্ন আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ উচ্চপদস্থ বৃটিশ কর্মচারীই বিধবা বিবাহের প্রস্তাব সমর্থন করেন নি। কলকাতা সদর আদালতের অস্থায়ী রেজিষ্ট্রার ‘আর ম্যাকান’ উত্তর দিয়েছিলেন - “বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়ার কুফল সম্বন্ধে এই আদালত সম্পূর্ণ সচেতন, কিন্তু তবু এই আদালতের নিশ্চিত মত এই যে বিধবা বিবাহের প্রস্তাবিত আইন পাশ করলে গভর্ণমেন্টের পক্ষে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হবে।” এলাহাবাদ সদর কোর্টের রেজিষ্ট্রার ‘এইচ. বি. হ্যারিংটন’ ১৮৩৭ সালের ১১ই আগষ্ট তারিখে লিখেছিলেন - “প্রস্তাবিত আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য খুবই ভাল সন্দেহ নেই৷ কিন্তু এই আইন প্রত্যক্ষভাবে হিন্দু আচারের বিরোধী হবে। এই সব আচার যে পরিমাণ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় তাতে এ আইন হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দিতে পারে। অতএব এই আদালত এ আইন পাশের যুক্তিযুক্ততা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করছে।” মাদ্রাজ সদর আদালতের রেজিষ্ট্রার ‘মিঃ ডবলিউ ডগলাস’ ১৮৩৭ সালের ৩১শে জুলাই তারিখে লিখেছিলেন - “বিচারকদের মত যে দেশের এই অঞ্চলে যে আইনের প্রস্তাব হয়েছে তা পাশ করলেও চালু করা সম্ভব হবে না। উপরন্তু উচ্চবর্ণের লোকেদের মধ্যে গোঁড়ামি আরও বেড়ে যাবে এবং তাঁরা দ্বিগুণভাবে বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করবে ...।” তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সদর আদালতগুলি আইন করে বিধবা বিবাহ চালু করার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন, কেননা তাঁদের আশঙ্কা হয়েছিল যে সেই আইন পাশ করলে হিন্দুদের সামাজিক রীতিনীতিতে হস্তক্ষেপ করা হবে। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠির আন্দোলনের এইটুকু ফল হয়েছিল যে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন এবং আইন দ্বারা বিধবা বিবাহ প্রচলন করা সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়েছিলেন। চতুর্থ দশকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রগতিশীল ব্যক্তিরা সেই সব বিচার ও আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কয়েকটি বিখ্যাত সংস্থা ছিল, যেমন ‘সোসাইটি ফর দি এ্যাকুইজিশান অব জেনারেল নলেজ’ (সাধারণ জ্ঞান আহরণী সমিতি), ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘বেথুন সমিতি’। সেই সব সভা সমিতিতে প্রায়ই সেই সমস্যার আলোচনা হত। সেই সব প্রকাশ্য বিচার বিতর্ক অবিরত চলার ফলে পঞ্চম দশকে সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে একটা নির্দিষ্ট মনোভাব গড়ে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়ে বিদ্যাসাগর আইন দ্বারা বিধবা বিবাহ প্রচলন ও বহু বিবাহ নিরোধের জন্য আন্দোলন শুরু করে সেই সমাজ সংস্কারমূলক মনোভাবকে কার্যকরী করে তুলেছিলেন। সেই আন্দোলনের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অবস্থা অনুকূল হয়ে উঠেছিল। সেই সংস্কারের প্রধান সমর্থনকারী মধ্যবিত্তশ্রেণী ততদিনে সমাজে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকেই বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ, বাধ্যতামূলক বৈধবা দশা পালন সম্বন্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছিলেন এবং সেই সব প্রথার সংস্কারের দাবী জানাচ্ছিলেন। চতুর্থ দশকে সেই দাবী খুবই প্রবল হয়ে উঠেছিল। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘দি বেঙ্গল স্পেটেটর’-এ সেই সব প্রথার বিলোপ দাবী করে উৎসাহের সঙ্গে প্রবন্ধ লেখা হচ্ছিল। সেই পত্রিকায় ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যাতেই বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছিল। ১৮৫৪-৫৫ সালে বিদ্যাসাগর নিজে তাঁর বিধবা বিবাহ বিষয়ক প্রবন্ধে যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন ‘বেঙ্গল স্পেটেটরের’ লেখকও সেগুলির উপযুক্ত ব্যবহার করেছিলেন। হিন্দু সমাজের নেতৃস্থানীয়দের দ্বারা স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পত্র গভর্ণমেন্টের কাছে পাঠানোর প্রস্তাবও সেই প্রবন্ধে করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে প্রয়োজন হলে আইনের দ্বারা বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকার দেওয়া উচিত। ১৮৫৪ সালের কোনও এক সময় ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সোসাইটি’ ‘ধর্মসভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র সঙ্গে বিধবাদের পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে পত্রালাপ করেছিল - “শেষোক্ত সংস্থা কোনও জবাব দেননি। ধর্মসভার সঙ্গে কিছুদিন পত্র বিনিময় চলেছিল বটে কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি৷” (দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, ২৫তম খণ্ড, জুলাই-ডিসেম্বর ১৮৫০) এই বছর দশেক পরে বিদ্যাসাগর নতুন উৎসাহ ও সাহস নিয়ে সেই আলোচনা পুনরায় শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে বাদ প্রতিবাদ চতুর্থ দশকের শুরুতে সবচেয়ে প্রবল হয়ে ঐ দশকের শেষের দিকে কমে এসেছিল। ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ দ্বারা যথাক্রমে ১৮৩৯ ও ১৮৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র প্রভাবে পঞ্চম দশকে সমাজে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ মাত্র দশজন তরুণ সভ্য নিয়ে আরম্ভ হয়েছিল। সেই সভার সাপ্তাহিক ও মাসিক অধিবেশনে সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে নানারূপ প্রবন্ধ পড়া হত এবং তা নিয়ে আলোচনা চলত। সেই সভা শুরুতে খুব ছোট ছিল। কিন্তু “এত কর্মশক্তি ও উৎসাহের সঙ্গে এই সভার কাজ চালান হত যে মাত্র দু বছরের মধ্যে এর সভ্য সংখ্যা হয়ে দাড়াল ৫০০ এবং আরও কয়েক বছরের মধ্যে বহু ধনী ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি এই সভার সভ্য হলেন বা এর সম্বন্ধে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন।” (History of Brahma Samaj, Shibnath Shastri, 1st part, page: 87) গত শতাব্দীর মধ্যভাগে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালীর মুখপাত্র হিসাবে সেই সভা অত্যন্ত প্রভাবশালী সংস্থা হয়ে উঠেছিল। বিদ্যাসাগর সেই সভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন; বস্তুতপক্ষে তিনি সেটির সভ্য ছিলেন। সেই সভা যখন নব প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছিল তার অব্যবহিত পূর্বে বিদ্যাসাগর সেটির সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন (১৮৫৮-৫৯ সাল)। এ ছাড়া বিদ্যাসাগর ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সম্পাদক মণ্ডলীর সভ্য ছিলেন এবং নিয়মিতভাবে ঐ পত্রিকায় লিখতেন। পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ‘অক্ষয়কুমার দত্ত’, তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন এবং সমাজ সংস্কার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে খুব সহযোগিতা করতেন। অক্ষয়কুমার একজন কঠোর যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী লোক ছিলেন এবং বিদ্যাসাগরের মত তিনিও একজন শক্তিশালী গদ্য লেখক ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনা সর্বপ্রথম শুরু করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অত্যন্ত স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। অতএব তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার’ মাধ্যমে বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ নিরোধ প্রভৃতি বিদ্যাসাগরের সমস্ত সমাজ সংস্কারমূলক প্রচেষ্টা সমর্থন করতেন। বিদ্যাসাগর নিজে বিধবা বিবাহ প্রচলনের প্রস্তাব করে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র ফাল্গুন ১৭৭৬ শক (১৮৫৪ সাল) সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং অক্ষয়কুমার একটি সম্পাদকীয় লিখে সেই প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন। সমাজের বিতর্কমূলক সমস্যাগুলি সম্বন্ধে তত্ত্ববোধিনী সভার তরুণ সভ্যদের আলাপ আলোচনা বাদপ্রতিবাদ চলেছিল এবং তারই ভিতর দিয়ে একটা নতুন মনোভাব গড়ে উঠতে শুরু হয়েছিল। সেই মনোভাব ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র বিভিন্ন প্রবন্ধের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল। স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহ সমর্থন করে এবং বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও মদ্যপানের নিন্দা করে পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লেখা হচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারের কাজে নেমেছিলেন। তাঁর অনেক জীবনীকার তাঁকে বিধবা বিবাহের সৃষ্টিকর্তা বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই ধারণা ভুল। এমনকি ‘পরাশর সংহিতা’র যে কয়েকটি সুপরিচিত শ্লোকে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় বিধবা বিবাহকে শাস্ত্রসম্মত বলা হয়েছে, কেবলমাত্র বিদ্যাসাগরই যে সেগুলোর আবিষ্কারক ছিলেন সে ধারণাও ভুল। তবে এই কথা সত্যি যে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র থেকে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে নজীর খুঁজে বের করবার জন্য বহুবিনিদ্র রজনী কাটিয়েছিলেন। কিন্তু এ কথা সত্যি নয় যে, হঠাৎ একদিন তিনি ‘পরাশর সংহিতা’র “নষ্টে মৃতে” শ্লোকটির সন্ধান পেয়ে বলে উঠেছিলেন, “এতদিনে আমি পেয়েছি, পেয়েছি”। এই গল্পের মধ্যে সংস্কৃত শাস্ত্রে বিদ্যাসাগরের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। কিন্তু বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে সফল করে তোলার যে কৃতিত্ব সেটা একমাত্র বিদ্যাসাগরেরই প্রাপ্য। সেই ঐতিহাসিক আদর্শসাধনে তিনি অসামান্য সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন।                      

এই কথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে বিদ্যাসাগরকে প্রাচীন শাস্ত্র থেকে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে যুক্তি আহরণ করার জন্য বিশেষ বেগ পেতে হয়েছিল। ‘পরাশর সংহিতা’র যে শ্লোকের উপর ভিত্তি করে তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর বহু আগেই ‘বৌধায়ন’, ‘নারদ’ প্রভৃতি ঋষিরা সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করে গিয়েছিলেন এবং ‘অগ্নিপুরাণ’ ও অন্যান্য পুরাণে সেগুলো সমর্থিত হয়েছিল। যে স্ত্রীলোক ‘ক্লীব বা জাতিচ্যুত স্বামী’কে পরিত্যাগ করে দ্বিতীয় বার বিবাহ করে তাঁর সন্তানকে ‘বৌধায়ন’ ‘পৌনর্ভব’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই যুগে সমাজে যদি বিধবা বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকত তা হলে ‘পৌনর্ভব’ সন্তানের প্রশ্নও থাকত না। ‘নারদ’, ‘পরাশর’ ও ‘অগ্নিপুরাণ’ বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে একই শ্লোক উল্লেখ করেছিলেন - “নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চাস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্য বিধীয়তে৷” ‘পরাশর সংহিতা’র এই শ্লোকের অর্থ হল - “স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব অথবা পতিত হয়, তাহলে এই পঞ্চপ্রকার আপদে নারীর অন্য পতি গ্রহণ বিধেয়।” (History of Dharmashastra, P.V. Kane, 2nd part, page: 610-11) অতএব বিদ্যাসাগরের মতন পণ্ডিত ব্যক্তিকে এই শাস্ত্রীয় বিধান খুঁজে বের করার জন্য খুব যে পরিশ্রম করতে হয়েছিল একথা সম্ভব বলে মনে হয় না। বহু যুগ ধরে ব্রাহ্মণ বা তাঁর সমতুল্য উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু অন্যান্য জাতির মধ্যে সেটা ছিল না। অন্ত্যজ, শূদ্র, আদিবাসী বা ঐ শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রথা অতীতে অনুমোদিত ছিল এবং এখনও আছে, যদিও তাঁদের সমাজে কুমারী বিবাহের তুলনায় বিধবা বিবাহকে কিছুটা নিকৃষ্ট বলে মনে করা হয়। এই সব শ্রেণীর মধ্যে স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীর দ্বিতীয় বার স্বামী গ্রহণের অনুমতি আছে, এমন কি স্বামীর জীবদ্দশাতেও সেটা হতে পারে, যদি স্বামী লিখিতভাবে স্ত্রীকে ‘ফারখৎ’ বা ‘সোদটিট্রি’ (মুক্তিপত্র) দিয়ে দেন। এই ধরনের বিবাহকে মহারাষ্ট্রে ‘পত’, গুজরাটে ‘নাত্রা’ এবং কর্ণাটকের জেলাগুলিতে ‘উদকী’ বলা হয়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় নিম্নশ্রেণী, সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতির মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। সাধারণ ভাষায় সেটাকে বলা হয় ‘নিকা’। বিদ্যাসাগর যে গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং বড় হয়েছিলেন তার আশেপাশে এই সব শ্রেণীর বহু সংখ্যক লোক বাস করতেন। সম্ভবতঃ প্রথম যৌবনে তিনি এই সব লোকেদের সামাজিক প্রথা থেকে বিধবা বিবাহ প্রচলন করার ব্যাপারে প্রেরণা পেয়েছিলেন। সম্ভবতঃ অল্প বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ১৮২৯ সালে ‘লর্ড বেন্টিঙ্ক’ ‘সতীদাহ’ প্রথা বন্ধ করার পরে বিধবাদের সমস্যা অত্যন্ত কঠিন রূপ ধারণ করেছে। আসলে ‘কৌলিন্য প্রথা’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘বহুবিবাহ প্রথা’ তখনও সমাজে খুবই প্রচলিত ছিল, অথচ ‘সতীদাহের’ মতন নৃশংস প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং সমাজে বিধবাদের সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আর সেই সব বিধবাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন অল্পবয়সী। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সেই সমস্যা এত গুরুতর আকার ধারন করেছিল যে বিচক্ষণ ব্যক্তিরা আশঙ্কা করেছিলেন যে, হয়ত সমাজের নৈতিক ভিত্তিই ভেঙ্গে পড়বে। বিদ্যাসাগরও সেই কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু অন্য লোকেদের মতন তিনি শুধু উপলব্ধি করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর চিন্তা ধারাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য একান্তভাবে চেষ্টা শুরু করেছিলেন। বিধবা বিবাহের সমর্থনে বিদ্যাসাগর তাঁর প্রথম পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন ১৮৫৫ সালের জানুয়ারী মাসে। ‘পরাশরের’ যে বিখ্যাত শ্লোকের উপরে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই শ্লোকের ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছিলেন, “স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করিলে অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত৷” সেই সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “পরাশর কলিযুগে বিধবাদের পক্ষে তিন বিধি দিতেছেন - বিবাহ, ব্রহ্মচর্য্য, সহগমন। তন্মধ্যে রাজকীয় আদেশক্রমে সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের দুইমাত্র পথ আছে - বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য্য করিবেক। কলিযুগে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্রা নিৰ্ব্বাহ করা বিধবাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান পরাশর সর্ব্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন। সে যাহা হউক, স্বামীর অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বৈগুণ্য ঘটিলে, স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহের স্পষ্ট বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, কলিযুগে, সেই সেই অবস্থায়, বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রসম্মত কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া অবধারিত হইতেছে।” এই ব্যাখ্যা নিয়ে তীব্র বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। কয়েকজন পণ্ডিত বলেছিলেন যে, ‘পরাশরের শ্লোকে’ অন্য কোনও যুগের সমাজ ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলা হয়েছে, অতএব তা কলিযুগ বা বর্তমান যুগ সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়৷ ‘নবদ্বীপ’ ও ‘ভাটপাড়া’র প্রাচীন শাস্ত্র চর্চার কেন্দ্র থেকে পণ্ডিতেরা এসে উত্তর কলকাতায় ‘রাজা রাধাকান্ত দেবের’ বাড়ীতে সম্মিলিত হয়েছিলেন। ‘শোভাবাজার রাজ পরিবারের’ সুযোগ্য সন্তান ‘রাধাকান্ত দেব’ শুধু যে সংস্কৃত বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তাই নয়, তিনি তৎকালীন হিন্দু সমাজের অন্যতম ধনী ও অগাধ প্রতিপত্তি শালী নেতা ছিলেন। রক্ষণশীল হিন্দুদের সেই নেতা অবশ্য একটি সৌজন্যের কাজ করেছিলেন - তিনি বিদ্যাসাগরকে ঐ পণ্ডিত সম্মেলনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ করেছিলেন। প্রথম দিনের তর্কবিতর্কে তরুণ পণ্ডিত ও সংস্কারক বিদ্যাসাগর প্রধান বিদগ্ধ সমাজের কাছে তাঁর সিদ্ধান্ত অত্যন্ত জোরালোভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে প্রতিপন্ন করেছিলেন। ‘রাজা রাধাকান্ত’ তাতে খুবই চমৎকৃত হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অনেক বিষয়ে একমত হননি। তবুও সে দিনের শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসাবে বিদ্যাসাগরকে তিনি এক জোড়া শাল উপহার দিয়েছিলেন। এতে সংরক্ষণশীল দলের নেতারা ভেবেছিলেন যে তাঁদের শ্রদ্ধেয় সমাজপতিকে বিদ্যাসাগর বশ করে ফেলেছেন। এর ফলে কলকাতার হিন্দু সমাজে একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং দলে দলে লোক ‘রাজা রাধাকান্তের’ কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রস্তাব সম্বন্ধে তাঁর মত কি? রাজা তাঁদের এই কথা বলে নিরস্ত করেছিলেন যে তিনি কোনও মতেই বিধবা বিবাহ সমর্থন করেন না এবং বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন নি, বিদ্যাসাগরকে তিনি পুরস্কার দিয়েছেন একমাত্র তাঁর অসামান্য যুক্তি ও পাণ্ডিত্যের জন্য। এরপরেও লোকেরা যাতে কোনও রূপ ভুল ধারণা না করেন সেজন্য রাজা তাঁর বাড়ীতে দ্বিতীয় পণ্ডিত সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই সভায় স্মৃতি শাস্ত্রে পারদর্শী বিখ্যাত পণ্ডিত ‘ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন’ উপস্থিত ছিলেন। সেবারে রাজা পণ্ডিত ‘ব্রজনাথ’কেও এক জোড়া শাল উপহার দিয়েছিলেন। ‘ব্রজনাথ’ তীব্র ভাষায় বিদ্যাসাগরের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। রাধাকান্ত দেবের বাড়ীতে সেই সব পণ্ডিত সম্মেলন থেকে বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন যে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। বিধবা বিবাহের বিপক্ষে মত দিয়ে তৎকালীন পণ্ডিত সমাজ ও হিন্দুদের সভাসমিতির পক্ষ থেকে অনেক বিতর্কমূলক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকেও পুস্তক পুস্তিকার মাধ্যমে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কলকাতার ‘ধর্মসভা’, যশোহরের ‘হিন্দুধর্ম সংরক্ষিণী সভা’ ও অন্যান্য সঙ্ঘ বিধবা বিবাহের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেই উপলক্ষে বাংলা সাহিত্যে অনেক ব্যঙ্গ কবিতা, নাটক, পারিবারিক গল্প, নকশা জাতীয় রচনার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই যুগের প্রধান ব্যঙ্গ কবি ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’ বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে কয়েকটি মজার কবিতা লিখেছিলেন। সে যুগের একজন জনপ্রিয় গীতিকার ‘দাশরথি রায়’ও সেই সম্বন্ধে কতগুলি গান বেঁধেছিলেন। সেগুলি গ্রামে ও শহরে মেলা বা উৎসব উপলক্ষে জনসাধারণ মজা করে গাইতেন৷ এমন কি শান্তিপুর, ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের বিখ্যাত বাঙালী তাঁতিরা শাড়ীর পাড়ে বিধবা বিবাহের ছড়া বুনে দিতেন। জনসাধারণের মধ্যে থেকে সেই যে অজস্র কবিতা, গান, নাটক ও কাহিনী উৎসারিত হয়ে উঠেছিল, সেগুলোর মধ্যে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে কোনও আক্রোশ ছিল না, বরং ছিল সেই মহান প্রচেষ্টা সম্বন্ধে এক সশ্রদ্ধ বিস্ময় আর বিদ্যাসাগরের প্রতি গভীর ভালবাসা ও সম্ভ্রম। বাংলার জনসাধারণ বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে কখনও কোনও বিদ্বেষ প্রকাশ করেন নি, একমাত্র গোঁড়া হিন্দু নেতা এবং প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতেরা তাঁর নিন্দা ও কুৎসা করেছিলেন। ১৮৫৪ সালের অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পুস্তিকায় তিনি প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলি অত্যন্ত সংযত এবং মার্জিত ভাষায় খণ্ডন করেছিলেন। কিন্তু এতেও তাঁর বিরুদ্ধ দল ক্ষান্ত হননি। তাঁদের আক্রোশ বেড়েই চলেছিল। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন যে সেই সব তর্ক বিতর্কে কোনও লাভ হবে না। অতএব তিনি সরাসরি কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। ১৮৫৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহকে বিধিসম্মত করবার জন্য ভারত সরকারের কাছে একটি আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলেন। সেই আবেদন পত্র বর্তমানে ভারতের ‘জাতীয় মহাফেজখানা’য় (ন্যাশনাল আরকাইভস্) রক্ষিত আছে। তাতে বিদ্যাসাগর ছাড়া ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর ছিল৷ নিম্নলিখিত চিঠির সঙ্গে সেই আবেদন পত্র পাঠানো হয়েছিল -

“ডবলিউ মরগ্যান, এস্কোয়্যার

ভারতের ব্যবস্থাপক সভার মাননীয় করণিক মহোদয় সমীপেষু -

মহাশয়,

আমি স্বাক্ষরকারীদের পক্ষে বঙ্গদেশের কয়েকজন হিন্দু অধিবাসীর এই আবেদন পত্র সবিনয়ে প্রেরণ করছি। আমার অনুরোধ যে আপনি অনুগ্রহ করে এই পত্র মাননীয় ব্যবস্থাপক সভার আগামী অধিবেশনে উপস্থাপিত করবেন।


কলিকাতা,                                     বিনীত নিবেদন -

সংস্কৃত কলেজ,              আপনার একান্ত অনুগত ভৃত্য

৪ঠা অক্টোবর, ১৮৫৫।                       ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা”


সেই আবেদনপত্রের ‘৮’ থেকে ‘১১’ অনুচ্ছেদে লেখা ছিল - (৮) “আপনার আবেদনকারীরা সবিনয়ে এই মত প্রকাশ করছে যে ব্যবস্থাপক সভার উচিত এমন সব প্রচলিত সামাজিক প্রথা দূরীকরণে সাহায্য করা যা হিন্দু জনসাধারণের অনেকের মতে অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং হিন্দু শাস্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্যের বিরোধী।” (৯) “বিধবা বিবাহের বিপক্ষে আইনগত বাধা দূর করাতে বহু সংখ্যক ধার্মিক ও রক্ষণশীল হিন্দুদেরও সমর্থন আছে এবং যাঁরা সত্যিই বিধবা বিবাহ শাস্ত্রানুসারে নিষিদ্ধ মনে করেন অথবা সামাজিক সুবিধা লাভের জন্য এই নিষেধ সমর্থন করেন তাঁদের কুসংস্কারে আঘাত লাগলেও সত্যিকারের কোনও ক্ষতি হবে না।” (১০) “বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয়, অথবা অন্য কোনও দেশের রীতি বিরুদ্ধ নয় বা পৃথিবীর অন্য কোনও সমাজে নিষিদ্ধ নয়৷” (১১) “অতএব আবেদনকারীদের বিনীত প্রার্থনা এই যে মাননীয় ব্যবস্থাপক সভা যেন একটি আইন প্রণয়নের (আইনের খসড়া সংযুক্ত করে দেওয়া হল) যুক্তিযুক্ততা বিবেচনা করেন যাতে বিধবাদের পুনর্বিবাহের আইনগত বাধা দূর হয় এবং এই বিবাহের সন্তান সন্ততিরা বৈধ বলে ঘোষিত হয়।”                           

১৮৫৫ সালের ১৭ই নভেম্বর ‘ব্যবস্থাপক সভা’র অন্যতম সদস্য ‘মিঃ জে. পি. গ্র্যান্ট’ সভায় একটি বিল উপস্থাপিত করেছিলেন, যেটির নাম ছিল ‘এ্যান এ্যাক্ট টু রিমুভ অল অবষ্ট্যাকল্স টু দি ম্যারেজ অব হিন্দু উইডোজ’ (হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের সকল বাধা দূর করবার জন্য প্রণোদিত আইন)। সেই বিল পেশ করার সময় তিনি বলেছিলেন, “বলা হয়ে থাকে যে এই প্রথা (বিধবা বিবাহ নিষেধ) অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অস্বাভাবিক। শুধু নৈতিক দিক দিয়ে নয়, সামাজিক দিক দিয়েও অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই কথা মেনে নিয়ে প্রস্তাবিত বিলে যুক্তি দেখান হয়েছে যে এমন একটি ক্ষতিকর প্রথা অনিচ্ছুক লোকেদের উপর জোর করে চাপানো উচিত নয় এবং এই প্রার্থনা করা হচ্ছে যে আবেদনকারীরা যখন বলছেন যে এই নিষেধাজ্ঞা হিন্দু শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তখনও এঁদের এবং যাঁরা এঁদের সঙ্গে একমত, তাঁদের উপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক।” সেই বিল সম্বন্ধে কাউন্সিলে যখন আলোচনা চলছিল, তখন শুধুমাত্র বঙ্গদেশের নয় সারা ভারতবর্ষের লোকের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। সর্বত্রই বিধবা বিবাহের সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাদানুবাদ চলেছিল। বহুলোক নিজেদের মতামত জানিয়ে কাউন্সিলের কাছে আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। ভারতের ‘জাতীয় মহাফেজখানা’য় (ন্যাশনাল আরকাইভস্ অব ইণ্ডিয়া) বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে যে সব দলিলপত্র রক্ষিত আছে তা থেকে দেখা যায় যে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে নানারকম যুক্তি দেখিয়ে ‘পুনা’, ‘ভিনচুর’, ‘সেকেন্দ্রাবাদ’, ‘সাতারা’, ‘ধারওয়ারা’, ‘বোম্বাই’, ‘আমেদাবাদ’, ‘সুরাট’ এবং বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবস্থাপক সভার কাছে বহু আবেদনপত্র এসেছিল। ‘ভিনচুরের মারাঠী সমাজের প্রধান’, ১২ই জানুয়ারী ১৮৫৬ সালে তাঁর আবেদনপত্রে লিখেছিলেন, “... প্রস্তাবিত আইনের বিশদ বিবরণ নিয়ে আলোচনা করা আমরা অনাবশ্যক মনে করি। যে নীতি অনুসারে এই আইনের প্রস্তাব হয়েছে আমরা শুধু সে সম্বন্ধে আমাদের আন্তরিক সমর্থন জানাতে চাই এবং নিবেদন করতে চাই যে পুনর্বিবাহে যদি আইনগত কোনও বাধা থাকে তবে ব্যবস্থাপক সভা যেন তা দূর করেন।” ‘পুনা’ থেকে ১৮৫৫ সালের ৭ই নভেম্বর তারিখে লেখা ৪৬টি স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্রে বলা হয়েছিল - “আমরা জানতে পারলাম যে আলোকপ্রাপ্ত হিন্দু অধিবাসীদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিধবাদের পুনর্বিবাহের আইনগত বাধা দূর করবার জন্য একটি আন্দোলন চলছে। যাঁরা ভারতের সত্যকারের কল্যাণকামী তাঁরা এই প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা অবশ্যই সমর্থন করবেন। এই প্রথায় হাজার হাজার নিরপরাধ এবং হতভাগ্য রমণীকে শুধু যে অসীম দুঃখভোগ করতে হয় তাই নয়, বর্তমানে সমাজে যে সব দুর্নীতি ও অপরাধ ঘটে থাকে তারও মূলে এই প্রথা। বিধবা বিবাহের বিধিগত বাধা দূর করলেই যে সমাজ অবিলম্বে সে কথা মেনে নেবে তা আমরা মনে করি না। হিন্দুদের মন থেকে কোনও প্রাচীন প্রথার প্রভাব দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে চারিদিকে জ্ঞানের আলোক বিস্তার করা, লোকের মন থেকে ভ্রান্ত ধারণা দূর করা এবং ধীরে ধীরে হিন্দু সমাজের উন্নতি বিধান করা ...।” ‘সেকেন্দ্রাবাদের’ ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’ এবং ‘ভদ্র হিন্দুরা’ ১৮৫৬ সালের ২রা মার্চ, তাঁদের আবেদন পত্রে লিখেছিলেন, “বাংলার কয়েকজন হিন্দু অধিবাসী বিধবা বিবাহকে বিধিসম্মত করবার জন্য যে আবেদনপত্র ও আইনের খসড়া দাখিল করেছেন আমরা তার একটি প্রতিলিপি পেশ করে ঐ আবেদন সমর্থন করবার অনুমতি প্রার্থনা করি।” আবার অনেক আবেদনপত্রে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সামাজিক আচারে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের সেই হস্তক্ষেপের প্রবল প্রতিবাদ করা হয়েছিল। সেই সম্পর্কিত দলিলপত্র থেকে দেখা যায় যে বাংলার বাইরে ‘মহারাষ্ট্রে’ এবং ‘দক্ষিণ ভারতের’ কোনও কোনও অঞ্চলে বিধবা বিবাহ আন্দোলন সম্বন্ধে জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। বিধবা বিবাহ নিয়ে বঙ্গদেশ শেষ পর্যন্ত দুই দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল - ‘বিদ্যাসাগর পন্থী’ ও ‘ধর্মসভা পন্থী’। কথাবার্তা ও আলোচনার ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে জনমত গড়ে উঠেছিল। সেই বিষয়ে অন্ততঃ ১০০ খানা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল এবং বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৫০,০০০ স্বাক্ষরযুক্ত ২০ খানি দরখাস্ত তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। সংখ্যার দিক দিয়ে দেখতে গেলে বঙ্গদেশের বেশী সংখ্যক আবেদনকারীই কিন্তু বিদ্যাসাগর ও তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। সমগ্র দেশ থেকে আবেদনকারীদের মধ্যে মাত্র শতকরা দশজন বিদ্যাসাগরের পক্ষে ছিলেন এবং তাঁরা বিধবা বিবাহকে আইন সম্মত করবার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রবলতম প্রতিবাদ এসেছিল সনাতন পন্থী হিন্দু সমাজের নেতা ‘রাজা রাধাকান্ত দেবের’ কাছে থেকে। তিনি ১৮৫৬ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ৩৬,৭৬৩টি স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই পত্রে অনেক কথা বলা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল এই যে, যেহেতু বিদ্যাসাগরের সমর্থনকারীদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, অতএব এক তুচ্ছ সংখ্যালঘুগোষ্ঠির স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন তৈরী করা উচিত হবে না। বঙ্গদেশ থেকে প্রায় এক হাজার জন পণ্ডিত দ্বারা স্বাক্ষরিত আর একটি দরখাস্ত পেশ করা হয়েছিল প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে। প্রস্তাবিত আইনের সমর্থনে বঙ্গদেশ থেকে যে আবেদনপত্রগুলি পাঠানো হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন - ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেরিত ‘নদীয়ার জমিদার’ ‘মহারাজ শ্রীশচন্দ্র’ ও তাঁর ‘দেওয়ান’ ‘কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায়’ (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা) ও ‘কৃষ্ণনগরের’ ২৬জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র; ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেরিত ‘কৃষ্ণনগর’ ও নিকটবর্তী অঞ্চলের প্রায় ১২৯ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত দরখাস্ত; ‘বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজের’ বিখ্যাত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘শান্তিপুর’ থেকে প্রেরিত দরখাস্ত; প্রস্তাবিত বিলের স্বপক্ষে ‘ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল’ ১৮৫৬ সালে ৫৩১ জনের স্বাক্ষরযুক্ত একটি প্রার্থনা পত্র সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন - ‘বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান গোঁসাইরা’ সেই দরখাস্তে সই করেছিলেন; ‘মুর্শিদাবাদ’ থেকে ‘সুরেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন’ নিজের উদ্যোগে ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কার’ প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিতের স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন - ‘তর্কালঙ্কার’ ছিলেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ১৮৫৬ সালের মার্চ মাসে প্রস্তাবিত বিলের সমর্থনে ‘রাজনারায়ণ বসু’ ‘মেদিনীপুর’ অঞ্চলের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত একটি দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন - প্রসঙ্গতঃ, ‘রাজনারায়ণ’ ছিলেন একজন প্রবীণ ‘ব্রাহ্মনেতা’ এবং বঙ্গদেশে ‘আধুনিক জাতীয়তার জনক’; ‘বর্ধমান’, ‘বাঁকুড়া’ ও ‘২৪ পরগণা’ জেলাগুলি থেকে বহুলোক বিলটি সমর্থন করে দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন; পূর্ববঙ্গের সুদূর ‘চট্টগ্রাম’ জেলার হিন্দু অধিবাসীরা বিলটি সমর্থন করে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে একটি দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন। বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত দলিল পত্রের মধ্যে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে আবেদন পত্রটি এখনও পর্যন্ত পাওয়া গেছে, সেটি পাঠিয়েছিলেন ‘রসিক কৃষ্ণ মল্লিক’, ‘রাধানাথ শিকদার’, ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’ ও অন্যান্য প্রধান ‘ডিরোজিও শিষ্যগণ’। সেই দরখাস্তে উল্লিখিত আইনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়টি সমর্থন করে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে বর্তমান যুগের স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ আইনের আমূল পরিবর্তন করা হোক। এই তথ্যটি আগে গবেষকদের জানা ছিল না। ঐ দরখাস্তে আইনটি পরিবর্তন করবার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল - “এই প্রস্তাবিত আইনে বিধবা বিবাহ যে কি হলে বৈধ হবে তার কোনও সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। অথচ এই সংজ্ঞা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা বিধবা বিবাহের প্রচলন হলে হিন্দু সমাজে একটা নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এবং বিভিন্ন লোক বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুসারে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করবেন, এমন কি এই সব বিবাহ নিয়ে আদালতে অনেক বিবাদ বিসংবাদও হবে।” কথাটি অত্যন্ত যুক্তিসম্মত বলে মনে হয়৷ সেটাই ছিল বিধবা বিবাহ সম্বন্ধীয় আইনের খসড়ার সবচেয়ে বড় ত্রুটি এবং ‘ডিরোজিও শিষ্যরা’ চেয়েছিলেন আইন পাস হওয়ার আগেই সেই ত্রুটী সংশোধন করতে। ‘ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী’ প্রস্তাব করেছিলেন যে বিবাহের আগে পাত্র ও পাত্রী দুটি পৃথক ঘোষণা পত্রে সই করবে। বিবাহের কার্যক্রম এই ধরনের হবে - “ঘোষণাপত্র: আমি ..., বিপত্নীক বা অবিবাহিত পুরুষ এবং আমি ..., বিধবা বা অবিবাহিতা মহিলা, যুক্তভাবে এবং একক ভাবে ঘোষণা করছি যে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং স্বেচ্ছায় আজ ... তারিখে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম ...”। “চুক্তিপত্র: আমি ... আজ ... কে আমার বিবাহিত স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমি এর জীবদ্দশায় দ্বিতীয়বার বিবাহ করব না এবং আমি যদি এই চুক্তি ভঙ্গ করি তবে আমার দ্বিতীয় বিবাহের দিনে আমি এঁকে কোম্পানীর টাকার হিসাবে ... টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকব।” সংশোধন প্রস্তাবে এটাও বলা হয়েছিল যে, আইনে একটি ‘বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন ধারা’ থাকা উচিত - “এই ধারা অনুসারে যে রীতিতেই হিন্দু বিধবার বিবাহ সম্পন্ন হোক না কেন সে বিবাহ তখনই বৈধ হবে যখন তা গভর্ণমেন্ট দ্বারা নিযুক্ত কর্মচারীদের সামনে পাত্র পাত্রীর দ্বারা রেজিস্ট্রী করা হবে।” বস্তুতপক্ষে বিধবা বিবাহের জন্য সেই সংশোধিত প্রস্তাবটি ১৯৭২ সালের ‘সিভিল ম্যারেজ এ্যাক্ট’ বা ‘বিধানিক বিবাহ আইন নং ৩’ যখন পাশ হয়েছিল তখন তাতে সংযোজিত হয়েছিল। ‘ব্রাহ্ম বিবাহের’ রূপ ও রীতি নিয়ে অনেক বাদানুবাদের পরে প্রধানতঃ ‘কেশবচন্দ্র সেনের’ উদ্যোগে সেই আইনপাশ হয়েছিল। কিন্তু ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই যখন ‘বিধবা বিবাহ বিল’ নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখন এই অত্যন্ত জরুরী সংশোধন প্রস্তাব সে বিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিদ্যাসাগর স্বয়ং বা ব্যবস্থাপক সভার সভ্যেরা কেউই সেদিন এই প্রস্তাবের গুরুত্ব বুঝতে পারেন নি। ‘ডিরোজিও শিষ্যদের’ সঙ্গে বিদ্যাসাগরের খুবই সদ্ভাব ছিল এবং তাঁরা যে বিদ্যাসাগরকে তাঁদের সংশোধন প্রস্তাব সম্বন্ধে কিছু জানাননি তা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। সম্ভবতঃ ‘বিবাহ রেজিস্ট্রী’ করার ব্যাপারে বিদ্যাসাগর তাঁদের সঙ্গে একমত ছিলেন না। বিদ্যাসাগর এবং ডিরোজিও শিষ্যদের মধ্যে যে মতের পার্থক্য ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। বিদ্যাসাগর হিন্দু বিবাহের অনুষ্ঠানের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আনবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি হিন্দু বিবাহের প্রচলিত কাঠামোর সঙ্গে বিধবা বিবাহের পরিকল্পনাকে খাপ খাওয়াতে চেয়েছিলেন। আর সেই কাঠামোর সীমানার মধ্যে কাজ করার ফলে আইন পাশ হওয়ার পরে বিদ্যাসাগরকে অনেক বিশৃঙ্খল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পরে আইন যখন কাজে পরিণত হয়েছিল তখন ডিরোজিও শিষ্যরা সেটার যে ত্রুটি দেখিয়েছিলেন সেটা প্রকট হয়ে উঠেছিল। তখনকার বেশীরভাগ বিধবা বিবাহই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল, কারণ স্বেচ্ছায় যে সব পুরুষ বিধবা বিবাহ করবার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, শীঘ্রই দেখা গিয়েছিল যে তাঁরা অত্যন্ত ‘সুবিধাবাদী ও কাপুরুষ’। অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁরা বিধবা বিবাহের পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছিলেন। এমন কি বিদ্যাসাগর নিজেও অনেক টাকা খরচ না করে অব্যাহতি পাননি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে জীবনের শেষ ভাগে বিদ্যাসাগরকে ‘ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী’র প্রস্তাব পরোক্ষভাবে মেনে নিতে হয়েছিল। তিনি নিজেই একটি চুক্তিপত্রের খসড়া করে পাত্র পাত্রীকে বিবাহের পূর্বে তা’তে সই করতে বাধ্য করেছিলেন। আইন পাশের ফলে হিন্দু বিবাহের আনুষ্ঠানিক রূপটি থেকে গিয়েছিল, কিন্তু বহু বিবাহ রদ হয়নি। সেই অবস্থায় কেবলমাত্র বিধবা বিবাহ আইনসঙ্গত করলেই যে কোন সুবিধা হবে না তা সুনিশ্চিত ছিল।

                                  ©️রানা©️

১৮৫৬ সালের ১৯শে জুলাই তারিখে ‘বিধবা পুনর্বিবাহ বিধেয়ক বিল’ তৃতীয়বার আলোচনার পরে ১৮৫৬ সালের ‘পঞ্চদশতম আইন’ হিসাবে পাশ হয়েছিল। ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই, ‘বড়লাট’ সেই আইনে স্বাক্ষর করে সেটিকে চালু করেছিলেন। আইনে ঘোষণা করা হয়েছিল - “পাত্রী বিধবা বা কোনও (অধুনা) মৃত ব্যক্তির বাগদত্তা, কেবলমাত্র এই কারণে কোনও হিন্দু বিবাহ আইন বিরুদ্ধ হবে না এবং এরকম বিবাহের সন্তান অবৈধ বলে বিবেচিত হবে না। এর বিরুদ্ধে হিন্দুশাস্ত্রের কোনও ব্যাখ্যা বা কোনও প্রথা থাকলেও এই আইন বলবৎ থাকবে।” ‘সুহৃদ সমিতি’ (দ্য এ্যাসোসিয়েশান অব ফ্রেণ্ডস্ ফর দি সোল্টাল ইমপ্রুভমেন্ট অব বেঙ্গল) তখনকার দিনের প্রগতিশীল সংস্কারকদের একটি প্রধান প্রতিষ্ঠান ছিল। সেই সমিতির ১৮৫৬-৫৭ সালের বার্ষিক বিবরণীতে লেখা হয়েছিল - “এই আইনে বিধবা বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে মাত্র এবং তাইই হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আইনে রেজিষ্ট্রেশান বা অন্য কোন পন্থার কথা বলা হয়নি যার দ্বারা এইরূপ বিবাহের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। আমাদের দেশে সচরাচর মিথ্যা দোষারোপ করা হয়ে থাকে এবং স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা নানারকম গোলমাল করতে পারে। অতএব এই সমিতি প্রস্তাব করছে যে এর পর আরও উদার বা ব্যাপক ধরনের বিবাহ বিষয়ক আইন করা উচিত। ১৮৫৬ সালের ত্রুটিপূর্ণ বিবাহ আইন সংস্কারের যে পরিকল্পনা এই সমিতি করেছিলেন সেই অনুসারে আর একটি আইন হওয়া উচিত৷” কিন্তু কোন কিছুতেই বিদ্যাসাগর আর পশ্চাৎপদ হননি, তিনি সেই আইনকে বাস্তবক্ষেত্রে চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আইন পাশ হওয়ার পরের চার মাস পর্যন্ত কেউই বিধবা বিবাহ করবার জন্য এগিয়ে আসেননি। ঐ আইনে প্রথম বিধবা বিবাহ হয়েছিল ১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর তারিখে। ‘ভারতীয় নারীর সামাজিক অধিকারের ইতিহাসে’ সে দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে আর থাকবে। প্রথম বিধবা বিবাহের পাত্র ছিলেন পণ্ডিত ‘শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন’। কিন্তু তা অন্য ইতিহাস।                           

(তথ্যসূত্র:

১- অনন্য বিদ্যাসাগর, শ্রী অনুনয় চট্টোপাধ্যায়।

২- স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, নবম খণ্ড, উদ্বোধন, ১৯৭৩।

৩- জীবন সন্ধানী বিদ্যাসাগর, রামরঞ্জন রায়।

৪- পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৪০১ বঙ্গাব্দ।

৫- ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী ও বিদ্যাসাগর, শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

৬- করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত), ইন্দ্রমিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৬।

৭- বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪।

৮- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙ্গালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, সুবর্ণ, ২০১৬।

৯- বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ।)

                    

No comments